শিকার by শেখ লুৎফর
চড়া দামে হাইব্রিড ধানের বীজ কিনবে কি কিনবে না, এই দ্বিধায় দুলতে-দুলতে বুড়ো মন্তু সার-বীজের দোকানের কাছে এসেও থপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেই সকাল থেকে তার শরীরজুড়ে কেমন একটা ল্যাপ্টাঝ্যাপ্টা অসাড়তা। দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে মন্তু ভুস করে একটা দম ছাড়ে। চোখে ভাসে অকর্মা ছেলে দুটোর মুখ আর তাতেই মন্তুর মনমর্জি আরও বিগড়ে যায়। কার জন্য সে খাটবে, কার জন্য এই হাইব্রিড ধানের বীজ? মানুষটা তার নিজের অজান্তে হাত দুটো কোলের ওপর ভাঁজ করে রেখে দুটো চোখের চাউনি চিলের মতো সরু-শানিত করে বাজারের চারপাশটা দেখে; কী গোপন আমোদেই না অঘ্রাণের এই দুপুরটা উড়াল দিতে চাইছে! একহারা পিচ রাস্তাটা দুই পাশের ফসলভরা মাঠের মাঝে হঠাৎ হেঁচকি মেরে গজিয়ে-ওঠা বাজারটাকে দুই ফালা করে সোজা নাক বরাবর ছুটে গেছে। অঘ্রাণের এই আমেজি দুপুরে বাজারের দোকানগুলোর ঝাঁপ খোলা থাকলেও লোকজন তেমন একটা নেই। শুধু সার-বীজের একমাত্র দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আশপাশের গেরামের কয়েকটা চাষা। মন্তুর শরীরটা কেমন টালমাটাল; উদ্গারের আগে যেমন হয়। তবু সে মাথা তুলে ফের বাজারের সবটা পরখ করে—আজ কত দিন! কত দিন...অর্জনহীন নিষ্ফলা জীবন লবণ-লঙ্কা ছাড়া পান্তাভাতের মতো। হঠাৎ মন্তু চমকে ওঠে, বাজারের দক্ষিণ দিকের সেলুনটায় ও কে? দুই হাত মুঠো করে মন্তু শিশুর মতো চোখ দুটো কচলায়। কয় হাত দূরের মানুষের মুখ চিনতে কেমন বেজান-বেজান লাগে। সেলুনে বসে ক্ষুরের নিচে গাল পেতে আছে; মানুষটা ক্যাডা, হবিবুল্লা না? চমক-খাওয়া মন্তুর কোটরগত চোখ দুটো ঝলকে ওঠে। আর মন্তু এও লক্ষ করে, সেলুনে বসে হবিবুল্লা খুব মউজ করে আলাপ করছে। মন্তু পুচ করে থুথু ফেলে। আঁত-নাড়ির গভীর থেকে তেতো ঢেকুর আসছে।
সেই কখন ল্যাড়ের মতো পাতলা কয় চামচ জাউ খেয়েছে, তাতেও এখনো তার পেটটা টক টক বিস্বাদে ভরে আছে। শাকচুন্নির মতো তার বুড়ি মাগিটা খালি কথায় কথায় বিষ ঢালে। ঘরে মুহূর্তের জন্যও মন্তু টিকতে পারে না। আর তার জোয়ান পুলা দুটো...। ছেলেদের কথা মনে পড়তেই মন্তুর হাত দুটো শিরশির করে ওঠে। কুপুত্রের রক্তে যদি তার হাত দুটো ভেজাতে পারত! কিন্তু তা কী করে হয়? মন্তু খক করে বড় একটা কফের দলা ফেলে ফের সেলুনটার দিকে তাকিয়ে আড়ে-আড়ে হবিবুল্লাকে দেখে। বর্তমানে গেরামের অনেকেই হবিবুল্লার মতো নগদ মালপানিতে ঝিলঝিলা। মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া আর আরবের টাকা এখন তার আশপাশেও কড়-কড় করে নাচে।...