আলোচনা- 'প্রসঙ্গ : দুর্নীতি উৎপাটন' by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

দেশকে উদ্ধার করাটা যে বর্তমানে একটি প্রধান কাজ, সুযোগ পেলেই সেকথা বলতে কেউ ভুল করে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কি উদ্দেশ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে।

সেটা কি আসলে দুর্নীতি নির্মূলের আন্তরিক ইচ্ছা থেকে, নাকি তা প্রধানত: দলবাজির চিন্তা থেকে? এ পক্ষের অভিযোগ যে, দেশকে তো 'ওরাই' দুর্নীতিতে ডুবিয়ে রেখে গেল। তাই আমাদের আমলে যা কিছু হচ্ছে তার সবটাই হলো 'ওদের' দুষ্কর্মের রেশ মাত্র। 'ওরা'ই হল দুর্নীতির পঙ্কে কলুষিত। আবার ওই পক্ষের বক্তব্যও অনুরূপ_দুর্নীতির জন্য যারা দায়ী তারা কেবলই অপরপক্ষ।
জনগণ কিন্তু জানে যে, আসলে দুই পক্ষই সত্য বলছে। অর্থাৎ উভয় সম্পর্কে পরস্পরের অভিযোগই সঠিক। দুই পক্ষই দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত।
দুর্নীতির আসল কারণ অনুসন্ধান না করে এর দায় শুধু অপর পক্ষের কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার ফলে যা হবার তাই হয়। মূল রোগ সমাজদেহে থেকেই যায়। দুর্নীতির উৎসমূল তার অপার শক্তি নিয়ে বিরাজ করতেই থাকে। অনেকের কাছে দুর্নীতির হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো, দুর্নীতিবাজদের ধর, বিচার কর, জেল-ফাঁসি দাও। একথা ঠিক যে, দুর্নীতিবাজদের বিশেষ করে, তাদের মধ্যকার 'রুই-কাতলা'দের সাজা দেয়াটা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সেটাই কি দুর্নীতি উৎপাটনের জন্য যথেষ্ট। ফুটো কলসিতে যতই পানি ঢালি, কলসি কিন্তু তাতে কখনোই ভরবে না। অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থাটা যদি এমনই থেকে যায়, তাতে প্রতিনিয়ত দুর্নীতিবাজ সৃষ্টি হতে থাকে, তাহলে মাঝে-মধ্যে কয়েক ডজন অথবা কয়েশ' দুর্নীতিবাজকে আটক করেও সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না।
আমাদের দেশে বর্তমান ঘুষ-দুর্নীতি যে ভয়াবহ প্রসারতা ও মাত্রা অর্জন করেছে, তা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে এর পিছনের আসল সামাজিক-অর্থনৈতিক উৎসটির কথা বুঝতে পারাটা একান্ত আবশ্যক। আমার বিবেচনায় ঘুষ-দুর্নীতির বর্তমান ভয়াবহতার ব্যাপারটি প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার একটি অভিঃপ্রকাশ মাত্র। যদি তাই হয়, তাহলে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে কি করতে হবে? শুধু কি অভিঃপ্রকাশটিকে (অর্থাৎ শুধু ঘুষ-দুর্নীতির বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলী) আক্রমণ করলেই চলবে। কিংবা শুধু কি অভিঃপ্রকাশের উৎস (অর্থাৎ শুধু প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে) আক্রমণ করার কাজে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে?
