রবীন্দ্র-প্রতিভার পরিচয় by হাবিবুর রহমান স্বপন
রবীন্দ্র-কাব্যের
মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের
মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী।
রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর
কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিনী শুধু তাই নয়,
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী। রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিনী শুধু তাই নয়,
রবীন্দ্র-প্রতিভার সামগ্রিক পরিচয় দেয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিশীল মহৎ ব্যক্তি। বাঙালি কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল রূপান্তর বা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। তাঁর কর্মকুশলতা, চিন্তা-চেতনা ও সৃষ্টিশীলতা এই সংস্কৃতিকে দিয়েছে নানা রূপময়তা, রঙ, গন্ধ ও বৈচিত্র্যমুখিতা। সংস্কৃতির এত বড় সংগঠক প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান আধুনিককালেও বাঙালি সমাজে জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান রূপকার। যদিও এই আধুনিককাল চূড়ান্ত নয়। আমাদের বোধ, মেধা ও মনন যাকে আধুনিক বলে জানতে, বুঝতে চাচ্ছে তা কতটুকু আধুনিক ও উৎকৃষ্ট সে সম্পর্কে এ যুগের মানুষ হিসেবে তার বিচারে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান বা প্রজ্ঞার পরিধি পরিমাপ করার সাধ্য আমার মতো অধমের নেই এটা সত্য, এর পরেও এই স্বল্প পরিসরে কিছু নমুনা উপস্থাপনের চেষ্টা করছি বিজ্ঞ পাঠকদের করকমলে। মহান কবি লিখেছেন-
‘হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা!
ওগো তপন, স্বপন দেখি যে, করিতে পারিনে সেবা।’
অন্তরের নিবিড়তম, সত্যতম কথাটি এমন সহজ সুরে কে গাইতে পারে? মানুষের ব্যক্ত-অব্যক্ত, জানা-অজানা, বোঝা-না-বোঝা, চেতন-অবচেতন সব লোকেরই কথা কবি বুঝেছেন এবং তা ব্যক্ত করেছেন। মানুষের মনের বিচিত্র আনন্দ-বেদনা, তৃপ্তি-অতৃপ্তি, পাওয়া-না-পাওয়ার কথা ফুট ওঠে তাঁর প্রতিটি ছন্দে। সর্বমানবের মনের মর্মকথার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্র-প্রতিভা সূর্যেরই মতো বিরাট বিস্ময়কর ব্যাপার। অফুরন্ত বিচিত্র বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির যেমন পরিমাপ করা যায় না এবং সমগ্রভাবে তা ধরাও যায় না, রবীন্দ্র-প্রতিভা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করাও আমাদের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। এত বড় বিরাট প্রতিভার সামনে দাঁড়াবে কে? তা ছাড়া আর একটা কথাও অন্তরের মধ্যে বিশেষভাবে নাড়া দেয় যে, যে অতিমানবীয় প্রতিভা বা ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথ অধিকার করেছেন সে প্রতিভা বা ক্ষমতা না-কি তাঁর নয়! এ কথা কবি বহুবার বলেছেন যে, কোনো এক অদৃষ্ট শক্তি বা প্রেরণা তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন তিনি তাই করেছেন। কবি বলেছেন-
অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সঙ্গীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
কবি কত কিছু বলেছেন সে তো কবির নিজের কথা নয়, সে তাঁর অন্তরের আদেশ; তাই একে বুঝতে চাওয়া সহজ নয়।
তবুও দুর্নিবার আগ্রহ, অসীম সাহস মানুষের, জানবার। দুঃসাধ্য সাধন করতে চায় মানুষ, দুর্লঙ্ঘকে লঙ্ঘন করতে সাহসী হয় মানুষ, অপ্রাপ্যকে করায়ত্ত করতে চায়- সেও তো মানুষ। অজানাকে জানতে হবে, অপ্রাপ্যকে পেতে হবে, মানুষকে পেতে হবে অমিত, দিতে হবে অমিত, তাকে হতে হবে অমিত মানব। এই সাধনা সহজ নয়, দুঃখের দুর্গম পথেই এর জয়যাত্রা। মানুষ সুখের কাঙাল নয়, দুঃখভীরু নয়, তাই সে এই পথই বেছে নিয়েছে।
রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি দিকের আস্বাদন করতে হলে এই সাধনা ও একান্ত তন্ময়তার প্রয়োজন। একাগ্র ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, ধ্যান-ধারণায় মানুষের অন্তরেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ আর আবিলতামুক্ত হয়। তখন যা অজ্ঞেয় রহস্যময়তায় সমাচ্ছন্ন তাকে জানা যায়, বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। এই সাধনার বেদনা যে বহন করতে পারে চির-আকাক্সিক্ষত প্রিয় বস্তুটি তার কাছে এসে আপনি ধরা দেয়। যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাকেই সত্যরূপে জানতে পারা যায়।
তাই রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি দিকের সমগ্র পরিচয় পাওয়া অসম্ভব হলেও এ কাজে কোনো কোনো দুঃসাহসী অগ্রসর হয়েছেন। তার কারণ ভালোবাসার মধ্যে ঐশ্বর্য-ভয়-ভীতি তো কিছু নেই, সেখানে শুধু অনাবিল মাধুর্য আর চির-পরিচয়ের স্বচ্ছ-আনন্দ। এই দাবিতে আমরাও কবিকে দেখব, জানব, বুঝব, নিবিড় করে কাছে পাব।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার কবি, রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের কবি, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সকল দেশের ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বহুমুখী অলোকসামান্য প্রতিভা সকল দেশ ও কালের গণ্ডিকে অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে গিয়েছে- সে গৌরব কেবলমাত্র ভারতবর্ষের নয়, সারা বিশ্বেরও। তাঁর বাণী ছিল বিশ্বজনীন, তাঁর প্রেম ছিল সর্বব্যাপী, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল সুগভীর। অনন্তকে আস্বাদন করবার জন্য মানুষের যে আর্তি, তাই ব্যক্ত হয়েছিল তাঁর ভাবধারার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশে রবীন্দ্র-প্রতিভার অভ্যুদয় পরম বিস্ময়কর এবং আকস্মিক ব্যাপার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ঠিকই, কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। তার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলার তথা ভারতবর্ষেরই কবি, ভারতীয় ভাবসাধনার আদর্শেই তাঁর কবিমানস অনুপ্রণিত ও পরিপুষ্ট।
