প্রেম বাঁচে কতকাল? -আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর প্রেম থেকে
----৪----
কেন প্রেমে এত আগুন? কেন হারিয়ে ফেলার এমন আতঙ্ক? উৎকণ্ঠায় যন্ত্রণায় কেন এত তিল তিল কষ্ট? কাছে পেয়েও কেন এমন হা-হুতাশ? (‘কেন আমার রজনী যায়/কাছে পেয়েও কাছে না পায়/ কেন গো তার মালার পরশ বুকে লাগেনি।’) প্রেমে দু-ধরনের দূরত্বেই কষ্ট। যে হারিয়ে গেছে তার জন্যে বেদনা তো আছেই, সে তবু সহ্যের, কিন্তু যে কাছে আছে অথচ থেকেও নেই, তার জন্যে শুধু দোজখের দাউদাউ অনল। আসুন এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করি, প্রেম কেন এমন হারানোর অশান্তি আর উৎকণ্ঠা দিয়ে ভরা।
সুধীবৃন্দ,
আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে, যাকে আমরা ভালোবাসি প্রথম দেখাতেই কিন্তু তাকে আমরা পুরো ভালোবেসে ফেলি না। প্রথমে তার কোনো-একটি দিক আমাদের ভালো লাগে, হয়ত কোনো গুণ, হয়ত রূপ, ব্যক্তিত্বের কোনো দিক, এমনকি কিছু একটা। তারপর সে-ভালো লাগার রং ধীরে ধীরে তার অন্য সবকিছুর ওপর ছড়িয়ে যায়। তখন আমরা সেই গোটা মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলি। কেবল ভালোবাসি না, তার ব্যাপারে ধীরে ধীরে এতটাই আচ্ছন্ন আর অন্ধ হয়ে পড়ি যে, তার ভেতরে-যে খারাপ কিছু আছে তা দেখার ক্ষমতা পর্যন্ত আমাদের এক সময় লোপ পায়। আমরা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাই।
যখন কারো প্রতি আমরা ঠিক ওই পরিমাণে আচ্ছন্ন হই, তখনই সেটা ভালোবাসা। যদি তার ভালোমন্দ বিচার করার বা বোঝার ক্ষমতা আমাদের থাকে তবে বুঝতে হবে, আমরা তখনো ভালোবাসি নি, তাকে আমাদের ভালো লেগেছে মাত্র।
এখন প্রশ্ন, যাকে ভালোবাসি তার ব্যাপারে আমরা এতটা অসহায় আর অন্ধ হই কেন? কেবল অন্ধ নয়: অন্ধ, আচ্ছন্ন, সম্মোহিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত? তার ভালোমন্দ বিচার তো করতে পারিই না, তার বাইরে-যে পৃথিবীতে আর কিছু আছে তাও ভাবতে পারি না?
আগেই বলেছি, আমরা যাদের প্রেমে পড়ি তাদের সবকিছু প্রথমেই আমরা ভালোবেসে ফেলি না। প্রথমে তাদের কোনো-একটা দিক আমাদের ভালো লাগে। একটা জিনিশ নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, কোনো মানুষের কোনো-একটি বিশেষ দিক ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ওই মানুষটি আমাদের কাছে কিছুটা বড় হয়ে ওঠে। আমাদের ভালোবাসাই তাকে বড় করে তোলে। আমাদের জীবনে যে ছিল দশজন মানুষের একজন, সে হঠাৎ ‘একাদশ’ হয়ে যায়। আমাদের জীবনের একান্ত মুহূর্তগুলোকে সে তখন খুশির হাওয়ায় ভরিয়ে তুলতে শুরু করে। যতই তাকে ভালো লাগতে থাকে ততই সে আমাদের চোখে বড় হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে বড় হতে হতে সে এক সময় আমাদের জীবনের সমান হয়ে যায়। এক সময় সে হয় তারও চেয়ে বেশি, আমাদের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। হয়ে আমাদের বিশ্বচরাচরকে গ্রাস করে আমাদের একচ্ছত্র ঈশ্বর হয়ে বসে। আমাদের জীবনকে সে তখন পূর্ণ করে ফেলে এক অপার্থিব অলৌকিক আনন্দে আর চরিতার্থতায়। জীবন হয়ে