পরিতাপের বিষয় এই যে, ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনাবলী নিয়ে বহু বছর ধরে এদেশে বহু কথাবার্তা হচ্ছে। এই ইস্যু ধরে তীব্র প্রচারণা হচ্ছে। কার আমলে ঘুষ-দুর্নীতি বেশি ছিল না বা কম ছিল তা নিয়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় উঠানো হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগকে ক্ষমতা পরিবর্তনের স্কিমে ইস্যু বানানো হচ্ছে। পূর্বতন 'দুর্নীতিবাজ' সরকারের পতন ঘটানো হচ্ছে। নতুন 'দুর্নীতিবাজ' সরকার উচ্ছেদের আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু কই, দুর্নীতির ভয়াবহতা তো দূর হচ্ছে না। সরকার যায়-আসে, কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতি দূর হয় না।
আমাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদ ও বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা অর্থনৈতিক-সামাজিক যে-দর্শন ও চলার পথ নির্দেশ করে চলেছে, সেটাই জন্ম দিয়েছে লুটেরা ও পরগাছাপরায়ণ লুটপাটের অর্থনীতি। এই নীতি-দর্শন অনুযায়ী দেশের অগ্রগতির (?) জন্য ব্যক্তিগত মালিকানায় পুঁজি সঞ্চয় জরুরি কাজ। সেইসাথে অবাধ বাণিজ্য অত্যাবশ্যক। ব্যক্তিমালিকানায় পুঁজিসঞ্চয় হবে কীভাবে? স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য দিয়ে (মুনাফার হার যদি ২৫% ধরি) একজন লাখপতিকে কোটিপতি হতে ২০/২৫ বছয় সময় লাগবে, অথচ সে চায় ২/১ বছরেই তাকে কোটিপতি হতে হবে। পথ একটাই। অস্বাভাবিক আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। আইনের পথের বাইরে অর্থ-উপার্জন নিশ্চিত করতে হবে। অবাধ লুটপাটের আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ব্যক্তিগত মালিকানায় পুঁজি সঞ্চয় হবে না, রাতারাতি কোটিপতি হওয়া যাবে না। এভাবেই এদেশে গড়ে উঠেছে একশ্রেণীর লুটেরা বিত্তবান। তারাই এখন হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রক। তাদের লুটপাট নিরাপদ রাখার জন্যই আমলাতন্ত্র, রাজনীতিবিদ, মাস্তান বাহিনী প্রভৃতিকে লুটপাটের ভাগিদার বানিয়ে তারা দেশকে (সরকার, বিরোধীদল, রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি প্রভৃতি সবকিছু) নিয়ন্ত্রণ করছে। দেশ আজ এক অশুভ 'মাফিয়া সিন্ডিকেটে'র হাতে বন্দী। সমাজ দর্শন ও সমাজ কাঠামোতে এ লুটপাটের ব্যবস্থা ও ধারা অব্যাহত থাকার কারণেই 'সরকার আসে-যায়, কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতি চলছে তো চলছেই'।
আদি পুঁজিসঞ্চয় থেকে উৎপাদনমুখী উদ্যোগে উত্তরণ এবং নূ্যনতম অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাও এদেশে সম্ভব হচ্ছে না একই কারণে। ফটকাবাজি-চোরাচালান-মজুদদারী এতগুলো তো মুনাফা রাতারাতি। কিন্তু শিল্প বিনিয়োগে খাটুনি বেশি, মুনাফা জমা হওয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘমেয়াদী। তাছাড়া 'অবাধ বাণিজ্য' নীতি দেশকে বিদেশি পণ্যের নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে পরিণত করেছে। ফলে দেশের নবীন শিল্প-উদ্যোগ অর্থনীতির নিয়মানুসারে 'অবাধ প্রতিযোগিতার' গলাকাটা প্রক্রিয়ায় উন্নত বিদেশি কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। এসব কারণে শিল্প-পুঁজির তুলনায় ব্যবসায়ী-পুঁজি (যা মূলত বিদেশি কোম্পানির স্থানীয় লুটেরা চরিত্র জিইয়ে রাখছে) তার আধিপত্য বজায় রেখে অর্থনীতির উৎপাদনবিমুখ, পরগাছাপরায়ণ ও লুটেরা চরিত্র জিইয়ে রাখছে। এগুলোই হলো এদেশের ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহ উৎস সূত্র। এখন মূল কথায় এসে বলা যায় যে, বর্তমানে যে সমাজ দর্শন ও অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ধারায় দেশ চলছে, ঘুষ-দুর্নীতির ভয়াবহতার অবসানের জন্য সেই ব্যবস্থার আমূল উচ্ছেদ একান্ত অপরিহার্য। এক্ষেত্রে উপযুক্ত আইন-কানুন প্রণয়ন, আরো কঠোরভাবে ঘুষ-দুর্নীতি মোকাবেলা করা ইত্যাদি যেমন প্রয়োজন_কিন্তু সবচেয়ে বড় যেটা প্রয়োজন তাহলো, ঘুষ-দুর্নীতির লালনকারী বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন। দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, বর্তমান মহাজোট সরকার মুখে দুর্নীতি উচ্ছেদের কথা