মাতৃভাষার রক্তক্ষরণ by ড. মো. নজরুল ইসলাম
‘মাতৃভাষা
বাংলা চাই’—এই দাবিতে একদিন বাংলাদেশ গর্জে উঠেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে
প্রথমবারের মতো কেউ মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়েছিল। ভাষার এই আন্দোলন
শুধু ভাষাতেই সীমিত থাকেনি, অতঃপর হয়ে উঠেছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার
আদায়ের আন্দোলন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতার আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই
আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
যে ভাষার জন্য রক্ত দিল সালাম, বরকত ও আরও অসংখ্য বীর, একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে যে ভাষা আন্দোলনকে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে, সে ভাষা আজ আমাদের কাছে শুধু একটি প্রভাত ফেরি ও কিছু আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে আছে। যে বাংলা থাকার কথা আমাদের বিশ্বাসে, চেতনায় ও কর্মে, সে বাংলা এখন ইংরেজি, হিন্দি, আরবি প্রভৃতি ভাষার ধাক্কায় অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। বাংলাকে নিয়ে গর্বের পরিবর্তে আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগি।
প্রথমেই আসি ইংরেজি প্রসঙ্গে। ইংরেজি এখন একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা, এ কথা সবাই বললেও কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা কিন্তু ইংরেজিকে এরূপ স্বীকৃতি কখনো দেয়নি। জাতিসংঘ ইংরেজির পাশাপাশি আরও কিছু ভাষাকে আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর ইংরেজি সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত ভাষা নয়। লোকসংখ্যার হিসেবে ইংরেজি ভাষাভাষীদের স্থান দ্বিতীয় বা তৃতীয়। তবে এ কথা সত্য, ইংরেজির দাপট অন্য সব ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। ইংরেজি ভাষার এই দাপট কি তার ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের কারণে? ইংরেজির চেয়েও উন্নত ভাষা পৃথিবীতে রয়েছে। তাহলে ইংরেজির কেন এত দাপট? এর উত্তর, ভাষা নয় বরং ভাষাভাষীদের কারণেই ইংরেজির এই দাপট। ইংরেজি ভাষাভাষী প্রধান দুটি জাতি, ব্রিটিশ ও আমেরিকান, সারা পৃথিবীতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল এবং এখনো রেখে চলেছে। এক সময় ব্রিটিশরা রাজ্য দখল করত। এসব অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে ইংরেজি শিখতে বাধ্য করত। এভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ইংরেজিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাল দিয়ে আমেরিকা সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অতএব প্রভুর সঙ্গে যোগাযোগ, প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন ও সুবিধা আদায়ের জন্য সারা বিশ্ব এখন ইংরেজিকেই মেনে নিয়েছে। ভবিষ্যতে চীন যদি বিশ্বকে দখল করে নেয়, তবে চীনা ভাষা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা। খোদ আমেরিকানরাও বাণিজ্যের প্রয়োজনে অন্য ভাষার চর্চা করে থাকে। সুতরাং, দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম কোনো ভাষা হবে তা ভাষার গুণগত মানের ওপর নয় বরং দুপক্ষের মধ্যে কে শক্তিশালী তার ওপর।
এই লেখা ইংরেজিকে তাড়িয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়, বরং ইংরেজির পাশে বাংলাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার অনেক উৎকর্ষ রয়েছে। যেমন, বর্ণমালা। মানুষের মুখে যে কয়েক প্রকার ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তা বর্ণ বা অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয় ভাষায়। ইংরেজি ভাষায় বর্ণমালার সংখ্যা ২৬। অথচ বাংলা রয়েছে ৪৬টি বা তারও বেশি বর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ‘ত’ ও ‘ট’-এর পৃথক উচ্চারণ অনেক ভাষায় নেই। ‘র’, ‘স’, ‘ণ’ ইত্যাদি বর্ণের যে প্রকারভেদ রয়েছে বাংলায় তা খুবই উন্নত বৈশিষ্ট্য। যেমন, ইংরেজিতে বর্ণের প্রকারভেদ অপ্রতুল হওয়ায় উচ্চারণের প্রকারভেদ করা হয় একটি শব্দে একটি বর্ণের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