আর এই মুহূর্তে সে ওই টাকার কথা ভাবতে-ভাবতেই কি কিঞ্চিৎ ভড়কে গেল? একটা জটিল স্রোত সময়কে যেন ঠেলা দিয়ে হড়কে যায় আর তাই তো মন্তুর ভেতরটাও এলোমেলো হয়ে ওঠে। সে আবার হবিবুল্লাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। হবিবুল্লার দু-দুটো পোলা আরব দেশে, আর ছোটটা ঢাকার কোনো এক ফ্যাক্টরির পিও না এমও পদে। সকাল থেকে সন্ধ্যাতক হবিবুল্লা পাক দিয়ে পাক দিয়ে বাজারে ওঠে। ফিনফিনা পাঞ্জাবির পরতে-পরতে কারদানি ফুটে থাকে। মন্তু যেন ভেতরে-ভেতরে কিসের একটা তাড়া বোধ করে। কী একটা জিনিস যেন আউলাঝাউলা হয়ে আছে, একটু সিজিল করতে হয়। মানুষটাকে লোকে আগে হাইব্ব্যা বলেই ডাকত, কিন্তু হাতে মালপানি আসতে না আসতেই সে এখন হবিবুল্লা। সালামালাইকুম—মন্তু সালাম দিয়ে হবিবুল্লার সামনে দাঁড়ায়। তাহলে মন্তু ট্যাং ট্যাং করে হাঁটতে হাঁটতে তার ভাবনার পরিধি ধরতে পেরেছে—এমন চিন্তায় সে মনে মনে খুশি হয়। সদ্য চুল-দাড়ি ছাঁটা হবিবুল্লা ঝেড়েঝুড়ে সাফ হচ্ছে; সালামের শব্দে একটু তড়িতে মাথা তুলে মন্তুকে দেখে। দোমড়ানো শরীরের মন্তু তিন বাঁকা দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে আলাপের গলা বাড়িয়ে আছে দেখে হবিবুল্লা প্রথমে একটু অবাক হয়। সে একটু ধিড়িক ধরে জিজ্ঞেস করে
—কেমুন আছেন?
—ভালাই আছি, কিন্তুক তুমি এই দিকে ক্যা?
—না, কয়ডা হাইব্রিড বীজ কিনতে আইছিলাম।
—হ, অহন তো হাইব্রিডেরই যুগ..., ফলন বেশি, সার বেশি...সব বেশি বেশি লাগে।
হবিবুল্লা লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে মাথা তোলে। আর এই ফাঁকে সেলুনের আয়নায় মন্তুর নিজের মুখাবয়ব চোখে পড়ে, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সে।
—ক্যাডা এইডা? তাহলে এই সে! কত বছর, কত যুগ পর সে নিজেকে নিজে দেখে ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যায়। হলুদ কেতুরভরা চোখ দুটোর মাঝে শকুনের ঠোঁটের মতো নাকটা। চুল-চামড়া আর শরীরের যা অবস্থা, তাতে সে একটা নিখাদ ভিক্ষুক, না একটা শকুন, না, না—একটা উপমাও তার মনমতো হলো না; এক নজরে সে আয়নায় যে মূর্তিটা দেখেছে, আসলে সেটা একটা বুড়ো সাপ, ক্রোধহীন বিদ্বেষে ক্লান্ত। সারবাঁধা দোকানের সামনে দিয়ে হবিবুল্লা বাজারের উত্তর দিকে হাঁটে। একটু বে-ভুলা ছন্দে ডাঁশ মাছির মতো হুলে বিষ ও তৃষ্ণা নিয়ে মন্তুও পেছন পেছন ট্যাং ট্যাং করে হাঁটে। কানাইয়ের স্টলের সামনে এসে হবিবুল্লা অপেক্ষা করে, দক্ষিণ থেকে একটা ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে আসছে। উড়ন্ত ধুলা থেকে রক্ষা পেতে হবিবুল্লা বাঁ হাতে নাক চেপে ধরে। মন্তুর কোনো প্রস্তুতি নেই। সে ঝিম মেরে আছে। আসলে বুড়োটা ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাচ্ছে, যা তার নিরীহ মুখ দেখে কেউ কস্মিনকালেও ভাবতে পারবে না। হবিবুল্লার ঘাড়ে একটা মাঝারি ভাঁজ পড়েছে, যদিও এটাই তার বর্তমান সুখী জীবনের একমাত্র সাইনবোর্ড নয়, কিন্তু মন্তুর কাছে আপাতত এটাই অসহনীয়। হবিবুল্লার এই অর্জনটি যেন চারপাশের গ্রামগুলোর সব মন্তুকে সারাক্ষণ টিটকারি দেয়, আর নিজের সুখের বিস্তর বয়ান করে।
—অ-মন্তু খাড়ায়া রইলা ক্যা, বও।
—জে, জে।
—তোমার পোলারা অহন কোনডা কোন দিকে?
