শেখ হাসিনার পর কে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এখন বিশ্ব পরিচিত নেতা এবং শুধু হাসিনা নামেই
সবাই তাঁকে চিনে ফেলে, এটা বিদেশে বাস করি বলে স্পষ্ট বুঝতে পারি। তা ছাড়া
তাঁর খ্যাতির পরিধিটাও বড়। লন্ডন শহর এখন টোরি দলের নতুন নেতা এবং টেরেসা
মের স্থলাভিষিক্ত নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে বিতর্কে মুখর। দৌড়ে
বরিস জনসন এগিয়ে আছেন। দেখতে, শুনতে এবং কেশবিন্যাসেও তিনি অনেকটা ডোনাল্ড
ট্রাম্পের মতো।
ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। এবার লন্ডন সফরে এসে প্রকাশ্যেই বলেছেন, বরিস ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি খুশি হন। ট্রাম্পের ভাবসাব, কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সম্ভবত ব্রিটেনকে এখন আমেরিকার উপনিবেশ মনে করেন। সেভাবেই ব্রিটেনকে উপদেশের আড়ালে নানা নির্দেশ দেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়লে তিনি ব্রিটেনকে ব্যবসা-বাণিজ্যে আঁচল ভরিয়ে দেবেন, বরিসকে যেন প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) যেন তাঁর হাতে (আমেরিকার) তুলে দেওয়া হয়। এই সার্ভিস তাঁর হাতে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটেনেও এখন বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল। তাই ইরাক যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র লন্ডন সফরে এলে বিশাল জনবিক্ষোভের মুখে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়ে লন্ডনের রাস্তায় নামতে পারেননি। এবার বুশের চেয়েও নিন্দিত ও বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্প লন্ডনে এলে রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁকে বুশের মতো গৃহবন্দি করে রাখা যায়নি, তাঁর লম্ফঝম্ফও বন্ধ করা যায়নি।
ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আসি। বলছিলাম ছোট ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বের বিশাল পরিধিতে তাঁর পরিচিত ও আলোচিত হওয়ার কথা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে এক লেবার দলীয় তরুণ এমপির সঙ্গে খেতে গেছি। উদ্দেশ্য ছিল টোরি দলের নতুন নেতা নির্বাচন সম্পর্কে উত্তপ্ত ঘরোয়া বিতর্ক উপভোগ করা এবং পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে আজকাল ডাল-ভাত খাদ্য তালিকায় আসায় তার স্বাদ নেওয়া।
খেতে বসে বন্ধু এমপি একসময় জিজ্ঞেস করলেন, এবার বরিসই হয়তো টোরি দলের নেতৃত্বে বসবেন, তোমাদের দেশের খবর কী? শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা তো শুধু আওয়ামী লীগে নয়, তোমাদের দেশেও দেখছি না, তাহলে দলের পরবর্তী নেতা কে হবেন, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীই বা কে হবেন? উপমহাদেশে এতকালের পরিবারতন্ত্রও অচল হতে চলেছে। ভারতে রাহুল গান্ধীর পরিণাম দেখলে তো।
বললাম, বাংলাদেশ নিয়ে এসব ভাবনা এখন কেউ ভাবছে না। সামনে আওয়ামী লীগের জন্য আরো পাঁচ বছর পড়ে আছে। শেখ হাসিনা এখনো দলের নেতৃত্বের হাল ধরে আছেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন। দেশের রাজনীতিও এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। আশা করা যায়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনেও মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় চাইবে।
বন্ধু এমপি বললেন, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে কী হবে তুমি তা জানো না। হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন পরবর্তী নির্বাচনে তিনি নেতৃত্ব দেবেন না। ক্ষমতায়ও থাকতে চান না। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার এবং তাঁর দলেরই তো উচিত আওয়ামী লীগের জন্য এখনই একজন যোগ্য ও দক্ষ নেতা খুঁজে বের করা এবং সময় থাকতে তাঁকে জনগণের কাছে পরিচিত করে তোলা। না হলে খালেদাবিহীন বিএনপির যে দশা হয়েছে, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের কি সেই অবস্থা হবে না?