রবীন্দ্র-সাহিত্য একটি বহু রূপময় বিচিত্র শিল্পসম্ভার; তাতে নব নব রেখা ও বর্ণবিন্যাসের অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার, গল্পরচয়িতা, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সমালোচক, চিত্রকর, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক একাধারে সবই, কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি কবি।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভা শতমুখী। তিনি নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করে নতুন রূপসৃষ্টির আনন্দে চিরচঞ্চল ছিলেন। কবি নিত্য নতুন ভাব চিন্তা আবেগ কল্পনা ভাষা ছন্দ অলঙ্কার করেছেন এবং তার প্রকাশভঙ্গিমায় কবিমানসের সে একটি অভিনব রূপ তিনি প্রকাশ করেছেন তা জগতের কাছে পরম বিস্ময়ের বস্তু।
রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা যেমন ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যের সন্ধান পাই, যেমন মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিদের রসমাধুর্যের আস্বাদ পাই, বাউলদের মনের মানুষের সন্ধান পাই, তেমনি পাই প্রতীচ্য সাহিত্যের তীব্র আবেগ, তার বাধাহীনতা, দেশকালনিরপেক্ষ মানবিকতা। বিশ্ব-প্রাণের বিচিত্র তরঙ্গমালা রবীন্দ্রনাথের ভাব ও কল্পনাকে আলোড়িত করেছে। এই আলোড়নের অভিব্যক্তি ঘটেছে নানা রূপে, রসে, ছন্দে ও মাধুর্যে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে বিশেষ কোনো দেশের, বিশেষ কোনো কালের বা বিশেষ কোনো জাতির নির্দিষ্ট কোনো ছাপ পড়েনি। সব দেশ কাল জাতি, সব বন্ধনমুক্ত, সর্বজনীন ভাব, কল্পনা ও আদর্শের ওপর তাঁর সাহিত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই তাঁর কাব্য যুগের হয়েও যুগাতীত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারাজীবনের সাধনার ধন কাব্য তথা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দেখেছেন যে, শান্তিময় বিশ্বপ্রেমই মানুষের জীবনের কাম্য বস্তু; বিশ্বজনীন ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ধরা দিয়ে তবে তার বিশেষ অভিব্যক্তি লাভ করে, আবার ব্যক্তিজীবন বিশ্বজীবনের মধ্যে লীলায়িত হয়ে তবেই তার সার্থকতা প্রাপ্ত হয়। এমনি করে সীমায় অসীমে, খণ্ডে পূর্ণে, ব্যক্তিজীবনে ও বিশ্বজীবনে একটি চিরন্তন লীলা চলছে। এই লীলাই সৃষ্টির আনন্দ ও সৌন্দর্য। এই আনন্দ ও সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথ আকণ্ঠ পান করেছেন এবং তাঁর কাব্যে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী। রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিণী শুধু তাই নয়, যেন তাঁর অন্তর-সত্তার চিরসঙ্গিনী। এই সঙ্গিনীর সঙ্গে কবি নিগূঢ়-আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। প্রকৃতির তুচ্ছতম বস্তুটির সঙ্গে পর্যন্ত কবি আদিজন্মের নাড়ির টান অনুভব করছেন। তাই তাঁর কাছে-
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
এই পৃথিবীর জল-স্থল, আকাশ-বাতাস, পশু-পাখি, সমস্ত রূপ-রস-স্পর্শ কবির চিত্তবীণায় নব নব রাগ-রাগিনীর সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব কিছুর সঙ্গে কবি স্বীয় প্রাণচেতনার স্পন্দন অনুভব করেছেন। তাই তিনি বিশ্বাস করেছেন যে, আদি প্রাণের যে প্রবল জীবনোচ্ছ্বাস পৃথিবীর প্রত্যেক গাছে, শিকড়ে শিকড়ে, শিরায় শিরায়, তৃণের প্রত্যেকটি রোমে রোমে প্রবাহিত হচ্ছে, সেই প্রাণধারা প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই সঞ্চারিত এবং কম্পিত হচ্ছে। তাই এত বড় বিশাল পৃথিবীকে আমাদের অনাত্মীয় বা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে না। কবি বলেছেন-
“প্রকৃতির মধ্যে যে এমন গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা নিগূঢ় আত্মীয়তা অনুভব করে। এই তৃণগুল্মতা, জলধারা, বায়ুপ্রবাহ, এই ছায়ালোকের আবর্তন, জ্যেতিষ্কদলের প্রবাহ, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীপর্যায়- এই সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ি-ছন্দের যেখানেই যতি পড়েছে সেখানেই ঝঙ্কার উঠছে, সেখানেই আমাদের মনের ভিতর থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে।’
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কবি, রবীন্দ্রনাথ আনন্দের কবি। অতুলনীয় মানবমুখিতা কবির কাব্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই পৃথিবীর কবি। তিনি মানুষকে, ধরণীকে ভালোবাসেন। রবীন্দ্র-কাব্যে মানবের অবিনশ্বর অনুভূতির প্রকাশ অতি ব্যাপকভাবেই রয়েছে। কবি বারবার কলেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
‘আত্ম-পরিচয়’-এ কবি বলেছেন, “প্রকৃতি তাহার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ লইয়া, মানুষ তাহার স্নেহ-প্রেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না, সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না।”
অবজ্ঞা করিনি তোমার মাটির দান
আমি যে মাটির কাছে ঋণী
জানিয়েছি বারম্বার-
কবি শুধু ঋণ স্বীকারই করেননি, তিনি মানুষকে চরম শ্রদ্ধাও দেখিয়েছেন-
তব প্রয়োজন হতে যে অতিরিক্ত মানুষ-
তারে দিতে হবে চরম সম্মান তব
শেষ নমস্কারে।
