নির্বাচন প্রশ্নে বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টায় বিএনপি by কাফি কামাল
গণতন্ত্র
পুনরুদ্ধার ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে জাতীয় ঐক্যের জোর তৎপরতা
শুরু করেছে বিএনপি। নিজ দল ও জোটে ঐক্য সুদৃঢ় রাখার পাশাপাশি বৃহত্তর
রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছেন সিনিয়র নেতারা। বিএনপির এ
উদ্যোগে সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের একটি অংশ। রায়ের
কয়েকদিন আগে গুলশান কার্যালয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে
সাক্ষাৎ করেন কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আগামী দিনের
পথচলা ও নির্বাচনের দাবি আদায়ে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া জোরদারে তারা খালেদা
জিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দেন। খালেদা জিয়া পরামর্শগুলো আমলে নিয়ে
‘রাজনৈতিক দলগুলোকে এক কাতারে’ আনার তৎপরতা জোরদার করতে দলের মহাসচিবকে
নির্দেশ দেন।
গতরাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব ও জোটের সমন্বয়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনগণের একটি জোট-প্ল্যাটফরম তৈরির কথা বলেছেন। খালেদা জিয়াও সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান রেখেছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে এই জোটের ঐক্যকে আরো প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা হবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রক্রিয়াটি সফল হলে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’- এর মাধ্যমে আগামীদিনে আন্দোলন ও নির্বাচন হবে। বিএনপির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট, বামজোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এক প্ল্যাটফরমে আসবে। বর্তমানে বিরোধীদলের ভূমিকায় সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির বড় অংশটিও সম্মিলিত বিরোধী দলে যুক্ত হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের তরফে এ উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে। বিএনপির সঙ্গে দলগুলোর আদর্শগত বিস্তর পার্থক্য থাকলেও জাতীয় সংকট উত্তরণে সাড়া মিলছে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায়। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতের সাজার পর নেতাকর্মীদের চাপ সত্ত্বেও কঠোর কর্মসূচির দিকে যায়নি বিএনপি। রাজপথের কড়া প্রতিবাদের চেয়ে দলটির এখন নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন, জাতীয় ঐক্য ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের তৎপরতা এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলায় সাজার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পথে হাঁটছে। অন্যদিকে জোটের শরিক দল জামায়াতের ব্যাপারে নীতিগত বিরোধ রয়েছে বাম ও বড় দুই জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর। ফলে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার স্বার্থে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে ২০ দলে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো ও অধিকার লঙ্ঘন বিএনপির জন্য শাপেবর হবে। যা জাতীয় রাজনীতিতে আনবে একটি অর্থবহ টার্নিং পয়েন্ট। খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া ও কারাগারে অধিকার বঞ্চিত করার ঘটনা জনমনে তার প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি ও জনমত যেমন বাড়াবে তেমনি রায় পরবর্তী বিএনপির শান্তিপূর্ণ পথচলায় বাড়বে জনসমর্থন। দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাজনিত দ্বন্দ্বগুলোর নিরসন ঘটবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার তৎপরতায় জড়িত কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, প্রাথমিকভাবে খালেদা জিয়ার রায় বা বিএনপির ইস্যুতে সরাসরি কিছু বলবে না বড় দুই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। তারা সরকারের বিরুদ্ধে মুখর থেকে চাপ বাড়াবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিসহ জাতীয় ইস্যুতে পরস্পরের প্রতি সঙ্গতি রেখেই বক্তব্য দেবে। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই একপর্যায়ে তৈরি করা হবে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। তারই অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পর শুক্রবার এক যৌথবিবৃতিতে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চেয়েছে ৮টি বামদল। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদ (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক এ যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ যে নিছক দুর্নীতির অপরাধের জন্য দেয়া হয়েছে, তার পেছনে যে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই- সে কথা প্রমাণ করতে হলে সরকারকে নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসম্মতিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী শাসন, ক্ষমতার প্রবল দাপট, বিপুল লুটপাটের অভিযোগ ইত্যাদির কোনো সুরাহা না করে খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অতি উৎসাহের কারণে দেশবাসীর মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে এই রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।’ একই সুরে বিবৃতি দিয়েছে গণফোরাম। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। তবে এই মামলার ইতিবাচক দিক হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও সর্বশেষ জনতা ব্যাংকের ৫৪০৮ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারিসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ লুটপাট ও পাচারের বিষয়টি অচিরেই বিচারের আওতায় আসবে এবং লুটপাটকারী ও সহায়তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। গণফোরাম নেতারা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি জনকল্যাণমুখী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণকে’ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার উদাত্ত আহ্বান জানান।
