কাকের কা কা আর চিলের ছোঁ by সারফুদ্দিন আহমেদ
পলিটিকসে পলিউশন আছে জানি। দেশি মসুর ডালে
বিদেশি ভেচ ঢুকেছে-তা-ও জানি। তবু বাঙালির চায়ের সঙ্গে পলিটিকস আর ভাতের
সঙ্গে পাতলা ডাল না হলে চলে না। বাঙালি আগে ছিল ‘মাছে-ভাতে’। এখন
‘ডালে-ভাতে’। তাই ডাল না হোক, ডালের মতো দেখা গেলেই হলো। ভেচ দিয়ে
ডাল-ভাতের কাজ চলে যাচ্ছে, তা-ই বা কম কী? একইভাবে নির্মল রাজনীতির বদলে
‘পলিউটেড পলিটিকস’ নিয়েই বাঙালি আপাতত খুশি। পারিবারিক কূটনীতিবহুল
সান্ধ্যকালীন টিভি সিরিয়ালে আসক্ত লোকদের কুটনামির আনন্দ থেকে যদিওবা দূরে
সরিয়ে রাখা সম্ভব, কিন্তু এই নশ্বর বাঙালি জীবন থেকে অবিনশ্বর রাজনীতিকে
দূরে রাখা অসম্ভব। বাঙালি জীবনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক তাজের সঙ্গে
মমতাজের মতো। যে চায়ের দোকানে ‘রাজনীতির আলাপ বন্ধ’ লেখা স্টিকার সাঁটানো
থাকে, সেখানেই এই আলাপ জমে ভালো। আলাপ-প্রলাপের ফাঁকে ফাঁকে পানাসক্ত
(পান-সুপারিতে আসক্ত ব্যক্তি) আলোচকদের মুখের খয়েরি পিক আর তর্জনীর
অগ্রভাগের রজতশুভ্র চুনের দাগে টিনের বেড়ায় সাঁটা সতর্কবার্তাটি বর্ণিল হতে
থাকে। একসময় চুন-পিক-কফ-সিকনির বিমূর্ত রঙে সেই স্টিকারটি ভ্যান গঘের
সুররিয়ালিস্টিক পেইন্টিংয়ে রূপ নেয়। অনেকে পড়তে পারে না বলে ওই স্টিকারে কী
লেখা আছে, তা বুঝতে পারে না। ফলে এই নির্দেশনা মানা, না মানার প্রশ্ন তার
বেলায় খাটে না। আরেক দল আছে, যারা পড়তে পারে এবং বোঝেও; কিন্তু মানে না।
আরেক দল আছে, যারা ‘ভদ্র’ এবং ভিতু গোছের। তারা এই লেখার মানে ও গুরুত্ব
দুই-ই বোঝে এবং তা মেনে চুপ করে চা খেয়ে উঠে চলে যায়। কারওয়ান বাজারের এমন
একটি ‘রাজনীতির আলাপ নিষিদ্ধ’ টি স্টলে সেদিন বসে আছি। আচমকা এক মুরব্বি
গালের ভেতর ডাবল খিলি চালান করে ধীরলয়ে চিবোতে চিবোতে আলোচনা শুরু করলেন:
‘রাজনীতি দ্যাশটারে শ্যাষ কইরা ফালাইল, বুঝলা! এই কারণে রাজনীতির আলাপ সহ্য
করবার পারি না...।’ তাঁর মতো রাজনীতিবিমুখ লোকের অভাব চায়ের দোকানে কোনো
দিন ছিল না। এখনো নেই। তাঁরা মুরব্বির কথায় সায় দিলেন। সৌজন্যসূচক ‘হুঁ’,
‘হাঁ’, ‘এক্কেরে ঠিক কইছেন’-এর পর আলোচনা জমে উঠতে সময় লাগল না। প্রথম দিকে
আলোচনার বিষয় ছিল: পজিশন,
অপজিশন-সবাই দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে।
আলোচনার সূত্রপাত করা পানাসক্ত মুরব্বির রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামানোর
যুক্তি শেষ হতে চায় না। ওদিকে তার হাটের বেলা যায়। তিনি ভয়ানক কাশির ফাঁকে
ফাঁকে রাজনৈতিক আলাপসংক্রান্ত সতর্কবার্তাটির ওপর বার কয়েক পানের পিক
ফেললেন। এরপর যথাযথ রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে তাঁর অসম্পূর্ণ বক্তব্য শেষ
করার দায়িত্ব সমমনাদের ঘাড়ে তুলে দিয়ে টুক করে সরে পড়লেন। সদ্য বিদায়ী
কমরেডের গছিয়ে দেওয়া দায়িত্ব হাজেরানে মজলিশ নিষ্ঠার সঙ্গে প্রথমে লালন,
তারপর পালন করতে লাগল। ‘গিবতালোচনা’ চলতে থাকল। দুই আঙুলের ফাঁকে ক্ষয়িষ্ণু