মানুষকে কবি কোনোদিনই ছোট পরিধির মধ্যে ছোট করে ভাবতে পারেননি। মহামানবের আবির্ভাব তিনি ক্ষণে ক্ষণে দেখেছেন। মানুষের ক্ষণিক অংশের মধ্যে চিরন্তনের অভিব্যক্তি তাঁকে বারে বারেই বিস্মিত পুলকে অবিভূত করেছে। মানুষের স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি প্রভৃতি সুকোমল চিত্তবৃত্তির ভিতর দিয়ে তিনি চির রসময়ের রসের পরিচয় পেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রকাব্য মানুষের জয়গানে মুখরিত। সে মানুষ ব্যক্তিগত পরিধি, দেশ কাল অতিক্রম করে মহামানবে পর্যবসিত। উপনিষদের বাণীঘন মূর্তি রবীন্দ্রনাথ মানুষকে অনন্তের সন্তান রূপেই দেখেছেন, তাই তিনি উপনিষদের বাণীতে বলেছেন, মানুষ মানুষ নয়, মানুষ ব্রহ্ম।
কবির ভগবৎ-উপলব্ধিও মানববিমুখতা নয়। সংসারের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর স্পর্শ লাভ করতে চেয়েছেন। ‘সংসারে বঞ্চিত করি তব পূজা নয়’ অথবা ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি আমার নয়’ -এই উক্তির মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায় যে, সংসারকে বাদ দিয়ে কবিসংসারাতীতের সন্ধান করেননি। পরন্তু এই জগতের খণ্ড স্নেহ প্রেম প্রীতির মধ্য দিয়েই তিনি পরম প্রিয়তমের স্পর্শ পেতে চেয়েছেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির বিচিত্র রূপকে তিনি আনন্দময়ের অমৃত রূপ বলেই অনুভব করেছেন। সর্বত্রই তাঁর লীলাবিলাস বিকম্পিত- এই উপলব্ধিই রবীন্দ্র-কাব্যের বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথ সাধক, তবে সে সাধনা বৈরাগ্য-সাধনে নয়, শিল্পসাধনে, রূপ সাধনে, ভাব সাধনে। নানা রূপের ক্ষুধা, রসের ক্ষুধা তাঁর ভাবকল্পনাকে উদ্বোধিত করেছে। বিশ্বের যেখানে যা কিছু আছে- অণু-পরমাণু পর্যন্ত, তাঁর কাছে রূপ রসে সৌন্দর্যে মাধুর্যে প্রতিভাত হয়েছে। সৌন্দর্যানুভূতিকে কবি একটি বিশেষ সত্তা রূপে দেখেছেন। সেই আদি অখণ্ড সত্তা অন্তরে বাইরে বিরাজিত। বাইরে যিনি বহুবিচিত্র, অন্তরে তিনি একা, অখণ্ড, স্থির-গম্ভীর। এই সৌন্দর্য-রূপিণী নারীকে তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে তাঁর কাব্যে প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য কল্পনার মধ্যেও সেই একই সুর ধ্বনিত, যে সুর নদী-গিরির ওপার থেকে ভেসে আসছে। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন, বিশ্ব প্রকৃতিতে, মানবপ্রকৃতিতে যে সৌন্দর্য উদ্ভাসিত তা সেই চিরসুন্দরেরই অঙ্গদ্যুতি। বিশ্ব-ভ্রহ্মাণ্ড সেই আদি রূপের ঝরনাধারায় অভিস্নাত। সমস্ত খণ্ড সৌন্দর্যের মধ্যে কবি অলৌকিক ও অখণ্ড সৌন্দর্য দেখেছেন। তাই কবির কাছে কিছুই তুচ্ছ নয়, কিছুই অসুন্দর নয়। অসুন্দর যদি কিছু থাকে তবে তা সুন্দরের খণ্ডিত প্রকাশ মাত্র। পরিপূর্ণতার কবি সব কিছুকেই সমগ্রভাবে দেখেছেন। তাই কোথাও কিছু অসুন্দর তাঁর চোখে পড়েনি, পড়লেও তার সামঞ্জস্য করিয়ে নিয়ে তবে স্বস্তি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনসাধনা, কাব্যসাধনার বিরাট সৌধ এই সৌন্দর্যানুভূতির শ্বেত প্রস্তরের উপরেই ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর সমস্ত অনুভূতিই সুন্দরের অনুভূতিতে রঞ্জিত।
কবির প্রেমানুভূতির মধ্যেও আছে এই সূক্ষ্ম মহিমাবোধ। তাই তাঁর প্রেমসাধনা একান্ত ভোগবাসনায় পর্যবসিত না হয়ে একটি বিশেষ আনন্দবোধে উপভোগ্য হয়েছে।
সৌন্দর্যানুভূতির সঙ্গে যে একটি ভোগতৃষ্ণা জেগে থাকে তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ভোগ সৌন্দর্র্যলাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে না যদি তার মধ্যে সংযত না থাকে। সেই কথাই কবি বলেছেন- “প্রবৃত্তিকে যদি একেবারে পুরামাত্রায় জ্বলিয়া উঠিতে দিই, তবে যে সৌন্দর্যকে কেবল রাঙাইয়া তুলিবার জন্য তাহার প্রয়োজন, তাহাকে জ্বালাইয়া ছাই করিয়া তবে সে ছাড়ে, ফুলকে তুলিতে গিয়া তাহাকে ছিঁড়িয়া ধুলায় লুটাইয়া দেয়। সৌন্দর্য আমাদের প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া আনিয়াছে।…সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে ক্রমে শোভনতার দিকে, সংযমের দিকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে, সংযমও তেমনি আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতা বাড়াইয়া দিতেছে।” তাই আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রেমসাধনা দেহকে অস্বীকার করেনি, আত্মা যেমন সত্য দেহও তেমনি, দেহ-আত্মার যে প্রেম তাই পূর্ণ প্রেম। ভোগ-বাসনা কবির কাব্যে যথেষ্ট আছে, কিন্তু সে ভোগ একান্তভাবে দেহের সীমাতেই আবদ্ধ নয়, দেহকে আশ্রয় করে সে প্রেম দেহাতীত এক অপার্থিব সৌন্দর্যলোকে তার নিত্য আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ও প্রেমানুভূতির এই যে বৈশিষ্ট্য, একে তিনি প্রকাশ করেছেন এইভাবে- “জীবের মধ্যে অখণ্ডকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা, প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্যসম্ভোগ।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার রহস্যও এইরকম একটি ভাবানুভূতি বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সুগভীর অধ্যাত্মবোধের মূলেও আছে এই ভাবানুভূতি। যে অদ্বিতীয় অর্ধপরিচিত দেবতার স্পর্শ তিনি বারংবার হৃয়ের মধ্যে অনুভব করেছেন, যার নিত্যনতুন লীলায় তাঁর কাব্যজীবন নব নব আনন্দরসে সিঞ্চিত পুষ্পিত হয়ে উঠেছে, সেই চিরবাঞ্ছিত হৃদয়দেবতাকেও তিনি লাভ করেছেন তাঁর নিবিড় অনুভূতির মধ্যে নানা রূপে। কখনো সখা রূপে, কখনো দেবতা রূপে, কখনো মানসসুন্দরী রূপে অদৃশ্য এই সত্তার স্পর্শ তিনি জীবনের ঊষালোক থেকেই পেয়ে এসেছেন। এই প্রণয়িনীর স্পর্শে কবি কখনো বেদনায় ব্যাকুল হয়েছেন, কখনো আনন্দে অধীর হয়েছেন। কখনো মিলনে, কখনো বিরহে এই মধুর স্পর্শটি ক্রমশই রসনিবিড় হয়ে উঠেছে। সুখে দুঃখে বিপদে সম্পদে জীবনের সকল অবস্থায় কবি এই জীবন-দেবতার স্পর্শ লাভ করেছেন। নিদারুণ দুঃখেও তিনি দুঃখরাতের রাজাকে অভ্যর্থনা করে নিয়েছেন। এইভাবে সীমা-অসীমের, পূর্ণ-অপূর্ণের, খণ্ড-অখণ্ডের লীলা-অভিসার চলেছে রবীন্দ্র-কাব্যে।
