প্রকৃতি- 'জলবায়ু পরিবর্তন : অদ্ভুত আঁধার এক' by আজাদুর রহমান চন্দন

পৃথিবীর বয়স ৪৬০ কোটি বছরের মতো। স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীর আরো ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি বছর টিকে থাকার কথা। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই সময় সূর্য তার সব হাইড্রোজেন জ্বালানি নিঃশেষ করে ফেলে প্রসারিত হবে এবং পৃথিবীসহ তার চারপাশের সব গ্রহকে

ভস্মীভূত করে দেবে। অন্যদিকে মানুষের তৈরি পরমাণু অস্ত্র যে কোনো সময় ধ্বংস করে দিতে পারে পৃথিবীকে। এই দুই চরম পরিণতির সুতোয় ঝুলছে পৃথিবীর আয়ু।
এ পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক। একেবারে নিখুঁত হিসাব পাওয়া না গেলেও ধরে নেয়া হয়, ইতিহাসটা ৩০-৪০ লাখ বছরের। ১৮০০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে লোকসংখ্যা ছিল ১০০ কোটির মতো।
এরপর গত কয়েক শতকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির হাতিয়ার নিয়ে মানুষ যেমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তেমনি তার বংশবৃদ্ধির গতিও হয়েছে দ্রুততর। মানুষের এই সংখ্যাটা বর্তমানে ৬০০ কোটি ছাড়িয়েছে। গত ১০০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে মানুষের গড় আয়ু। নগরায়নও বাড়ছে খুব দ্রুত হারে। দুনিয়ার অনেক দেশেই কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বেড়েছে, নানা ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে জীবনে। অন্যদিকে এই অতি সাফল্য আর দ্রুত বংশবৃদ্ধি পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জন্য রীতিমতো হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বাতাস, মাটি, পানি সবই দূষিত হচ্ছে সীমাহীনভাবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। কেননা এর ফলে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু। মেরু অঞ্চলের হিমবাহ ও হিমালয়চূড়ার বরফ গলার মাত্রা যাচ্ছে বেড়ে। স্ফীত হচ্ছে সমুদ্রের উপরিতল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। অঞ্চলভেদে খরা ও বন্যায় ফসলহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক। ফলন কমে যাচ্ছে ফসলের। সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পরিবর্তন ঘটছে সুপেয় পানির প্রাপ্যতার। কোনো কোনো দেশের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
পিলে চমকানোর মতো একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে সম্প্রতি বিবিসি। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে অক্টোবরের (২০০৯) প্রথম সপ্তাহে বিবিসি জানায়, উত্তর মেরু বা আর্কটিকে তাপমাত্রা এখন গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ওই অঞ্চলের বরফখণ্ড, হ্রদের তলদেশ ও গাছ পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, ১০০ বছর আগেও উত্তর মেরুতে তাপমাত্রার তেমন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ১০০ বছর আগে থেকে সেখানে বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা। ভূপৃষ্ঠের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকে।
মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই নির্গমন ঘটে এই গ্যাসের। ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসের শেষদিকে সায়েন্স জার্নালে মার্কিন বিজ্ঞানীরা লিখেছিলেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সানস্পট বা ভলকানোর মতো প্রাকৃতিক কোনো কারণ নেই; বরং মানুষই এর জন্য দায়ী। একই জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, গ্রিনহাউসের প্রভাব ও সৌর উষ্ণায়ন দুটোর বিষয়েই উত্তর মেরুর আবহাওয়া যথেষ্ট সংবেদনশীল, সেখানে উষ্ণতা বৃদ্ধির ঘটনা এটাই নিশ্চিত করেছে। গবেষণায় ২৩টি এলাকার তাপমাত্রার চিত্র দশকওয়ারি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, গত দশকে অর্থাৎ ১৯৯৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত উত্তর মেরুর তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, ১৯০০ সাল পর্যন্ত প্রতি সহস্রাব্দে উত্তর মেরুর তাপমাত্রা কমেছে গড়ে দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস করে। কিন্তু এরপর থেকে ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। গবেষক দলের সদস্য আরিজোনা ইউনিভার্সিটির নিকোলাস ম্যাককেই বলেন, 'বিশ শতকেই প্রথম সূর্যের বাইরের অন্য তাপ-উৎস উত্তর মেরুর তাপমাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।'
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, জলবায়ু গবেষকরা যেসব বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন, তার অনেক কিছুই এখন ঘটতে শুরু করেছে। প্রায় একই সময়ে জেনেভায় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) নির্বাহী পরিচালক আচিম স্টেইনার বলেন, 'আমাদের ধারণার চেয়েও দ্রুতগতিতে ও ব্যাপক আকারে বিশ্বের উষ্ণায়ন ঘটে চলেছে।'
