প্রিয় গাবো, কল্পরাজ্যের অধিশ্বরকে বিদায়ী কুর্নিশ by প্রিয় গাবো,
নিয়তির অমোঘ নিয়মে অবশেষে লোকান্তরিত হলেন
আপনি। আমার এই চিঠি কোনো দিন আপনার কাছে পৌঁছুবে না। শুধু ভিন্ন ভাষায়
লেখা বলে নয়, যে-মানুষটি বেঁচে নেই, তার কাছে এরকমভাবে চিঠি লেখা কারও কারও
কাছে বালখিল্য বলে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে মূঢ়তা কিংবা চমক দেওয়ার
খেলা। এর সবই আংশিক সত্যি, কিন্তু আপনাকে নিয়ে প্রথাসিদ্ধ রীতিতে
সমালোচনামূলক লেখা লিখতে ইচ্ছে হলো না। কেননা, আপনিই সেই লেখক যিনি ক্রমাগত
প্রথা বা প্রচলিত রীতিকে ভেঙে নিরন্তর নতুন নতুন উপন্যাস লিখে গেছেন। রচনা
করে গেছেন অসংখ্য গল্প। চিত্রনাট্য রচনাতেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন আপনি।
চলচ্চিত্রকে ভালোবাসতেন বলে আজীবন যুক্ত ছিলেন শিল্পের এই আধুনিকতম
মাধ্যমটির সঙ্গে। নাটকের প্রতিও অনুরাগ ছিল আপনার। সংবাদ প্রতিবেদনকে
সৃষ্টিশীল রচনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। কিন্তু এই মাধ্যমটিও আপনার
প্রতিভার স্পর্শে সৃষ্টিশীলতার মহিমা পেয়ে গেছে। আসলে আপনার প্রতিভার
সূচনাবিন্দু আছে, শেষকথা বলে কিছু নেই। এতটাই অনিঃশেষ আর প্রসারিত ছিল
আপনার সৃজনীবোধ।
রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে দেশে দেশে যেসব গল্পযশোপ্রার্থী ছড়িয়ে আছেন, তাদের সবার কাছেই আপনি ছিলেন সমাদৃত। কুবার কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা ফিডেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে আপনার বন্ধুতাতো সবসময় সংবাদমাধ্যমগুলোর মুখরোচক কাহিনি হয়ে উঠেছে। আপনার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রে শোকবাণীর যে স্তূপ জমেছে তার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও একটা শোকবাণী আছে : পৃথিবী আজ বিশ্বের একজন স্বাপ্নিক দূরদর্শী লেখককে হারালো। বিল ক্লিনটন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন অনেকবার আপনি হোয়াইট হাউজে তার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। আপনার দীর্ঘদিনের বন্ধু এই রাষ্ট্রনায়ক শোকবার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, আমি সবসময় তাঁর অনন্য কল্পনাশক্তি, পরিচ্ছন্ন ভাবনা আর আবেগিক সততার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলাম। অধিকাংশ প্রাজ্ঞ সমালোচকের ধারণা, জনপ্রিয়তা শিল্পের শত্র“। কিন্তু আপনি সেই লেখক যিনি একদিকে যেমন ছিলেন জনপ্রিয়, তেমনি শিল্পের শুদ্ধতম বরপুত্র।
কিন্তু খুব সহজ ছিল কী আপনার এই উত্থান? গাবোর বর্ণময় জীবনেতিহাস সেকথা বলে না। এই সেদিনও আপনার জন্মবর্ষ নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার চৌদ্দ বছর পর জানা গেল আপনার সঠিক জন্ম তারিখ : ১৯২৮ সাল নয়, ১৯২৭ সালের ৬ মার্চে জন্মেছিলেন আপনি। নোবেল পুরস্কার পারিষদও ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী নিউ ইয়র্কার-এ ২০০১ সালে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আপনিই জানিয়ে দিয়েছেন সঠিক তারিখটি। ভিভির পারা কন্তারলা শীর্ষক আত্মজীবনীতে আপনি লিখেছেন, দিনটি ছিল রবিবার, বর্ষণমুখর ছুটির দিন। বারো ভাইবোনের প্রথম ভাইটির সেদিন জন্ম হয়।
মনে পড়ছে ১৯৩০ সালের প্রথম দিককার আরও একটা দিনের কথা। উত্তর কলোম্বিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র উপকূল দিয়ে ছুটে চলেছে একটা ট্রেন। ওই ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের সারি সারি কলাবাগানের দিকে তাকিয়ে আছে এক তরুণী। আগের রাতে স্টিমারে চেপে, মশার কামড় খেয়ে, সিয়েনাগা জলাভূমি পেরিয়ে তবেই উঠতে পেরেছিলেন এই ট্রেনে। গন্তব্য আরাকাতাকা। কয়েক বছর আগে এই আরাকাতাকাতেই তিনি তার সদ্য-ভূমিষ্ঠ প্রথম সন্তানকে বাবা ও মায়ের কাছে রেখে স্বামী গাবরিয়েল এলিহিও গার্সিয়ার সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন র্বারানকুইলায়। সন্তানটি ছিল ছেলে সন্তান, সবাই তাকে আদর করে ডাকতো গাবিতো বা গাবো। এখন আমরা জানি, এই গাবোই হচ্ছেন আপনি, বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। সেদিন ওই তরুণী, অর্থাৎ আপনার মা লুইসা সান্তিয়াগা মার্কেস ইগুয়ারাঁ দে গার্সিয়া আপনার নানার মৃত্যু হলে আপনাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জন্মের কিছুদিন পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মাকে সেদিন খুবই অচেনা মনে হয়েছিল আপনার। ঘরে ঢুকেই দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দর এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন, মাথায় খড়ের হ্যাট, গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক। তখন কতই-বা বয়স হবে আপনার, আট পেরিয়ে নয়ে পা দিয়েছেন মাত্র। এর আগে নানা কর্নেল নিকোলাস মার্কেস মেহিয়া আর নানী ত্রানকুইলিনা ইগুয়ারাঁ এবং নানীর বোনদের সঙ্গে চমৎকার দিন কাটছিল আপনার। নানা ছিলেন, আপনার ভাষ্য অনুসারে, চমৎকার গল্পকথক। নানীর কাছেও শুনেছেন আজগুবি সব গল্প। নানার চরিত্রটাও ছিল দারুণ চিত্তাকর্ষক। বিশশতকের প্রথম দিকে হাজার দিনের যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধে বীরের মতো যুদ্ধ করে ছোট্ট ওই শহরে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