তাঁকে বললাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণার সঙ্গে আমার ধারণার একটা পার্থক্য আছে। অবশ্য আমাদের দুজনের ধারণার মধ্যে কার ধারণা সফল হবে, তা বলতে পারি না। প্রথমে শেখ হাসিনার আগামী নির্বাচনে, যা এখনো পাঁচ বছর দূরে, তাতে নেতৃত্ব না দেওয়ার সম্পর্কে বলি? চার-চারবার দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই ক্লান্তিবোধ করছেন এবং যথার্থভাবেই রাজনীতির সম্মুখ সারি থেকে সরে যেতে চাইছেন। এটা অনেক দেশের জনপ্রিয় নেতাই চান।
কিন্তু জনগণের বিপুলভাবে আস্থাভাজন কোনো নেতা যদি দেখেন, দেশের কল্যাণের স্বার্থেই তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে জনগণ উন্মুখ, তাহলে তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। একবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর জামাল নাসের মিসরের প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু কায়রোর রাজপথে উত্তাল জনগণের দাবিতে তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।
এটা শেখ হাসিনার জীবনেও ঘটেছে। এরশাদের আমলে এক সাধারণ নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দলের নেতাকর্মীরা শুধু নয়, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করার দাবিতে। তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতেও শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব ছেড়ে রাজনীতির পেছনের সারিতে যেতে চাইলে একই অবস্থার উদ্ভব ঘটবে। তা ছাড়া তাঁর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সও হয়নি। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭২ বছর। পাঁচ বছর পরেও তিনি ৮০ বছর বয়সে পৌঁছাবেন না। দ্য গল, চার্চিল, রিগ্যান, মাহাথির প্রমুখ নেতা বয়সের তোয়াক্কা করে ক্ষমতায় থাকেননি। যদি দেশের স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে তাহলে সক্ষমতা থাকা পর্যন্ত হাসিনা কেন ক্ষমতায় থাকবেন না? ইসরায়েলের নেতানিয়াহু এবার নিয়ে কত দফা ক্ষমতায় আছেন?
ব্রিটিশ এমপি বন্ধুকে বললাম, খালেদাবিহীন বিএনপির আজ যে অবস্থা, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের সেই অবস্থা হবে তা মনে করি না। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে এবং নেতৃত্ব ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক। জনগণের মধ্যে এই দলের কোনো শিকড় (root) নেই। এই দলের পরিণতি ঘটতে চলেছে মুসলিম লীগের মতো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্ম গণ-আন্দোলন থেকে। দলে নেতৃত্ব ও নীতির ক্রমবিবর্তন হয়েছে। নেতৃত্বেও বারবার বদল ঘটেছে। দলটির জন্ম মূলত মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। মওলানা ভাসানীর পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। ছয় দফা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বসে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তাঁর মৃত্যুর পর বেগম জোহরা তাজউদ্দীন ও আবদুল মালেক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। লিখতে ভুলে গেছি, বঙ্গবন্ধু যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের ওপর। সর্বশেষ শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং এখনো আছেন। তাঁর নেতৃত্বেই দল আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং এখনো শাসন ক্ষমতায় আছে।
দলের নেতৃত্বের মতো নীতিরও পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছিল একটি মডারেট সাম্প্রদায়িক দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলটি গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল হিসেবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি মডার্ন ও সেক্যুলার ডেমোক্র্যাট পার্টি। প্রতিটি সংকটে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আছে এবং নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় নতুন নেতা তৈরির সক্ষমতা আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর চরম নেতৃত্বহীন অবস্থায় দলটি কি নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে সক্ষমতা দেখায়নি? হাসিনা-নেতৃত্ব কি উঠে আসেনি?