ওঠে মধুময়, মধুময় হয় বিশ্বচরাচরের সব ধূলিকণা। সে যখন আমাদের কাছে ছোট ছিল তখন তাকে হারাবার ভয়টাও ছিল ছোট। কিন্তু সে এত বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তারাবার ভয়ও হয়ে যায় অতিকায়। ফলে শুরু হয় প্রেমের আতঙ্ক আর যন্ত্রণা। তাই যে একদিন আমাদের চোখে ছিল একজন সামান্য মানুষ, সে দেখতে দেখতে আমাদের সর্বময় প্রভু হয়ে আমাদের জীবনকে দুহাতের নখরে চিরে রক্ত পান করতে শুরু করে। আমাদের অসহায়তার সুযোগে সে আমাদেরকে তার নিশ্চিত ক্রীতদাস বানায়। নির্দয় স্বৈরাচারীর মতো আমাদের ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা জীবনটাকে নিয়ে ইচ্ছামতো ছিনিমিনি করে। আমাদের শান্তি-স্বস্তি হরণ করে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের দাহ দেয়। অথচ এ সবাই কিন্তু হয় আমাদেরই ভেতরকার আশঙ্কা আর অশান্তির কারণে। মধ্যযুগের গোবিন্দদাসের একটা কবিতায় কৃষ্ণ রাধাকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গীকে বলছেন।
ঈ সখি কো ধনি সহচরি মেলি
হামারি জীবন সঙে করতাই খেলি।
‘সখি, কে ঐ রূপসী যে তার সহচরীদের সঙ্গে মিলে আমার জীবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলছে।’ স্বয়ং ভগবানেরই যখন এই অবস্থা তখন আমরা তো ছার। এমনি করে প্রেম আমাদের জিম্মি করে। আমরা পড়ে যাই এক অভেদ্য চক্রে। যাকে ভালোবাসি তাকে দেবতার পর্যায়ে তুলে নেওয়ায় তাকে নিয়ে আমাদের প্রতিটি স্বপ্ন বা তার প্রতিটি স্পর্শ আমাদের অস্তিত্বকে এমন অনির্বচণীয়, স্বর্গীয় ও জ্বলন্ত আনন্দে ভরিয়ে তুলতে থাকে যে, তাকে তুচ্ছতায় নামিয়ে এনে সেই অবিশ্বাস্য সুখের স্বর্গকে হারানোর ক্ষমতা আমাদের শেষ হয়ে যায়। আবার একইসঙ্গে সেই দেবতার মতো বড় হয়ে ওঠা মানুষটির বিশালতার চাপ বা হারানোর দুর্ভাবানা সহ্য করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। স্বর্গের এমন দুর্লভ দানকে হারিয়ে ভিখিরি হয়ে পড়ার আতঙ্কে আমাদের দিনরাত্রির সব সুখ-স্বস্তি শেষ হয়ে যায়। এক অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর নিদ্রাহীন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে আমরা প্রায় মানসিক অসুস্থতায় জর্জরিত হতে থাকি। তাই যে-প্রেমের হওয়ার কথা ছিল শুধুমাত্র সুখের তৃপ্তিতে থৈ থৈ, তা একইসঙ্গে হয়ে ওঠে যন্ত্রণা আর আর্তনাদে ভরা এক জ্বলন্ত নরক।
এভাবে প্রেমের ভেতর একজন মানুষকে অন্যায়রকম বড় করে তুলে আমরা নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনি। একদিন সে ছিল নিতান্তই তুচ্ছ বা সামান্য মানুষ, যার বেঁচে থাকা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না, সেই মানুষকে হারানোর সামান্যতম আশঙ্কায় আমরা কাঁপতে থাকি। সে অন্যদিকে এতটুকু মুখ ঘোরালেও বুকের ভেতরটা উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে ওঠে: ‘ওদিকে কেন তাকায়? তবে কি তার মন সম্পূর্ণভাবে আমার দিকে নেই?’ আকাশের প্লেনের দিকে সে তাকালেও মনে হয়, ‘প্লেনের দিকে তাকাল কেন? তবে কি ওই প্লেনে এমন কেউ যাচ্ছে, যার কথা সে ভাবছে?’