হবিবুল্লার কথায় মন্তু কানাইয়ের স্টলের টুলে বসতে-বসতে চোখ দুটোতে ঝামরি কেটে তীক্ষ-সচেতন হয়ে ওঠে।
—বুঝলা মন্তু, খালি হাইব্রিড বীজ কিনলে কি অইবো, সার-কীটনাশক-ডিজেলের বাজার দ্যাহো না কত গরম।
—জে, আফনে হাচা কইছেন।
মন্তু অবোধ বালকের মতো সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
—খালি কিনলে ত অইত না, টাইমমতো হেগোর খাওন-পানি জুগাইতে অইব।
—অবশ্যি...অবশ্যি... মন্তু প্রাজ্ঞ কৃষকের মতো মাথা নাড়ে। আসলে মন্তু ভিত্তে-ভিত্তে পুরা প্রস্তুত; এখন শুধু ছোবলের ক্ষেত্রটি তৈরি করতে তাকে যা মুখ চবলাতে হচ্ছে।
—অ-কানাই, দুইডা চা দ্যাচা। রইদে বইবানি মন্তু, রইডা বড় মজার। হবিবুল্লার কাছে তামাম দুনিয়াটাই মজার। দামি সোয়েটারটা সে হাতে তুলে নেয়, যেটা চুল কাটার আগেই সে খুলেছিল। ওর খাবলা-ধরা কালচে আঙুলে সোয়েটারটার রঙিন চেকনাই ঝলক দেয়। কত আর হবে, এই সাত-আট সাল আগেও হবিবুল্লা একটা মেইড়-ভাঙা চাষা ছিল, তারও আগে এই পিচ পথটা যখন আধা জংলা-গোপাট, তখন বালক মন্তুরা দুই মাইল দূরের চন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতনে যাওয়ার জন্য এই গোপাটে এসে মিলিত হতো। ঢ্যাঙা-লিকলিকে, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক-পরা হ্যাবলা হইব্ব্যা চারপাশের জংলার হিয়াল-বান্দরের ডরে দলের মধ্যে থেকেও কেমুন ভ্যা-ভ্যা করত। আর অহন...হবিবুল্লার বাড়িটা দালান হয়ে গেছে। মাঠে ফসলের মেলা জমিও কিনেছে, আর ইজ্জতটাই কি কারও চেয়ে কম? স্টলের ঝাঁপের নিচের বেঞ্চিতে এসে ওরা রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। কচি ছেলের দুধদাঁতের কামড়ের মতো অঘ্রাণের রোদ ওদের পিঠে তুরতুরি আরাম জাগায়।
—আপনের ছেলেগুলান খুব লায়েকমান। মন্তু আলাপ জুড়ে। চোখে ভাসে তার নিজের আচোদা পোলা দুটোর মুখ। সর্বদিক দিয়ে একেবারে পয়মাল করে দিল। সেই রাগেই তো মন্তু আর তেমন করে চাষবাস করে না। পেটের দায়ে আর বুড়িটার কুদাম-পাদামে ঘরে টিকতে পারে না বলেই তো সে হাল-গরু নিয়ে মাঠে নামে; না-হলে ঘুরে-ঘেঁটে বাকি জিন্দিগিটা কাটিয়ে দিত।
—তোমার পোলা দুইডার খবর কী?