রবীন্দ্রনাথ সত্য-শিব-সুন্দরের একনিষ্ঠ পূজারি। কঠোর দুঃখ, নির্মম কষাঘাতের মধ্য দিয়ে যে শান্তি লাভ করা যায়, সত্য লাভ করা যায় তাই তাঁর কাম্য। তাই অত্যন্ত সহজেই তিনি বলতে পেরেছেন-
‘মনেরে আজ কহ যে,
ভালমন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’
সত্যসন্ধানী কবি আরো বলেছেন-
আরাম হতে ছিন্ন করে
সেই গভীরে লও গো মোরে
অশান্তির অন্তরে যেথায়
শান্তি সুমহান।
এইজন্য তাঁর কাব্যে রুদ্র ও শিব সমান পূজা লাভ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনে মৃত্যু একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মৃত্যুর এত মহিমাময় ঐশ্বর্যময় মাধুর্যময় কল্পনা অন্য কোনো কবির কাব্যে আছে কিনা সন্দেহ। জীবনের সোনালি ঊষাতেই কবি অনুরাগকম্পিত কণ্ঠে বলেছেন- ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সম।’
মৃত্যু-বরের জন্য জীবন-বধূ উৎসুক হয়ে সর্বক্ষণ প্রতীক্ষা করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ জীবনের অনন্ত-অনাদি প্রবাহবোধ স্বীকার করেছেন। জীবন-মরণ তো শুধু ইহলোকের বিষয় নয়। তা লোক-লোকান্তরের একটি সংলগ্ন ঘটনা- এ বিশ্বাস তাঁর দৃঢ় ছিল। তাই তিনি জীবন ও মরণকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারেননি।
বিশ্ববোধ আর সর্বানুভূতি রবীন্দ্র-সাহিত্যের একটি মূল সুর। এই বোধের উদ্ভব হয়েছে তাঁর অতীন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে। এই অধ্যাত্ম-অনুভূতিই সমগ্র রবীন্দ্র-জীবন ও সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভারতের অধ্যাত্ম-সাধনায় যে ভূমার আদর্শ ‘ঈশাবাস্যং ঈদং সর্বং কিষ্ণ জগত্যাং জগৎ’- ঈশ্বরের দ্বারা নিখিল জগৎ পরিব্যাপ্ত রয়েছে, সেই সর্বব্যাপিত্বের আদর্শই রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের মূল কথা। তিনি রসো বই সঃ-তিনি রসস্বরূপ, আনন্দানুভূতির তিনিই পরম প্রকাশ। আমাদের কবি এই সর্বানুভূতির কথা, এই আনন্দের কথা অক্লান্ত সুরে নানা ছন্দে রূপে রসে বর্ণে বৈচিত্র্যে প্রকাশ করেছেন। এই অনুভূতির প্রেরণাতেই তিনি লিখেছেন-
“পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম
কস্তরীমৃগ সম।”
এই প্রেরণাতেই সারা জীবন ধরে তিনি পৃথিবীর নানা পথে প্রান্তরে মরুতে পর্বতে অনন্ত পথ-পরিক্রমায় চলেছিলেন, তিনি চঞ্চলের চিরসহচর ছিলেন। তাঁর কাব্যে চিরদিনই এই আকুতি ধ্বনিত হয়েছে- “আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী।”
রবীন্দ্রনাথে সুবিপুল, সর্বোতমুখী প্রতিভা ও বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কত বিচিত্র দিকে, কত বিচিত্রভাবে যে তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছে, কোনটিকে ছাপিয়ে কোন দিকটি যে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা সমগ্ররূপে ধারণা করাই দুঃসাধ্য। সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মের সমস্ত দিকে কারও প্রতিভা এমন অম্লান দীপ্তিতে প্রতিভাত হয়েছে পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্তে দুর্লভ বলা যায়। রবীন্দ্র-জীবন ও কর্মের সম্যক ও সত্য উপলব্ধি আজো স্বদেশে-বিদেশে কোনো দেশেই হয়েছে কি-না সন্দেহ। কবি নিজেই তাঁর ‘আত্মপরিচয়’-এ বলেছেন- ‘নিজের সত্য পরিচয় পাওয়া সহজ নয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতরকার মূল সূত্রটি ধরা পড়তে চায় না।… নানাখানা করে দেখেছি, নানা কাজে প্রবর্তিত করেছি, ক্ষণে ক্ষণে তাতে আপনার অভিজ্ঞান আপনার কাছে বিক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবনের এই দীর্ঘ চক্রপথ প্রদক্ষিণ করতে করতে বিদায়কালে আজ সেই চক্রকে সমগ্ররূপে দেখতে পেলাম। তখন এটা বুঝতে পেরেছি যে, একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই।’
পরিপূর্ণতার প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক টান আছে, তাই আমরা আমাদের প্রিয়তম কবিকে পরিপূর্ণ রূপেই পেতে চাই। বিশ্বের অমৃত ছবির পরিপূর্ণ সার্থক প্রকাশ রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাব্যের মধ্য দিয়ে আমরা পরিপূর্ণতার স্বাদ পাই।
বিশ্বচিত্তের দূত রবীন্দ্রনাথ, তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর কাব্যে, তাই তিনি সবার উপরে কবি, তাহার উপরে নাই।
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী। রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিনী শুধু তাই নয়,
রবীন্দ্র-প্রতিভার সামগ্রিক পরিচয় দেয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সৃষ্টিশীল মহৎ ব্যক্তি। বাঙালি কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির বিশাল রূপান্তর বা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন। তাঁর কর্মকুশলতা, চিন্তা-চেতনা ও সৃষ্টিশীলতা এই সংস্কৃতিকে দিয়েছে নানা রূপময়তা, রঙ, গন্ধ ও বৈচিত্র্যমুখিতা। সংস্কৃতির এত বড় সংগঠক প্রাচীন, মধ্য ও বর্তমান আধুনিককালেও বাঙালি সমাজে জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি আমাদের আধুনিক সংস্কৃতির প্রধান রূপকার। যদিও এই আধুনিককাল চূড়ান্ত নয়। আমাদের বোধ, মেধা ও মনন যাকে আধুনিক বলে জানতে, বুঝতে চাচ্ছে তা কতটুকু আধুনিক ও উৎকৃষ্ট সে সম্পর্কে এ যুগের মানুষ হিসেবে তার বিচারে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান বা প্রজ্ঞার পরিধি পরিমাপ করার সাধ্য আমার মতো অধমের নেই এটা সত্য, এর পরেও এই স্বল্প পরিসরে কিছু নমুনা উপস্থাপনের চেষ্টা করছি বিজ্ঞ পাঠকদের করকমলে। মহান কবি লিখেছেন-
‘হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কে বা!