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
এই কবিতাও কি এমনি কোনো যন্ত্রণা থেকে লেখা? সে তখন আমাদের ছাপিয়ে এতবড় হয়ে উঠছে যে, তাকে হারানোর বিশাল ক্ষতির কথা ভাবতে আমরা পুরো ভেঙে পড়ি। যে আমাদের এত অপরিমেয় সুখে পরিপূর্ণ করে রেখেছে সেই দুর্লভ স্বর্গকে হারাই কী করে? তাই এত যন্ত্রণা প্রেমে বন্ধুরা! সে মানুষটি সামান্য কেউ হলে কিন্তু এত আতঙ্ক থাকত না। কিন্তু সে বড় বলে, তার দেওয়া সুখ অসম্ভবরকম বেশি বলে, তাকে হারানোর আতঙ্ক দিয়ে সে আমাদের এভাবে কাঁদায়।
-----৫----
প্রেম কতদিন বাঁচে সুধীবৃন্দ? মানুষ বলে ‘আমি চিরদিন তোমাকে ভালোবাসব’। এটা বলে এজন্যে যে, মানুষ মরণশীল হলেও তার মধ্যে রয়েছে এক ব্যক্তিগত অমরত্বের স্বর্গীয় অনুভূতি। সে তার এই নশ্বর ছোট্ট জীবনকে চিরকালের সমান মনে করে। কিন্তু আসলে কতদিন পর্যন্ত সে ভালোবাসে? কতদিন পর্যন্ত একজন মানুষের পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব? বড়ই অল্পদিন সুধীরা। প্রেম বড় ক্ষণস্থায়ী। বসন্তের ফুলের মতোই সে দুদ-ের! চ-ীদাস লিখেছিলেন:
হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া
কাঁদিতে জনম গেল।
প্রেমে হাসির মুহূর্তে ক্ষণকালের, কান্নাই চিরকালের। ভেবে দেখুন, মানুষ জীবনে প্রেম করে কটা দিন আর প্রেমের স্মৃতি নিয়ে বাঁচে কতকাল? কেন প্রেমের স্মৃতি এত দীর্ঘায়ু? কারণ প্রেমের দিনগুলোতে আমরা বাস করি আবেগের এক অসম্ভব তুঙ্গ মুহূর্তে। আবেগের সেই তীব্রতা আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীটাকে এমন আলোকিত ও বিভাময় করে রাখে যে, সেই শীর্ষ থেকে নেম এলেও সে দিনগুলোর উজ্জ্বলতম আলোকচ্ছটা আমাদের চোখ থেকে হারায় না।
কেন প্রেম মরে যায় এত তাড়াতাড়ি? কতদিন বাঁচে প্রেম? এমন উদগ্র ঝাঁঝালো সর্বনাশা আবেগকে কতদিন আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন: কিছুতেই এক বছরের বেশি নয়। প্রেমে যে অকথ্য যন্ত্রণা আর অসহ্য সুখ আমাদের সর্বগ্রাসীভাবে দগ্ধ করে তা বেশিদিন বইতে হলে মাথার উচ্চ রক্তচাপে আমরা ছিঁড়ে যেতাম। তাই, চাই বা না-চাই কিছুদিনের মধ্যে প্রেমকে আমাদের বিদায় দিতে হয়। এটা করতে পারি আমরা দুটো উপায়ে: প্রেমকে হত্যা করে, অথবা প্রেমকে বন্ধুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে তাকে ছোট বা সহনীয় করে ফেলে।
কিন্তু এ দুয়ের কোনোটাই কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? প্রেম একবার জন্ম নিলে সে কি কোনোদিন মরে? মীর্জা গালিব লিখেছিলেন: ‘প্রেমের ওপর জোর খাঠে না। এ এমন এক আগুন, গালিব, যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না।’ প্রেম কখনো নেভে না, বন্ধুরা। পেলেও না, না-পেলেও না। যাকে আমরা ভালোবাসি তাকে গোটা হৃদয়টাই আমরা দিয়ে বসি। তাই তার কাছ থেকেও তার গোটা হৃদয়টাই চাই। এর কম পেলে আমরা তা নিতে অস্বীকার করি। করি, কিন্তু তার প্রেমকেও তো ছাড়তে পারি না। যে-মানুষকে আমরা বড় করে তুলেছি সে ছোট হয়ে গেলে তার কাছ থেকে পাওয়া সুখও তো ছোট হয়ে গেল। আমরাই যে ছোট হয়ে গেলাম। তাই ছোট সেই সুখকে নিতে আমরা অস্বীকার করি। এইজন্যে রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতন পোস্টমাস্টারের সহৃদয় সৌজন্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেম থেকে নিচে নামতে এ কারণেই আমাদের কত কষ্ট। তাই বন্ধু কখনো কখনো প্রেমিক বা প্রেমিক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কেউ একবার প্রেমিক বা প্রেমিক হলে সে আর কখনো বন্ধু হয় না। কেউ যদি প্রেমকে বন্ধুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে, তখন বুঝতে হবে তার প্রেম ছোট ছিল। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সে বড় করে তুলেছিল ঠিকই কিন্তু তাকে বিশ্বব্যাপী করতে পারে নি। তা জন্মান্ধ বা নিষ্কৃতিহীন ছিল না। যাকে সে প্রেম বলে ভেবেছে আসলে তা ছিল বন্ধুত্ব। হয়ত সম্পন্ন মাপের বন্ধুত্ব, কিন্তু বন্ধুত্ব।
বন্ধুত্ব নিয়ে এখানে একটা কথা বলে রাখতে চাই। বন্ধুত্বকে নিয়ে অনেকেই অনেক সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কিন্তু আসলে তা আদৌ হেলা করার জিনিশ নয়। ফ্রান্সিস বেকন, শোপেন হাওয়ার, রাশফুকো বন্ধুত্বকে প্রেমের চেয়ে বড় জায়গা দিয়েছেন। প্রেম জীবনের উজ্জ্বলতম মুহূর্ত। এর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলোময় রূপময় পৃথিবীতে কিছু নেই। এ হল মানব-অস্তিত্বের সর্বোচ্চ শীর্ষ; মানুষের জীবনের শুভ্রতম উত্তুঙ্গতম কাঞ্চনজঙ্ঘা। মানুষের জীবনকে তীব্রতম সুখের আস্বাদ দেয় সে। বন্ধুত্ব প্রেমের মতো অত উঁচু নয়। প্রেম যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা হয় তবে বন্ধুত্ব পামীর মালভূমি। কিন্তু নিচু হলেও প্রেমের তুলনায় একটা বড় জিনিশ আছে তার মধ্যে: বিশালতা। সে প্রশস্ত, দিগন্তবিস্তৃত। তার আয়তন বিশাল। তার মধ্যে আছে অনেক মানুষ আর সবুজ হৃদয়ের নিরাপদ আশ্রয়। তাছাড়া উচ্চতায় সে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো না হলেও সমতল থেকে সে তো অনেক ওপরে। অনেক উঁচু পর্বতের চেয়েও ওপরে। এই বা কম কিসে? তাছাড়া প্রেমের মতো আগুনের লেলিহান শিখা বা কাঞ্চনজঙ্ঘার তীক্ষè নির্মম শীর্ষ দিয়ে জীবনকে সে তো ছিন্নভিন্ন বা রক্তাক্ত করে না। প্রেমে মানুষ বড় সুখের আশায় বড় দুঃখ ডেকে আনে। এনে সেই দুঃখের ভেতর ককিয়ে ককিয়ে শেষ হয়। বন্ধুত্বে সুখ-দুঃখ কোনোটাই এতবড় নয়। কিন্তু অনেক মানুষের প্রীতিতে, তৃপ্তিতে, দীর্ঘস্থায়িতায়, সহাবস্থানে তা চরিতার্থ। কিন্তু যা নিয়ে আমি বলছি তা প্রেম; বন্ধুত্ব নয়। প্রেম একটা কারণেই কেবল শেষ হয়ে যেতে পারে বা বন্ধুত্বের পর্যায়ে নেমে আসতে পারে: শ্রদ্ধা হারালে। বড় হয়ে-ওঠা মানুষটা কোনো কারণে আমাদের চোখে ছোট হয়ে গেলে। কিন্তু সে-বিষয়ে একটু পরে আসছি। (চলবে)
>>>আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ- এর বক্তৃতা সংগ্রহ থেকে নেয়া
