আলোচনা- 'ভুরকি গ্রামের স্ব্বপ্না বিবি থেকে রুশনারা আলী' by ইফতেখার মাহমুদ

ডাকনাম স্বপ্না। ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ভুরকি গ্রামে জন্ম। গ্রামের মানুষ ও স্বজনেরা ডাকতেন স্বপ্না বিবি নামে। বাবার দেওয়া নাম রুশনারা আলী।

ভুরকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা। বাবা আফতাব আলী থাকতেন লন্ডনে। সেই সূত্রে ১৯৮২ সালে রুশনারারা সবাই মিলে পাড়ি দেন বিলাতে।
হ্যাঁ, বাঙালি মেয়ে হয়ে ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হওয়া প্রথম এশিয়ান নারীসদস্য রুশনারা আলীর কথা বলছি। বিবিসি ও গার্ডিয়ান পত্রিকা যাঁকে নিয়ে লেখা প্রতিবেদনে বলেছে, ‘ব্রিটেনের আগামী দিনের তরুণ তুর্কি। লেবার পার্টির পরবর্তী নেতৃত্ব। এরই মধ্যে নিজ দলের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক ছায়ামন্ত্রীর ভূমিকা পালন করছেন।’
রুশনারা গত ৪ নভেম্বর ২০১০ইং ঢাকায় এসেছিলেন, প্রতীকী জলবায়ু আদালতের পর্যবেক্ষক হিসেবে। গ্রামীণ জীবনযাত্রার জন্য স্থায়িত্বশীল প্রচারাভিযানের (সিএসআরএল) আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার সাথে কথা বলে লিখেছেন ইফতেখার মাহমুদ।
সিলেটবাসী তাঁকে এখনো স্বপ্না নামেই চেনে। বিশ্বনাথ উপজেলার ভুরকি গ্রামের ওই ছোট্ট মেয়েটি এখন স্বপ্ন দেখেন মাতৃভূমি বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাওয়ার। তিনি চান, ব্রিটেনের পার্লামেন্ট বাংলাদেশের জলবায়ুর ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। মাতৃভূমি বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তার আশ্বাস সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে।
আদালতে বসে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্বামী-সংসার হারানো বরগুনার জেলেপল্লির মমতাজ বেগম ও সূর্য বানুর কান্না আর বিলাপ শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি রুশনারা। এই কষ্ট-বেদনার কথা যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন তিনি। বিশ্বমন্দার কথা বলে যুক্তরাজ্য সরকার উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করলেও বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ বরাদ্দ যেন না কমানো হয়, সে সম্পর্কে প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
লন্ডনের নির্বাচনী ঝড় যখন সিলেটে
রুশনারার এবারের বাংলাদেশে আসা নিয়ে অনেক তোলপাড় হলেও তিনি কিন্তু বাংলাদেশে নিয়মিতভাবেই আসেন। নির্বাচনী প্রচারণার বাইরে পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিয়ের দাওয়াত কিংবা নিছক বেড়াতে তিনি প্রায়ই দেশে আসতেন। এসেই সরাসরি চলে যেতেন নিজের গ্রামের বাড়িতে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বার দেশে এসে উঠেছিলেন গ্রামের বাড়ি ভুরকিতে। থেকেছেন চাচা ও মামাদের বাসায়।
এবারও পাঁচ দিনের সফরের মধ্যে দুই দিন তাঁর কেটেছে নিজের গ্রামের বাড়িতে। চেনা পথ, পরিচিত স্কুলঘর ও শৈশবের স্মৃতিমাখা রাঙা ধুলো গায়ে মেখে গেছেন তিনি। নানা ব্যস্ততার মধ্যে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতেও ভুলে যাননি।
লন্ডনের বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটে যখন নির্বাচন হয়, তার প্রচারণার একটা বড় অংশ হয় সিলেটে। এত দিন সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে আসতেন ব্রিটিশ প্রার্থীরা। রুশনারার আগে ওই আসন থেকে নির্বাচিত এমপি জর্জ গ্যালাওয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় সিলেটে এসেছিলেন।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে সিলেটবাসী জানল, তাদের এলাকায় পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন বো আসনের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে আসছেন বিশ্বনাথের ভুরকি গ্রামের স্বপ্না বিবি। ১০ বছর ধরে লেবার পার্টির সঙ্গে যুক্ত এই বাঙালি তরুণী এরই মধ্যে তাঁর মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রসঙ্গত, প্রতিপক্ষ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য আজমল মশরুরের বাড়িও সিলেটের ছাতকে।
রুশনারার মতো আজমলও সিলেটের প্রতিটি উপজেলায় নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। যে সিলেটে এখন পর্যন্ত কোনো নারী সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হননি, আর সেই সিলেটের মেয়ে লন্ডনে গিয়ে নির্বাচন করছেন, এটা ভেবে এলাকাবাসী পুলকিত হয়। লন্ডনের নির্বাচনের আমেজ তৈরি হয় সিলেটের বিশ্বনাথ, ছাতক, ফেঞ্চুগঞ্জসহ সব উপজেলায়। নির্বাচনী জনসভাগুলোতে মানুষের ঢল নামে।
বিশ্বনাথের স্থানীয় রাজনীতিতে শফিক-ইলিয়াস-মুহিবের মধ্যে দা-কুড়ালের সম্পর্ক থাকলেও রুশনারা আলীকে নির্বাচিত করানোর জন্য তাঁরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতৈক্যে পৌঁছান। চিরবৈরিতা বাদ দিয়ে তাঁরা তিনজনই সমানতালে সমর্থন দিয়েছেন রুশনারা আলীকে। রুশনারা আলীর পক্ষে প্রচারণার জন্য সুদূর ব্রিটেনে যান স্থানীয় সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী। ব্রিটেনে যেতে না পারলেও দেশে থেকেই সাবেক সাংসদ নুরুল ইসলাম খান, এম ইলিয়াস আলী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুর রহমান, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ন ম শফিকুল হক ও সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীমসহ অনেক ব্যক্তি ও বিশ্বনাথ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন রুশনারা আলীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালায়।
বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের মোট জনসংখ্যা এক লাখ। এর মধ্যে ৭০ হাজারই বাঙালি। ওই আসনে মনোনয়ন পাওয়া ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন ছিলেন বাঙালি। তাঁরা হলেন লেবার পার্টি থেকে রুশনারা আলী, কনজারভেটিভ পার্টি থেকে জাকির খান, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে আজমল মশরুর, রেসপেক্ট পার্টি থেকে আবজন মিয়া ও গ্রিন পার্টি থেকে ফরিদ বখত। তাঁরা ছোটবেলায় ব্রিটেনে অভিবাসী হয়েছেন। প্রার্থীদের সবারই পৈতৃক নিবাস বৃহত্তর সিলেটে।
৬ মে ২০১০-এ অনুষ্ঠিত হয় সেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন। এতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন রুশনারা আলী। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আজমল মশরুর। নির্বাচনে জয়লাভ প্রসঙ্গে বিনয়ী রুশনারা বলেন, ‘আমার এ জয় সম্ভব হয়েছে মালবেরি স্কুল, টাওয়ার হ্যামলেট কলেজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টায়। তাঁদের সহায়তার কারণে আমি ব্রিটেনের পাসপোর্ট পেয়েছি। ইনস্টিটিউট অব পাবলিক পলিসি রিসার্চ ও পার্লামেন্টে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।’
রুশনারার আলো
নির্বাচনে জিতলে এলাকার তীব্র বেকার ও আবাসন-সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন রুশনারা। সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশিরা লন্ডনে অনেক কষ্টে আছে। সেখানকার পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধানের জন্য একজন বাংলাদেশিকে পার্লামেন্টে যেতে হবে।’
নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রচেষ্টায় স্থাপিত হয়েছে টাওয়ার হ্যামলেট সামার ইউনিভার্সিটি। প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে অপরাধ কমে আসার পেছনে এই বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কর্মজীবনের শুরুটা ছিল লন্ডনের ইস্ট এন্ডে।
শিক্ষা, নেতৃত্ব, স্বাস্থ্য, বর্ণ সম্পর্ক, সামাজিক নীতি ও উদ্ভাবন বিষয়ে মূলধারার দৈনিকগুলোতে প্রচুর লেখালেখি করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন তিনি। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসে হিউম্যান রিসার্চ ফেলো এবং সাবেক এমপি ওনা সিংয়ের পার্লামেন্টারি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রুশনারা কাজ করেছেন। ওনা সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে একবার বাংলাদেশ সফরও করে গেছেন তিনি।
টাওয়ার হ্যামলেট এলাকার বেশির ভাগ অধিবাসী বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠী। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা কম থাকায় উচ্চশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও এখানকার অধিবাসীরা ভালো চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। ইংরেজি ভাষায় দুর্বল মানুষদের জন্য টেলিফোন সহায়তা কেন্দ্র গড়ে তোলেন তিনি। যেখানে যেকোনো এশীয় ও আফ্রো-ব্রিটিশ মাতৃভাষায় কথা বলে, তার ইংরেজি ভাষান্তরের সহায়তা দেওয়া হয়। ইয়াং ফাউন্ডেশন অব বেথনালের সহযোগী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিনি। লন্ডন চাইল্ড পোভার্টি কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
নিজের রাজনৈতিক দর্শন তুলে ধরতে গিয়ে রুশনারা বলেন, ‘আমি জানি, কীভাবে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করা যায়। আমার আছে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ স্থানে উঠে আসার অভিজ্ঞতা।’ তৃণমূল থেকে ব্রিটেনের রাজনীতির সর্বোচ্চ মঞ্চে প্রবেশ করেছেন রুশনারা। প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশিরা সুযোগ পেলে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারে। লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে আমাদের এই সিলেটি মেয়ে ব্রিটেনের ছায়ামন্ত্রী থেকে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হবেন—এমন আশা করা তাই হয়তো অমূলক হবে না।
========================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধের বিচার' by শ্যামল সরকার  প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন  প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ  শিল্প-অর্থনীতি 'অবকাঠামোর উন্নয়নে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ' by হানিফ মাহমুদ  প্রবন্ধ- 'সাবধান থেকো তাদের থেকে...' by বদিউল আলম মজুমদার  আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা  আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান


প্রথম আলো এর সৌজন্য
লেখকঃ ইফতেখার মাহমুদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.