ওগো তপন, স্বপন দেখি যে, করিতে পারিনে সেবা।’
অন্তরের নিবিড়তম, সত্যতম কথাটি এমন সহজ সুরে কে গাইতে পারে? মানুষের ব্যক্ত-অব্যক্ত, জানা-অজানা, বোঝা-না-বোঝা, চেতন-অবচেতন সব লোকেরই কথা কবি বুঝেছেন এবং তা ব্যক্ত করেছেন। মানুষের মনের বিচিত্র আনন্দ-বেদনা, তৃপ্তি-অতৃপ্তি, পাওয়া-না-পাওয়ার কথা ফুট ওঠে তাঁর প্রতিটি ছন্দে। সর্বমানবের মনের মর্মকথার মূর্ত প্রতীক রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্র-প্রতিভা সূর্যেরই মতো বিরাট বিস্ময়কর ব্যাপার। অফুরন্ত বিচিত্র বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির যেমন পরিমাপ করা যায় না এবং সমগ্রভাবে তা ধরাও যায় না, রবীন্দ্র-প্রতিভা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করাও আমাদের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। এত বড় বিরাট প্রতিভার সামনে দাঁড়াবে কে? তা ছাড়া আর একটা কথাও অন্তরের মধ্যে বিশেষভাবে নাড়া দেয় যে, যে অতিমানবীয় প্রতিভা বা ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথ অধিকার করেছেন সে প্রতিভা বা ক্ষমতা না-কি তাঁর নয়! এ কথা কবি বহুবার বলেছেন যে, কোনো এক অদৃষ্ট শক্তি বা প্রেরণা তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন তিনি তাই করেছেন। কবি বলেছেন-
অন্তর মাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সঙ্গীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
কোথা ভেসে যাই দূরে।
কবি কত কিছু বলেছেন সে তো কবির নিজের কথা নয়, সে তাঁর অন্তরের আদেশ; তাই একে বুঝতে চাওয়া সহজ নয়।
তবুও দুর্নিবার আগ্রহ, অসীম সাহস মানুষের, জানবার। দুঃসাধ্য সাধন করতে চায় মানুষ, দুর্লঙ্ঘকে লঙ্ঘন করতে সাহসী হয় মানুষ, অপ্রাপ্যকে করায়ত্ত করতে চায়- সেও তো মানুষ। অজানাকে জানতে হবে, অপ্রাপ্যকে পেতে হবে, মানুষকে পেতে হবে অমিত, দিতে হবে অমিত, তাকে হতে হবে অমিত মানব। এই সাধনা সহজ নয়, দুঃখের দুর্গম পথেই এর জয়যাত্রা। মানুষ সুখের কাঙাল নয়, দুঃখভীরু নয়, তাই সে এই পথই বেছে নিয়েছে।
রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি দিকের আস্বাদন করতে হলে এই সাধনা ও একান্ত তন্ময়তার প্রয়োজন। একাগ্র ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, ধ্যান-ধারণায় মানুষের অন্তরেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ আর আবিলতামুক্ত হয়। তখন যা অজ্ঞেয় রহস্যময়তায় সমাচ্ছন্ন তাকে জানা যায়, বোঝা যায়, উপলব্ধি করা যায়। এই সাধনার বেদনা যে বহন করতে পারে চির-আকাক্সিক্ষত প্রিয় বস্তুটি তার কাছে এসে আপনি ধরা দেয়। যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাকেই সত্যরূপে জানতে পারা যায়।
তাই রবীন্দ্র-প্রতিভার কোনো একটি দিকের সমগ্র পরিচয় পাওয়া অসম্ভব হলেও এ কাজে কোনো কোনো দুঃসাহসী অগ্রসর হয়েছেন। তার কারণ ভালোবাসার মধ্যে ঐশ্বর্য-ভয়-ভীতি তো কিছু নেই, সেখানে শুধু অনাবিল মাধুর্য আর চির-পরিচয়ের স্বচ্ছ-আনন্দ। এই দাবিতে আমরাও কবিকে দেখব, জানব, বুঝব, নিবিড় করে কাছে পাব।
রবীন্দ্রনাথ বাংলার কবি, রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের কবি, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সকল দেশের ও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম। রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র বহুমুখী অলোকসামান্য প্রতিভা সকল দেশ ও কালের গণ্ডিকে অবলীলাক্রমে অতিক্রম করে গিয়েছে- সে গৌরব কেবলমাত্র ভারতবর্ষের নয়, সারা বিশ্বেরও। তাঁর বাণী ছিল বিশ্বজনীন, তাঁর প্রেম ছিল সর্বব্যাপী, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল সুগভীর। অনন্তকে আস্বাদন করবার জন্য মানুষের যে আর্তি, তাই ব্যক্ত হয়েছিল তাঁর ভাবধারার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশে রবীন্দ্র-প্রতিভার অভ্যুদয় পরম বিস্ময়কর এবং আকস্মিক ব্যাপার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ঠিকই, কিন্তু একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। তার প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলার তথা ভারতবর্ষেরই কবি, ভারতীয় ভাবসাধনার আদর্শেই তাঁর কবিমানস অনুপ্রণিত ও পরিপুষ্ট।
রবীন্দ্র-সাহিত্য একটি বহু রূপময় বিচিত্র শিল্পসম্ভার; তাতে নব নব রেখা ও বর্ণবিন্যাসের অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীতজ্ঞ, নাট্যকার, গল্পরচয়িতা, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, সমালোচক, চিত্রকর, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক একাধারে সবই, কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি কবি।
রবীন্দ্রনাথের কাব্য-প্রতিভা শতমুখী। তিনি নিজের সৃষ্টিকে নিজেই অতিক্রম করে নতুন রূপসৃষ্টির আনন্দে চিরচঞ্চল ছিলেন। কবি নিত্য নতুন ভাব চিন্তা আবেগ কল্পনা ভাষা ছন্দ অলঙ্কার করেছেন এবং তার প্রকাশভঙ্গিমায় কবিমানসের সে একটি অভিনব রূপ তিনি প্রকাশ করেছেন তা জগতের কাছে পরম বিস্ময়ের বস্তু।
