ক্রাইস্টচার্চ যেন ভুতুড়ে নগরী by উৎপল শুভ্র
শুক্রবার
রাত মানেই আনন্দের রাত। সামনের দুদিন ছুটি, এই রাতে নিউজিল্যান্ডের কোনো
শহর এমনিতেই ঘুমায় না। আর এই শুক্রবারটা তো ছিল বিশেষ কিছু।
হাসি–আনন্দে–উৎসবে যেটির আরও রঙিন হয়ে ওঠার কথা ছিল। ১৭ মার্চ সেন্ট
পিটার্স ডে। আইরিশদের সবচেয়ে বড় সন্তের জন্মদিন। সেটির জন্য অনেক দিন ধরেই
প্রস্তুতি নিচ্ছিল ক্রাইস্টচার্চ। নানা আয়োজনে সাজছিল শহরের আইরিশ পাবগুলো।
এই রাতে যেখানে ভিড় উপচে পড়ার কথা।
সেই শুক্রবার রাতেই ক্রাইস্টচার্চ যেন ভুতুড়ে এক নগরী! বার–পাব খোলা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তাঘাটও প্রায় জনশূন্য। এর সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি মিলে অদ্ভুত একটা বিষণ্নতা নামিয়ে এনেছে চারপাশে। এই শহর যেন আর আগের সেই শহর নেই। আসলেই নেই। আর কোনো দিন আগের মতো হবেও না। ভয়াল এক শুক্রবার চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছে ক্রাইস্টচার্চকে। আসলে তো পুরো নিউজিল্যান্ডকেই।
হিংসাকবলিত পৃথিবীতে এই একটা দেশই হয়তো বাকি ছিল, যেখানে এত দিন সেই অর্থে সন্ত্রাসের কালো ছায়া পড়েনি। শান্তির এক দেশ। যে দেশে নিশ্চিন্তে রাতবিরাতে যেখানে–সেখানে ঘুরে বেড়ানো যায়। বিমানবন্দরে চেকইন করার পরও যতবার ইচ্ছা বাইরে বেরিয়ে আবার ভেতরে ঢোকা যায়। যেখানে গুলি নেই, বোমা নেই। হায়, এর সবই এখন অতীতকাল দিয়ে লিখতে হবে। ‘যায়’–এর বদলে ‘যেত’, ‘নেই’–এর জায়গায় ‘ছিল না’।
সন্ত্রাসের ছোঁয়া থেকে দেশটাকে বাঁচিয়ে এমনই রাখতে অস্ট্রেলিয়ার প্রচণ্ড চাপ উপেক্ষা করেও কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার পরিণতি দেখে আরও বেশি করে খুঁজে পেয়েছে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা। আর এক অস্ট্রেলিয়ানই কিনা রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে বদলে দিল এই দেশটাকে!
রাগ–ক্ষোভের হয়তো সময়মতো উদ্গিরণ ঘটবে, কিন্তু ভয়াল এই শুক্রবারে যতজন নিউজিল্যান্ডারের সঙ্গে কথা হলো, সবার একটাই অনুভূতি—অবিশ্বাস্য! আমাদের দেশে এমন কিছু কীভাবে হয়! নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক, রেডিও স্পোর্টের ব্রায়ান ওয়াডল বারবার মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, ‘এটাও কি সম্ভব! আমাদের দেশে এমন কিছু আগে কখনো হয়নি।’
কাল দুপুরে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠে যত মানুষ ছিল, সবাই একটা রুমে একরকম বন্দী। যেটির পোশাকি নাম ‘লক্ড ডাউন’। পুরো ক্রাইস্টচার্চই কাল বেলা দুইটার পর থেকে খণ্ড খণ্ড ‘লকড্ ডাউন’–এর সমষ্টি। যে যেখানে ছিল, সেখানেই থাকতে হবে। শহর নিরাপদ মনে হলেই কেবল অনুমতি মিলবে বাইরে বেরোনোর। হ্যাগলি ওভালে ‘হ্যাডলি প্যাভিলিয়ন’ নামে বিশাল হলরুমটাতে বাংলাদেশের সাতজন সাংবাদিক ছাড়া বাকি সবাই নিউজিল্যান্ডের। কেউ মোবাইলে সর্বশেষ অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। কারও চোখ টেলিভিশনে। দেখছেন আর তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠছে অবিশ্বাস আর চিরদিনের জন্য চেনা ক্রাইস্টচার্চকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। স্কাই স্পোর্টসের ফ্লোর ম্যানেজার তারিনা স্টিফেনস, দেখে মনে হলো বয়স ত্রিশের একটু এদিক–ওদিকই হবে। একটু পরপর এসে হাতের মোবাইলে এটা–ওটা দেখাচ্ছিলেন। মসজিদে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালানো অস্ট্রেলিয়ান সন্ত্রাসীর ভিডিওটাও তাঁর সৌজন্যেই প্রথম দেখা। দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমাদের দেশে এমন কিছু হতে পারে না।’
ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গিয়েছিলাম বলে বারবার জানতে চাইলেন, কী দেখেছি সেখানে। দেখেছি রক্তাক্ত মৃতদেহ, সারা শরীরে রক্ত নিয়ে হেঁটে আসতে থাকা তরুণ, সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলা একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স, সাবমেশিনগান হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ...। থামিয়ে দিয়ে তারিনা স্টিফেনস বললেন, ‘আমিও টিভিতে দেখলাম, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো সাবমেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তো এটা ব্যবহার করতে পারবে কি না আমার সন্দেহ হয়। কখনো ব্যবহার করেছে নাকি! আমাদের দেশে পুলিশের কাছে তো এমনিতে কোনো অস্ত্রই থাকে না। থাকে শুধু ছোট্ট একটা লাঠি।’
‘লকড্ ডাউন’ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের টিম হোটেল নভোটেলে পৌঁছে দিচ্ছিলেন কেটলিন গডফ্রে নামের এক তরুণী। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন। যে কোম্পানির ওপর দায়িত্ব ছিল হ্যাগলি ওভাল সাজানোর। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘এই শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখানে আমি কখনো একমুহূর্তের জন্যও অনিরাপদ বোধ করিনি। আর এখানেই কিনা...’। কথাটা শেষ করার আগেই তাঁর দুই চোখে জলের ধারা।
‘এখানে’ মানে শুধু ক্রাইস্টচার্চে নয়, পুরো নিউজিল্যান্ডেই তো এত দিন কেউ কখনো অনিরাপদ বোধ করেনি। নামাজ পড়তে যাওয়া বাংলাদেশ দলের বাসের সামনে–পেছনে পুলিশের গাড়ি দূরে থাক, বাসে যে একজন নিরাপত্তা কর্মীও ছিল না—এটি বাংলাদেশের বিবেচনায় অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এটাই তো স্বাভাবিক। যেখানে টিম হোটেলেও বাড়তি কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়নি কখনো। ক্রিকেটাররা রাতের বেলায়ও যেখানে ইচ্ছা যেতে পেরেছেন। কখনো দু–তিনজন মিলে। কখনোবা একাই। বাকি বিশ্বের সঙ্গে ব্যতিক্রম হয়ে এ দেশের আকাশ–বাতাস ছড়িয়ে দিত শান্তির বারতা। সেই বাতাসে এখন লাশের গন্ধ।
পরপর দুই বছরে দুটি বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে আবার আগের রূপে ফেরার লড়াই–ই শেষ হয়নি ক্রাইস্টচার্চের। ভাঙা ক্যাথেড্রাল, পরিত্যক্ত ভবন এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই দুঃস্বপ্ন। সেসব হয়তো আবারও আগের রূপে ফিরে আসবে কোনো একদিন। কিন্তু ভয়াল এই শুক্রবারের পর ক্রাইস্টচার্চ আর কখনো আগের মতো হবে না। নিউজিল্যান্ডও না।
সেই শুক্রবার রাতেই ক্রাইস্টচার্চ যেন ভুতুড়ে এক নগরী! বার–পাব খোলা থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। রাস্তাঘাটও প্রায় জনশূন্য। এর সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি মিলে অদ্ভুত একটা বিষণ্নতা নামিয়ে এনেছে চারপাশে। এই শহর যেন আর আগের সেই শহর নেই। আসলেই নেই। আর কোনো দিন আগের মতো হবেও না। ভয়াল এক শুক্রবার চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছে ক্রাইস্টচার্চকে। আসলে তো পুরো নিউজিল্যান্ডকেই।
হিংসাকবলিত পৃথিবীতে এই একটা দেশই হয়তো বাকি ছিল, যেখানে এত দিন সেই অর্থে সন্ত্রাসের কালো ছায়া পড়েনি। শান্তির এক দেশ। যে দেশে নিশ্চিন্তে রাতবিরাতে যেখানে–সেখানে ঘুরে বেড়ানো যায়। বিমানবন্দরে চেকইন করার পরও যতবার ইচ্ছা বাইরে বেরিয়ে আবার ভেতরে ঢোকা যায়। যেখানে গুলি নেই, বোমা নেই। হায়, এর সবই এখন অতীতকাল দিয়ে লিখতে হবে। ‘যায়’–এর বদলে ‘যেত’, ‘নেই’–এর জায়গায় ‘ছিল না’।
সন্ত্রাসের ছোঁয়া থেকে দেশটাকে বাঁচিয়ে এমনই রাখতে অস্ট্রেলিয়ার প্রচণ্ড চাপ উপেক্ষা করেও কখনো কোনো সামরিক জোটে যোগ দেয়নি নিউজিল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার পরিণতি দেখে আরও বেশি করে খুঁজে পেয়েছে সেই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা। আর এক অস্ট্রেলিয়ানই কিনা রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে বদলে দিল এই দেশটাকে!