তাপ শোষণকারী মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন যৌগ, ওজোন প্রভৃতি উপাদানই মূলত বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানি দহন এবং জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব উপাদান যুক্ত হচ্ছে বাতাসে। শিল্প-কারখানা ও যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়ায় এসব উপাদান থাকে। এছাড়া শিল্পবর্জ্য মাটির রাসায়নিক সংযুতি ভেঙে দিয়ে ফসফরাস, নাইট্রোজেন, সালফার প্রভৃতি উপাদানকে ফিরে আসতে সাহায্য করছে বাতাসে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোই দায়ী। কিন্তু এর পরিণামস্বরূপ বদলে যাচ্ছে গোটা বিশ্বের জলবায়ু। আর তা মানুষসহ জীবজগৎকে ঠেলে দিচ্ছে প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে। গত সেপ্টেম্বরে (২০০৯) ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অক্সফামের প্রকাশ করা এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে ৪৫ লাখ শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
পরিবেশ সংগঠন ওয়ার্ল্ডওয়াচ ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে জানায়, সে বছরের প্রথম ১১ মাসে আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সারাবিশ্বে কমপক্ষে ৮৯০০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এই দুর্যোগে মানুষের ওপর সরাসরি যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা ছিল ভয়াবহ। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকৃতির ওপর মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে এ সময় আনুমানিক ৩২ হাজার লোক মারা যায় এবং কমপক্ষে ৩০ কোটি লোক ছিন্নমূল হয় অথবা তাদের ঘরবাড়ি নতুন করে বানাতে হয়। ওয়ার্ল্ডওয়াচ আরো জানায়, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হয়। রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০ হাজার মাইল। ধান উৎপাদন কম হয় ২০ লাখ টন। জলবায়ুর পরিবর্তন এবং সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরো বেশি বন্যা দেখা দেয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ওই বছরই নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডবি্লউডবি্লউএফ) এক প্রতিবেদনে জানায়, বিশ্বের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা এবং আবহাওয়ার চূড়ান্ত পরিবর্তন বিভিন্ন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা বাড়িয়েছে। আগে সংক্রমিত হয়নি এমন এলাকায়ও এসব রোগের বিস্তার ঘটতে পারে। আর্জেন্টিনার উত্তরাঞ্চলে ও অস্ট্রেলিয়ায় এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ ঘটেছে। এশিয়ায় নিয়মিত এ রোগ দেখা দিচ্ছে কয়েক বছর ধরেই।
গবেষকদের আশঙ্কা, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়লে গ্রীষ্মকালীন রোগ বাড়বে। বিশেষ করে বাড়বে হেপাটাইটিস-বি, সংক্রামক সেরিব্রাল, মেনিনজাইটিস পোলিও, কলেরা ইত্যাদি। এছাড়া সূর্যের বিকিরণ করা অতিবেগুনি রশ্মির অনুপ্রবেশ বাড়ার কারণে ত্বকের ক্যান্সার ও চোখের ছানিপড়া রোগ বাড়বে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজষ্ক্রিয়তাও বেড়ে যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)। এরপর থেকে জাতিসংঘের আওতায় কাজ করছে এ প্যানেল। প্রতিষ্ঠার পর এই প্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো না গেলে একুশ শতকের প্রতি দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.২ থেকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৩ থেকে ১০ সেন্টিমিটার।
আইপিসিসির ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হবে। পৃথিবীর শুকনোভাবাপন্ন এলাকাগুলো চাষের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ১৯৯০ সালের তুলনায় গড় তাপমাত্রা ৩.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বিদ্যমান জীববৈচিত্র্যের ৩০ শতাংশ হারিয়ে যেতে পারে। নানা ধরনের সমস্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উত্তর আমেরিকায়, ইউরোপ থেকে আফ্রিকায়। আফ্রিকা মহাদেশে পানি স্বল্পতার সংকটে পড়বে ২৫ কোটি মানুষ। সেখানে ব্যাপকভাবে কমে যাবে খাদ্য উৎপাদন। অন্যদিকে এশিয়ার বন্যাপ্রবণ এলাকায় তীব্র হবে বন্যার মাত্রা, হিমালয়ের তুষারঢাকা চূড়া ও হিমবাহ থেকে বরফগলা বাড়বে। ফলে যেসব নদী হিমালয়ের বরফগলা পানিতে এখনো বহমান, সেগুলো শীর্ণ হয়ে যাবে। বেড়ে যাবে বরফধস ও ভূমিধস। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়বে আফ্রিকা মহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া।