কেন প্রেমে এত আগুন? কেন হারিয়ে ফেলার এমন আতঙ্ক? উৎকণ্ঠায় যন্ত্রণায় কেন এত তিল তিল কষ্ট? কাছে পেয়েও কেন এমন হা-হুতাশ? (‘কেন আমার রজনী যায়/কাছে পেয়েও কাছে না পায়/ কেন গো তার মালার পরশ বুকে লাগেনি।’) প্রেমে দু-ধরনের দূরত্বেই কষ্ট। যে হারিয়ে গেছে তার জন্যে বেদনা তো আছেই, সে তবু সহ্যের, কিন্তু যে কাছে আছে অথচ থেকেও নেই, তার জন্যে শুধু দোজখের দাউদাউ অনল। আসুন এবার আমরা দেখতে চেষ্টা করি, প্রেম কেন এমন হারানোর অশান্তি আর উৎকণ্ঠা দিয়ে ভরা।
সুধীবৃন্দ,
আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন যে, যাকে আমরা ভালোবাসি প্রথম দেখাতেই কিন্তু তাকে আমরা পুরো ভালোবেসে ফেলি না। প্রথমে তার কোনো-একটি দিক আমাদের ভালো লাগে, হয়ত কোনো গুণ, হয়ত রূপ, ব্যক্তিত্বের কোনো দিক, এমনকি কিছু একটা। তারপর সে-ভালো লাগার রং ধীরে ধীরে তার অন্য সবকিছুর ওপর ছড়িয়ে যায়। তখন আমরা সেই গোটা মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলি। কেবল ভালোবাসি না, তার ব্যাপারে ধীরে ধীরে এতটাই আচ্ছন্ন আর অন্ধ হয়ে পড়ি যে, তার ভেতরে-যে খারাপ কিছু আছে তা দেখার ক্ষমতা পর্যন্ত আমাদের এক সময় লোপ পায়। আমরা পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাই।
যখন কারো প্রতি আমরা ঠিক ওই পরিমাণে আচ্ছন্ন হই, তখনই সেটা ভালোবাসা। যদি তার ভালোমন্দ বিচার করার বা বোঝার ক্ষমতা আমাদের থাকে তবে বুঝতে হবে, আমরা তখনো ভালোবাসি নি, তাকে আমাদের ভালো লেগেছে মাত্র।
এখন প্রশ্ন, যাকে ভালোবাসি তার ব্যাপারে আমরা এতটা অসহায় আর অন্ধ হই কেন? কেবল অন্ধ নয়: অন্ধ, আচ্ছন্ন, সম্মোহিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত? তার ভালোমন্দ বিচার তো করতে পারিই না, তার বাইরে-যে পৃথিবীতে আর কিছু আছে তাও ভাবতে পারি না?
আগেই বলেছি, আমরা যাদের প্রেমে পড়ি তাদের সবকিছু প্রথমেই আমরা ভালোবেসে ফেলি না। প্রথমে তাদের কোনো-একটা দিক আমাদের ভালো লাগে। একটা জিনিশ নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন যে, কোনো মানুষের কোনো-একটি বিশেষ দিক ভালো লাগার সঙ্গে সঙ্গেই ওই মানুষটি আমাদের কাছে কিছুটা বড় হয়ে ওঠে। আমাদের ভালোবাসাই তাকে বড় করে তোলে। আমাদের জীবনে যে ছিল দশজন মানুষের একজন, সে হঠাৎ ‘একাদশ’ হয়ে যায়। আমাদের জীবনের একান্ত মুহূর্তগুলোকে সে তখন খুশির হাওয়ায় ভরিয়ে তুলতে শুরু করে। যতই তাকে ভালো লাগতে থাকে ততই সে আমাদের চোখে বড় হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে বড় হতে হতে সে এক সময় আমাদের জীবনের সমান হয়ে যায়। এক সময় সে হয় তারও চেয়ে বেশি, আমাদের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে। হয়ে আমাদের বিশ্বচরাচরকে গ্রাস করে আমাদের একচ্ছত্র ঈশ্বর হয়ে বসে। আমাদের জীবনকে সে তখন পূর্ণ করে ফেলে এক অপার্থিব অলৌকিক আনন্দে আর চরিতার্থতায়। জীবন হয়ে ওঠে