বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর কি হাসতে পারে?
সময়টা খুব খারাপ। আমরা পথে বের হতে পারি না, স্কুল-কলেজ-কর্মস্থলে যেতে পারি না, আমাদের জিম্মি করে রাখা হয়েছে, যেমন করে বিমান হাইজ্যাক করে তার যাত্রীদের বন্দী করা হয়। কারণ, যারা বিমান হাইজ্যাক করেছেন, তাঁদের আছে কতগুলো ন্যায়সংগত দাবি, সেগুলো তাঁদের আদায় করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে জিম্মি করে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ পবিত্র উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে। কারও কোনো বিকার নেই। যেন এই অবস্থা চলতেই থাকবে। শুধু আমারটা আমি পেয়ে গেলেই হলো। এই রকম ঘোরতর দুঃসময়ে আমরা কী করতে পারি? আমরা চুল ছিঁড়তে পারি, কান্নাকাটি করতে পারি, গালিগালাজও করতে পারি। কিন্তু মুক্তির পথ আমাদের নেই। আমাদের মরতেই হবে। কীভাবে মরব, সেটাও আমরা জানি না। আমরা পেট্রলের আগুনে মরতে পারি, বোমার আঘাতে মরতে পারি, পুলিশের গুলিতেও মরতে পারি। এই রকম খারাপ সময়ে আমি যদি কৌতুক পরিবেশন করি, আপনারা কি আমাকে ক্ষমা করবেন? জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন সুবিনয় মুস্তফীর কথা, তিনি নাকি একই সঙ্গে বিড়ালকে আর বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরকে হাসাতে পারতেন। আমরা তো বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুর, আমাদের কি হাসার অধিকার আছে? একটা কৌতুক আগে বলে নিই। একজন ভদ্রলোক গাড়ি চালাচ্ছেন।
বিপরীত দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে, সেটা চালাচ্ছেন আরেক ভদ্রলোক। দুজনের গাড়িরই গতি ছিল ভীষণ। গাড়ি দুটো মুখোমুখি সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে চালক দুজন ধ্বংসস্তূপ থেকে মোটামুটি অক্ষত শরীরে বেরিয়ে আসতে পারলেন। প্রথমজন বললেন, আমাদের গাড়ি দুটো একেবারে শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা বেঁচে গেছি। এটা নিশ্চয়ই ঈশ্বরের একটা ইঙ্গিত। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। নিশ্চয়ই ওপরওয়ালা চান আমরা বন্ধুত্ব করি। কার দোষ, এই নিয়ে বাদানুবাদ নিশ্চয়ই এখন কাম্য নয়। দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। প্রথম ভদ্রলোক তখন ধ্বংসস্তূপ থেকে অক্ষত একটা হুইস্কির বোতল বের করলেন। বললেন, আশ্চর্য তো, এই বোতলটা অক্ষত আছে। এটাও নিশ্চয়ই একটা ইঙ্গিত। আমাদের উচিত পান করে আমাদের নতুন বন্ধুত্ব উদ্যাপন করা। দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, তা-ই হবে। তিনি বোতলের মুখ খুলে খানিকটা পান করে প্রথমজনের দিকে এগিয়ে দিলেন বোতলটা। এবার আপনার পালা। প্রথমজন বললেন, জি না, আমি খাব না। আমি পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছি। পুলিশ আসছে। মানে, পুলিশ এসে দ্বিতীয় ভদ্রলোকের মুখে গন্ধ পাবে, তারপর মাতাল হয়ে ড্রাইভ করার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করবে।
আমাদের দেশ মোটামুটি বিধ্বস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ। অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায়। দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে এই অবস্থা হয়েছে। এখন এঁদের মধ্যে আপনি কাকে দায়ী করবেন? খুবই পুরোনো একটা কৌতুক। রাজনীতি কী? ছোট্ট জনি জানতে চাইল। বাবা বললেন, রাজনীতি কী বুঝতে চাও। ধরো, আমি হলাম সরকার। তোমার মা হলো পার্লামেন্ট। আর আমাদের কাজের মেয়েটা হলো শ্রমজীবী মানুষ। তুমি হলে দেশের জনগণ। তোমার ছোট্ট ভাইটি হলো দেশের ভবিষ্যৎ। বুঝলে? না। বুঝিনি। আচ্ছা ঘুমাও। পরে তোমাকে বোঝাব। জনি ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের বেলা তার ঘুম ভাঙল ছোট ভাইয়ের কান্নাকাটিতে। সে উঠে দেখল, ছোট্ট ভাইটি পেশাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে কাঁদছে। সে তখন মাকে ডাকতে গেল। উঁকি দিয়ে দেখল, মা ঘুমোচ্ছে। সে গেল কাজের মেয়েকে দেখতে। দেখতে পেল, তার বাবা কাজের মেয়েটাকে নিপীড়ন করছে। সে তখন বলল, বুঝেছি। রাজনীতি কী। জনগণ যখন কষ্ট পাচ্ছে, পার্লামেন্ট তখন ঘুমোচ্ছে, সরকার তখন শ্রমজীবী মানুষের ওপরে অত্যাচার করছে, আর দেশের ভবিষ্যৎ তখন গুয়ে-মুতে ভেসে যাচ্ছে। এবার একটা কৌতুক, যেটা ওয়ান-ইলেভেনের পরে এই কলামে আমি আপনাদের জানিয়েছিলাম। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। খুব কড়াকড়ি। অবৈধ দোকানপাট-স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এই সময় কোনো এক গ্রামের পথে এক লোক সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। তাকে যৌথ বাহিনী আটকাল। বলল, তোমার সাইকেলের লাইসেন্স আছে? না।
তুমি একবার কানে ধরে ওঠবস করো। লোকটা কানে ধরে ১০ বার ওঠবস করল। তোমাকে একবার ওঠবস করতে বলা হলো, তুমি ১০ বার করলে কেন। লোকটা বলল, একবার করলাম সাইকেলের লাইসেন্স নেই বলে, আর নয়বার করলাম অমুক মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম বলে। একই লোককে এবার ধরা হয়েছে। সে এবার রাস্তার ডান পাশ দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল। তাকে বলা হলো, একবার কানে ধরে ওঠবস করো। সে ১০০ বার কানে ধরে উঠবস করছে। একবার সে করল ডান দিক দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল বলে, আর ৯৯ বার করল অমুক মার্কায় ভোট দিয়েছিল বলে। আমাদের সরকার বড়ই সুবিবেচক। কোনো একটা মার্কায় ভোট দেওয়ার কারণে দেশের কোনো নাগরিককে যাতে আর বিবেকের দংশনে ভুগতে না হয়, সে ব্যবস্থা তারা করে ফেলেছে। এমন পদ্ধতি তারা আবিষ্কার করেছে, যাতে কাউকে আর ভোট দিতে যেতে না হয়। আর পরবর্তী বছরগুলোতে প্রত্যাশাভঙ্গের বেদনায় বা কৃতকর্মের অনুশোচনায় জ্বলতে না হয়। কারণ, আমরা অনেক সময় বলি, আমাদের এই দুরবস্থার জন্য আমরাই দায়ী। আমরাই তো ভোট দিয়ে দিয়ে এদের নেতা বানাই। আমাদের সেই সমস্যা আর রইল না। আমাদের আর নেতা বানাতে হবে না। শাসক বানাতে হবে না। শাসক কারা হবেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের যোগ্যতাবলে ঠিক করে নিয়েছেন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments