গণতন্ত্রের সংকট-১- দুই-তৃতীয়াংশের শাসন কি অভিশাপ? by আলী রীয়াজ
সংসদীয় ব্যবস্থায় যেকোনো প্রধান রাজনৈতিক দলই চাইবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হতে, যাতে ওই দল দেশ শাসন করতে পারে।
নিরঙ্কুশ
সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা খুবই স্বাভাবিক। এই ধরনের
ফলাফলকে দলের নেতারা তাঁদের নেতৃত্বের সাফল্য বলেই বিবেচনা করে থাকেন।
কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ই ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট
হতে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে অন্য দলের সঙ্গে ক্ষমতা
ভাগাভাগি করতে হয়। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থায়
রাজনৈতিক দল কি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অতিরিক্ত, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে,
বিজয়ী হতে চায়? কোনো দেশে কোনো একক দল বা জোটের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী
হওয়া কি গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক?
দুই-তৃতীয়াংশ
কি আশীর্বাদ বা অভিশাপ? বাংলাদেশে উপর্যুপরি যখন তৃতীয়বারের মতো একটি সংসদ
‘নির্বাচিত’ হতে চলেছে, যেখানে ক্ষমতাসীনেরা দুই-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী
হবে, সেখানে এই প্রশ্নটি বিবেচনা করা জরুরি। বিবেচনা করা দরকার যে
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশ থেকে ভিন্ন কি না।
১৯৭১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মোট ৩৫টি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব দেশের সংসদীয় নির্বাচন হয়েছে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে, যার অর্থ হলো, প্রতিটি আসনে যে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাবেন, তিনি বিজয়ী হবেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী দল এমনকি সেই দল যদি সব মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না-ও পায়, সরকার গঠন করবে।
এর একমাত্র ব্যতিক্রম হলো শ্রীলঙ্কা; সে দেশে ১৯৭৮ সালের সংবিধান পরিবর্তন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ৩৫টি নির্বাচনের নয়টি হয়েছে বাংলাদেশে, ভারতে ১১টি, পাকিস্তানে আটটি ও শ্রীলঙ্কায় সাতটি। এসব নির্বাচনের মধ্যে ১১টি নির্বাচনে বিজয়ী দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রেই দুই-তৃতীয়াংশের শাসনে দেশটির অভিজ্ঞতা হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার, দেশে নাগরিক অধিকারের অবনতি ঘটেছে এবং সংবিধানের এমন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, যার রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশে এ ধরনের দুই-তৃতীয়াংশের সংসদ তৈরি হয়েছে ছয়বার, ভারতে দুবার, পাকিস্তানে দুবার ও শ্রীলঙ্কায় একবার।
দুই-তৃতীয়াংশের শাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পরিচয় ঘটে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই, দেশের প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংসদের ৯৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসন লাভ করে। এতে দলের পক্ষে সংবিধানের এতটাই পরিবর্তন সম্ভব হয় যে দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশটি একদলীয় ব্যবস্থায় উপনীত হয়। সংসদ তার নিজের মেয়াদকাল বর্ধিত করে নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দেশের গোটা শাসনকাঠামোই বদলে যায়।
১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ যে সংবিধান তৈরি করেছিল, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাতে নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুটি সংশোধনী—দ্বিতীয় ও চতুর্থ, কার্যত এসব অধিকার সীমিত করে দেয়। চতুর্থ সংশোধনী বিচার বিভাগকেও নির্বাহী বিভাগের অধীন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের শাসনের অবসান ঘটে নির্মম ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা-অভ্যুত্থানের সময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার ও তাঁর সহযোগী জাতীয় নেতাদের। বছরের শেষ পর্যন্ত দেশে অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিরতা চলতেই থাকে।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যার সৃষ্টি হয়েছিল সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, ৬৯ শতাংশ আসন লাভ করে। এই নির্বাচন গোড়া থেকেই সাজানো হয়, যেন তা সেনাশাসনকে বৈধতা দিতে পারে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে যেসব কার্যকলাপ করা হয়েছে, সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়, যার মধ্যে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল।
শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবিষয়ক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রকে স্থায়ীভাবে বদলে দেয় এই সংশোধনী। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আরেক সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে, তাতে প্রধান বিরোধী দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ নেয়নি। তাতে জেনারেল এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি ৮৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসনের অধিকারী হয়। এই নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষ থাকলেও শাসকেরা সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তৎকালীন বিরোধীরা যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে এই ধারা তুলে দেবে, কিন্তু তা আর কোনো দিনই বাংলাদেশের সংবিধান থেকে অপসৃত হয়নি।
তবে দুই-তৃতীয়াংশ বা সুপার মেজরিটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে ওঠে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে। সবচেয়ে কম ভোটারের সমর্থন নিয়ে গঠিত সংসদে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলই বিজয়ী হয়নি। কেননা, প্রধান সব দলই তা বর্জন করে। সংসদের ১০০ শতাংশ আসনে বিজয়ী বিএনপি স্বল্পতম সময়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়। এই সংশোধনী নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে; বিরোধী দলের চাপের মুখে তাড়াহুড়ো করে করা এই সংশোধনীর ব্যাপারে সংসদ আর কারও মতামতই নেয়নি এবং তা যে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার বীজ বপন করেছিল, ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই চারটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন ও তার ফলাফলকে আমরা ব্যত্যয় বলে ধরতে পারি এই বিবেচনায় যে সেগুলো হয়েছিল সেনাশাসনের আমলে সেসব শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে আমরা এই বলে বিবেচনার বাইরে রাখতে পারি যে তা ছিল বিরোধীদের চাপের মুখে এবং সেই সংসদ দেশ শাসনের চেষ্টা করেনি।
কিন্তু এসব কোনো বিবেচনাই আমরা তৈরি করতে পারি না ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের ব্যাপারে। সবচেয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ বলে যে নির্বাচনগুলোকে মনে করা হয়, তার মধ্যে এই দুই নির্বাচন অন্যতম। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪-দলীয় জোট ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই সরকারের আমলে দেশে ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের ঘটনাই শুধু ঘটেনি, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন বিচারককে বসানোর উদ্দেশ্যে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস করা হয়, যাতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়ানো হয়। এতে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূচনা হয়, তার পরিণতিতেই ২০০৭ সালের নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দুই বছর দেশ শাসন করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট; তাদের প্রাপ্ত আসনের পরিমাণ ৮১ শতাংশ। নির্বাচনের তিন বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটি, যার সব সদস্যই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের, এই ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিলেও আদালতের একটি রায়ের ওপরে আংশিকভাবে নির্ভর করে এই ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানোর কারণে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করছে এবং দেশজুড়ে এক সহিংস অস্থিরতার সূচনা হয়েছে।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের সেনাশাসকেরা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের জোরে সংবিধানের যত পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, দেশের বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো তা থেকে মোটেই পিছিয়ে থাকেনি।
১৯৭১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চার দশকে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ—বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মোট ৩৫টি সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব দেশের সংসদীয় নির্বাচন হয়েছে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে, যার অর্থ হলো, প্রতিটি আসনে যে প্রার্থী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাবেন, তিনি বিজয়ী হবেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী দল এমনকি সেই দল যদি সব মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না-ও পায়, সরকার গঠন করবে।
এর একমাত্র ব্যতিক্রম হলো শ্রীলঙ্কা; সে দেশে ১৯৭৮ সালের সংবিধান পরিবর্তন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব-ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই ৩৫টি নির্বাচনের নয়টি হয়েছে বাংলাদেশে, ভারতে ১১টি, পাকিস্তানে আটটি ও শ্রীলঙ্কায় সাতটি। এসব নির্বাচনের মধ্যে ১১টি নির্বাচনে বিজয়ী দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি ক্ষেত্রেই দুই-তৃতীয়াংশের শাসনে দেশটির অভিজ্ঞতা হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার, দেশে নাগরিক অধিকারের অবনতি ঘটেছে এবং সংবিধানের এমন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, যার রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশে এ ধরনের দুই-তৃতীয়াংশের সংসদ তৈরি হয়েছে ছয়বার, ভারতে দুবার, পাকিস্তানে দুবার ও শ্রীলঙ্কায় একবার।
দুই-তৃতীয়াংশের শাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পরিচয় ঘটে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই, দেশের প্রথম নির্বাচনে ১৯৭৩ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংসদের ৯৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসন লাভ করে। এতে দলের পক্ষে সংবিধানের এতটাই পরিবর্তন সম্ভব হয় যে দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশটি একদলীয় ব্যবস্থায় উপনীত হয়। সংসদ তার নিজের মেয়াদকাল বর্ধিত করে নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দেশের গোটা শাসনকাঠামোই বদলে যায়।