মধুময়, মধুময় হয় বিশ্বচরাচরের সব ধূলিকণা। সে যখন আমাদের কাছে ছোট ছিল তখন তাকে হারাবার ভয়টাও ছিল ছোট। কিন্তু সে এত বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে তারাবার ভয়ও হয়ে যায় অতিকায়। ফলে শুরু হয় প্রেমের আতঙ্ক আর যন্ত্রণা। তাই যে একদিন আমাদের চোখে ছিল একজন সামান্য মানুষ, সে দেখতে দেখতে আমাদের সর্বময় প্রভু হয়ে আমাদের জীবনকে দুহাতের নখরে চিরে রক্ত পান করতে শুরু করে। আমাদের অসহায়তার সুযোগে সে আমাদেরকে তার নিশ্চিত ক্রীতদাস বানায়। নির্দয় স্বৈরাচারীর মতো আমাদের ছিন্নভিন্ন রক্তমাখা জীবনটাকে নিয়ে ইচ্ছামতো ছিনিমিনি করে। আমাদের শান্তি-স্বস্তি হরণ করে জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনের দাহ দেয়। অথচ এ সবাই কিন্তু হয় আমাদেরই ভেতরকার আশঙ্কা আর অশান্তির কারণে। মধ্যযুগের গোবিন্দদাসের একটা কবিতায় কৃষ্ণ রাধাকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গীকে বলছেন।
ঈ সখি কো ধনি সহচরি মেলি
হামারি জীবন সঙে করতাই খেলি।
‘সখি, কে ঐ রূপসী যে তার সহচরীদের সঙ্গে মিলে আমার জীবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলছে।’ স্বয়ং ভগবানেরই যখন এই অবস্থা তখন আমরা তো ছার। এমনি করে প্রেম আমাদের জিম্মি করে। আমরা পড়ে যাই এক অভেদ্য চক্রে। যাকে ভালোবাসি তাকে দেবতার পর্যায়ে তুলে নেওয়ায় তাকে নিয়ে আমাদের প্রতিটি স্বপ্ন বা তার প্রতিটি স্পর্শ আমাদের অস্তিত্বকে এমন অনির্বচণীয়, স্বর্গীয় ও জ্বলন্ত আনন্দে ভরিয়ে তুলতে থাকে যে, তাকে তুচ্ছতায় নামিয়ে এনে সেই অবিশ্বাস্য সুখের স্বর্গকে হারানোর ক্ষমতা আমাদের শেষ হয়ে যায়। আবার একইসঙ্গে সেই দেবতার মতো বড় হয়ে ওঠা মানুষটির বিশালতার চাপ বা হারানোর দুর্ভাবানা সহ্য করাও আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। স্বর্গের এমন দুর্লভ দানকে হারিয়ে ভিখিরি হয়ে পড়ার আতঙ্কে আমাদের দিনরাত্রির সব সুখ-স্বস্তি শেষ হয়ে যায়। এক অসহ্য যন্ত্রণার ভেতর নিদ্রাহীন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে আমরা প্রায় মানসিক অসুস্থতায় জর্জরিত হতে থাকি। তাই যে-প্রেমের হওয়ার কথা ছিল শুধুমাত্র সুখের তৃপ্তিতে থৈ থৈ, তা একইসঙ্গে হয়ে ওঠে যন্ত্রণা আর আর্তনাদে ভরা এক জ্বলন্ত নরক।
এভাবে প্রেমের ভেতর একজন মানুষকে অন্যায়রকম বড় করে তুলে আমরা নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনি। একদিন সে ছিল নিতান্তই তুচ্ছ বা সামান্য মানুষ, যার বেঁচে থাকা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না, সেই মানুষকে হারানোর সামান্যতম আশঙ্কায় আমরা কাঁপতে থাকি। সে অন্যদিকে এতটুকু মুখ ঘোরালেও বুকের ভেতরটা উৎকণ্ঠায় অস্থির হয়ে ওঠে: ‘ওদিকে কেন তাকায়? তবে কি তার মন সম্পূর্ণভাবে আমার দিকে নেই?’ আকাশের প্লেনের দিকে সে তাকালেও মনে হয়, ‘প্লেনের দিকে তাকাল কেন? তবে কি ওই প্লেনে এমন কেউ যাচ্ছে, যার কথা সে ভাবছে?’