আমার বক্তব্য শেষ করে বন্ধু ব্রিটিশ এমপিকে বলেছি, অবশ্যই বাংলাদেশের গণতন্ত্র চিরকাল এক দল, এক নেতানির্ভর থাকুক তা দেশের মানুষ চায় না। কিন্তু বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত—এরা গণতান্ত্রিক দল নয় এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প দলও নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠা দরকার। আজকের সুধীসমাজ নামক গোষ্ঠীর ছড়ানো বিভ্রান্তি থেকে দেশের মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্ত হলে জনগণের চাহিদা, আন্দোলন ও উদ্যোগ থেকে বিকল্প রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। পচা শামুকে বারবার জনগণের পা কাটবে না।
লন্ডন, ১৭ জুন, সোমবার ২০১৯
ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। এবার লন্ডন সফরে এসে প্রকাশ্যেই বলেছেন, বরিস ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি খুশি হন। ট্রাম্পের ভাবসাব, কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সম্ভবত ব্রিটেনকে এখন আমেরিকার উপনিবেশ মনে করেন। সেভাবেই ব্রিটেনকে উপদেশের আড়ালে নানা নির্দেশ দেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়লে তিনি ব্রিটেনকে ব্যবসা-বাণিজ্যে আঁচল ভরিয়ে দেবেন, বরিসকে যেন প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) যেন তাঁর হাতে (আমেরিকার) তুলে দেওয়া হয়। এই সার্ভিস তাঁর হাতে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটেনেও এখন বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল। তাই ইরাক যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র লন্ডন সফরে এলে বিশাল জনবিক্ষোভের মুখে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়ে লন্ডনের রাস্তায় নামতে পারেননি। এবার বুশের চেয়েও নিন্দিত ও বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্প লন্ডনে এলে রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁকে বুশের মতো গৃহবন্দি করে রাখা যায়নি, তাঁর লম্ফঝম্ফও বন্ধ করা যায়নি।
ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আসি। বলছিলাম ছোট ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বের বিশাল পরিধিতে তাঁর পরিচিত ও আলোচিত হওয়ার কথা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে এক লেবার দলীয় তরুণ এমপির সঙ্গে খেতে গেছি। উদ্দেশ্য ছিল টোরি দলের নতুন নেতা নির্বাচন সম্পর্কে উত্তপ্ত ঘরোয়া বিতর্ক উপভোগ করা এবং পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে আজকাল ডাল-ভাত খাদ্য তালিকায় আসায় তার স্বাদ নেওয়া।
খেতে বসে বন্ধু এমপি একসময় জিজ্ঞেস করলেন, এবার বরিসই হয়তো টোরি দলের নেতৃত্বে বসবেন, তোমাদের দেশের খবর কী? শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা তো শুধু আওয়ামী লীগে নয়, তোমাদের দেশেও দেখছি না, তাহলে দলের পরবর্তী নেতা কে হবেন, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীই বা কে হবেন? উপমহাদেশে এতকালের পরিবারতন্ত্রও অচল হতে চলেছে। ভারতে রাহুল গান্ধীর পরিণাম দেখলে তো।
বললাম, বাংলাদেশ নিয়ে এসব ভাবনা এখন কেউ ভাবছে না। সামনে আওয়ামী লীগের জন্য আরো পাঁচ বছর পড়ে আছে। শেখ হাসিনা এখনো দলের নেতৃত্বের হাল ধরে আছেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন। দেশের রাজনীতিও এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। আশা করা যায়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনেও মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় চাইবে।
বন্ধু এমপি বললেন, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে কী হবে তুমি তা জানো না। হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন পরবর্তী নির্বাচনে তিনি নেতৃত্ব দেবেন না। ক্ষমতায়ও থাকতে চান না। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার এবং তাঁর দলেরই তো উচিত আওয়ামী লীগের জন্য এখনই একজন যোগ্য ও দক্ষ নেতা খুঁজে বের করা এবং সময় থাকতে তাঁকে জনগণের কাছে পরিচিত করে তোলা। না হলে খালেদাবিহীন বিএনপির যে দশা হয়েছে, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের কি সেই অবস্থা হবে না?