এসব তো হলো পূর্বাভাস। কিন্তু বর্তমানেই আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ করছি আবহাওয়ার বৈরী আচরণ এবং এর কারণে সৃষ্ট নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ২০০৫ সালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে যুক্তরাষ্ট্রে। এ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয় লাখ লাখ মানুষ। সে বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে 'ঘব িঊৎধ ড়ভ ঠরড়ষবহঃ ডবধঃযবৎ' শিরোনামে। এতে বলা হয়, 'মানবজাতি খুব ঘন ঘন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর শক্তি প্রত্যক্ষ করছে। গত বছর (২০০৪ সাল) ফ্লোরিডায় আঘাত হেনেছিল চারটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এ বছর ক্যাটরিনার রেশ কাটতে না কাটতেই আঘাত হেনেছে রিটা। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে নিউ অরলিন্স ও মিসিসিপি এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে।' ক্যাটরিনায় ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে হারিকেন রিটার ছোবল চলাকালেই ভারত ও বাংলাদেশে নামে প্রবল বর্ষণ। ভারতের মুম্বাই নগরী ও আশপাশের এলাকা সয়লাব হয়ে যায় বৃষ্টির পানিতে। বর্ষণজনিত বন্যায় প্রাণ হারায় সহস্রাধিক মানুষ। বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সেবা খাত অচল হয়ে পড়ে। সে বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের চট্টগ্রামে যে ভারী বর্ষণ হয় তাকে রেকর্ড হিসেবে উল্লেখ করে আবহাওয়া বিভাগ। এ বৃষ্টির প্রভাবে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি ছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুনামি আঘাত হেনেছিল ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাসহ ১১টি দেশে। ভারত মহাসাগরের তলদেশে সৃষ্ট ভূমিকম্পের প্রভাবে ১০০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস প্রবল বেগে আছড়ে পড়েছিল উপকূলভাগে। এতে প্রাণহানি ঘটেছিল ২ লাখ ৩০ হাজার লোকের। শুধু ইন্দোনেশিয়ায়ই মারা গিয়েছিল দেড় লাখের বেশি মানুষ। ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে ১৬ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি লোক আশ্রয় হারিয়েছিল। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে পরপর দু'বছর ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে ৯ ঘণ্টার প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় (সুপার সাইক্লোন) এবং ২০ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ১৫ লাখ ঘরবাড়ি। ভেসে গিয়েছিল ১০ লাখ গবাদিপশু। এরপর ১৯৯৮ সালে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা। ২০০৪ সালে দেখা দেয় আরেকটি মাঝারি বন্যা। তাতে দেশের ৩৮টি জেলা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানি ঘটে ৬৩৮ জনের। ওই বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই সে বছরের মধ্য সেপ্টেম্বরের টানা বর্ষণ কয়েক দশকের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। ২০০৭ সালে একটি বিলম্বিত বন্যার পরপরই আঘাত হানে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় 'সিডর'। ওই বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী সিডরে প্রাণহানি ঘটে তিন হাজার ২৬৮ জনের। জাতিসংঘের হিসাব মতে, সিডরে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা দুই লাখ। বনবিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী ওই ঘূর্ণিঝড়ে শুধু সুন্দরবনের ক্ষতির পরিমাণ ১৪৫ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ এক হাজার ১৫ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় 'আইলা'র আঘাতে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ সময় জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ৫৫ শতাংশ চিংড়িঘের ও আট হাজার মৎস্য খামার, যাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২২০ কোটি টাকা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্র উপরিতলের স্ফীতি ঘটবে বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার। ২১০০ সাল নাগাদ তা আরো বেড়ে দাঁড়াবে ৮৮ সেন্টিমিটার। এর ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো উপকূলীয় বাঁধের ভেতরে দেখা দেবে লবণ পানির জলাবদ্ধতা (আরভিসি, ২০০৩ এবং সিইজিআইএস, ২০০৬)।
এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে স্থানীয় সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে ১৪৪ সেন্টিমিটার। তাতে দেশের ১৬ শতাংশ জমি তলিয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১৩ শতাংশ মানুষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফসিহউদ্দিন মাহতাবের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে সমুদ্র উপরিতল স্ফীতির সম্ভাব্য পরিমাণ ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১.৫ মিটার। তার মতে, বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৩.৭৪ শতাংশ আবাদি জমি, ২৮.২৯ শতাংশ বনভূমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে বাস্তুহারা হবে এক কোটি মানুষ।