—না, আগের মতোই। একটা পল্টিফার্মে আছিন, হেইহানত্তেই ছুরতুনের ছেমড়িডারে লইয়া ভাগছে।...অহন আর কোনো তত্ত্ব-তালাশ জানি না। আর ছোট্ট পোলাডা কাঠের কাম ভালাই শিখছিল, কিন্তুক কামের চে আড্ডাবাজিই বেশি পছন্দ।
—হ, বাজারেও হেরে বেশি বেশি দ্যাহি; তাইলে কাম করে কোন টাইমে? হবিবুল্লা মন্তুর কথায় সাক্ষ্য দেয়। ফের আফসোসও করে, হেইডা আমারেও একটা শোকেস বানায়া দিছিন, জিনিসটা যা সুন্দর অইছে না। পোলাডা যুদিন ঠিকমতন কাম করত... তারা এখন চায়ে চুমুক দিয়ে চুক-চুক করে স্বাদ নিচ্ছে। গরুর চোনার মতো লেশমা-লেশমা শেষ বাজারের কড়া চা। আপাত এই পান নীরবতায় উল্টা দিকের ফোনের দোকান থেকে একজনের রাগী গলার হাঁকডাক তাদের মাঝে বারবার হামলে পড়ে। মন্তু আন্দাজে ধরে নেয়, লোকটা ফোনের ওপাশের মানুষটাকে খুব নিচ্ছে। অপরিচিত সেই ব্যক্তির নাজেহাল চেহারাটা যেন সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। পোলা দুটোর জন্য সেও কি কম ভুগতেছে। যত মারো-কাটো, মন্তু কিন্তু পিটপিট করে হাসবে, আর সুবিধামতো ছোবল দেওয়ার জন্য ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাবে। যত দিন না কাম হাসিল হবে, তত দিন সে শিকারের পেছনে নিষ্ঠাবান তাপস। হবিবুল্লা কাপটা ঠাস করে নামিয়ে রাখে। মন্তু চমকে ওঠে। লোকটা কি হুদাহুদিই গরম হয়ে যাচ্ছে? মালদার মানুষের মতিগতি আন্দাজ করা শক্ত। যেই কথা, সেই কাজ। হবিবুল্লা বিষাক্ত গলায় বলে, তুমিই পোলা দুইডারে নষ্ট করছ। বাপ হিসাবে তুমি কী শাসনডা করলা। ডাক-ডাক করতে করতে হেরা পয়মাল হয়ে গেল। মন্তুর মাথাটা ঝিমঝিম করে, চোখের সামনের সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
—বাদ দেন, বাদ দেন হেই চ্যাট-মুইক্ষ্যা পোলাগর কথা। আফনার নিজের আলাপ করেন, হুনতেও সুখ। হুনলাম আফনের ছোডো পালারে নাকি ঢাকায় শাদি করাইছেন। ছোট্ট পুত্রবধূর মিষ্টিমুখ আর বেয়াইয়ের ছবির মতো ঝকমকা দালানটার কথা মনে হতেই তৃপ্তির ঢেকুরে হবিবুল্লা শীতল হয়ে আসে। তার ঘাড়ের চর্বির মোটা ভাঁজটি তেল-ময়লাসহ রোদের জেল্লায় চকচক করে। মন্তুর ইচ্ছা হয়, প্রকাশ্যেই সেখানে দাঁত বসিয়ে দিতে। হবিবুল্লার মুখের পান-সুপারি জুত হয়ে এলে সে পকেট থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ধরানোর উদ্যোগ নেয়।
—হ, হেরা খুব মালদার পাট্টি, হেদের তুল্যে আমি কিচ্ছু না, কিন্তুক আমার পোলারে তারা খুব পছন্দ করছে, হেই ভরসাতেই কামডা সামুটতা পাড়ছি।
—আর বড় দুইজনরে? মন্তু একটু-একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে।
—বড় দুই ছেলে সামনের সন বাড়িত আসলেই...
—হেই দেশটা খুব ধনী মাইনষের, না?
—তুমি যে কী কও, ধনী না হইলে কি আর হেরা শখ কইরা বিদেশতে মানুষ নেয়।
—অইব...অইব...। মন্তু আমতা-আমতা করে আর পিট পিট করে হাসে। এই হাসিটা তার আসল অস্ত্র। পায়ে উষ্টা দিয়ে ফেলে দিলেও ওই হাবড়া মুখটা থেকে হাসিটা মুছে ফেলা যায় না।
—তে আফনের বড় মেয়ের জামাইয়ের খবর কী? এই কথায় হবিবুল্লা বজ্রাহতের মতো নির্বাক চেয়ে থাকে। তার বড় মেয়ের জামাই এখন কারাগারে। বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে বন্দী। বড় কঠিন বিচারের সম্মুুখীন। হবিবুল্লার খাড়া মাথাটা ঝপাস করে বুকের কাছে নুয়ে পড়ে। তার ঘাড়ের মোটা-গম্ভীর ভাঁজটি কেমন মেন্দা মেরে যায়। মন্তু নিজেকে দিয়ে বোঝে, বাপ সন্তানের জন্য কতটুকু দরদ রাখে। হবিবুল্লার সেই গোপন জাগাটার খবর পাওয়াতক মন্তুর দাঁত শিরশির করছিল। দুই-তিন মাসের মধ্যে এমন বড় শিকার সে ধরতে পারেনি। কষ্ট ছাড়া তার জীবনে আর কিচ্ছু প্রাপ্তি নেই। তার সব গোল্লায় গেছে। দিনে দিনে বুড়ি মাগিটা একটা ঝগড়াটে শাকচুন্নিতে পরিণত হয়েছে। যা কিছু জমি আছে, তাও উপযুক্ত চাষ ও যত্নের অভাবে তামাদি হয়ে গেছে। তাই মুফতে যা মেলে তাতেই সুখ, আর সেটুকুই তার সব না-পাওয়ার পাওয়া।
—তে কইলেন না জামাইয়ের খবর কী? জোশ-রোষহীন হবিবুল্লা মরা শরীরটা যেন পাথরের মতো টেনে তুলে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না বলে নুয়ে-নুয়ে বাড়ির পথ ধরে। চরম প্রশান্তির মাঝে মন্তুর খুব শখ হয়, একবার ডাক দিয়ে হবিবুল্লাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই মিয়া সাব, কিছু হারাইছেন নাকি?’ কিন্তু তার পেছনে একটা জিপ ক্যাচ করে ব্রেক কষার শব্দে সে ফিরে তাকায়। হাতে দড়ি, হ্যান্ডকাফ আর তেলতেলা রুল নিয়ে কয়টা পুলিশ জিপ থেকে নামছে। একজন তার দিকে কড়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, হালিমের বাপ মন্তুর বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো? মন্তুর মুখে তৃপ্তি জড়ানো চিলবিল হাসিটি এখনো লেগে আছে; সেই হাসি নিয়েই ভয়ে ভয়ে সে উল্টা প্রশ্ন করে, কেন...। খাটো কিন্তু ধামার মতো ভোটকা যে লোকটা একপাশে দাঁড়িয়ে, তাকে নীরবে পরখ করছিল, সে বলে—কেন, জানস না? বাইনচোদটারে শ্বশুরবাড়িত নিতাম দাওয়াত খাওয়াইতে, খানকির পুত ক্যাশবাক্স ভাইঙ্গা ট্যাহাও নিছে, লগে কামের ছেমড়িডারেও নিছে। মন্তু একনিমিষে সব বুঝে নেয় আর চিনে নেয় তার পোলার পল্টিফার্মের মালিককেও। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে বলে, কী যে কন, পারতাম না ক্যা, আইয়েন হালিমের বাফের বাড়িডা দ্যাহায়া দিতাছি। মন্তু সবার আগে ঝুলতে ঝুলতে হাঁটে, আর তার পেছনে কয় জোড়া প্রশিক্ষিত পা ভারী বুটের মচমচ শব্দ তুলে হালিমের বাপ মন্তুর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তাদের শিকারটি হস্তগত করার জন্য।
—কেমুন আছেন?
—ভালাই আছি, কিন্তুক তুমি এই দিকে ক্যা?
—না, কয়ডা হাইব্রিড বীজ কিনতে আইছিলাম।
—হ, অহন তো হাইব্রিডেরই যুগ..., ফলন বেশি, সার বেশি...সব বেশি বেশি লাগে।
হবিবুল্লা লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে মাথা তোলে। আর এই ফাঁকে সেলুনের আয়নায় মন্তুর নিজের মুখাবয়ব চোখে পড়ে, ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সে।