ভাষা বিচারের আর একটি মাপকাঠি হলো এর সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাংলার মতো সাহিত্যের সব শাখায় এত উন্নত মানের রচনা খুব কম ভাষাতেই রয়েছে। নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও আমাদের রয়েছে অগণিত বিশ্বমানের কবি-সাহিত্যিক। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষা, গবেষণা ও জাতিগত উন্নয়নে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সেখানে আমরা গুরুত্ব দিই ইংরেজির ওপর। শিশুদের আমরা পাঠাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে। বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ছড়া ও বর্ণমালা শেখানো হয় একেবারে শিশুকাল থেকে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দুভাবে সংকটাপন্ন হচ্ছে।
প্রথমত, মাতৃভাষা অবহেলিত হওয়ায় কোনো শিক্ষা পরিপূর্ণ হচ্ছে না। কারণ মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় জ্ঞান কখনোই আত্মস্থ হয় না। দ্বিতীয়ত, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় বাদ দিয়ে শুধু একটি বিদেশি ভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করায় শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটছে না। অতএব মাতৃভাষায় প্রকৃত জ্ঞানচর্চা শুরু করা উচিত। এরপর ধীরে ধীরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষা শেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে জ্ঞানচর্চা এমনকি প্রযুক্তির শিক্ষায় নিজ ভাষা ব্যবহার করে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো ভাষা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নে কিন্তু ইংরেজির তুলনায় অন্য ভাষাভাষীরা এগিয়ে। আমরা ইদানীং কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহার শুরু করেছি, ই-মেইল, ফেসবুক, ইত্যাদি মাধ্যমে বাংলায় লিখি। সেখানেও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ইংরেজিতে লেখার সময় আমরা বানান ও ব্যাকরণ নিয়ে সতর্ক থাকি। কিন্তু বাংলায় অহরহ ভুল বানানে ও শব্দচয়নে লিখে যাচ্ছি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে। ইংরেজিতে ভুল করা লজ্জার বিষয়, আর বাংলায় ভুল করা যেন গর্বের।
এবার আসি অন্যান্য ভাষার আগ্রাসন প্রসঙ্গে, যেমন উর্দু। এই আগ্রাসন শুরু হয় এ দেশে ইংরেজদের দৌরাত্ম্য শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর। আমাদের দেশে প্রথম আঘাত হানল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক অন্যায়ভাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার মাধ্যমে। প্রাণের বিনিময়ে এই ষড়যন্ত্রকে ঠেকানো গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের গভীর ষড়যন্ত্র থামানো যায়নি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা প্রচারণায় মেতে উঠল, বাংলা হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু মুসলমানদের ভাষা। এই ধারায় প্রথমে হিন্দু কবি অভিযোগে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নজরুলকেও ইসলামিকরণ করা হয়, তাঁর সাম্যবাদী সাহিত্যকর্মকে বর্জন করা হয়, বাকি সাহিত্যের অনেক শব্দ পরিবর্তন করে উর্দু বা ফারসি শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। সর্বোপরি সাম্যের কবিকে ইসলামি কবি বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এভাবে আমরা অনেক উর্দু শব্দকে মেনে নিয়েছি। যেমন, আজ আমরা ‘জল’-এর পরিবর্তে ‘পানি’, ‘দাদা’-র পরিবর্তে ‘ভাইয়া’—এরকম বহু উর্দু শব্দ গ্রহণ করে এক ইসলামি বাংলা ভাষা তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, উর্দু আর হিন্দি ভাষা প্রায় কাছাকাছি। হিন্দিতেও হিন্দুরা ‘পানি’, ‘ভাইয়া’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে থাকে। তাহলে তারা কি মুসলমান হয়ে গেল?