১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ যে সংবিধান তৈরি করেছিল, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাতে নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু দুটি সংশোধনী—দ্বিতীয় ও চতুর্থ, কার্যত এসব অধিকার সীমিত করে দেয়। চতুর্থ সংশোধনী বিচার বিভাগকেও নির্বাহী বিভাগের অধীন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের শাসনের অবসান ঘটে নির্মম ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা-অভ্যুত্থানের সময় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিব, তাঁর পরিবার ও তাঁর সহযোগী জাতীয় নেতাদের। বছরের শেষ পর্যন্ত দেশে অভ্যুত্থান ও পাল্টা-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে অস্থিরতা চলতেই থাকে।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যার সৃষ্টি হয়েছিল সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, ৬৯ শতাংশ আসন লাভ করে। এই নির্বাচন গোড়া থেকেই সাজানো হয়, যেন তা সেনাশাসনকে বৈধতা দিতে পারে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে যেসব কার্যকলাপ করা হয়েছে, সেগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়, যার মধ্যে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা পর্যন্ত ছিল।
শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবিষয়ক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্রকে স্থায়ীভাবে বদলে দেয় এই সংশোধনী। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আরেক সেনাশাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে, তাতে প্রধান বিরোধী দলগুলো যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশ নেয়নি। তাতে জেনারেল এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি ৮৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসনের অধিকারী হয়। এই নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষ থাকলেও শাসকেরা সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তৎকালীন বিরোধীরা যদিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা ক্ষমতায় গেলে এই ধারা তুলে দেবে, কিন্তু তা আর কোনো দিনই বাংলাদেশের সংবিধান থেকে অপসৃত হয়নি।
তবে দুই-তৃতীয়াংশ বা সুপার মেজরিটির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে ওঠে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের আমলে। সবচেয়ে কম ভোটারের সমর্থন নিয়ে গঠিত সংসদে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলই বিজয়ী হয়নি। কেননা, প্রধান সব দলই তা বর্জন করে। সংসদের ১০০ শতাংশ আসনে বিজয়ী বিএনপি স্বল্পতম সময়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায়। এই সংশোধনী নির্বাচনকালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে; বিরোধী দলের চাপের মুখে তাড়াহুড়ো করে করা এই সংশোধনীর ব্যাপারে সংসদ আর কারও মতামতই নেয়নি এবং তা যে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার বীজ বপন করেছিল, ২০১৩ সালে এসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই চারটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন ও তার ফলাফলকে আমরা ব্যত্যয় বলে ধরতে পারি এই বিবেচনায় যে সেগুলো হয়েছিল সেনাশাসনের আমলে সেসব শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনকে আমরা এই বলে বিবেচনার বাইরে রাখতে পারি যে তা ছিল বিরোধীদের চাপের মুখে এবং সেই সংসদ দেশ শাসনের চেষ্টা করেনি।
কিন্তু এসব কোনো বিবেচনাই আমরা তৈরি করতে পারি না ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের ব্যাপারে। সবচেয়ে সুষ্ঠু ও অবাধ বলে যে নির্বাচনগুলোকে মনে করা হয়, তার মধ্যে এই দুই নির্বাচন অন্যতম। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪-দলীয় জোট ৭০ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসনে বিজয়ী হয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই সরকারের আমলে দেশে ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের ঘটনাই শুধু ঘটেনি, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন বিচারককে বসানোর উদ্দেশ্যে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস করা হয়, যাতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা বাড়ানো হয়। এতে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থার সূচনা হয়, তার পরিণতিতেই ২০০৭ সালের নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দুই বছর দেশ শাসন করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট; তাদের প্রাপ্ত আসনের পরিমাণ ৮১ শতাংশ। নির্বাচনের তিন বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটায়। সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত সংসদীয় কমিটি, যার সব সদস্যই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের, এই ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিলেও আদালতের একটি রায়ের ওপরে আংশিকভাবে নির্ভর করে এই ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানোর কারণে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করছে এবং দেশজুড়ে এক সহিংস অস্থিরতার সূচনা হয়েছে।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের সেনাশাসকেরা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের জোরে সংবিধানের যত পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, দেশের বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলো তা থেকে মোটেই পিছিয়ে থাকেনি।
আলী রীয়াজ: গণনীতিবিষয়ক গবেষক, উড্রো উইলসন সেন্টার, ওয়াশিংটন।
No comments