আপনার মা ছিলেন এই আরাকাতাকার অভিজাত এই কর্নেল পরিবারের দীর্ঘাঙ্গি, প্রাণচঞ্চল, সুন্দরী মেয়ে। অথচ আক্ষরিক অর্থে আপনার বাবার কোনো চালচুলো নেই। আপনার দাদী, অর্থাৎ আর্হেমিরা গারসিয়া পাতেরনিনার সন্তান তিনি। কুমারী অবস্থায় মাত্র চৌদ্দবছর বয়সে সাতাশ বছরের স্কুলশিক্ষক গাবরিয়েল মার্তিনেস গাররিদোর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আপনার বাবার জন্ম। অর্থের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন আরাকাতাকায়। চমৎকার বেহালা বাজাতে পারতেন, গানের গলাটাও ছিল দারুণ, কবিতাও আবৃত্তি করতেন চমৎকার। অল্প দিনের মধ্যে দীর্ঘকায়, বুদ্ধিদীপ্ত, সুদর্শন এই যুবক রমণীমোহন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও আপনার মা ওর প্রেমেই হাবুডুবু খেতে থাকেন। অনেক চেষ্টা করে সেই সম্পর্কে চিড় ধরাতে না পেরে আপনার নানা ও নানী বিয়েটা মেনে নেন, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা উপস্থিত হননি। জেরাল্ড মার্টিন আপনার যে জীবনীটি লিখেছেন, তাতে এই প্রেমের চমৎকার বিবরণ আছে।
এতকিছুর পরও এই নানার বাড়িতেই জন্মেছিলেন আপনি। কিন্তু আপনার জন্মের কিছুদিন পর বাবা-মা দুজনেই বাররানকুইলায় চলে গেলে নানার বাড়িই হয়ে ওঠে আপনার ছেলেবেলার জমজমাট সাম্রাজ্য। নানার কাছে শোনা যুদ্ধের গল্প আর নানীর কাছে শোনা ভূত-প্রেত দৈত্য-দানোর কল্পকাহিনি আপনার মনে যে মায়াজাল বিস্তার করেছিল, পরে সেসবই নানা ভঙ্গি আর শৈলীতে উপস্থিত হয়েছে আপনার সৃষ্টিশীল রচনায়। নিজেই এপ্রসঙ্গে আমাদের জানিয়েছেন, “নির্বিকার মুখে, নানী আমাকে সারাক্ষণ আশ্চর্য ও আজগুবি সব গল্প শোনাতেন, অথচ মাথার চুল খাড়া হতো না, মনে হতো যা বর্ণনা করছেন তা যেন তিনি এইমাত্র দেখতে পেয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর ওই অবিচল নির্বিকার ভঙ্গি আর তার চিত্রকল্পগুলোর ঐশ্বর্যই তাঁর গল্পগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতো। আমি একশো বছরের নিঃসঙ্গতা লিখেছিলাম আমার নানীর (গল্প বলার) কৌশল ব্যবহার করেই।”
ছেলেবেলায় এইভাবে গল্প শুনে-শুনেই কী আপনার মধ্যে লেখক হয়ে উঠবার বাসনা জেগেছিল? কোনো লেখায় বা সাক্ষাৎকারে সরাসরি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি আপনি। কিন্তু আপনি যে লেখক হওয়ার সংকল্প নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি টেনেছিলেন, আÍজীবনীতে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে : “আজ, পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে আসার পর মনে হচ্ছে, জীবনে যত ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পেশা হিসেবে লেখক হয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ছিল. বলা যায়, আমার সমগ্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন।” বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে হিস্পানি স্বর্ণযুগের কবিতা নিয়ে আপনি মশগুল ছিলেন। আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে গোগ্রাসে পড়তে শুরু করলেন সফোক্লিস, হেমিংওয়ে, জয়েস, উলফ, ফকনার, কাফকার লেখা। ফকনারের ইয়োকনাপাটাফার আদলেই পরে আপনার মাথায় এসেছিল মাকোন্দো নামের কল্পজনপদের কথা। সফোক্লিস পড়ে বুঝতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতাপ কীভাবে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ফকনারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বাস্তবতার প্রথম পাঠ। এইসময়ে, ১৯৪৭ সালে, প্রকাশিত হলো আপনার প্রথম ছোটগল্প লা তেরেসের রেজিগনেশন (তৃতীয় ত্যাগ)। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত আপনার প্রথম উপন্যাস লা ওয়ারাস্কাতেও (পাতার ঝড়) আছে মাকোন্দোর উপস্থিতি। পরে এই মাকোন্দোই হয়ে উঠেছে আপনার উপন্যাসের প্রভাবশালী চরিত্র।
এইসময়েই বোহেমিয়ান জীবনটা দারুণ উপভোগ করছিলেন আপনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব চুকিয়ে দিয়ে বিশ্বকোষ বিক্রির চাকরি কিংবা বলা যায় জীবনাভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কোনো জায়গাতেই থিতু হননি, এখানে সেখানে ঘুরে বেরিয়েছেন। এরকম অস্থির মুক্ত অবস্থাতেই প্রেমিকা মের্সেদেস বারখা পারদোর সঙ্গে সেরে ফেলেন আনুষ্ঠানিক বাগদান। বোগোতায় ফিরে যোগ দিলেন এল এসপেক্তাদোর পত্রিকায়। সবকিছু ছাপিয়ে সাংবাদিকতাকেই আপনার মনে হয়েছিল লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত পেশা। তবে সাদামাঠা অর্থে আমাদের মনে রিপোর্টারদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেরকম সাংবাদিক ছিলেন না আপনি। সংবাদের পেছনে লুকিয়ে থাকা যে ঘটনা সংবাদের জন্ম দেয়, ব্যক্তিক বিপন্নতা বা রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হয়, সেই ধরনের সংবাদের প্রতি আগ্রহ ছিল আপনার। ফলে সংবাদ নয়, সংবাদভাষ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন আপনি। আমার অ্যাডভেঞ্চারের অন্তর্নিহিত সত্য শিরোনামে প্রকাশিত এরকম একটা সংবাদ প্রকাশের জন্য এল এসপেক্তাদোর পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় আর আপনাকে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় ইউরোপে।
