আব্বাসের বিমান কেনা ও ইসরায়েলের ভণ্ডামি by রবার্ট ফিস্ক
উড়োজাহাজটির
নাম বোয়িং বিজনেস জেট ১ (সংক্ষেপে বিবিজে১। এটির রেজিস্ট্রেশন মার্ক হলো
বি-৫২৮৬। এটি বোয়িং ৭৩৭-৭০০ মডেলেরই অন্য একটি সংস্করণ। এটি ঘণ্টায় ৫৪১
কিলোমিটার গতিতে চলে। একটানা ছয় হাজার মাইলের বেশি পথ পাড়ি দেয়। এই
উড়োজাহাজটি নিয়েই এখন ইসরায়েলের নোংরা খেলা শুরু হয়েছে। প্রায় পাঁচ কোটি
মার্কিন ডলার দিয়ে উড়োজাহাজটি ফিলিস্তিন সরকার তার ৮২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট
মাহমুদ আব্বাসের জন্য কিনতে যাচ্ছে। ইসরায়েল বলছে, যেখানে তাদের
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিজের একখানা ব্যক্তিগত জেট নেই,
সেখানে ফিলিস্তিন কীভাবে এই বিলাসবহুল উড়োজাহাজ তাদের প্রেসিডেন্টের জন্য
কিনছে? আহা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী কী ব্যয়কুণ্ঠ মানসিকতা দেখালেন! অথচ এই
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর জন্যই মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো বিশেষ বিমান
‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটির দাম পড়ছে সাত
কোটি ডলার। ফিলিস্তিনের এই উড়োজাহাজ কেনার দলিলপত্র ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার
হাতে এসেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উড়োজাহাজটি কেনা সম্পন্ন হলে
এটির মালিক হবে ফিলিস্তিনের সার্বভৌম তহবিল ‘প্যালেস্টাইন ইনভেস্টমেন্ট
ফান্ড’। এই তহবিলটি যারা গঠন করেছে, তাদের বলা হয়, ‘দ্য পিপল অব
প্যালেস্টাইন’। ফিলিস্তিনের কয়েকটি কোম্পানির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই তহবিল
গঠিত। বাইরের দেশের অনুদানের অর্থ এই তহবিলে নেই। কিন্তু ট্রাম্প যখন
সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের না খাইয়ে মারার হুমকি দিচ্ছেন, ঠিক এমন
একসময় মাহমুদ আব্বাসের এই ‘বিলাসিতা’ নিয়ে ইসরায়েল শোরগোল বাধিয়ে দিয়েছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আগেই দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। শিগগিরই পুলিশ
আনুষ্ঠানিকভাবে সেই অভিযোগ উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। সেই তিনি নিজের জন্য
‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ কিনতে যাচ্ছেন। আব্বাস যে উড়োজাহাজ কিনবেন, প্রায় একই
ধরনের উড়োজাহাজ কিনবেন নেতানিয়াহু। কিন্তু তাঁর ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’-এর দাম
পড়বে অনেক বেশি; সাত কোটি ডলারের মতো। ২০১৩ সালে মার্গারেট থ্যাচারের
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে নেতানিয়াহু লন্ডন যান।
তাঁকে বহনকারী ই১ এ ১
উড়োজাহাজে তখন ডবল বেড স্থাপন করা হয়। শুধু এটি করতেই ইসরায়েলি করদাতাদের
পকেট থেকে মোট ১ লাখ ২৭ হাজার ডলার নেওয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে ইসরায়েলি
জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভ করেছিল। এ ছাড়া তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শিমোন পেরেজের
জন্য বিমানে বাড়তি অক্সিজেন ট্যাংক বসাতে ৪ হাজার ৭০০ ডলার খরচ হয়েছিল। এখন
তারাই ফিলিস্তিনকে ব্যয়কুণ্ঠ হওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রাইভেট
উড়োজাহাজ কেনার প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত জটিল। আব্বাসের উড়োজাহাজ কেনার
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল গত শরতে; অর্থাৎ
ফিলিস্তিনকে ট্রাম্পের সহায়তা বন্ধের হুমকি দেওয়ার অনেক আগে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার জেট ক্র্যাফট করপোরেশনের মাধ্যমে চায়নিজ নানশান
জেট কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ কোটি ডলারে কেনার কথা ঠিক হয়। দুবাইভিত্তিক
আইনি প্রতিষ্ঠান ‘ডোনাল্ড এইচ বাঙ্কার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর মাধ্যমে
সৌজন্য অগ্রিম হিসেবে পাঁচ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়। বেশ কিছু দলিলে
প্যালেস্টাইন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরও
রয়েছে।ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে প্যালেস্টাইন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের
কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার হয়েছিল। তাঁরা এই দলিলপত্র নিয়ে
আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে এই চুক্তির সঙ্গে
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ইয়াসির আরাফাতের
আমল থেকেই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের অফিশিয়াল প্লেন রয়েছে। আর অফিশিয়াল
এয়ারক্র্যাফট সব সময় প্যালেস্টাইন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের বিপরীতে নিবন্ধিত
হয়ে থাকে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বেশির ভাগ দেশই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে
ভিআইপি মর্যাদার বলে মনে করে থাকে। তিনি বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে
প্রেসিডেন্ট বাণিজ্যিক ফ্লাইটে চড়তে পারেন না। আবার অফিশিয়াল উড়োজাহাজ কেনা
না থাকলে তার বদলে নিয়মিত প্লেন ভাড়া নেওয়া অনেক বেশি ব্যয়সাধ্য। ওই
কর্মকর্তা জানান, গত বছর প্রেসিডেন্টকে বহনকারী উড়োজাহাজে বেশ কয়েকবার
যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার
স্বার্থে প্যালেস্টাইন ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের সহায়তা চাওয়া হয়। তারা এই
তহবিল দিতে সম্মত হয়। সম্প্রতি ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী বলে
ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
এই মুহূর্তে ইসরায়েল আব্বাসের বিরুদ্ধে যে ‘বিলাসিতার’ অভিযোগ তুলেছে, তা
ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ফিলিস্তিনের
নিজেদের কোনো এয়ারলাইন নেই। জার্মানি, স্পেন, জাপান, মিসর, সৌদি আরব ও
মরক্কোর সহায়তায় গাজায় তাদের একমাত্র বিমানবন্দর গড়ে তোলা হয়েছিল। ২০০১
সালে ইসরায়েল বোমা মেরে এটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এখন তারাই ফিলিস্তিনের
‘ব্যয় বাহুল্যে’ উতলা হয়ে উঠেছে।
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি
দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি
No comments