তাঁকে বললাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণার সঙ্গে আমার ধারণার একটা পার্থক্য আছে। অবশ্য আমাদের দুজনের ধারণার মধ্যে কার ধারণা সফল হবে, তা বলতে পারি না। প্রথমে শেখ হাসিনার আগামী নির্বাচনে, যা এখনো পাঁচ বছর দূরে, তাতে নেতৃত্ব না দেওয়ার সম্পর্কে বলি? চার-চারবার দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই ক্লান্তিবোধ করছেন এবং যথার্থভাবেই রাজনীতির সম্মুখ সারি থেকে সরে যেতে চাইছেন। এটা অনেক দেশের জনপ্রিয় নেতাই চান।
কিন্তু জনগণের বিপুলভাবে আস্থাভাজন কোনো নেতা যদি দেখেন, দেশের কল্যাণের স্বার্থেই তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে জনগণ উন্মুখ, তাহলে তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। একবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর জামাল নাসের মিসরের প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু কায়রোর রাজপথে উত্তাল জনগণের দাবিতে তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।
এটা শেখ হাসিনার জীবনেও ঘটেছে। এরশাদের আমলে এক সাধারণ নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দলের নেতাকর্মীরা শুধু নয়, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করার দাবিতে। তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতেও শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব ছেড়ে রাজনীতির পেছনের সারিতে যেতে চাইলে একই অবস্থার উদ্ভব ঘটবে। তা ছাড়া তাঁর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সও হয়নি। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭২ বছর। পাঁচ বছর পরেও তিনি ৮০ বছর বয়সে পৌঁছাবেন না। দ্য গল, চার্চিল, রিগ্যান, মাহাথির প্রমুখ নেতা বয়সের তোয়াক্কা করে ক্ষমতায় থাকেননি। যদি দেশের স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে তাহলে সক্ষমতা থাকা পর্যন্ত হাসিনা কেন ক্ষমতায় থাকবেন না? ইসরায়েলের নেতানিয়াহু এবার নিয়ে কত দফা ক্ষমতায় আছেন?
ব্রিটিশ এমপি বন্ধুকে বললাম, খালেদাবিহীন বিএনপির আজ যে অবস্থা, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের সেই অবস্থা হবে তা মনে করি না। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে এবং নেতৃত্ব ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক। জনগণের মধ্যে এই দলের কোনো শিকড় (root) নেই। এই দলের পরিণতি ঘটতে চলেছে মুসলিম লীগের মতো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্ম গণ-আন্দোলন থেকে। দলে নেতৃত্ব ও নীতির ক্রমবিবর্তন হয়েছে। নেতৃত্বেও বারবার বদল ঘটেছে। দলটির জন্ম মূলত মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। মওলানা ভাসানীর পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। ছয় দফা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বসে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তাঁর মৃত্যুর পর বেগম জোহরা তাজউদ্দীন ও আবদুল মালেক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। লিখতে ভুলে গেছি, বঙ্গবন্ধু যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের ওপর। সর্বশেষ শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং এখনো আছেন। তাঁর নেতৃত্বেই দল আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং এখনো শাসন ক্ষমতায় আছে।
দলের নেতৃত্বের মতো নীতিরও পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছিল একটি মডারেট সাম্প্রদায়িক দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলটি গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল হিসেবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি মডার্ন ও সেক্যুলার ডেমোক্র্যাট পার্টি। প্রতিটি সংকটে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আছে এবং নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় নতুন নেতা তৈরির সক্ষমতা আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর চরম নেতৃত্বহীন অবস্থায় দলটি কি নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে সক্ষমতা দেখায়নি? হাসিনা-নেতৃত্ব কি উঠে আসেনি?
আমার বক্তব্য শেষ করে বন্ধু ব্রিটিশ এমপিকে বলেছি, অবশ্যই বাংলাদেশের গণতন্ত্র চিরকাল এক দল, এক নেতানির্ভর থাকুক তা দেশের মানুষ চায় না। কিন্তু বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত—এরা গণতান্ত্রিক দল নয় এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প দলও নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠা দরকার। আজকের সুধীসমাজ নামক গোষ্ঠীর ছড়ানো বিভ্রান্তি থেকে দেশের মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্ত হলে জনগণের চাহিদা, আন্দোলন ও উদ্যোগ থেকে বিকল্প রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। পচা শামুকে বারবার জনগণের পা কাটবে না।
লন্ডন, ১৭ জুন, সোমবার ২০১৯
No comments