—ক্যাডা এইডা? তাহলে এই সে! কত বছর, কত যুগ পর সে নিজেকে নিজে দেখে ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যায়। হলুদ কেতুরভরা চোখ দুটোর মাঝে শকুনের ঠোঁটের মতো নাকটা। চুল-চামড়া আর শরীরের যা অবস্থা, তাতে সে একটা নিখাদ ভিক্ষুক, না একটা শকুন, না, না—একটা উপমাও তার মনমতো হলো না; এক নজরে সে আয়নায় যে মূর্তিটা দেখেছে, আসলে সেটা একটা বুড়ো সাপ, ক্রোধহীন বিদ্বেষে ক্লান্ত। সারবাঁধা দোকানের সামনে দিয়ে হবিবুল্লা বাজারের উত্তর দিকে হাঁটে। একটু বে-ভুলা ছন্দে ডাঁশ মাছির মতো হুলে বিষ ও তৃষ্ণা নিয়ে মন্তুও পেছন পেছন ট্যাং ট্যাং করে হাঁটে। কানাইয়ের স্টলের সামনে এসে হবিবুল্লা অপেক্ষা করে, দক্ষিণ থেকে একটা ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে আসছে। উড়ন্ত ধুলা থেকে রক্ষা পেতে হবিবুল্লা বাঁ হাতে নাক চেপে ধরে। মন্তুর কোনো প্রস্তুতি নেই। সে ঝিম মেরে আছে। আসলে বুড়োটা ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাচ্ছে, যা তার নিরীহ মুখ দেখে কেউ কস্মিনকালেও ভাবতে পারবে না। হবিবুল্লার ঘাড়ে একটা মাঝারি ভাঁজ পড়েছে, যদিও এটাই তার বর্তমান সুখী জীবনের একমাত্র সাইনবোর্ড নয়, কিন্তু মন্তুর কাছে আপাতত এটাই অসহনীয়। হবিবুল্লার এই অর্জনটি যেন চারপাশের গ্রামগুলোর সব মন্তুকে সারাক্ষণ টিটকারি দেয়, আর নিজের সুখের বিস্তর বয়ান করে।
—অ-মন্তু খাড়ায়া রইলা ক্যা, বও।
—জে, জে।
—তোমার পোলারা অহন কোনডা কোন দিকে?
হবিবুল্লার কথায় মন্তু কানাইয়ের স্টলের টুলে বসতে-বসতে চোখ দুটোতে ঝামরি কেটে তীক্ষ-সচেতন হয়ে ওঠে।
—বুঝলা মন্তু, খালি হাইব্রিড বীজ কিনলে কি অইবো, সার-কীটনাশক-ডিজেলের বাজার দ্যাহো না কত গরম।
—জে, আফনে হাচা কইছেন।
মন্তু অবোধ বালকের মতো সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
—খালি কিনলে ত অইত না, টাইমমতো হেগোর খাওন-পানি জুগাইতে অইব।
—অবশ্যি...অবশ্যি... মন্তু প্রাজ্ঞ কৃষকের মতো মাথা নাড়ে। আসলে মন্তু ভিত্তে-ভিত্তে পুরা প্রস্তুত; এখন শুধু ছোবলের ক্ষেত্রটি তৈরি করতে তাকে যা মুখ চবলাতে হচ্ছে।
—অ-কানাই, দুইডা চা দ্যাচা। রইদে বইবানি মন্তু, রইডা বড় মজার। হবিবুল্লার কাছে তামাম দুনিয়াটাই মজার। দামি সোয়েটারটা সে হাতে তুলে নেয়, যেটা চুল কাটার আগেই সে খুলেছিল। ওর খাবলা-ধরা কালচে আঙুলে সোয়েটারটার রঙিন চেকনাই ঝলক দেয়। কত আর হবে, এই সাত-আট সাল আগেও হবিবুল্লা একটা মেইড়-ভাঙা চাষা ছিল, তারও আগে এই পিচ পথটা যখন আধা জংলা-গোপাট, তখন বালক মন্তুরা দুই মাইল দূরের চন্দ্রনাথ বিদ্যানিকেতনে যাওয়ার জন্য এই গোপাটে এসে মিলিত হতো। ঢ্যাঙা-লিকলিকে, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক-পরা হ্যাবলা হইব্ব্যা চারপাশের জংলার হিয়াল-বান্দরের ডরে দলের মধ্যে থেকেও কেমুন ভ্যা-ভ্যা করত। আর অহন...হবিবুল্লার বাড়িটা দালান হয়ে গেছে। মাঠে ফসলের মেলা জমিও কিনেছে, আর ইজ্জতটাই কি কারও চেয়ে কম? স্টলের ঝাঁপের নিচের বেঞ্চিতে এসে ওরা রোদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে। কচি ছেলের দুধদাঁতের কামড়ের মতো অঘ্রাণের রোদ ওদের পিঠে তুরতুরি আরাম জাগায়।
—আপনের ছেলেগুলান খুব লায়েকমান। মন্তু আলাপ জুড়ে। চোখে ভাসে তার নিজের আচোদা পোলা দুটোর মুখ। সর্বদিক দিয়ে একেবারে পয়মাল করে দিল। সেই রাগেই তো মন্তু আর তেমন করে চাষবাস করে না। পেটের দায়ে আর বুড়িটার কুদাম-পাদামে ঘরে টিকতে পারে না বলেই তো সে হাল-গরু নিয়ে মাঠে নামে; না-হলে ঘুরে-ঘেঁটে বাকি জিন্দিগিটা কাটিয়ে দিত।
—তোমার পোলা দুইডার খবর কী?