রাগ–ক্ষোভের হয়তো সময়মতো উদ্গিরণ ঘটবে, কিন্তু ভয়াল এই শুক্রবারে যতজন নিউজিল্যান্ডারের সঙ্গে কথা হলো, সবার একটাই অনুভূতি—অবিশ্বাস্য! আমাদের দেশে এমন কিছু কীভাবে হয়! নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক, রেডিও স্পোর্টের ব্রায়ান ওয়াডল বারবার মাথা নাড়ছেন আর বলছেন, ‘এটাও কি সম্ভব! আমাদের দেশে এমন কিছু আগে কখনো হয়নি।’
কাল দুপুরে ক্রাইস্টচার্চের হ্যাগলি ওভাল মাঠে যত মানুষ ছিল, সবাই একটা রুমে একরকম বন্দী। যেটির পোশাকি নাম ‘লক্ড ডাউন’। পুরো ক্রাইস্টচার্চই কাল বেলা দুইটার পর থেকে খণ্ড খণ্ড ‘লকড্ ডাউন’–এর সমষ্টি। যে যেখানে ছিল, সেখানেই থাকতে হবে। শহর নিরাপদ মনে হলেই কেবল অনুমতি মিলবে বাইরে বেরোনোর। হ্যাগলি ওভালে ‘হ্যাডলি প্যাভিলিয়ন’ নামে বিশাল হলরুমটাতে বাংলাদেশের সাতজন সাংবাদিক ছাড়া বাকি সবাই নিউজিল্যান্ডের। কেউ মোবাইলে সর্বশেষ অবস্থার খোঁজখবর নিচ্ছেন। কারও চোখ টেলিভিশনে। দেখছেন আর তাঁদের চোখেমুখে ফুটে উঠছে অবিশ্বাস আর চিরদিনের জন্য চেনা ক্রাইস্টচার্চকে হারিয়ে ফেলার বেদনা। স্কাই স্পোর্টসের ফ্লোর ম্যানেজার তারিনা স্টিফেনস, দেখে মনে হলো বয়স ত্রিশের একটু এদিক–ওদিকই হবে। একটু পরপর এসে হাতের মোবাইলে এটা–ওটা দেখাচ্ছিলেন। মসজিদে ঢুকে হত্যাযজ্ঞ চালানো অস্ট্রেলিয়ান সন্ত্রাসীর ভিডিওটাও তাঁর সৌজন্যেই প্রথম দেখা। দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমাদের দেশে এমন কিছু হতে পারে না।’
ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গিয়েছিলাম বলে বারবার জানতে চাইলেন, কী দেখেছি সেখানে। দেখেছি রক্তাক্ত মৃতদেহ, সারা শরীরে রক্ত নিয়ে হেঁটে আসতে থাকা তরুণ, সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলা একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স, সাবমেশিনগান হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ...। থামিয়ে দিয়ে তারিনা স্টিফেনস বললেন, ‘আমিও টিভিতে দেখলাম, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেগুলো সাবমেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তো এটা ব্যবহার করতে পারবে কি না আমার সন্দেহ হয়। কখনো ব্যবহার করেছে নাকি! আমাদের দেশে পুলিশের কাছে তো এমনিতে কোনো অস্ত্রই থাকে না। থাকে শুধু ছোট্ট একটা লাঠি।’
‘লকড্ ডাউন’ শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের টিম হোটেল নভোটেলে পৌঁছে দিচ্ছিলেন কেটলিন গডফ্রে নামের এক তরুণী। একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করেন। যে কোম্পানির ওপর দায়িত্ব ছিল হ্যাগলি ওভাল সাজানোর। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘এই শহরেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এখানে আমি কখনো একমুহূর্তের জন্যও অনিরাপদ বোধ করিনি। আর এখানেই কিনা...’। কথাটা শেষ করার আগেই তাঁর দুই চোখে জলের ধারা।
‘এখানে’ মানে শুধু ক্রাইস্টচার্চে নয়, পুরো নিউজিল্যান্ডেই তো এত দিন কেউ কখনো অনিরাপদ বোধ করেনি। নামাজ পড়তে যাওয়া বাংলাদেশ দলের বাসের সামনে–পেছনে পুলিশের গাড়ি দূরে থাক, বাসে যে একজন নিরাপত্তা কর্মীও ছিল না—এটি বাংলাদেশের বিবেচনায় অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এটাই তো স্বাভাবিক। যেখানে টিম হোটেলেও বাড়তি কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়নি কখনো। ক্রিকেটাররা রাতের বেলায়ও যেখানে ইচ্ছা যেতে পেরেছেন। কখনো দু–তিনজন মিলে। কখনোবা একাই। বাকি বিশ্বের সঙ্গে ব্যতিক্রম হয়ে এ দেশের আকাশ–বাতাস ছড়িয়ে দিত শান্তির বারতা। সেই বাতাসে এখন লাশের গন্ধ।
পরপর দুই বছরে দুটি বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে আবার আগের রূপে ফেরার লড়াই–ই শেষ হয়নি ক্রাইস্টচার্চের। ভাঙা ক্যাথেড্রাল, পরিত্যক্ত ভবন এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই দুঃস্বপ্ন। সেসব হয়তো আবারও আগের রূপে ফিরে আসবে কোনো একদিন। কিন্তু ভয়াল এই শুক্রবারের পর ক্রাইস্টচার্চ আর কখনো আগের মতো হবে না। নিউজিল্যান্ডও না।
No comments