রবীন্দ্র-কাব্যে আমরা যেমন ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্যের সন্ধান পাই, যেমন মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিদের রসমাধুর্যের আস্বাদ পাই, বাউলদের মনের মানুষের সন্ধান পাই, তেমনি পাই প্রতীচ্য সাহিত্যের তীব্র আবেগ, তার বাধাহীনতা, দেশকালনিরপেক্ষ মানবিকতা। বিশ্ব-প্রাণের বিচিত্র তরঙ্গমালা রবীন্দ্রনাথের ভাব ও কল্পনাকে আলোড়িত করেছে। এই আলোড়নের অভিব্যক্তি ঘটেছে নানা রূপে, রসে, ছন্দে ও মাধুর্যে। রবীন্দ্র-সাহিত্যে বিশেষ কোনো দেশের, বিশেষ কোনো কালের বা বিশেষ কোনো জাতির নির্দিষ্ট কোনো ছাপ পড়েনি। সব দেশ কাল জাতি, সব বন্ধনমুক্ত, সর্বজনীন ভাব, কল্পনা ও আদর্শের ওপর তাঁর সাহিত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই তাঁর কাব্য যুগের হয়েও যুগাতীত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারাজীবনের সাধনার ধন কাব্য তথা সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দেখেছেন যে, শান্তিময় বিশ্বপ্রেমই মানুষের জীবনের কাম্য বস্তু; বিশ্বজনীন ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ধরা দিয়ে তবে তার বিশেষ অভিব্যক্তি লাভ করে, আবার ব্যক্তিজীবন বিশ্বজীবনের মধ্যে লীলায়িত হয়ে তবেই তার সার্থকতা প্রাপ্ত হয়। এমনি করে সীমায় অসীমে, খণ্ডে পূর্ণে, ব্যক্তিজীবনে ও বিশ্বজীবনে একটি চিরন্তন লীলা চলছে। এই লীলাই সৃষ্টির আনন্দ ও সৌন্দর্য। এই আনন্দ ও সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথ আকণ্ঠ পান করেছেন এবং তাঁর কাব্যে বিচিত্রভাবে প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্র-কাব্যের মূল সুর প্রকৃতির সৌন্দর্যসম্ভোগ, মানবমহিমাবোধ এবং প্রকৃতি ও মানবের মিলনে অতীন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতি। কবির কাছে প্রকৃতি জড় নয়, প্রাণময়ী। রবীন্দ্র-কাব্য পরিক্রমা করলে আমরা দেখতে পাই, এই প্রাণময়ী প্রকৃতি তাঁর কাব্যের উৎস, তাঁর আবেগ-সঞ্চারিণী শুধু তাই নয়, যেন তাঁর অন্তর-সত্তার চিরসঙ্গিনী। এই সঙ্গিনীর সঙ্গে কবি নিগূঢ়-আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। প্রকৃতির তুচ্ছতম বস্তুটির সঙ্গে পর্যন্ত কবি আদিজন্মের নাড়ির টান অনুভব করছেন। তাই তাঁর কাছে-
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়,
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ জগতের ব্যর্থতম প্রাণ।
এই পৃথিবীর জল-স্থল, আকাশ-বাতাস, পশু-পাখি, সমস্ত রূপ-রস-স্পর্শ কবির চিত্তবীণায় নব নব রাগ-রাগিনীর সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের সব কিছুর সঙ্গে কবি স্বীয় প্রাণচেতনার স্পন্দন অনুভব করেছেন। তাই তিনি বিশ্বাস করেছেন যে, আদি প্রাণের যে প্রবল জীবনোচ্ছ্বাস পৃথিবীর প্রত্যেক গাছে, শিকড়ে শিকড়ে, শিরায় শিরায়, তৃণের প্রত্যেকটি রোমে রোমে প্রবাহিত হচ্ছে, সেই প্রাণধারা প্রত্যেকটি জীবের মধ্যেই সঞ্চারিত এবং কম্পিত হচ্ছে। তাই এত বড় বিশাল পৃথিবীকে আমাদের অনাত্মীয় বা অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে না। কবি বলেছেন-
“প্রকৃতির মধ্যে যে এমন গভীর আনন্দ পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা নিগূঢ় আত্মীয়তা অনুভব করে। এই তৃণগুল্মতা, জলধারা, বায়ুপ্রবাহ, এই ছায়ালোকের আবর্তন, জ্যেতিষ্কদলের প্রবাহ, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীপর্যায়- এই সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ি-ছন্দের যেখানেই যতি পড়েছে সেখানেই ঝঙ্কার উঠছে, সেখানেই আমাদের মনের ভিতর থেকে সায় পাওয়া যাচ্ছে।’
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির কবি, রবীন্দ্রনাথ আনন্দের কবি। অতুলনীয় মানবমুখিতা কবির কাব্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। রবীন্দ্রনাথ এই পৃথিবীর কবি। তিনি মানুষকে, ধরণীকে ভালোবাসেন। রবীন্দ্র-কাব্যে মানবের অবিনশ্বর অনুভূতির প্রকাশ অতি ব্যাপকভাবেই রয়েছে। কবি বারবার কলেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
‘আত্ম-পরিচয়’-এ কবি বলেছেন, “প্রকৃতি তাহার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ লইয়া, মানুষ তাহার স্নেহ-প্রেম লইয়া আমাকে মুগ্ধ করিয়াছে। সেই মোহকে আমি অবিশ্বাস করি না, সেই মোহকে আমি নিন্দা করি না।”
অবজ্ঞা করিনি তোমার মাটির দান
আমি যে মাটির কাছে ঋণী
জানিয়েছি বারম্বার-
কবি শুধু ঋণ স্বীকারই করেননি, তিনি মানুষকে চরম শ্রদ্ধাও দেখিয়েছেন-
তব প্রয়োজন হতে যে অতিরিক্ত মানুষ-
তারে দিতে হবে চরম সম্মান তব
শেষ নমস্কারে।
