বাংলাদেশের সামনে কিছু ঝুঁকি আছে by আ ন ম মুনীরুজ্জামান
প্রতিবছর
আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে
প্রতিটি দেশের নিরাপত্তা, পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। আমরা
জানি, বিশ্বে ভূকৌশলগত পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছে, তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়া ও
বাংলাদেশের ওপরও পড়তে শুরু করেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ওপর কী কী
নিরাপত্তা ঝুঁকি পড়তে পারে, সেদিকে এখনই বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন।
শুরুতেই ঝুঁকিগুলো শনাক্ত করা গেলে সেগুলো মোকাবিলায় ভালো পরিকল্পনা প্রণয়ন
করা সম্ভব হয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ বছরের শেষে।
ঐতিহাসিকভাবে এ দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন বেশ হিংসাত্মক। প্রায়শই
সংঘাত-সহিংসতা ঘটে। এসব বিবেচনায় ২০১৭ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ
যথেষ্ট শান্ত ও স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে এই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে
যেতে পারে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন
সম্পর্কে ঐকমত্য না হলে সংঘাত-সহিংসতা এড়ানো যাবে না। নির্বাচন এগিয়ে আসার
সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে। নির্বাচনকালীন সংঘাত-সহিংসতা
নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে
দুর্বল করে তুলতে পারে। হোলি আর্টিজান বেকারির ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে ২০১৭ সাল
যখন শুরু হয়, তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিল, ২০১৭ সালেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে পারে।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানের ফলে
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম স্তিমিত ছিল। কিন্তু এর মানে এই নয়,
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস
অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষণা বলছে, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সাংগঠনিক
কার্যক্রম সংগোপনে অব্যাহত আছে। প্রায়শই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জঙ্গি
আস্তানার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। আগামী নির্বাচন
সামনে রেখে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো আবার তৎপর হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু
নির্বাচন গণতন্ত্রের একটা শক্তিশালী উপাদান এবং লক্ষণীয় প্রকাশ, ফলে
নির্বাচন যাতে নির্বিঘ্নে না হয়, সে লক্ষ্যে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো তৎপর থাকে। তা
ছাড়া তারা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের ফায়দা নেওয়ার সন্ধানে থাকে। ফলে
নির্বাচনের আগে, নির্বাচন চলাকালে ও নির্বাচনের পরের দিনগুলোতে জঙ্গি
তৎপরতা বাড়তে পারে। রোহিঙ্গা সংকট ২০১৮ সালেও আমাদের জন্য গভীর উদ্বেগের
কারণ হয়ে থাকবে। নির্মম অত্যাচারের শিকার রোহিঙ্গাদের প্রতি এ দেশের মানুষ
সহানুভূতিশীল হয়ে তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই সহানুভূতি
কমে আসবে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন স্থানীয় মানুষজন ইতিমধ্যে
রোহিঙ্গাদের এই উটকো আগমনের কারণে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করছে। প্রায়শই
তাদের ক্ষোভের কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গাদের
প্রত্যাবাসন বিষয়ে ইতিমধ্যে চুক্তি হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার
সংগঠনগুলো বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার অনুকূল পরিবেশ এখনো তৈরি
হয়নি। তা ছাড়া উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি না হলে রোহিঙ্গারাও ফিরে যেতে নারাজ।
আর চুক্তি অনুসারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যদি এখন শুরু হয়ও, সব রোহিঙ্গার
ফিরে যেতে কমপক্ষে এক দশক লেগে যাবে। মিয়ানমারে ভবিষ্যতে আরও সংঘাত হলে
আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হবে। রোহিঙ্গাদের আসার ফলে
বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের থাকা-খাওয়ার
প্রাথমিক দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর। ফলে এ দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে
পারে। কক্সবাজারের ডিস্ট্রিক্ট কমিশনারের অফিসের দেওয়া তথ্য অনুসারে প্রায়
৩ হাজার ৫০০ একর বনভূমি ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের আবাসনের জন্য বরাদ্দ করা
হয়েছে। পাহাড়ের গাছপালা কেটে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। ফলে সেখানকার
প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আসন্ন
বর্ষায় পাহাড়ে ভূমিধসে বিরাট মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। রোহিঙ্গারা এ