এই লেখাকে কেউ ইসলামবিরোধী ভাববেন না। মূল বক্তব্য হচ্ছে, ধর্ম ও ভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। ভাষা হচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা প্রকাশের একটি উপায়। অন্যদিকে ধর্ম হচ্ছে একটি আদর্শ, জীবনযাপনের একটি মূলনীতি, একটি বিশ্বাস। এই আদর্শ, নীতি ও বিশ্বাসকে যেকোনো ভাষাতেই প্রকাশ করা যেতে পারে। ‘জল’ বলি আর ‘পানি’ বলি, আমার বিশ্বাস ও আদর্শ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বুঝে নিচ্ছেন।
একইভাবে বলা যায়, আরবি ভাষা প্রসঙ্গে। আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে বলে আরবি ইসলামি ভাষা হয়ে যায়নি। আরবিতে কিন্তু অনেক অমুসলমানরাও কথা বলে। আরবি নাম রাখলেই আমি মুসলমান হব আর বাংলা নাম রাখলে হিন্দু হয়ে যাব—এ ধারণা সঠিক নয়। ধর্ম ভাষার ওপর যেমন নির্ভর করে না, তেমনি একটি ভাষাও ধর্ম দ্বারা পরিচিত হয় না। তাই ধর্মের নামে আমাদের বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা খুবই অনুচিত।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে আকাশ সংস্কৃতি ও অধুনা ইন্টারনেট প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে হিন্দি ভাষা আমাদের সংস্কৃতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। হিন্দি ভাষা, গান ও নাচ আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র চোখ বুজে হিন্দিকে অনুকরণ করে যাচ্ছে। সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে হিন্দি গান ও নাচের দৌরাত্ম্য খুবই বেদনাদায়ক। এমনকি প্রবাসেও নতুন প্রজন্ম বাংলা না জানলেও হিন্দি গান ও নাচ ঠিকই শিখছে।
এভাবেই বিভিন্ন অজুহাতে বা উপায়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিগৃহীত ও বিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো ধারার আবির্ভাব ঘটবে। আমাদের উন্নসিকতায় অন্য ভাষা ও সংস্কৃতি চেপে বসবে আমাদের ওপর। হারিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হাসন রাজা, লালন। তখন বিশ্বে জাতি হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু বাকি থাকবে না। তবে আবার এমন দিনও আসতে পারে, জাতীয়তার সংকটে ভুগতে ভুগতে আগামী প্রজন্মের কেউ হয়তো জেগে উঠবে, গগন উঁচিয়ে দাবি জানাবে, ‘মাতৃভাষা বাংলা চাই’।
অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল
যে ভাষার জন্য রক্ত দিল সালাম, বরকত ও আরও অসংখ্য বীর, একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার মাধ্যমে যে ভাষা আন্দোলনকে সারা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে, সে ভাষা আজ আমাদের কাছে শুধু একটি প্রভাত ফেরি ও কিছু আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে আছে। যে বাংলা থাকার কথা আমাদের বিশ্বাসে, চেতনায় ও কর্মে, সে বাংলা এখন ইংরেজি, হিন্দি, আরবি প্রভৃতি ভাষার ধাক্কায় অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। বাংলাকে নিয়ে গর্বের পরিবর্তে আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগি।
প্রথমেই আসি ইংরেজি প্রসঙ্গে। ইংরেজি এখন একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা, এ কথা সবাই বললেও কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা কিন্তু ইংরেজিকে এরূপ স্বীকৃতি কখনো দেয়নি। জাতিসংঘ ইংরেজির পাশাপাশি আরও কিছু ভাষাকে আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আর ইংরেজি সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত ভাষা নয়। লোকসংখ্যার হিসেবে ইংরেজি ভাষাভাষীদের স্থান দ্বিতীয় বা তৃতীয়। তবে এ কথা সত্য, ইংরেজির দাপট অন্য সব ভাষার চেয়ে অনেক বেশি। ইংরেজি ভাষার এই দাপট কি তার ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের কারণে? ইংরেজির চেয়েও উন্নত ভাষা পৃথিবীতে রয়েছে। তাহলে ইংরেজির কেন এত দাপট? এর উত্তর, ভাষা নয় বরং ভাষাভাষীদের কারণেই ইংরেজির এই দাপট। ইংরেজি ভাষাভাষী প্রধান দুটি জাতি, ব্রিটিশ ও আমেরিকান, সারা পৃথিবীতে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল এবং এখনো রেখে চলেছে। এক সময় ব্রিটিশরা রাজ্য দখল করত। এসব অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে ইংরেজি শিখতে বাধ্য করত। এভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ইংরেজিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাল দিয়ে আমেরিকা সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অতএব প্রভুর সঙ্গে যোগাযোগ, প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জন ও সুবিধা আদায়ের জন্য সারা বিশ্ব এখন ইংরেজিকেই মেনে নিয়েছে। ভবিষ্যতে চীন যদি বিশ্বকে দখল করে নেয়, তবে চীনা ভাষা হবে আন্তর্জাতিক ভাষা। খোদ আমেরিকানরাও বাণিজ্যের প্রয়োজনে অন্য ভাষার চর্চা করে থাকে। সুতরাং, দুপক্ষের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম কোনো ভাষা হবে তা ভাষার গুণগত মানের ওপর নয় বরং দুপক্ষের মধ্যে কে শক্তিশালী তার ওপর।
এই লেখা ইংরেজিকে তাড়িয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়, বরং ইংরেজির পাশে বাংলাকে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। অন্য ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষার অনেক উৎকর্ষ রয়েছে। যেমন, বর্ণমালা। মানুষের মুখে যে কয়েক প্রকার ধ্বনি উচ্চারিত হয়, তা বর্ণ বা অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয় ভাষায়। ইংরেজি ভাষায় বর্ণমালার সংখ্যা ২৬। অথচ বাংলা রয়েছে ৪৬টি বা তারও বেশি বর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ‘ত’ ও ‘ট’-এর পৃথক উচ্চারণ অনেক ভাষায় নেই। ‘র’, ‘স’, ‘ণ’ ইত্যাদি বর্ণের যে প্রকারভেদ রয়েছে বাংলায় তা খুবই উন্নত বৈশিষ্ট্য। যেমন, ইংরেজিতে বর্ণের প্রকারভেদ অপ্রতুল হওয়ায় উচ্চারণের প্রকারভেদ করা হয় একটি শব্দে একটি বর্ণের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
ভাষা বিচারের আর একটি মাপকাঠি হলো এর সাহিত্য। বাংলা সাহিত্যের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। বাংলার মতো সাহিত্যের সব শাখায় এত উন্নত মানের রচনা খুব কম ভাষাতেই রয়েছে। নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও আমাদের রয়েছে অগণিত বিশ্বমানের কবি-সাহিত্যিক। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শিক্ষা, গবেষণা ও জাতিগত উন্নয়নে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সেখানে আমরা গুরুত্ব দিই ইংরেজির ওপর। শিশুদের আমরা পাঠাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে। বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ছড়া ও বর্ণমালা শেখানো হয় একেবারে শিশুকাল থেকে। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দুভাবে সংকটাপন্ন হচ্ছে।
প্রথমত, মাতৃভাষা অবহেলিত হওয়ায় কোনো শিক্ষা পরিপূর্ণ হচ্ছে না। কারণ মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষায় জ্ঞান কখনোই আত্মস্থ হয় না। দ্বিতীয়ত, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় বাদ দিয়ে শুধু একটি বিদেশি ভাষার ওপর গুরুত্বারোপ করায় শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটছে না। অতএব মাতৃভাষায় প্রকৃত জ্ঞানচর্চা শুরু করা উচিত। এরপর ধীরে ধীরে দ্বিতীয়, তৃতীয় ভাষা শেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশে জ্ঞানচর্চা এমনকি প্রযুক্তির শিক্ষায় নিজ ভাষা ব্যবহার করে থাকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোনো ভাষা নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়নে কিন্তু ইংরেজির তুলনায় অন্য ভাষাভাষীরা এগিয়ে। আমরা ইদানীং কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহার শুরু করেছি, ই-মেইল, ফেসবুক, ইত্যাদি মাধ্যমে বাংলায় লিখি। সেখানেও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ইংরেজিতে লেখার সময় আমরা বানান ও ব্যাকরণ নিয়ে সতর্ক থাকি। কিন্তু বাংলায় অহরহ ভুল বানানে ও শব্দচয়নে লিখে যাচ্ছি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে। ইংরেজিতে ভুল করা লজ্জার বিষয়, আর বাংলায় ভুল করা যেন গর্বের।
এবার আসি অন্যান্য ভাষার আগ্রাসন প্রসঙ্গে, যেমন উর্দু। এই আগ্রাসন শুরু হয় এ দেশে ইংরেজদের দৌরাত্ম্য শেষ হওয়ার পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর। আমাদের দেশে প্রথম আঘাত হানল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক অন্যায়ভাবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার মাধ্যমে। প্রাণের বিনিময়ে এই ষড়যন্ত্রকে ঠেকানো গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের গভীর ষড়যন্ত্র থামানো যায়নি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা প্রচারণায় মেতে উঠল, বাংলা হিন্দুদের ভাষা আর উর্দু মুসলমানদের ভাষা। এই ধারায় প্রথমে হিন্দু কবি অভিযোগে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নজরুলকেও ইসলামিকরণ করা হয়, তাঁর সাম্যবাদী সাহিত্যকর্মকে বর্জন করা হয়, বাকি সাহিত্যের অনেক শব্দ পরিবর্তন করে উর্দু বা ফারসি শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়। সর্বোপরি সাম্যের কবিকে ইসলামি কবি বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। এভাবে আমরা অনেক উর্দু শব্দকে মেনে নিয়েছি। যেমন, আজ আমরা ‘জল’-এর পরিবর্তে ‘পানি’, ‘দাদা’-র পরিবর্তে ‘ভাইয়া’—এরকম বহু উর্দু শব্দ গ্রহণ করে এক ইসলামি বাংলা ভাষা তৈরি করে নিয়েছি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, উর্দু আর হিন্দি ভাষা প্রায় কাছাকাছি। হিন্দিতেও হিন্দুরা ‘পানি’, ‘ভাইয়া’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে থাকে। তাহলে তারা কি মুসলমান হয়ে গেল?
এই লেখাকে কেউ ইসলামবিরোধী ভাববেন না। মূল বক্তব্য হচ্ছে, ধর্ম ও ভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। ভাষা হচ্ছে মানুষের চিন্তাধারা প্রকাশের একটি উপায়। অন্যদিকে ধর্ম হচ্ছে একটি আদর্শ, জীবনযাপনের একটি মূলনীতি, একটি বিশ্বাস। এই আদর্শ, নীতি ও বিশ্বাসকে যেকোনো ভাষাতেই প্রকাশ করা যেতে পারে। ‘জল’ বলি আর ‘পানি’ বলি, আমার বিশ্বাস ও আদর্শ কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ঠিকই বুঝে নিচ্ছেন।
একইভাবে বলা যায়, আরবি ভাষা প্রসঙ্গে। আরবি ভাষায় পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে বলে আরবি ইসলামি ভাষা হয়ে যায়নি। আরবিতে কিন্তু অনেক অমুসলমানরাও কথা বলে। আরবি নাম রাখলেই আমি মুসলমান হব আর বাংলা নাম রাখলে হিন্দু হয়ে যাব—এ ধারণা সঠিক নয়। ধর্ম ভাষার ওপর যেমন নির্ভর করে না, তেমনি একটি ভাষাও ধর্ম দ্বারা পরিচিত হয় না। তাই ধর্মের নামে আমাদের বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার প্রচেষ্টা খুবই অনুচিত।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে আকাশ সংস্কৃতি ও অধুনা ইন্টারনেট প্রযুক্তি। স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে হিন্দি ভাষা আমাদের সংস্কৃতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। হিন্দি ভাষা, গান ও নাচ আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র চোখ বুজে হিন্দিকে অনুকরণ করে যাচ্ছে। সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে হিন্দি গান ও নাচের দৌরাত্ম্য খুবই বেদনাদায়ক। এমনকি প্রবাসেও নতুন প্রজন্ম বাংলা না জানলেও হিন্দি গান ও নাচ ঠিকই শিখছে।
এভাবেই বিভিন্ন অজুহাতে বা উপায়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিগৃহীত ও বিকৃত করার অপচেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো ধারার আবির্ভাব ঘটবে। আমাদের উন্নসিকতায় অন্য ভাষা ও সংস্কৃতি চেপে বসবে আমাদের ওপর। হারিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হাসন রাজা, লালন। তখন বিশ্বে জাতি হিসেবে পরিচয় দেওয়ার মতো কিছু বাকি থাকবে না। তবে আবার এমন দিনও আসতে পারে, জাতীয়তার সংকটে ভুগতে ভুগতে আগামী প্রজন্মের কেউ হয়তো জেগে উঠবে, গগন উঁচিয়ে দাবি জানাবে, ‘মাতৃভাষা বাংলা চাই’।
অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল
No comments