বিচ্ছিন্ন গাজার অবরুদ্ধ জীবন
গাজার জাবালা শরণার্থী শিবিরে সাত সদস্যের
পরিবার নিয়ে দুই কক্ষের খুপরিতে বসবাস মোস্তাফিজের। জাতিসংঘের দেওয়া চাল,
আটা, টিনজাত মাংস, সূর্যমুখী তেল, সীমিত স্বাস্থ্যসেবার ওপর বেঁচে আছে এই
পরিবার। শুধু মোস্তাফিজের পরিবারই নয়, পৈতৃক ভিটা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে
আশ্রয় নেওয়া এমন পরিবারগুলোর না আছে অর্থ, না আছে আয়রোজগারের কাজ। এমনকি
কোনো আশাও নেই।
সাত বছর ধরে ইসরায়েলি অবরোধে গাজাবাসীর স্বাভাবিক জীবন অবরুদ্ধ। ১০ মাস ধরে মিসর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ বন্ধ। এসব কারণে গাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। ২০১৩ সালের শেষনাগাদ বেকারত্বের হার বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছায়।
সম্প্রতি রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। হামাসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের অধীনে গাজাবাসী এখন বলতে গেলে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছে। অনেকে এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
গাজাবাসী তরুণ তারেকের (২২) বক্তব্যে সে আভাস স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ডুবছি...আমাদের মনে হয় পুরো বিশ্ব আমাদের ওপর। টেলিভিশনে অন্যদের জীবনযাপন দেখে মনে হয়, হে আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করো। আমি যেন এখান থেকে বের হতে পারি।’
তারেক বলেন, ‘এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার বা বিয়ে করার মতো অর্থ নেই। এমনকি এখানে বাড়ির বাইরে কিছুটা সময় কাটাতে পারি, সে সুযোগও নেই। এটা কেমন জীবন?’
জাতিসংঘের শরণার্থীদের জন্য কাজ করে এমন সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, তারা এখন আট লাখ ২০ হাজার মানুষকে খাবার বিতরণ করে যাচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় ৪০ হাজার বেশি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এক লাখ ৮০ হাজার মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হলে অনেকে নিজের ভিটা ছেড়ে ফিলিস্তিনে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে গাজার ১৮ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১২ লাখের বেশি শরণার্থী।
গাজায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য কাজ করে এমন একটি সংগঠনের ইমান শান্নান রয়টার্সকে বলেন, প্রতিদিনই নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত পাঁচজন রোগী আসছেন। ক্যানসারে তাঁদের মৃত্যু হয় না, যতটা না আশপাশের পরিবেশের কারণে হয়। মানুষ ক্যানসার থেকে সেরে উঠতে পারে, কিন্তু এ পরিস্থিতি থেকে নয়।
গাজা উপত্যকায় ১৩ হাজার লোক ক্যানসারে ভুগছে। ফিলিস্তিনে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। এর পরই রয়েছে ক্যানসার।
উত্তর গাজায় ৬৭ বছর বয়সী এক কৃষক স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ইসরায়েল সীমান্তে তাঁর এক লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার জমি ছিল। সেখানে জলপাই, লেবু, কমলার উত্পাদন হতো। সেখানকার পানিও ছিল সুপেয়। কিন্তু ২০০৮ সালে ইসরায়েল সীমা লঙ্ঘন করে বুলডোজার দিয়ে তাঁর খামার গুঁড়িয়ে দেয়। এখন এখানকার পানি লবণাক্ত ও পানের অযোগ্য। তাই পানি বিশুদ্ধ করতে গেলে তাঁদের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। তিনি বলেন, ‘তারা (ইসরায়েল) যখন জমি দখল করে নিল, তখনই আমাদের জীবন শেষ। এক সময় আমরা ফল বিক্রি করতাম। এখন যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের এখন উল্টো মিসর ও ইসরায়েল থেকে ফল কিনতে হয়।’
এ দুর্ভোগের জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন ওই কুষকের ছেলে মাহমুদ (২২)। তিনি বলেন, যদি কাজের সুযোগ থাকে, তাহলে তাদের লোকজনই তা পায়। তারা কখনোই দুর্ভোগ পোহায় না।
হামাস এই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য ইসরায়েলকে অনেকটা দায়ী করেছে।
ইউএনআরডব্লিউএর উপপরিচালক (অপারেশন) স্কট অ্যান্ডারসন বলেন, দিন দিন গাজায় দারিদ্র্য বেড়েই চলেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। গাজাবাসী যে ‘অর্থনৈতিক ধাক্কা’র মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কেবল সিয়েরা লিওনের মানুষই বুঝতে পারবে। কেননা তারাও এ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
No comments