আপনার ইউরোপের দিনগুলো ছিল অর্থনৈতিক দৈন্য, পেশাগত অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চকর ঘটনায় পূর্ণ। কিন্তু যতই অনিশ্চয়তা থাকুক, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে এতটুকু পিছপা হননি আপনি। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, ইউরোপ কোনদিনই আপনাকে সেইভাবে টানেনি, তাহলে কেন এতটা ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ ঘুরে বেরিয়েছিলেন আপনি? আসলে কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানিনা, আপনি যে পুঁজিবাদী-গণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক-রাজতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে খুব কাছে থেকে দেখে আন্তঃমহাদেশীয় রাজনীতির অন্তর্নিহিত পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে চাইছিলেন, চল্লিশ বছর বাদে নিজেই সেকথা জানিয়েছেন আমাদের : “উনিশশো ছাপ্পান্নর গোড়ায় ইউরোপে আমার চাকরি চলে যায়। চেষ্টা করলে অন্য কোনো পত্রপত্রিকার একটা কাজ হয়তো খুঁজে নেওয়া যেত। কিন্তু নিজের ভেতরকার আবেগকে মর্যাদা দিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম।”
আপনার লেখক সত্তাকে বুঝতে হলে এই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে কখনও বোঝা যাবে না। সমগ্র লাতিন আমেরিকা জুড়ে যে স্বৈরশাসন বছরের পর বছর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে, হত্যা করা হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে, আপনি ছিলেন তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সোচ্চার। ইউরোপে থাকতেই আরেকটি কাজ আপনি করেছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রতি আপনার প্যাশন সুবিদিত। এরই টানে রোমের বিখ্যাত সেন্ত্রো স্পেরিমেন্তালে দে সিনেমায় চলচ্চিত্র সম্বন্ধে
প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নিলেন। ভিক্তেরিও ডি সিকা, সিজার জাভাত্তিনি, ফ্রেদেরিকো ফেলিনি, অর্থাৎ ইতালীয় নব্যবাস্তববাদী বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাহচর্যে এসে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্র হচ্ছে সেই মাধ্যম যা দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে। চলচ্চিত্রের প্রতি এই অনুরাগের পাশাপাশি চলছিল ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক প্রতিবেদন লেখালেখি আর প্রকাশের কাজ।
একবার লন্ডনে ছসপ্তাহ আটকে যাওয়ায় হোটেলে বসেই লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছোটগল্প। দুম করে কলোম্বিয়ায় ফিরে মের্সেদেসকে বিয়ে করে ফেললেন। মের্সেদেসের বহুদিনের অপেক্ষার অবসান হলো। কিন্তু আবার তাকে মায়ের কাছে রেখে ছুটলেন ভেনিজুয়েলায়। সেখান থেকে কলোম্বিয়ায় ফিরে কিউবা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বোগোতায় স্থাপন করলেন প্রেনসা লাতিনা। পরে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে এরই একটা শাখা খোলার জন্য সপরিবারে ছুটলেন নিউ ইয়র্ক। কিছুদিন পর সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ইতিমধ্যে জন্ম নেয়া বড় ছেলে রোদরিগো আর স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন মেহিকোতে।
মেহিকোতে দারিদ্র্য ছিল আপনার নিত্যসঙ্গী। বেঁচে থাকবার জন্যে তাই শুরু করেছিলেন সিনেমার সাবটাইটেল আর চিত্রনাট্য লেখা। সময়টা ১৯৬২ সাল, এই সময়েই মেহিকোতে বসেই লিখলেন কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না শীর্ষক অসাধারণ বড় গল্প বা নোভেলা। প্রকাশিত হলো প্রথম গল্পসংকলন বিগ মামাস ফ্যুন্যারেল। অনন্য বর্ণনারীতি আর লাতিন সমাজজীবনের দ্বারা সমৃদ্ধ এর গল্পগুলো বিশ্বের গল্পপাঠকদের দিল নতুনত্বের স্বাদ। ওই বছরই জন্ম নিল আপনার দ্বিতীয় পুত্র গোনসালো। চলচ্চিত্রের জন্য পর পর লিখলেন দুটি চিত্রনাট্য : তিয়েম্পো দে মোরিরে (সহচিত্রনাট্যকার কার্লোস ফুয়েন্তেস) এবং হোগো পেরিগোজো।
চলচ্চিত্র, গল্প, নোভেলা, নানা মাধ্যমে আপনার প্রতিভা বিকশিত হলেও প্রকাশিত বইগুলো তেমন বিক্রি হচ্ছিল না। দারিদ্র্য আর হতাশা তাই আপনার জীবনে এসে ভর করলো। বেঁচে থাকার জন্য কাজ নিতে হলো বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আর জড়িয়ে পড়লেন পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে। এর পর এলো সেই অভূতপূর্ব সময়। অবকাশ কাটাবার জন্যে গাড়ি চালিয়ে মেহিকো থেকে আকাপুলকোর দিকে চলেছেন আপনি। হঠাৎ আপনার মানসপটে ভেসে উঠলো কল্পিত সেই মাকান্দো জনপদের ছবি, বিগত কুড়ি বছর ধরে যা নিয়ে ভাবছিলেন আপনি। এ প্রসঙ্গে পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন : “অকস্মাৎ জানিনা কীভাবে যেন উপন্যাসটার সম্পূর্ণ খসড়াটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমার চিন্তাস্রোতটা এতটাই স্বচ্ছ, স্পষ্ট আর সম্পৃক্ত লাগছিল যেন আমি একের পর এক এর প্রতিটি শব্দ কোনো এক টাইপিস্টকে গড় গড় করে বলে যেতে পারছি।” সংসার আর বাচ্চাদের সব দায়-দায়িত্ব মের্সেদেসের হাতে তুলে দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন আপনি। জগৎ সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একটানা আঠারো মাস ধরে লিখে ফেললেন আপনার স্বপ্নের উপন্যাস : শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা। সামান্য উদরপূর্তি আর ছয় প্যাকেট সিগারেটই ছিল তখন আপনার সঙ্গী। এদিকে ধারদেনায় জেরবার মের্সেদেস। গাড়িতো বটেই, বিক্রি করতে হলো আসবাবপত্র, বাসনকোসন। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারলো, গাবো কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখায় ব্যস্ত। কিছুদিন বাদে উপন্যাসটির প্রথম তিনটি অধ্যায়ের খসড়া পাঠিয়ে দিলেন বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেসকে। ফুয়েন্তেসতো পড়েই রীতিমতো বিমুগ্ধ। সংবাদমাধ্যমে বলেই ফেললেন, এইমাত্র আমি আসন্ন চিরায়ত সাহিত্যের প্রথম আশি পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করলাম।
অবশেষে আঠারো মাসের অজ্ঞাতবাস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আপনি। হাতে তেরোশো পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি। কী কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমই-না আপনাকে করতে হয়েছিল এই বইটি লিখবার জন্য! স্ত্রী এবং বন্ধুদের শোনাবার একপর্যায়ে শেষপৃষ্ঠায় পৌঁছে পেয়ে গেলেন উপন্যাসের নাম - সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ। প্রকাশকের কাছে পাঠাবার ডাকমাশুলও তখন আপনার নেই। বৌয়ের চুল শুকোবার যন্ত্র আর বৈদ্যুতিক স্টোভ বিক্রি করে জোগাড় করতে হলো সেই টাকা। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেসের সুদামেরিকানা প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরুলো সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা লাতিন আমেরিকা জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল। প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হলো আট হাজার কপি, এর পর প্রতিমাসে কয়েকটি মুদ্রণ। তিন বছরে বিক্রি হলো পাঁচ লাখ বই। ১৯৭০ সালে গ্রেগরি রাবাসার অনুবাদে বেরুলো এর ইংরেজি অনুবাদ : ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে পৃথিবীর এমন কোনো ভাষা নেই যে ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়নি। ইংরেজি অনুবাদসহ এ পর্যন্ত এই বইয়ের বিক্রির সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। এই উপন্যাসটির রাষ্ট্রীয় ও সাহিত্য পুরস্কার যেমন জুটেছে, তেমনি আপনাকে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেছে। মারিও ভার্গাস ইয়োসা আপনার জীবনের প্রথম তেতাল্লিশ বছরকে নিয়ে লিখে ফেললেন একটি বই। এরপর সাড়া পৃথিবী জুড়ে এই উপন্যাসটিকে সর্বকালের সেরা উপন্যাস বা মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তেমন দেরি হয়নি। অর্থ, খ্যাতি আর পুরস্কারের মধ্যে যখন আপনি ডুবে যাচ্ছেন, তখনই স্বৈরাচারের চেহারা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করবার জন্য চলে গেলেন ফ্রাঙ্কোর স্পেনে। কী সাহস আপনার!
বিশ্বসাহিত্যের পাঠকমাত্রই আমরা জানি, লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের প্রধান অংশ জুড়ে আছে স্বৈরাচারের বিচিত্র প্রসঙ্গ। এই স্বৈরাচারের চমৎকার ছবি পাওয়া যায় আপনার কুলপতির হেমন্তকাল উপন্যাসে। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপের স্বৈরাচারী শাসক কীভাবে একাকীত্বের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যেতে পাওে, এতে আছে সেরকমি একটা গল্প। ব্যক্তিমানুষের এই সংকট, বিশেষ করে নারীর হাতে নারীর বা পুরুষের দ্বারা নারীলাঞ্ছনার দুঃসহ কাহিনি হচ্ছে আপনার বেচারি এরেন্দিরা আর তারহিৃদয়হীন দাদীমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি। দেশপ্রেম ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি হিসেবে আপনার গোলকধাঁধায় সেনাপতি উপন্যাসটিও অসাধারণ।
ভাবতে অবাক লাগে, আপনি শুধু কলোম্বিয়া নয়, হয়ে উঠেছেন সমগ্র লাতিন আমেরিকার কণ্ঠস্বর। সমগ্র মহাদেশের মানুষ সেই ঔপনিবেশিক কাল থেকে যে অবিশ্বাস্য নিপীড়িন, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের দ্বারা মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে, সেই নির্মম বাস্তবতারই করুণ ছবি কথাসাহিত্যে তুলে ধরেছেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তেও এসব কথা ভুলে যাননি আপনি। সেই সঙ্গে আপনার গুরু ফকনারের মতোই উচ্চারণ করেছিলেন মানুষের অজেয় সম্ভাবনা ও মুক্তির কথা : “এই ভয়াল বাস্তবতার সামনে - সমস্ত মানুষী কালে যাকে মনে হয়েছিল নিছক কোনো কল্পলোক বলেই, আমরা যারা কথা বানাই, কাহন গড়ি, আমরা তবু কিন্তু বিশ্বাস করি সবকিছু, বিশ্বাস করবার দাবি ও অনুভূতি রাখি যে এখনও এক বিকল্প/বিরুদ্ধ কল্পরাজ্য গড়বার কাজে আত্মনিয়োগ করার সময় আছে - এখনও সময় চলে যায়নি।” একশো বছরের রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতার দণ্ড পেয়ে যে মহাদেশের মানুষ ভেঙে পড়েছে, সেই মানুষকেই আবার উঠে দাঁড়াবার আহ্বান জানালেন আপনি।
কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, এ কী শুধু একমহাদেশের কথা? নাকি আপনি নির্যাতিত বিশ্বমানবতার কথা ধনিত হলো আপনার কণ্ঠে? জানি, আজ আর এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া যাবে না, যা কিছু উত্তর তা উৎকীর্ণ হয়ে আছে আপনার লেখা রচনাবলিতে, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে। সেই মর্মবাণীটি হলো - মানুষ অজেয়, মানবের কোনো অবসান নেই। এই হচ্ছে আপনার অসাধারণত্ব, এই হচ্ছে সর্বকালের সেরা কথাসাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যার দেহ নশ্বর, কিন্তু ভাবনা মানবিক জয়গাথা হিসেবে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
গাবো, আপনাকে কুর্নিশ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে দেশে দেশে যেসব গল্পযশোপ্রার্থী ছড়িয়ে আছেন, তাদের সবার কাছেই আপনি ছিলেন সমাদৃত। কুবার কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা ফিডেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে আপনার বন্ধুতাতো সবসময় সংবাদমাধ্যমগুলোর মুখরোচক কাহিনি হয়ে উঠেছে। আপনার মৃত্যুর পর সংবাদপত্রে শোকবাণীর যে স্তূপ জমেছে তার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও একটা শোকবাণী আছে : পৃথিবী আজ বিশ্বের একজন স্বাপ্নিক দূরদর্শী লেখককে হারালো। বিল ক্লিনটন যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন অনেকবার আপনি হোয়াইট হাউজে তার আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। আপনার দীর্ঘদিনের বন্ধু এই রাষ্ট্রনায়ক শোকবার্তা পাঠিয়ে বলেছেন, আমি সবসময় তাঁর অনন্য কল্পনাশক্তি, পরিচ্ছন্ন ভাবনা আর আবেগিক সততার দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলাম। অধিকাংশ প্রাজ্ঞ সমালোচকের ধারণা, জনপ্রিয়তা শিল্পের শত্র“। কিন্তু আপনি সেই লেখক যিনি একদিকে যেমন ছিলেন জনপ্রিয়, তেমনি শিল্পের শুদ্ধতম বরপুত্র।
কিন্তু খুব সহজ ছিল কী আপনার এই উত্থান? গাবোর বর্ণময় জীবনেতিহাস সেকথা বলে না। এই সেদিনও আপনার জন্মবর্ষ নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার চৌদ্দ বছর পর জানা গেল আপনার সঠিক জন্ম তারিখ : ১৯২৮ সাল নয়, ১৯২৭ সালের ৬ মার্চে জন্মেছিলেন আপনি। নোবেল পুরস্কার পারিষদও ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী নিউ ইয়র্কার-এ ২০০১ সালে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আপনিই জানিয়ে দিয়েছেন সঠিক তারিখটি। ভিভির পারা কন্তারলা শীর্ষক আত্মজীবনীতে আপনি লিখেছেন, দিনটি ছিল রবিবার, বর্ষণমুখর ছুটির দিন। বারো ভাইবোনের প্রথম ভাইটির সেদিন জন্ম হয়।
মনে পড়ছে ১৯৩০ সালের প্রথম দিককার আরও একটা দিনের কথা। উত্তর কলোম্বিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সমুদ্র উপকূল দিয়ে ছুটে চলেছে একটা ট্রেন। ওই ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের সারি সারি কলাবাগানের দিকে তাকিয়ে আছে এক তরুণী। আগের রাতে স্টিমারে চেপে, মশার কামড় খেয়ে, সিয়েনাগা জলাভূমি পেরিয়ে তবেই উঠতে পেরেছিলেন এই ট্রেনে। গন্তব্য আরাকাতাকা। কয়েক বছর আগে এই আরাকাতাকাতেই তিনি তার সদ্য-ভূমিষ্ঠ প্রথম সন্তানকে বাবা ও মায়ের কাছে রেখে স্বামী গাবরিয়েল এলিহিও গার্সিয়ার সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন র্বারানকুইলায়। সন্তানটি ছিল ছেলে সন্তান, সবাই তাকে আদর করে ডাকতো গাবিতো বা গাবো। এখন আমরা জানি, এই গাবোই হচ্ছেন আপনি, বিশ্বখ্যাত কথাসাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। সেদিন ওই তরুণী, অর্থাৎ আপনার মা লুইসা সান্তিয়াগা মার্কেস ইগুয়ারাঁ দে গার্সিয়া আপনার নানার মৃত্যু হলে আপনাকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জন্মের কিছুদিন পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মাকে সেদিন খুবই অচেনা মনে হয়েছিল আপনার। ঘরে ঢুকেই দেখলেন অনিন্দ্যসুন্দর এক রমণী দাঁড়িয়ে আছেন, মাথায় খড়ের হ্যাট, গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক। তখন কতই-বা বয়স হবে আপনার, আট পেরিয়ে নয়ে পা দিয়েছেন মাত্র। এর আগে নানা কর্নেল নিকোলাস মার্কেস মেহিয়া আর নানী ত্রানকুইলিনা ইগুয়ারাঁ এবং নানীর বোনদের সঙ্গে চমৎকার দিন কাটছিল আপনার। নানা ছিলেন, আপনার ভাষ্য অনুসারে, চমৎকার গল্পকথক। নানীর কাছেও শুনেছেন আজগুবি সব গল্প। নানার চরিত্রটাও ছিল দারুণ চিত্তাকর্ষক। বিশশতকের প্রথম দিকে হাজার দিনের যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধে বীরের মতো যুদ্ধ করে ছোট্ট ওই শহরে কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