গবেষকদের আশঙ্কা, সমুদ্র উপরিতল স্ফীত হলে দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল আরো বেশিমাত্রায় প্লাবিত হবে। বর্ষা মৌসুমে বাড়বে বৃষ্টিপাত। বাড়বে নদীর পানির উচ্চতা। এতে বন্যার প্রকোপ বাড়বে। অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে প্রধান প্রধান নদীর প্রবাহ কমে যাবে। উত্তরাঞ্চলে দেখা দেবে মরুকরণ। সামুদ্রিক লোনা পানি দেশের আরো অভ্যন্তরে প্রবেশ করে লবণাক্ততা বাড়াবে। ফলে বিপর্যস্ত হবে কৃষি। প্রভাব পড়বে মৎস্যসম্পদের ওপরও। নষ্ট হবে জীববৈচিত্র্য। ঘন ঘন সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মানুষের প্রাণহানিসহ ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। এসবের আলামত এরই মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে 'জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব : মরে যাচ্ছে প্যারাবনের কেওড়া-বাইনগাছ' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর তীরে উপকূলীয় বন বিভাগের গড়া প্যারাবনের লাখ লাখ কেওড়া ও বাইনগাছ মরে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সাগর ও নদীর পানি এবং মাটিতে লবণাক্ততা, একই সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ায় গাছপালার মৃত্যু ঘটছে। এতে বনাঞ্চলের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।'
বছর বছর বন্যা-জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও বাংলাদেশের দক্ষিণে বিশ্বের সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের আয়তন কমে যাচ্ছে। কমছে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা। ১০০ বছর আগেও সুন্দরবনের আয়তন ছিল ১০ হাজার ৬০০ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৫ সালের জরিপে দেখা যায় এর আয়তন দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৭৩ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে তা ৪ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও নিচে নেমে এসেছে। সুন্দরী গাছের সংখ্যা কমে গেছে অর্ধেকের বেশি।
এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের সুন্দরবন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির টার্টমাউথ ক্যাম্পাস এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এ সমীক্ষায় জানা যায়, সুন্দরবনের নদী, খাঁড়ি ও মোহনার জলের তাপমাত্রা প্রতি দশকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ছে। সুন্দরবনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়নের গড় হারের আট গুণ বেশি। সুন্দরবনে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব কতটা তা যাচাই করতে গবেষকরা জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা, অম্ল-ক্ষারের আনুপাতিক মাত্রা, জলের মান ও স্বচ্ছতা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষায় তারা দেখতে পেয়েছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে জলজ প্রাণী।
==========================
প্রকৃতি- 'বাঘ রক্ষার বিশ্বসভা রাশিয়ায়' by ইফতেখার মাহমুদ  শিল্প-অর্থনীতি 'অবকাঠামোর উন্নয়নে পেছনের সারিতে বাংলাদেশ' by হানিফ মাহমুদ  প্রবন্ধ- 'সাবধান থেকো তাদের থেকে...' by বদিউল আলম মজুমদার  আলোচনা- 'ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-অপুষ্টি ও নির্যাতনের শৃঙ্খলে বন্দি শিশুরা' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- 'এমন ঘটনাও ঘটে'! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী  আলোচনা- 'হাইকোর্টের রায় এবং আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে' by শক্তিপদ ত্রিপুরা  আলোচনা- 'আইন'-এর শাসন বনাম 'অহং'-এর শাসন' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  খবর- কজাহাজভাঙা শিল্পে সংকটমোচন  আলোচনা- 'বাংলাদেশের সংবিধানের দর্শনের গল্পসল্প' by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ও পঙ্কিল রাজনীতি  রাজনৈতিক আলোচনা- 'মুক্ত বাতাসে সু চি' by রফিকুল রঞ্জু  বিশ্ব অর্থনীতি 'জি-২০ সম্মেলনে ধাক্কা খেল আমেরিকা'  ভ্রমণ- 'রেলগাড়িতে চড়ে' by মঈনুস সুলতান  'উৎসবের আমেজ সময়ের সংস্কৃতির' by শামসুজ্জামান খান


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্য
লেখকঃ আজাদুর রহমান চন্দন


এই নিবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.