ভারতীয় কোম্পানির চাপের মুখে ডিএসই
চীনের
দুই স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে শেয়ার বিক্রি নিয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের চাপের
মুখে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কর্তাব্যক্তিরা। ডিএসইর এ শেয়ার বিক্রি
নিয়ে চাপ প্রয়োগের জন্য ভারতের অন্যতম শেয়ারবাজার ন্যাশনাল স্টক
এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিক্রম লিমা এখন ঢাকায়।
রোববার তিনি ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাজেদুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক
করে নানাভাবে তাদের দেশের প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রিতে চাপ প্রয়োগ
করেন। সূত্র বলছে, বৈঠকে বিক্রম লিমা যে ভাষা প্রয়োগ করেছেন, তা কূটনৈতিক
শিষ্টাচার বর্জিত। ডিএসই সূত্র বলছে, বিক্রম লিমার প্রস্তাব অন্যায় ও
অযৌক্তিক। ভারতীয় এ কর্মকর্তার প্রস্তাব যে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় সে
বিষয়টিও তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। চীনের শেনজেন ও সাংহাই স্টক
এক্সচেঞ্জের কাছে ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসই। মঙ্গলবার এ
ব্যাপারে প্রাথমিক এবং শনিবারের বোর্ড মিটিংয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়
ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ। স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (ব্যবস্থাপনা
থেকে মালিকানা আলাদাকরণ) শর্ত অনুসারে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে তাদের
কাছে এ শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি
শেয়ারের দাম ২২ টাকা দিচ্ছে চীনা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এ
শেয়ারের মূল্য চাপের মুখে ফেলে ১৫ টাকায় কিনে নিতে চাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে
স্টক এক্সচেঞ্জে চরম ক্ষোভ রয়েছে। সূত্র জানায়, চীনের কাছে ঢাকা স্টক
এক্সচেঞ্জের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্তের খবর পেয়ে রোববার সকালে ঢাকায় আসেন
বিক্রম লিমা। উঠেন ওয়েস্টিন হোটেলে। সেখানে বসেই ডিএসইর এমডিকে তিনি ডাকেন।
কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদের পরামর্শে ওয়েস্টিনে যেতে রাজি
হননি মাজেদুর রহমান। পরে সকালে ডিএসইতে এসে এমডির সঙ্গে বৈঠকে করেন বিক্রম
লিমা। বৈঠকে তিনি জানতে চান সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শনিবার ডিএসই বোর্ড মিটিং
করতে পারে কিনা? শুধু তাই নয়, ভারতীয় এ কর্মকর্তা এ সময় নানা অশালীন
মন্তব্য করেন। ডিএসইর এমডিও এর জবাব দেন। তিনি জানতে চান, কীভাবে ভারতীয়
কোম্পানি শেয়ার পেতে পারে। ডিএসইর পক্ষ থেকে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়, আর
কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা
পরিচালককে বিকালে ডেকে নিয়ে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। শেয়ারবাজারে
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশনের
সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে স্টক এক্সচেঞ্জের
প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কৌশলগত অংশীদারের কাছে ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির
বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে সদস্যদের মালিকানায় ৪০ এবং ৩৫ শতাংশ
থাকবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। তবে সাড়ে চার বছরেও কৌশলগত বিনিয়োগকারী
চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ নিয়ে গঠিত
কনসোর্টিয়াম এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, নাসডাক এবং ফ্রন্টিয়ার মিলে গঠিত
কনসোর্টিয়াম ডিএসইর শেয়ার কেনার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব দুটি ৬ ফেব্র“য়ারি
খোলে ডিএসইর পর্ষদ। এতে দেখা যায়, ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার
চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ২২ টাকা দর প্রস্তাব করেছে। সব
মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটি ৯৯২ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে ডিএসইর
কার্যক্রমের মানোন্নয়নে বিনামূল্যে উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ করবে। যার
বাজারমূল্য ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) নেতৃত্বাধীন জোট
শেয়ারপ্রতি ১৫ টাকা দরে মোট ৬৭৬ কোটি টাকা দিতে চেয়েছে। তাছাড়া জোটে নাসডাক
থাকলেও তারা কোনো শেয়ার নেবে না। জোটটি মোট ২৫ দশমিক ০১ শতাংশ কেনার
প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে এনএসই ২২ দশমিক ০১ শতাংশ শেয়ার নিতে চায়। বাকি ৩
শতাংশ শেয়ার নেবে ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ। এছাড়াও আগামী ৫ বছরের মধ্যে যে
কোনো প্রক্রিয়ায় তাদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
এছাড়াও পর্ষদে মোট দু’জন সদস্য থাকার প্রস্তাব করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু
আইনে আছে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মাত্র একজন সদস্য রাখা যাবে।
ডিএসইর পদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি কারণে চীনের প্রতিষ্ঠানকে
বেছে নেয়া হয়েছে। প্রথমত আইন ও ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম অনুযায়ী সব ধরনের
নিয়ম মেনে কৌশলগত বিনিয়োগকারী হতে চায় সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ।
দ্বিতীয়ত শেয়ার কেনার জন্য বেশি দাম প্রস্তাব করেছে তারা। তৃতীয়ত
প্রযুক্তিগত সহায়তার বিষয়টিও পরিষ্কার করেছে এ কনসোর্টিয়াম। সবশেষ যুক্তি
হল কোনো ভায়ার মাধ্যমে নয়, তারা সরাসরি শেয়ার কেনার প্রস্তাব দিয়েছে।
অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের নাম ব্যবহার করা হলেও সরাসরি
তারা নয়। এ ক্ষেত্রে বিক্রম লিমা এক ধরনের দালালি করছেন। এছাড়া তিনি যে সব
ভাষা ব্যবহার করেছেন তা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিবর্জিত। বিষয়টি কোনোভাবেই
গ্রহণযোগ্য নয়। জানা গেছে, দেশের আর্থিক খাতে ভারতের সম্পৃক্ততা বাড়ছে।
সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে আসছে ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স
কোম্পানি। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ
অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইনডিয়ার (সেবি) মধ্যে সমঝোতা
চুক্তি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর
সেবির চেয়ারম্যান ইউকে সিনহা এবং বিএসইসির চেযারম্যান ড. এম খায়রুল হোসেন
চুক্তিতে সই করেন। এই চুক্তির ফলে তথ্য বিনিময়, স্টেক হোল্ডারদের
প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পণ্য চালুর বিষয়ে সহায়তা দেবে সেবি। সরকারের পাশাপাশি
ভারতের বেসরকারি উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগে সম্পৃক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে ব্যবসা
করার অনুমোদন পেয়েছে ভারতের বৃহত্তম এবং এশিয়ার ৬ষ্ঠ বীমা কোম্পানি লাইফ
ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (এলআইসি)। ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরের দুটি
ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব পেয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত
প্রতিষ্ঠান অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশনের (ওএনজিসি) এবং অয়েল
ইন্ডিয়া। এদিকে বহুল আলোচিত রামপালের কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কাজ পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি ভারত হেভি
ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল)। এছাড়াও ভারতের বড় দুই শিল্প গ্র“প আদানি ও
রিলায়েন্স- গ্র“প দুটি বাংলাদেশে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহের
কথা জানিয়েছে।
No comments