আপনার মা ছিলেন এই আরাকাতাকার অভিজাত এই কর্নেল পরিবারের দীর্ঘাঙ্গি, প্রাণচঞ্চল, সুন্দরী মেয়ে। অথচ আক্ষরিক অর্থে আপনার বাবার কোনো চালচুলো নেই। আপনার দাদী, অর্থাৎ আর্হেমিরা গারসিয়া পাতেরনিনার সন্তান তিনি। কুমারী অবস্থায় মাত্র চৌদ্দবছর বয়সে সাতাশ বছরের স্কুলশিক্ষক গাবরিয়েল মার্তিনেস গাররিদোর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আপনার বাবার জন্ম। অর্থের অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে টেলিগ্রাফ অফিসে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন আরাকাতাকায়। চমৎকার বেহালা বাজাতে পারতেন, গানের গলাটাও ছিল দারুণ, কবিতাও আবৃত্তি করতেন চমৎকার। অল্প দিনের মধ্যে দীর্ঘকায়, বুদ্ধিদীপ্ত, সুদর্শন এই যুবক রমণীমোহন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও আপনার মা ওর প্রেমেই হাবুডুবু খেতে থাকেন। অনেক চেষ্টা করে সেই সম্পর্কে চিড় ধরাতে না পেরে আপনার নানা ও নানী বিয়েটা মেনে নেন, কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে তারা উপস্থিত হননি। জেরাল্ড মার্টিন আপনার যে জীবনীটি লিখেছেন, তাতে এই প্রেমের চমৎকার বিবরণ আছে।
এতকিছুর পরও এই নানার বাড়িতেই জন্মেছিলেন আপনি। কিন্তু আপনার জন্মের কিছুদিন পর বাবা-মা দুজনেই বাররানকুইলায় চলে গেলে নানার বাড়িই হয়ে ওঠে আপনার ছেলেবেলার জমজমাট সাম্রাজ্য। নানার কাছে শোনা যুদ্ধের গল্প আর নানীর কাছে শোনা ভূত-প্রেত দৈত্য-দানোর কল্পকাহিনি আপনার মনে যে মায়াজাল বিস্তার করেছিল, পরে সেসবই নানা ভঙ্গি আর শৈলীতে উপস্থিত হয়েছে আপনার সৃষ্টিশীল রচনায়। নিজেই এপ্রসঙ্গে আমাদের জানিয়েছেন, “নির্বিকার মুখে, নানী আমাকে সারাক্ষণ আশ্চর্য ও আজগুবি সব গল্প শোনাতেন, অথচ মাথার চুল খাড়া হতো না, মনে হতো যা বর্ণনা করছেন তা যেন তিনি এইমাত্র দেখতে পেয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর ওই অবিচল নির্বিকার ভঙ্গি আর তার চিত্রকল্পগুলোর ঐশ্বর্যই তাঁর গল্পগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতো। আমি একশো বছরের নিঃসঙ্গতা লিখেছিলাম আমার নানীর (গল্প বলার) কৌশল ব্যবহার করেই।”
ছেলেবেলায় এইভাবে গল্প শুনে-শুনেই কী আপনার মধ্যে লেখক হয়ে উঠবার বাসনা জেগেছিল? কোনো লেখায় বা সাক্ষাৎকারে সরাসরি এ সম্পর্কে কিছু বলেননি আপনি। কিন্তু আপনি যে লেখক হওয়ার সংকল্প নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ইতি টেনেছিলেন, আÍজীবনীতে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে : “আজ, পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে আসার পর মনে হচ্ছে, জীবনে যত ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি, পেশা হিসেবে লেখক হয়ে ওঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ছিল. বলা যায়, আমার সমগ্র জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন।” বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে হিস্পানি স্বর্ণযুগের কবিতা নিয়ে আপনি মশগুল ছিলেন। আইন পড়া ছেড়ে দিয়ে গোগ্রাসে পড়তে শুরু করলেন সফোক্লিস, হেমিংওয়ে, জয়েস, উলফ, ফকনার, কাফকার লেখা। ফকনারের ইয়োকনাপাটাফার আদলেই পরে আপনার মাথায় এসেছিল মাকোন্দো নামের কল্পজনপদের কথা। সফোক্লিস পড়ে বুঝতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতাপ কীভাবে ব্যক্তিমানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে ফকনারের কাছ থেকে পেয়েছিলেন বাস্তবতার প্রথম পাঠ। এইসময়ে, ১৯৪৭ সালে, প্রকাশিত হলো আপনার প্রথম ছোটগল্প লা তেরেসের রেজিগনেশন (তৃতীয় ত্যাগ)। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত আপনার প্রথম উপন্যাস লা ওয়ারাস্কাতেও (পাতার ঝড়) আছে মাকোন্দোর উপস্থিতি। পরে এই মাকোন্দোই হয়ে উঠেছে আপনার উপন্যাসের প্রভাবশালী চরিত্র।
এইসময়েই বোহেমিয়ান জীবনটা দারুণ উপভোগ করছিলেন আপনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্ব চুকিয়ে দিয়ে বিশ্বকোষ বিক্রির চাকরি কিংবা বলা যায় জীবনাভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কোনো জায়গাতেই থিতু হননি, এখানে সেখানে ঘুরে বেরিয়েছেন। এরকম অস্থির মুক্ত অবস্থাতেই প্রেমিকা মের্সেদেস বারখা পারদোর সঙ্গে সেরে ফেলেন আনুষ্ঠানিক বাগদান। বোগোতায় ফিরে যোগ দিলেন এল এসপেক্তাদোর পত্রিকায়। সবকিছু ছাপিয়ে সাংবাদিকতাকেই আপনার মনে হয়েছিল লেখালেখি চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত পেশা। তবে সাদামাঠা অর্থে আমাদের মনে রিপোর্টারদের যে ছবি ভেসে ওঠে সেরকম সাংবাদিক ছিলেন না আপনি। সংবাদের পেছনে লুকিয়ে থাকা যে ঘটনা সংবাদের জন্ম দেয়, ব্যক্তিক বিপন্নতা বা রাষ্ট্রীয় সংকট তৈরি হয়, সেই ধরনের সংবাদের প্রতি আগ্রহ ছিল আপনার। ফলে সংবাদ নয়, সংবাদভাষ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন আপনি। আমার অ্যাডভেঞ্চারের অন্তর্নিহিত সত্য শিরোনামে প্রকাশিত এরকম একটা সংবাদ প্রকাশের জন্য এল এসপেক্তাদোর পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় আর আপনাকে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় ইউরোপে।
আপনার ইউরোপের দিনগুলো ছিল অর্থনৈতিক দৈন্য, পেশাগত অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চকর ঘটনায় পূর্ণ। কিন্তু যতই অনিশ্চয়তা থাকুক, অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে এতটুকু পিছপা হননি আপনি। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, ইউরোপ কোনদিনই আপনাকে সেইভাবে টানেনি, তাহলে কেন এতটা ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ ঘুরে বেরিয়েছিলেন আপনি? আসলে কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানিনা, আপনি যে পুঁজিবাদী-গণতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক-রাজতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে খুব কাছে থেকে দেখে আন্তঃমহাদেশীয় রাজনীতির অন্তর্নিহিত পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষভাবে বুঝতে চাইছিলেন, চল্লিশ বছর বাদে নিজেই সেকথা জানিয়েছেন আমাদের : “উনিশশো ছাপ্পান্নর গোড়ায় ইউরোপে আমার চাকরি চলে যায়। চেষ্টা করলে অন্য কোনো পত্রপত্রিকার একটা কাজ হয়তো খুঁজে নেওয়া যেত। কিন্তু নিজের ভেতরকার আবেগকে মর্যাদা দিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ছিলাম।”
আপনার লেখক সত্তাকে বুঝতে হলে এই রাজনীতিকে বাদ দিয়ে কখনও বোঝা যাবে না। সমগ্র লাতিন আমেরিকা জুড়ে যে স্বৈরশাসন বছরের পর বছর কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে, হত্যা করা হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে, আপনি ছিলেন তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সোচ্চার। ইউরোপে থাকতেই আরেকটি কাজ আপনি করেছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রতি আপনার প্যাশন সুবিদিত। এরই টানে রোমের বিখ্যাত সেন্ত্রো স্পেরিমেন্তালে দে সিনেমায় চলচ্চিত্র সম্বন্ধে
প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ নিলেন। ভিক্তেরিও ডি সিকা, সিজার জাভাত্তিনি, ফ্রেদেরিকো ফেলিনি, অর্থাৎ ইতালীয় নব্যবাস্তববাদী বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাহচর্যে এসে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্র হচ্ছে সেই মাধ্যম যা দুনিয়াকে বদলে দিতে পারে। চলচ্চিত্রের প্রতি এই অনুরাগের পাশাপাশি চলছিল ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিক প্রতিবেদন লেখালেখি আর প্রকাশের কাজ।
একবার লন্ডনে ছসপ্তাহ আটকে যাওয়ায় হোটেলে বসেই লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছোটগল্প। দুম করে কলোম্বিয়ায় ফিরে মের্সেদেসকে বিয়ে করে ফেললেন। মের্সেদেসের বহুদিনের অপেক্ষার অবসান হলো। কিন্তু আবার তাকে মায়ের কাছে রেখে ছুটলেন ভেনিজুয়েলায়। সেখান থেকে কলোম্বিয়ায় ফিরে কিউবা সরকারের মুখপাত্র হিসেবে বোগোতায় স্থাপন করলেন প্রেনসা লাতিনা। পরে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়ে এরই একটা শাখা খোলার জন্য সপরিবারে ছুটলেন নিউ ইয়র্ক। কিছুদিন পর সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ইতিমধ্যে জন্ম নেয়া বড় ছেলে রোদরিগো আর স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন মেহিকোতে।
মেহিকোতে দারিদ্র্য ছিল আপনার নিত্যসঙ্গী। বেঁচে থাকবার জন্যে তাই শুরু করেছিলেন সিনেমার সাবটাইটেল আর চিত্রনাট্য লেখা। সময়টা ১৯৬২ সাল, এই সময়েই মেহিকোতে বসেই লিখলেন কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না শীর্ষক অসাধারণ বড় গল্প বা নোভেলা। প্রকাশিত হলো প্রথম গল্পসংকলন বিগ মামাস ফ্যুন্যারেল। অনন্য বর্ণনারীতি আর লাতিন সমাজজীবনের দ্বারা সমৃদ্ধ এর গল্পগুলো বিশ্বের গল্পপাঠকদের দিল নতুনত্বের স্বাদ। ওই বছরই জন্ম নিল আপনার দ্বিতীয় পুত্র গোনসালো। চলচ্চিত্রের জন্য পর পর লিখলেন দুটি চিত্রনাট্য : তিয়েম্পো দে মোরিরে (সহচিত্রনাট্যকার কার্লোস ফুয়েন্তেস) এবং হোগো পেরিগোজো।
চলচ্চিত্র, গল্প, নোভেলা, নানা মাধ্যমে আপনার প্রতিভা বিকশিত হলেও প্রকাশিত বইগুলো তেমন বিক্রি হচ্ছিল না। দারিদ্র্য আর হতাশা তাই আপনার জীবনে এসে ভর করলো। বেঁচে থাকার জন্য কাজ নিতে হলো বিজ্ঞাপনী সংস্থায় আর জড়িয়ে পড়লেন পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে। এর পর এলো সেই অভূতপূর্ব সময়। অবকাশ কাটাবার জন্যে গাড়ি চালিয়ে মেহিকো থেকে আকাপুলকোর দিকে চলেছেন আপনি। হঠাৎ আপনার মানসপটে ভেসে উঠলো কল্পিত সেই মাকান্দো জনপদের ছবি, বিগত কুড়ি বছর ধরে যা নিয়ে ভাবছিলেন আপনি। এ প্রসঙ্গে পরে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন : “অকস্মাৎ জানিনা কীভাবে যেন উপন্যাসটার সম্পূর্ণ খসড়াটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমার চিন্তাস্রোতটা এতটাই স্বচ্ছ, স্পষ্ট আর সম্পৃক্ত লাগছিল যেন আমি একের পর এক এর প্রতিটি শব্দ কোনো এক টাইপিস্টকে গড় গড় করে বলে যেতে পারছি।” সংসার আর বাচ্চাদের সব দায়-দায়িত্ব মের্সেদেসের হাতে তুলে দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে গেলেন আপনি। জগৎ সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একটানা আঠারো মাস ধরে লিখে ফেললেন আপনার স্বপ্নের উপন্যাস : শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা। সামান্য উদরপূর্তি আর ছয় প্যাকেট সিগারেটই ছিল তখন আপনার সঙ্গী। এদিকে ধারদেনায় জেরবার মের্সেদেস। গাড়িতো বটেই, বিক্রি করতে হলো আসবাবপত্র, বাসনকোসন। প্রতিবেশীরা বুঝতে পারলো, গাবো কোনো গুরুত্বপূর্ণ লেখায় ব্যস্ত। কিছুদিন বাদে উপন্যাসটির প্রথম তিনটি অধ্যায়ের খসড়া পাঠিয়ে দিলেন বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেসকে। ফুয়েন্তেসতো পড়েই রীতিমতো বিমুগ্ধ। সংবাদমাধ্যমে বলেই ফেললেন, এইমাত্র আমি আসন্ন চিরায়ত সাহিত্যের প্রথম আশি পৃষ্ঠা পড়ে শেষ করলাম।