—না, আগের মতোই। একটা পল্টিফার্মে আছিন, হেইহানত্তেই ছুরতুনের ছেমড়িডারে লইয়া ভাগছে।...অহন আর কোনো তত্ত্ব-তালাশ জানি না। আর ছোট্ট পোলাডা কাঠের কাম ভালাই শিখছিল, কিন্তুক কামের চে আড্ডাবাজিই বেশি পছন্দ।
—হ, বাজারেও হেরে বেশি বেশি দ্যাহি; তাইলে কাম করে কোন টাইমে? হবিবুল্লা মন্তুর কথায় সাক্ষ্য দেয়। ফের আফসোসও করে, হেইডা আমারেও একটা শোকেস বানায়া দিছিন, জিনিসটা যা সুন্দর অইছে না। পোলাডা যুদিন ঠিকমতন কাম করত... তারা এখন চায়ে চুমুক দিয়ে চুক-চুক করে স্বাদ নিচ্ছে। গরুর চোনার মতো লেশমা-লেশমা শেষ বাজারের কড়া চা। আপাত এই পান নীরবতায় উল্টা দিকের ফোনের দোকান থেকে একজনের রাগী গলার হাঁকডাক তাদের মাঝে বারবার হামলে পড়ে। মন্তু আন্দাজে ধরে নেয়, লোকটা ফোনের ওপাশের মানুষটাকে খুব নিচ্ছে। অপরিচিত সেই ব্যক্তির নাজেহাল চেহারাটা যেন সে দিব্যি দেখতে পাচ্ছে। পোলা দুটোর জন্য সেও কি কম ভুগতেছে। যত মারো-কাটো, মন্তু কিন্তু পিটপিট করে হাসবে, আর সুবিধামতো ছোবল দেওয়ার জন্য ভিত্তে-ভিত্তে দাঁত ধারাবে। যত দিন না কাম হাসিল হবে, তত দিন সে শিকারের পেছনে নিষ্ঠাবান তাপস। হবিবুল্লা কাপটা ঠাস করে নামিয়ে রাখে। মন্তু চমকে ওঠে। লোকটা কি হুদাহুদিই গরম হয়ে যাচ্ছে? মালদার মানুষের মতিগতি আন্দাজ করা শক্ত। যেই কথা, সেই কাজ। হবিবুল্লা বিষাক্ত গলায় বলে, তুমিই পোলা দুইডারে নষ্ট করছ। বাপ হিসাবে তুমি কী শাসনডা করলা। ডাক-ডাক করতে করতে হেরা পয়মাল হয়ে গেল। মন্তুর মাথাটা ঝিমঝিম করে, চোখের সামনের সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে।
—বাদ দেন, বাদ দেন হেই চ্যাট-মুইক্ষ্যা পোলাগর কথা। আফনার নিজের আলাপ করেন, হুনতেও সুখ। হুনলাম আফনের ছোডো পালারে নাকি ঢাকায় শাদি করাইছেন। ছোট্ট পুত্রবধূর মিষ্টিমুখ আর বেয়াইয়ের ছবির মতো ঝকমকা দালানটার কথা মনে হতেই তৃপ্তির ঢেকুরে হবিবুল্লা শীতল হয়ে আসে। তার ঘাড়ের চর্বির মোটা ভাঁজটি তেল-ময়লাসহ রোদের জেল্লায় চকচক করে। মন্তুর ইচ্ছা হয়, প্রকাশ্যেই সেখানে দাঁত বসিয়ে দিতে। হবিবুল্লার মুখের পান-সুপারি জুত হয়ে এলে সে পকেট থেকে সিগারেট-ম্যাচ বের করে ধরানোর উদ্যোগ নেয়।
—হ, হেরা খুব মালদার পাট্টি, হেদের তুল্যে আমি কিচ্ছু না, কিন্তুক আমার পোলারে তারা খুব পছন্দ করছে, হেই ভরসাতেই কামডা সামুটতা পাড়ছি।
—আর বড় দুইজনরে? মন্তু একটু-একটু করে লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে।
—বড় দুই ছেলে সামনের সন বাড়িত আসলেই...