দেশে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে, তাদের মাদকদ্রব্য ও ক্ষুদ্রাস্ত্র
কেনাবেচা ও বহনের কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা পরিবার
বাংলাদেশে এসেছে পুরুষ সদস্য ছাড়া, সেসব পরিবারের নারী ও শিশুরা
আন্তরাষ্ট্রীয় পাচার চক্রের কবলে পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক ও দেশি
জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো জঙ্গি সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গাদের দিকে নজর দিতে পারে। এসব
কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন। নইলে এটা
বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর একটা দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ২০১৮ সালেও পরিবেশগত ঝুঁকিতে থাকবে। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, শক্তিশালী
সাইক্লোন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ঘটতে পারে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে
থাকবে এবং আবহাওয়ার ধরনেও পরিবর্তন ঘটবে। বাংলাদেশ শক্তিশালী ভূমিকম্পের
ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের শহরগুলো অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হয়েছে এবং
ভূমিকম্প-পরবর্তী বিপর্যয় মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা খুবই সীমিত। ফলে ঢাকার
কাছাকাছি শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে। সাইবার
নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। অধিকাংশ সাইবার
নিরাপত্তাকাঠামো দুর্বল এবং এ-সংক্রান্ত সক্ষমতা সীমিত। ২০১৮ সালেও ঝুঁকি
থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ বড় আকারে সাইবার ডাকাতির শিকার হয়েছিল। খোয়া
যাওয়া অর্থের অধিকাংশই এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে
সাইবার আক্রমণ বাড়ছে। সাইবার আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা ও আইনগত ব্যবস্থা
নেওয়া দুরূহ। ফলে সাইবার আক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আগামী সংসদ নির্বাচনকে
কেন্দ্র করে সাইবারস্পেসে নানা কারসাজির আশঙ্কা আছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের
ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজার আগের মতোই অস্থিতিশীল থাকবে। সম্প্রতি আমরা
শেয়ারবাজারের আংশিক পতন হতে দেখেছি। দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে
সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ খোয়া গেছে। বর্তমানে ফারমার্স
ব্যাংক প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় রয়েছে। গ্রাহকেরা নিজেদের মূলধন পর্যন্ত
তুলতে পারছে না। এ রকম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিগ্রস্ত পরিচালনা অব্যাহত
থাকলে এই সংকট বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। ব্যাংকিং খাতে
ব্যর্থতার ‘ডোমিনো ইফেক্ট’ সামগ্রিক আর্থিক খাতে পড়তে পারে। যদি
অনতিবিলম্বে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আমাদের পুরো আর্থিক খাত
অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক সামাজিক
নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়বে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নিজের
অনিচ্ছায় আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের শিকার হতে পারে। আমরা দেখেছি, গত বছরের শেষের
দিকে কয়েক মাস ধরে ভারত ও চীনের মধ্যে ভুটানের কাছের একটা ছোট জায়গা
‘দোকলাম’ নিয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অবস্থা যুদ্ধের দিকে মোড়
নেওয়ার সমূহ আশঙ্কা ছিল। যদিও অচলাবস্থা আপাতত কেটে গেছে, কিন্তু ২০১৮ সালে
নতুন করে আবার সংঘাত দেখা দিতে পারে। চীনের একটা সরকারি পত্রিকা লিখেছে,
২০১৮ সালে চীন সরকার আরও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে ‘দোকলাম’, জায়গাটা বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে
৯০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। জায়গাটা শিলিগুড়ি করিডরের কাছাকাছি অবস্থিত,
যেটা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে
কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং দেশ
দুটির কোনোটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ফলে, আমরা নিজেরা না চাইলেও,
সম্ভাব্য চীন-ভারত দ্বন্দ্বের ভুক্তভোগী হতে পারি। যদিও ২০১৭ সাল
তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল, কিন্তু ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু
নিরাপত্তাঝুঁকি রয়েছে। এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমাদের একটি
সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। বিকল্প পরিকল্পনাও তৈরি করে রাখতে হবে,
যদি মূল পরিকল্পনা কাজে না আসে। তাহলেই নিরাপত্তাঝুঁকিগুলো পুরোপুরি
নির্মূল করতে না পারলেও অনেকাংশেই মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি।
আ ন ম মুনীরুজ্জামান: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি।
No comments