অবশেষে আঠারো মাসের অজ্ঞাতবাস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন আপনি। হাতে তেরোশো পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি। কী কঠোর অধ্যবসায় আর পরিশ্রমই-না আপনাকে করতে হয়েছিল এই বইটি লিখবার জন্য! স্ত্রী এবং বন্ধুদের শোনাবার একপর্যায়ে শেষপৃষ্ঠায় পৌঁছে পেয়ে গেলেন উপন্যাসের নাম - সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ। প্রকাশকের কাছে পাঠাবার ডাকমাশুলও তখন আপনার নেই। বৌয়ের চুল শুকোবার যন্ত্র আর বৈদ্যুতিক স্টোভ বিক্রি করে জোগাড় করতে হলো সেই টাকা। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আর্হেন্তিনার বুয়েনোস আইরেসের সুদামেরিকানা প্রকাশনা সংস্থা থেকে বেরুলো সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সারা লাতিন আমেরিকা জুড়ে হৈচৈ পড়ে গেল। প্রথম সপ্তাহে বিক্রি হলো আট হাজার কপি, এর পর প্রতিমাসে কয়েকটি মুদ্রণ। তিন বছরে বিক্রি হলো পাঁচ লাখ বই। ১৯৭০ সালে গ্রেগরি রাবাসার অনুবাদে বেরুলো এর ইংরেজি অনুবাদ : ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে পৃথিবীর এমন কোনো ভাষা নেই যে ভাষায় উপন্যাসটি অনূদিত হয়নি। ইংরেজি অনুবাদসহ এ পর্যন্ত এই বইয়ের বিক্রির সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি। এই উপন্যাসটির রাষ্ট্রীয় ও সাহিত্য পুরস্কার যেমন জুটেছে, তেমনি আপনাকে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেছে। মারিও ভার্গাস ইয়োসা আপনার জীবনের প্রথম তেতাল্লিশ বছরকে নিয়ে লিখে ফেললেন একটি বই। এরপর সাড়া পৃথিবী জুড়ে এই উপন্যাসটিকে সর্বকালের সেরা উপন্যাস বা মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে তেমন দেরি হয়নি। অর্থ, খ্যাতি আর পুরস্কারের মধ্যে যখন আপনি ডুবে যাচ্ছেন, তখনই স্বৈরাচারের চেহারা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করবার জন্য চলে গেলেন ফ্রাঙ্কোর স্পেনে। কী সাহস আপনার!
বিশ্বসাহিত্যের পাঠকমাত্রই আমরা জানি, লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের প্রধান অংশ জুড়ে আছে স্বৈরাচারের বিচিত্র প্রসঙ্গ। এই স্বৈরাচারের চমৎকার ছবি পাওয়া যায় আপনার কুলপতির হেমন্তকাল উপন্যাসে। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপের স্বৈরাচারী শাসক কীভাবে একাকীত্বের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যেতে পাওে, এতে আছে সেরকমি একটা গল্প। ব্যক্তিমানুষের এই সংকট, বিশেষ করে নারীর হাতে নারীর বা পুরুষের দ্বারা নারীলাঞ্ছনার দুঃসহ কাহিনি হচ্ছে আপনার বেচারি এরেন্দিরা আর তারহিৃদয়হীন দাদীমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনি। দেশপ্রেম ও স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি হিসেবে আপনার গোলকধাঁধায় সেনাপতি উপন্যাসটিও অসাধারণ।
ভাবতে অবাক লাগে, আপনি শুধু কলোম্বিয়া নয়, হয়ে উঠেছেন সমগ্র লাতিন আমেরিকার কণ্ঠস্বর। সমগ্র মহাদেশের মানুষ সেই ঔপনিবেশিক কাল থেকে যে অবিশ্বাস্য নিপীড়িন, নির্যাতন, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের দ্বারা মানবেতর জীবনযাপন করে আসছে, সেই নির্মম বাস্তবতারই করুণ ছবি কথাসাহিত্যে তুলে ধরেছেন। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তেও এসব কথা ভুলে যাননি আপনি। সেই সঙ্গে আপনার গুরু ফকনারের মতোই উচ্চারণ করেছিলেন মানুষের অজেয় সম্ভাবনা ও মুক্তির কথা : “এই ভয়াল বাস্তবতার সামনে - সমস্ত মানুষী কালে যাকে মনে হয়েছিল নিছক কোনো কল্পলোক বলেই, আমরা যারা কথা বানাই, কাহন গড়ি, আমরা তবু কিন্তু বিশ্বাস করি সবকিছু, বিশ্বাস করবার দাবি ও অনুভূতি রাখি যে এখনও এক বিকল্প/বিরুদ্ধ কল্পরাজ্য গড়বার কাজে আত্মনিয়োগ করার সময় আছে - এখনও সময় চলে যায়নি।” একশো বছরের রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতার দণ্ড পেয়ে যে মহাদেশের মানুষ ভেঙে পড়েছে, সেই মানুষকেই আবার উঠে দাঁড়াবার আহ্বান জানালেন আপনি।
কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, এ কী শুধু একমহাদেশের কথা? নাকি আপনি নির্যাতিত বিশ্বমানবতার কথা ধনিত হলো আপনার কণ্ঠে? জানি, আজ আর এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া যাবে না, যা কিছু উত্তর তা উৎকীর্ণ হয়ে আছে আপনার লেখা রচনাবলিতে, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে। সেই মর্মবাণীটি হলো - মানুষ অজেয়, মানবের কোনো অবসান নেই। এই হচ্ছে আপনার অসাধারণত্ব, এই হচ্ছে সর্বকালের সেরা কথাসাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যার দেহ নশ্বর, কিন্তু ভাবনা মানবিক জয়গাথা হিসেবে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
গাবো, আপনাকে কুর্নিশ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
No comments