—হেই দেশটা খুব ধনী মাইনষের, না?
—তুমি যে কী কও, ধনী না হইলে কি আর হেরা শখ কইরা বিদেশতে মানুষ নেয়।
—অইব...অইব...। মন্তু আমতা-আমতা করে আর পিট পিট করে হাসে। এই হাসিটা তার আসল অস্ত্র। পায়ে উষ্টা দিয়ে ফেলে দিলেও ওই হাবড়া মুখটা থেকে হাসিটা মুছে ফেলা যায় না।
—তে আফনের বড় মেয়ের জামাইয়ের খবর কী? এই কথায় হবিবুল্লা বজ্রাহতের মতো নির্বাক চেয়ে থাকে। তার বড় মেয়ের জামাই এখন কারাগারে। বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে বন্দী। বড় কঠিন বিচারের সম্মুুখীন। হবিবুল্লার খাড়া মাথাটা ঝপাস করে বুকের কাছে নুয়ে পড়ে। তার ঘাড়ের মোটা-গম্ভীর ভাঁজটি কেমন মেন্দা মেরে যায়। মন্তু নিজেকে দিয়ে বোঝে, বাপ সন্তানের জন্য কতটুকু দরদ রাখে। হবিবুল্লার সেই গোপন জাগাটার খবর পাওয়াতক মন্তুর দাঁত শিরশির করছিল। দুই-তিন মাসের মধ্যে এমন বড় শিকার সে ধরতে পারেনি। কষ্ট ছাড়া তার জীবনে আর কিচ্ছু প্রাপ্তি নেই। তার সব গোল্লায় গেছে। দিনে দিনে বুড়ি মাগিটা একটা ঝগড়াটে শাকচুন্নিতে পরিণত হয়েছে। যা কিছু জমি আছে, তাও উপযুক্ত চাষ ও যত্নের অভাবে তামাদি হয়ে গেছে। তাই মুফতে যা মেলে তাতেই সুখ, আর সেটুকুই তার সব না-পাওয়ার পাওয়া।
—তে কইলেন না জামাইয়ের খবর কী? জোশ-রোষহীন হবিবুল্লা মরা শরীরটা যেন পাথরের মতো টেনে তুলে দাঁড়ায়। কাউকে কিছু না বলে নুয়ে-নুয়ে বাড়ির পথ ধরে। চরম প্রশান্তির মাঝে মন্তুর খুব শখ হয়, একবার ডাক দিয়ে হবিবুল্লাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এই মিয়া সাব, কিছু হারাইছেন নাকি?’ কিন্তু তার পেছনে একটা জিপ ক্যাচ করে ব্রেক কষার শব্দে সে ফিরে তাকায়। হাতে দড়ি, হ্যান্ডকাফ আর তেলতেলা রুল নিয়ে কয়টা পুলিশ জিপ থেকে নামছে। একজন তার দিকে কড়া চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, হালিমের বাপ মন্তুর বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো? মন্তুর মুখে তৃপ্তি জড়ানো চিলবিল হাসিটি এখনো লেগে আছে; সেই হাসি নিয়েই ভয়ে ভয়ে সে উল্টা প্রশ্ন করে, কেন...। খাটো কিন্তু ধামার মতো ভোটকা যে লোকটা একপাশে দাঁড়িয়ে, তাকে নীরবে পরখ করছিল, সে বলে—কেন, জানস না? বাইনচোদটারে শ্বশুরবাড়িত নিতাম দাওয়াত খাওয়াইতে, খানকির পুত ক্যাশবাক্স ভাইঙ্গা ট্যাহাও নিছে, লগে কামের ছেমড়িডারেও নিছে। মন্তু একনিমিষে সব বুঝে নেয় আর চিনে নেয় তার পোলার পল্টিফার্মের মালিককেও। কিন্তু সে নির্বিকারভাবে বলে, কী যে কন, পারতাম না ক্যা, আইয়েন হালিমের বাফের বাড়িডা দ্যাহায়া দিতাছি। মন্তু সবার আগে ঝুলতে ঝুলতে হাঁটে, আর তার পেছনে কয় জোড়া প্রশিক্ষিত পা ভারী বুটের মচমচ শব্দ তুলে হালিমের বাপ মন্তুর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় তাদের শিকারটি হস্তগত করার জন্য।
No comments