মানুষকে কবি কোনোদিনই ছোট পরিধির মধ্যে ছোট করে ভাবতে পারেননি। মহামানবের আবির্ভাব তিনি ক্ষণে ক্ষণে দেখেছেন। মানুষের ক্ষণিক অংশের মধ্যে চিরন্তনের অভিব্যক্তি তাঁকে বারে বারেই বিস্মিত পুলকে অবিভূত করেছে। মানুষের স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি প্রভৃতি সুকোমল চিত্তবৃত্তির ভিতর দিয়ে তিনি চির রসময়ের রসের পরিচয় পেয়েছেন। তাই রবীন্দ্রকাব্য মানুষের জয়গানে মুখরিত। সে মানুষ ব্যক্তিগত পরিধি, দেশ কাল অতিক্রম করে মহামানবে পর্যবসিত। উপনিষদের বাণীঘন মূর্তি রবীন্দ্রনাথ মানুষকে অনন্তের সন্তান রূপেই দেখেছেন, তাই তিনি উপনিষদের বাণীতে বলেছেন, মানুষ মানুষ নয়, মানুষ ব্রহ্ম।
কবির ভগবৎ-উপলব্ধিও মানববিমুখতা নয়। সংসারের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর স্পর্শ লাভ করতে চেয়েছেন। ‘সংসারে বঞ্চিত করি তব পূজা নয়’ অথবা ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি আমার নয়’ -এই উক্তির মধ্য দিয়েই বুঝতে পারা যায় যে, সংসারকে বাদ দিয়ে কবিসংসারাতীতের সন্ধান করেননি। পরন্তু এই জগতের খণ্ড স্নেহ প্রেম প্রীতির মধ্য দিয়েই তিনি পরম প্রিয়তমের স্পর্শ পেতে চেয়েছেন। বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতির বিচিত্র রূপকে তিনি আনন্দময়ের অমৃত রূপ বলেই অনুভব করেছেন। সর্বত্রই তাঁর লীলাবিলাস বিকম্পিত- এই উপলব্ধিই রবীন্দ্র-কাব্যের বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথ সাধক, তবে সে সাধনা বৈরাগ্য-সাধনে নয়, শিল্পসাধনে, রূপ সাধনে, ভাব সাধনে। নানা রূপের ক্ষুধা, রসের ক্ষুধা তাঁর ভাবকল্পনাকে উদ্বোধিত করেছে। বিশ্বের যেখানে যা কিছু আছে- অণু-পরমাণু পর্যন্ত, তাঁর কাছে রূপ রসে সৌন্দর্যে মাধুর্যে প্রতিভাত হয়েছে। সৌন্দর্যানুভূতিকে কবি একটি বিশেষ সত্তা রূপে দেখেছেন। সেই আদি অখণ্ড সত্তা অন্তরে বাইরে বিরাজিত। বাইরে যিনি বহুবিচিত্র, অন্তরে তিনি একা, অখণ্ড, স্থির-গম্ভীর। এই সৌন্দর্য-রূপিণী নারীকে তিনি বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে তাঁর কাব্যে প্রকাশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য কল্পনার মধ্যেও সেই একই সুর ধ্বনিত, যে সুর নদী-গিরির ওপার থেকে ভেসে আসছে। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন, বিশ্ব প্রকৃতিতে, মানবপ্রকৃতিতে যে সৌন্দর্য উদ্ভাসিত তা সেই চিরসুন্দরেরই অঙ্গদ্যুতি। বিশ্ব-ভ্রহ্মাণ্ড সেই আদি রূপের ঝরনাধারায় অভিস্নাত। সমস্ত খণ্ড সৌন্দর্যের মধ্যে কবি অলৌকিক ও অখণ্ড সৌন্দর্য দেখেছেন। তাই কবির কাছে কিছুই তুচ্ছ নয়, কিছুই অসুন্দর নয়। অসুন্দর যদি কিছু থাকে তবে তা সুন্দরের খণ্ডিত প্রকাশ মাত্র। পরিপূর্ণতার কবি সব কিছুকেই সমগ্রভাবে দেখেছেন। তাই কোথাও কিছু অসুন্দর তাঁর চোখে পড়েনি, পড়লেও তার সামঞ্জস্য করিয়ে নিয়ে তবে স্বস্তি পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনসাধনা, কাব্যসাধনার বিরাট সৌধ এই সৌন্দর্যানুভূতির শ্বেত প্রস্তরের উপরেই ভিত্তি স্থাপন করেছে। তাঁর সমস্ত অনুভূতিই সুন্দরের অনুভূতিতে রঞ্জিত।
কবির প্রেমানুভূতির মধ্যেও আছে এই সূক্ষ্ম মহিমাবোধ। তাই তাঁর প্রেমসাধনা একান্ত ভোগবাসনায় পর্যবসিত না হয়ে একটি বিশেষ আনন্দবোধে উপভোগ্য হয়েছে।
সৌন্দর্যানুভূতির সঙ্গে যে একটি ভোগতৃষ্ণা জেগে থাকে তাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু ভোগ সৌন্দর্র্যলাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে না যদি তার মধ্যে সংযত না থাকে। সেই কথাই কবি বলেছেন- “প্রবৃত্তিকে যদি একেবারে পুরামাত্রায় জ্বলিয়া উঠিতে দিই, তবে যে সৌন্দর্যকে কেবল রাঙাইয়া তুলিবার জন্য তাহার প্রয়োজন, তাহাকে জ্বালাইয়া ছাই করিয়া তবে সে ছাড়ে, ফুলকে তুলিতে গিয়া তাহাকে ছিঁড়িয়া ধুলায় লুটাইয়া দেয়। সৌন্দর্য আমাদের প্রবৃত্তিকে সংযত করিয়া আনিয়াছে।…সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে ক্রমে শোভনতার দিকে, সংযমের দিকে আকর্ষণ করিয়া আনিতেছে, সংযমও তেমনি আমাদের সৌন্দর্যভোগের গভীরতা বাড়াইয়া দিতেছে।” তাই আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রেমসাধনা দেহকে অস্বীকার করেনি, আত্মা যেমন সত্য দেহও তেমনি, দেহ-আত্মার যে প্রেম তাই পূর্ণ প্রেম। ভোগ-বাসনা কবির কাব্যে যথেষ্ট আছে, কিন্তু সে ভোগ একান্তভাবে দেহের সীমাতেই আবদ্ধ নয়, দেহকে আশ্রয় করে সে প্রেম দেহাতীত এক অপার্থিব সৌন্দর্যলোকে তার নিত্য আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য ও প্রেমানুভূতির এই যে বৈশিষ্ট্য, একে তিনি প্রকাশ করেছেন এইভাবে- “জীবের মধ্যে অখণ্ডকে অনুভব করারই অন্য নাম ভালোবাসা, প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্যসম্ভোগ।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনদেবতার রহস্যও এইরকম একটি ভাবানুভূতি বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সুগভীর অধ্যাত্মবোধের মূলেও আছে এই ভাবানুভূতি। যে অদ্বিতীয় অর্ধপরিচিত দেবতার স্পর্শ তিনি বারংবার হৃয়ের মধ্যে অনুভব করেছেন, যার নিত্যনতুন লীলায় তাঁর কাব্যজীবন নব নব আনন্দরসে সিঞ্চিত পুষ্পিত হয়ে উঠেছে, সেই চিরবাঞ্ছিত হৃদয়দেবতাকেও তিনি লাভ করেছেন তাঁর নিবিড় অনুভূতির মধ্যে নানা রূপে। কখনো সখা রূপে, কখনো দেবতা রূপে, কখনো মানসসুন্দরী রূপে অদৃশ্য এই সত্তার স্পর্শ তিনি জীবনের ঊষালোক থেকেই পেয়ে এসেছেন। এই প্রণয়িনীর স্পর্শে কবি কখনো বেদনায় ব্যাকুল হয়েছেন, কখনো আনন্দে অধীর হয়েছেন। কখনো মিলনে, কখনো বিরহে এই মধুর স্পর্শটি ক্রমশই রসনিবিড় হয়ে উঠেছে। সুখে দুঃখে বিপদে সম্পদে জীবনের সকল অবস্থায় কবি এই জীবন-দেবতার স্পর্শ লাভ করেছেন। নিদারুণ দুঃখেও তিনি দুঃখরাতের রাজাকে অভ্যর্থনা করে নিয়েছেন। এইভাবে সীমা-অসীমের, পূর্ণ-অপূর্ণের, খণ্ড-অখণ্ডের লীলা-অভিসার চলেছে রবীন্দ্র-কাব্যে।
রবীন্দ্রনাথ সত্য-শিব-সুন্দরের একনিষ্ঠ পূজারি। কঠোর দুঃখ, নির্মম কষাঘাতের মধ্য দিয়ে যে শান্তি লাভ করা যায়, সত্য লাভ করা যায় তাই তাঁর কাম্য। তাই অত্যন্ত সহজেই তিনি বলতে পেরেছেন-
‘মনেরে আজ কহ যে,
ভালমন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।’
সত্যসন্ধানী কবি আরো বলেছেন-
আরাম হতে ছিন্ন করে
সেই গভীরে লও গো মোরে
অশান্তির অন্তরে যেথায়
শান্তি সুমহান।
এইজন্য তাঁর কাব্যে রুদ্র ও শিব সমান পূজা লাভ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনে মৃত্যু একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মৃত্যুর এত মহিমাময় ঐশ্বর্যময় মাধুর্যময় কল্পনা অন্য কোনো কবির কাব্যে আছে কিনা সন্দেহ। জীবনের সোনালি ঊষাতেই কবি অনুরাগকম্পিত কণ্ঠে বলেছেন- ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সম।’
মৃত্যু-বরের জন্য জীবন-বধূ উৎসুক হয়ে সর্বক্ষণ প্রতীক্ষা করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ জীবনের অনন্ত-অনাদি প্রবাহবোধ স্বীকার করেছেন। জীবন-মরণ তো শুধু ইহলোকের বিষয় নয়। তা লোক-লোকান্তরের একটি সংলগ্ন ঘটনা- এ বিশ্বাস তাঁর দৃঢ় ছিল। তাই তিনি জীবন ও মরণকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারেননি।
বিশ্ববোধ আর সর্বানুভূতি রবীন্দ্র-সাহিত্যের একটি মূল সুর। এই বোধের উদ্ভব হয়েছে তাঁর অতীন্দ্রিয় অনুভূতি থেকে। এই অধ্যাত্ম-অনুভূতিই সমগ্র রবীন্দ্র-জীবন ও সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ভারতের অধ্যাত্ম-সাধনায় যে ভূমার আদর্শ ‘ঈশাবাস্যং ঈদং সর্বং কিষ্ণ জগত্যাং জগৎ’- ঈশ্বরের দ্বারা নিখিল জগৎ পরিব্যাপ্ত রয়েছে, সেই সর্বব্যাপিত্বের আদর্শই রবীন্দ্রনাথের জীবন-দর্শনের মূল কথা। তিনি রসো বই সঃ-তিনি রসস্বরূপ, আনন্দানুভূতির তিনিই পরম প্রকাশ। আমাদের কবি এই সর্বানুভূতির কথা, এই আনন্দের কথা অক্লান্ত সুরে নানা ছন্দে রূপে রসে বর্ণে বৈচিত্র্যে প্রকাশ করেছেন। এই অনুভূতির প্রেরণাতেই তিনি লিখেছেন-
“পাগল হইয়া বনে বনে ফিরি আপন গন্ধে মম
কস্তরীমৃগ সম।”
এই প্রেরণাতেই সারা জীবন ধরে তিনি পৃথিবীর নানা পথে প্রান্তরে মরুতে পর্বতে অনন্ত পথ-পরিক্রমায় চলেছিলেন, তিনি চঞ্চলের চিরসহচর ছিলেন। তাঁর কাব্যে চিরদিনই এই আকুতি ধ্বনিত হয়েছে- “আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসী।”
রবীন্দ্রনাথে সুবিপুল, সর্বোতমুখী প্রতিভা ও বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। কত বিচিত্র দিকে, কত বিচিত্রভাবে যে তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছে, কোনটিকে ছাপিয়ে কোন দিকটি যে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা সমগ্ররূপে ধারণা করাই দুঃসাধ্য। সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মের সমস্ত দিকে কারও প্রতিভা এমন অম্লান দীপ্তিতে প্রতিভাত হয়েছে পৃথিবীতে এমন দৃষ্টান্তে দুর্লভ বলা যায়। রবীন্দ্র-জীবন ও কর্মের সম্যক ও সত্য উপলব্ধি আজো স্বদেশে-বিদেশে কোনো দেশেই হয়েছে কি-না সন্দেহ। কবি নিজেই তাঁর ‘আত্মপরিচয়’-এ বলেছেন- ‘নিজের সত্য পরিচয় পাওয়া সহজ নয়। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভিতরকার মূল সূত্রটি ধরা পড়তে চায় না।… নানাখানা করে দেখেছি, নানা কাজে প্রবর্তিত করেছি, ক্ষণে ক্ষণে তাতে আপনার অভিজ্ঞান আপনার কাছে বিক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবনের এই দীর্ঘ চক্রপথ প্রদক্ষিণ করতে করতে বিদায়কালে আজ সেই চক্রকে সমগ্ররূপে দেখতে পেলাম। তখন এটা বুঝতে পেরেছি যে, একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে, সে আর কিছুই নয়, আমি কবি মাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই।’
পরিপূর্ণতার প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক টান আছে, তাই আমরা আমাদের প্রিয়তম কবিকে পরিপূর্ণ রূপেই পেতে চাই। বিশ্বের অমৃত ছবির পরিপূর্ণ সার্থক প্রকাশ রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাব্যের মধ্য দিয়ে আমরা পরিপূর্ণতার স্বাদ পাই।
বিশ্বচিত্তের দূত রবীন্দ্রনাথ, তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর কাব্যে, তাই তিনি সবার উপরে কবি, তাহার উপরে নাই।
No comments