নির্বাচন ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্যের প্রসঙ্গে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো নয়, আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাখ্যা হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমূল সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার, প্রার্থিতার অধিকার, ভোটের হারের ওপর সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আমরা নির্বাচনে টাকার খেলা ও পেশিশক্তির দাপট বন্ধ, সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থাসহ (ভোটের হার অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব) নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের এ আন্দোলন আরো জোরদার করব। আমরা আদর্শকে পাশে রেখে কারও সঙ্গে জোট করব না। আওয়ামী লীগ-বিএনপিকেই ঠিক করতে হবে তারা নির্বাচন ইস্যুতে আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে কিনা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, গণতন্ত্র, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ইস্যুতে কর্মসূচিগত ঐক্য হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো চর্চা হয়নি। তিনি বলেন, কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। বিএনপিতে এখন পর্যন্ত সে লক্ষণ নেই। বিচার বিভাগ, বিশেষত নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ছিল না বিএনপি। আর এখানেই তারা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সরকার এখন খালেদা জিয়ার দুই কোটি টাকা লুটপাটের ব্যাপারে হৈচৈ করছে কিন্তু তাদের আমলে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। বিএনপিও এ লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না, কর্মসূচি দেয় না। আমরা সব ধরনের লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলছি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজার রায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। শনিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রায়ের সমালোচনা করে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছে এলডিপি। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির যে কোনো কর্মসূচিতে আগাম সমর্থনও ঘোষণা করেছেন দলটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জামায়াত বলেছে- ‘খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার সরকারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এই রায় দেয়া হয়েছে।’ পৃথক বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির (জাফর) বলেছে, ‘জাতীয় রাজনীতির জন্য এটি একটি চরম অশনি সংকেত।’ ‘সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ ন্যাপ। খেলাফত মজলিস প্রতিহিংসামূলক সাজানো রায় আখ্যায়িত করে বলেছে, ‘এ রায়ে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে।’ এদিকে গতরাতে জোটের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০ দলীয় জোটের এই সভায় দেশনেত্রীর মুক্তি দাবিতে বিএনপি যে কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেছে, সেই কর্মসূচির প্রতি তারা একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তারা এই সব কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন। এই আন্দোলনে ‘অদূর’ ভবিষ্যতে ২০ দলীয় জোট থেকে কর্মসূচি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতরাতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব ও জোটের সমন্বয়ক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনগণের একটি জোট-প্ল্যাটফরম তৈরির কথা বলেছেন। খালেদা জিয়াও সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান রেখেছিলেন। তারই প্রেক্ষিতে এই জোটের ঐক্যকে আরো প্রসারিত করার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা হবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রক্রিয়াটি সফল হলে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’- এর মাধ্যমে আগামীদিনে আন্দোলন ও নির্বাচন হবে। বিএনপির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট, বামজোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এক প্ল্যাটফরমে আসবে। বর্তমানে বিরোধীদলের ভূমিকায় সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির বড় অংশটিও সম্মিলিত বিরোধী দলে যুক্ত হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বাইরে থাকা বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের তরফে এ উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে। বিএনপির সঙ্গে দলগুলোর আদর্শগত বিস্তর পার্থক্য থাকলেও জাতীয় সংকট উত্তরণে সাড়া মিলছে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায়। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতের সাজার পর নেতাকর্মীদের চাপ সত্ত্বেও কঠোর কর্মসূচির দিকে যায়নি বিএনপি। রাজপথের কড়া প্রতিবাদের চেয়ে দলটির এখন নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন, জাতীয় ঐক্য ও কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের তৎপরতা এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলায় সাজার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের পথে হাঁটছে। অন্যদিকে জোটের শরিক দল জামায়াতের ব্যাপারে নীতিগত বিরোধ রয়েছে বাম ও বড় দুই জোটের বাইরে থাকা দলগুলোর। ফলে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার স্বার্থে কৌশলগত পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে ২০ দলে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো ও অধিকার লঙ্ঘন বিএনপির জন্য শাপেবর হবে। যা জাতীয় রাজনীতিতে আনবে একটি অর্থবহ টার্নিং পয়েন্ট। খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া ও কারাগারে অধিকার বঞ্চিত করার ঘটনা জনমনে তার প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি ও জনমত যেমন বাড়াবে তেমনি রায় পরবর্তী বিএনপির শান্তিপূর্ণ পথচলায় বাড়বে জনসমর্থন। দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতাজনিত দ্বন্দ্বগুলোর নিরসন ঘটবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার তৎপরতায় জড়িত কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, প্রাথমিকভাবে খালেদা জিয়ার রায় বা বিএনপির ইস্যুতে সরাসরি কিছু বলবে না বড় দুই জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। তারা সরকারের বিরুদ্ধে মুখর থেকে চাপ বাড়াবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিসহ জাতীয় ইস্যুতে পরস্পরের প্রতি সঙ্গতি রেখেই বক্তব্য দেবে। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই একপর্যায়ে তৈরি করা হবে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। তারই অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ের পর শুক্রবার এক যৌথবিবৃতিতে আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চেয়েছে ৮টি বামদল। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদ (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক এ যুক্ত বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ যে নিছক দুর্নীতির অপরাধের জন্য দেয়া হয়েছে, তার পেছনে যে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই- সে কথা প্রমাণ করতে হলে সরকারকে নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসম্মতিহীন অগণতান্ত্রিক সরকারের স্বেচ্ছাচারী শাসন, ক্ষমতার প্রবল দাপট, বিপুল লুটপাটের অভিযোগ ইত্যাদির কোনো সুরাহা না করে খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়ার ব্যাপারে সরকারের অতি উৎসাহের কারণে দেশবাসীর মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে এই রায়ের মধ্য দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।’ একই সুরে বিবৃতি দিয়েছে গণফোরাম। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেছেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রায় নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। তবে এই মামলার ইতিবাচক দিক হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও সর্বশেষ জনতা ব্যাংকের ৫৪০৮ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারিসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ লুটপাট ও পাচারের বিষয়টি অচিরেই বিচারের আওতায় আসবে এবং লুটপাটকারী ও সহায়তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে বলে জনগণ প্রত্যাশা করে। গণফোরাম নেতারা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে একটি জনকল্যাণমুখী অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণকে’ যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার উদাত্ত আহ্বান জানান।
নির্বাচন ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্যের প্রসঙ্গে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো নয়, আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাখ্যা হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমূল সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিটি নাগরিকের ভোটাধিকার, প্রার্থিতার অধিকার, ভোটের হারের ওপর সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আমরা নির্বাচনে টাকার খেলা ও পেশিশক্তির দাপট বন্ধ, সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থাসহ (ভোটের হার অনুযায়ী প্রতিনিধিত্ব) নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের এ আন্দোলন আরো জোরদার করব। আমরা আদর্শকে পাশে রেখে কারও সঙ্গে জোট করব না। আওয়ামী লীগ-বিএনপিকেই ঠিক করতে হবে তারা নির্বাচন ইস্যুতে আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে কিনা। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, গণতন্ত্র, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন ইস্যুতে কর্মসূচিগত ঐক্য হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো চর্চা হয়নি। তিনি বলেন, কেবল ক্ষমতার পালাবদল নয়, আমরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। বিএনপিতে এখন পর্যন্ত সে লক্ষণ নেই। বিচার বিভাগ, বিশেষত নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ছিল না বিএনপি। আর এখানেই তারা বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সরকার এখন খালেদা জিয়ার দুই কোটি টাকা লুটপাটের ব্যাপারে হৈচৈ করছে কিন্তু তাদের আমলে লক্ষ কোটি টাকা লুটপাটের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই। বিএনপিও এ লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না, কর্মসূচি দেয় না। আমরা সব ধরনের লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলছি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজার রায় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ও বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। শনিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে রায়ের সমালোচনা করে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেছে এলডিপি। সেই সঙ্গে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির যে কোনো কর্মসূচিতে আগাম সমর্থনও ঘোষণা করেছেন দলটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে জামায়াত বলেছে- ‘খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার সরকারি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এই রায় দেয়া হয়েছে।’ পৃথক বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির (জাফর) বলেছে, ‘জাতীয় রাজনীতির জন্য এটি একটি চরম অশনি সংকেত।’ ‘সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক আচরণ বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশ ন্যাপ। খেলাফত মজলিস প্রতিহিংসামূলক সাজানো রায় আখ্যায়িত করে বলেছে, ‘এ রায়ে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে।’ এদিকে গতরাতে জোটের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০ দলীয় জোটের এই সভায় দেশনেত্রীর মুক্তি দাবিতে বিএনপি যে কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেছে, সেই কর্মসূচির প্রতি তারা একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তারা এই সব কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন। এই আন্দোলনে ‘অদূর’ ভবিষ্যতে ২০ দলীয় জোট থেকে কর্মসূচি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
No comments