বললেও উল্লেখিত দুটি কাজের একটিও করছে না। বরঞ্চ সরকার বিপরীতমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। উপযুক্ত আইন-কানুন প্রণয়ন ও সেসবের আরো কঠোর প্রয়োগের বদলে নরম নীতি অনুসরণ করছে। দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ তালিকা প্রস্তুুতিতে অস্বচ্ছতা চলছে। দুর্নীতিদমন কমিশনের চেয়ারম্যান তো বলেই দিয়েছেন যে, এই স্বাধীন সংস্থাটিকে নখ-দন্তহীন বাঘে পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে যে অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা বিভিন্ন সরকারের রাজত্বকালে বছরের পর বছর ঘুষ-দুর্নীতির প্রবণতা জন্ম দিয়ে চলেছে, তা থেকে দেশকে সরিয়ে আনার কোনো প্রচেষ্টাই এ সরকারের নেই। বরঞ্চ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের নামে লুটপাটের ব্যবস্থাকেই জিইয়ে-রাখা ও শক্তিশালী করা হচ্ছে। কুখ্যাত এশিয়া এনার্জির পৃষ্ঠপোষকতায় লন্ডনে 'রোড মার্চের' আয়োজন, দলীয় ক্যাডারদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সরকারি ক্রয়নীতি সংশোধন ঘুষ-দুর্নীতি পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটাবে। হাতে হাতেই এর ফল পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার সতর্কবাণী, এমনকি চূড়ান্ত সতর্কবাণী, দেয়ার পরেও ছাত্র-যুবসহ দলীয় ক্যাডারদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলদারি ইত্যাদি বন্ধ তো দূরের কথা, কমানোও যাচ্ছে না। অপরাধ বিস্তৃৃত হচ্ছে সুদূর তৃণমূলে।
দুর্নীতি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে আসল জায়গায় আঘাত করতে হবে। যে-মাফিয়া সিন্ডিকেট সর্বগ্রাসী সর্বব্যাপী এক মহাশক্তিরূপে সব সরকারের আমলেই ক্ষমতার প্রকৃত নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে আছে, তার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের নবধারা বেগবান করতে হবে। এই অপশক্তিকে নির্মূল করতে হবে। তাহলেই পরিত্রাণ সম্ভব। এ লড়াই খুব কঠিন এক সংগ্রাম। দেশের মেহনতি শ্রমজীবী জনগণকেই এই লড়াইয়ের অগ্রভাগে এসে দাঁড়াতে হবে। সমাজের অন্যসব বিবেকবান সৎ মানুষকে সেসব ধারার সংগ্রামে সমবেত করতে হবে। সেই সুস্পষ্ট লক্ষ্যে গড়ে তুলতে হবে জাতীয় জাগরণ। এটা হবে নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে জাতীয় নবউত্থান। মূল কাজের কথা মনে রেখে অগ্রসর হতে পারলেই জনগণ তার নিজের ও দেশ-জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে এগিয়ে আসবে, সঙ্ঘবদ্ধ হবে, সৃষ্টি করবে নবজাগরণ। জনগণের সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের আঘাতে উপড়ে ফেলতে সক্ষম হবে ঘুষ-দুর্নীতির বর্তমান ভয়াবহতার উৎসবকে। জাতি নবজন্ম লাভ করবে। শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর, উৎপাদনমুখী শিল্পপতি, সৎ ব্যবসায়ী, মধ্যবিত্ত সমাজ, সকলের সামনেই এটা সাধারণ কর্তব্য। সকলকে একত্রে, শক্তভাবে, নীতিনিষ্ঠতার সাথে রচনা করতে হবে জাতির জন্য সত্যিকারের এক নতুন পথ। কিন্তু এজন্য প্রয়োজন প্রগতিমুখী সমাজ বিপ্লব। সে-কাজটি করতে হবে দেশের বামপন্থী, প্রগতিশীল, প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তিকে।
======================
ইতিহাস- পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পরিচিতি  প্রকৃতি- 'কোপেনহেগেনের বিক্ষোভ' by জোয়ান হ্যারি  আলোচনা- 'আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করা দরকার' by ইলিরা দেওয়ান  আলোচনা- 'ভুরকি গ্রামের স্ব্বপ্না বিবি থেকে রুশনারা আলী' by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'সংবিধান সংশোধন, যুদ্ধাপরাধের বিচার' by শ্যামল সরকার  প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন  প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ  শিল্প-অর্থনীতি 'অবকাঠামোর উন্নয়নে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ' by হানিফ মাহমুদ  প্রবন্ধ- 'সাবধান থেকো তাদের থেকে...' by বদিউল আলম মজুমদার  আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা 


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.