সিগারেটের পশ্চাদ্দেশে আখেরি টান দিয়ে ‘যাই গা, কাম আছে’ বলে দু-চারজন উঠে
গেলেও বক্তার সংখ্যা কমল না। তাঁদের জায়গায় নতুন দু-চারজন তশরিফ রাখলেন।
তাঁরা সংলাপের সিলসিলা জারি রাখলেন। হাজেরানে মজলিশের এই মাশোয়ারায়
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্ভব-ক্রমবিকাশ-ইতিহাস-ইতিবৃত্ত; গণতন্ত্রের
সংকট-সমাধান, সরকার ও বিরোধীদের করণীয় থেকে কপালপোড়া সর্বংসহা পাবলিকের
ঘুরে দাঁড়ানোর কৌশল-সব উঠে আসতে লাগল। একটু আগে রাজনীতির আলোচনা একেবারেই
বরদাশত করতে পারেন না বলে যাঁরা ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন, তাঁদের পক্ষেও শেষ
পর্যন্ত তাঁরা কোন দল সাপোর্ট করেন, তা চেপে রাখা সম্ভব হলো না। কে
ডানপন্থী, কে বামপন্থী, কে মধ্যপন্থী, কে লিবারেল, কে রেডিক্যাল-সব আস্তে
আস্তে বের হতে থাকল। পানাসক্ত মুরব্বি আলাপের সূত্রপাত করে দিয়ে গেছেন। সেই
আলাপ ধীরে ধীরে সংলাপ এবং সেখান থেকে প্রলাপে মোড় নিল। অনেকগুলো পক্ষ
কোয়ালিশন করে দুই পক্ষ হয়ে গেল। এক পক্ষে সরকার-সমর্থকেরা। অন্য পক্ষে
সরকারবিরোধীরা। বিরোধীরা বলল, ‘হবে না। বুঝলেন, এই সরকার থাকলে দেশ এগোবে না। এদের টেনে নামাতে হবে।’
‘লোটা-কম্বল’-এর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতি মেরে দিয়ে সরকারপন্থীরা
বলল, ‘যদ্দিন এ দেশে বিরোধীরা আছে, তদ্দিন এ দেশের কিচ্ছু হবে না। কী করে
হবে বলতে পারেন? সব সময় আপনার কাছা ধরে যদি কেউ টানাটানি করে, সেই কাছা
সামলাতে সামলাতেই তো পাঁচটা বছর ফুস। কাজ করতে হলে পায়ের তলায় শক্ত জমি
চাই, যে জমি টলে না, টলানো যায় না।’ সরকারপন্থী জোট বলল, কিসের নিরপেক্ষ
সরকার! নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে। এই সরকারের আন্ডারেই নির্বাচন হতে হবে।
খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। সে নির্বাচন থেকে বাদ। বিরোধী শিবির বলল, ‘মানি
না! মানব না!’ তারা সরকারের ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে মারাত্মক তেজস্ক্রিয় ভাষণ
দেওয়া শুরু করল। তর্কাতর্কির মধ্যে বোঝা যাচ্ছিল না, কে বক্তা আর কে
শ্রোতা। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল খিস্তিখেউড় চলল। পরে হাতাহাতি। আমি
গোবেচারা নিরপেক্ষ দর্শক। গা বাঁচিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ‘অবলোকনকাম চরিতার্থ’
করছি। বুঝতে পারছি, রাজনৈতিক আমজনতার এতেই সুখ। সমাজ আর রাজনীতির
লেন-বাইলেনে ভাইরাসের মতো এই ‘সুখ’ ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এই
সুখটাকে তারা জীবনের ফ্রাইপ্যানে ঝলসানো রুটির মতো উল্টে-পাল্টে সেঁকতে চায়
পাঁচসালা বাজেটের মতো। বুঝতে পারছি, দেশ হয়ে গেছে মরা ইঁদুর। এক পক্ষ চিল
হয়ে ছোঁ মারছে। অন্য পক্ষ বেকায়দায় পড়ে কাক হয়ে কা কা করছে। কাক ও চিলের
কাড়াকাড়ির অনেক ওপরে চক্কর দিচ্ছে শকুনের ঘোলাটে চোখ।
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com
সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com
No comments