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
এই কবিতাও কি এমনি কোনো যন্ত্রণা থেকে লেখা? সে তখন আমাদের ছাপিয়ে এতবড় হয়ে উঠছে যে, তাকে হারানোর বিশাল ক্ষতির কথা ভাবতে আমরা পুরো ভেঙে পড়ি। যে আমাদের এত অপরিমেয় সুখে পরিপূর্ণ করে রেখেছে সেই দুর্লভ স্বর্গকে হারাই কী করে? তাই এত যন্ত্রণা প্রেমে বন্ধুরা! সে মানুষটি সামান্য কেউ হলে কিন্তু এত আতঙ্ক থাকত না। কিন্তু সে বড় বলে, তার দেওয়া সুখ অসম্ভবরকম বেশি বলে, তাকে হারানোর আতঙ্ক দিয়ে সে আমাদের এভাবে কাঁদায়।
-----৫----
প্রেম কতদিন বাঁচে সুধীবৃন্দ? মানুষ বলে ‘আমি চিরদিন তোমাকে ভালোবাসব’। এটা বলে এজন্যে যে, মানুষ মরণশীল হলেও তার মধ্যে রয়েছে এক ব্যক্তিগত অমরত্বের স্বর্গীয় অনুভূতি। সে তার এই নশ্বর ছোট্ট জীবনকে চিরকালের সমান মনে করে। কিন্তু আসলে কতদিন পর্যন্ত সে ভালোবাসে? কতদিন পর্যন্ত একজন মানুষের পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব? বড়ই অল্পদিন সুধীরা। প্রেম বড় ক্ষণস্থায়ী। বসন্তের ফুলের মতোই সে দুদ-ের! চ-ীদাস লিখেছিলেন:
হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া
কাঁদিতে জনম গেল।
প্রেমে হাসির মুহূর্তে ক্ষণকালের, কান্নাই চিরকালের। ভেবে দেখুন, মানুষ জীবনে প্রেম করে কটা দিন আর প্রেমের স্মৃতি নিয়ে বাঁচে কতকাল? কেন প্রেমের স্মৃতি এত দীর্ঘায়ু? কারণ প্রেমের দিনগুলোতে আমরা বাস করি আবেগের এক অসম্ভব তুঙ্গ মুহূর্তে। আবেগের সেই তীব্রতা আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীটাকে এমন আলোকিত ও বিভাময় করে রাখে যে, সেই শীর্ষ থেকে নেম এলেও সে দিনগুলোর উজ্জ্বলতম আলোকচ্ছটা আমাদের চোখ থেকে হারায় না।
কেন প্রেম মরে যায় এত তাড়াতাড়ি? কতদিন বাঁচে প্রেম? এমন উদগ্র ঝাঁঝালো সর্বনাশা আবেগকে কতদিন আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন: কিছুতেই এক বছরের বেশি নয়। প্রেমে যে অকথ্য যন্ত্রণা আর অসহ্য সুখ আমাদের সর্বগ্রাসীভাবে দগ্ধ করে তা বেশিদিন বইতে হলে মাথার উচ্চ রক্তচাপে আমরা ছিঁড়ে যেতাম। তাই, চাই বা না-চাই কিছুদিনের মধ্যে প্রেমকে আমাদের বিদায় দিতে হয়। এটা করতে পারি আমরা দুটো উপায়ে: প্রেমকে হত্যা করে, অথবা প্রেমকে বন্ধুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে তাকে ছোট বা সহনীয় করে ফেলে।
কিন্তু এ দুয়ের কোনোটাই কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? প্রেম একবার জন্ম নিলে সে কি কোনোদিন মরে? মীর্জা গালিব লিখেছিলেন: ‘প্রেমের ওপর জোর খাঠে না। এ এমন এক আগুন, গালিব, যা জ্বালালে জ্বলে না, নেভালে নেভে না।’ প্রেম কখনো নেভে না, বন্ধুরা। পেলেও না, না-পেলেও না। যাকে আমরা ভালোবাসি তাকে গোটা হৃদয়টাই আমরা দিয়ে বসি। তাই তার কাছ থেকেও তার গোটা হৃদয়টাই চাই। এর কম পেলে আমরা তা নিতে অস্বীকার করি। করি, কিন্তু তার প্রেমকেও তো ছাড়তে পারি না। যে-মানুষকে আমরা বড় করে তুলেছি সে ছোট হয়ে গেলে তার কাছ থেকে পাওয়া সুখও তো ছোট হয়ে গেল। আমরাই যে ছোট হয়ে গেলাম। তাই ছোট সেই সুখকে নিতে আমরা অস্বীকার করি। এইজন্যে রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে রতন পোস্টমাস্টারের সহৃদয় সৌজন্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রেম থেকে নিচে নামতে এ কারণেই আমাদের কত কষ্ট। তাই বন্ধু কখনো কখনো প্রেমিক বা প্রেমিক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কেউ একবার প্রেমিক বা প্রেমিক হলে সে আর কখনো বন্ধু হয় না। কেউ যদি প্রেমকে বন্ধুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে, তখন বুঝতে হবে তার প্রেম ছোট ছিল। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সে বড় করে তুলেছিল ঠিকই কিন্তু তাকে বিশ্বব্যাপী করতে পারে নি। তা জন্মান্ধ বা নিষ্কৃতিহীন ছিল না। যাকে সে প্রেম বলে ভেবেছে আসলে তা ছিল বন্ধুত্ব। হয়ত সম্পন্ন মাপের বন্ধুত্ব, কিন্তু বন্ধুত্ব।
বন্ধুত্ব নিয়ে এখানে একটা কথা বলে রাখতে চাই। বন্ধুত্বকে নিয়ে অনেকেই অনেক সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কিন্তু আসলে তা আদৌ হেলা করার জিনিশ নয়। ফ্রান্সিস বেকন, শোপেন হাওয়ার, রাশফুকো বন্ধুত্বকে প্রেমের চেয়ে বড় জায়গা দিয়েছেন। প্রেম জীবনের উজ্জ্বলতম মুহূর্ত। এর চেয়ে সৌন্দর্যময় আলোময় রূপময় পৃথিবীতে কিছু নেই। এ হল মানব-অস্তিত্বের সর্বোচ্চ শীর্ষ; মানুষের জীবনের শুভ্রতম উত্তুঙ্গতম কাঞ্চনজঙ্ঘা। মানুষের জীবনকে তীব্রতম সুখের আস্বাদ দেয় সে। বন্ধুত্ব প্রেমের মতো অত উঁচু নয়। প্রেম যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা হয় তবে বন্ধুত্ব পামীর মালভূমি। কিন্তু নিচু হলেও প্রেমের তুলনায় একটা বড় জিনিশ আছে তার মধ্যে: বিশালতা। সে প্রশস্ত, দিগন্তবিস্তৃত। তার আয়তন বিশাল। তার মধ্যে আছে অনেক মানুষ আর সবুজ হৃদয়ের নিরাপদ আশ্রয়। তাছাড়া উচ্চতায় সে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো না হলেও সমতল থেকে সে তো অনেক ওপরে। অনেক উঁচু পর্বতের চেয়েও ওপরে। এই বা কম কিসে? তাছাড়া প্রেমের মতো আগুনের লেলিহান শিখা বা কাঞ্চনজঙ্ঘার তীক্ষè নির্মম শীর্ষ দিয়ে জীবনকে সে তো ছিন্নভিন্ন বা রক্তাক্ত করে না। প্রেমে মানুষ বড় সুখের আশায় বড় দুঃখ ডেকে আনে। এনে সেই দুঃখের ভেতর ককিয়ে ককিয়ে শেষ হয়। বন্ধুত্বে সুখ-দুঃখ কোনোটাই এতবড় নয়। কিন্তু অনেক মানুষের প্রীতিতে, তৃপ্তিতে, দীর্ঘস্থায়িতায়, সহাবস্থানে তা চরিতার্থ। কিন্তু যা নিয়ে আমি বলছি তা প্রেম; বন্ধুত্ব নয়। প্রেম একটা কারণেই কেবল শেষ হয়ে যেতে পারে বা বন্ধুত্বের পর্যায়ে নেমে আসতে পারে: শ্রদ্ধা হারালে। বড় হয়ে-ওঠা মানুষটা কোনো কারণে আমাদের চোখে ছোট হয়ে গেলে। কিন্তু সে-বিষয়ে একটু পরে আসছি। (চলবে)
>>>আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ- এর বক্তৃতা সংগ্রহ থেকে নেয়া
No comments