অরক্ষিত নাগরিক জীবন by শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শোনা ঘটনা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে ফারাক মেলা। হরতাল-অবরোধে অবরুদ্ধ জীবনের কথা অনেক শুনেছি।
তা যে আসলে কেমন, এর প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছি গত ৩০ নভেম্বর। ওই দিন ১৮-দলীয় জোটের অবরোধ চলছিল।
সকালে স্ত্রীসহ রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলাম। নয়টার দিকে যখন ফার্মগেটের গ্রিনভিউ সুপার মার্কেট পার হয়েছি, এমন সময় কোত্থেকে উদয় হলো এক মিছিল। পান্থপথের ওদিকে থেকে আসছিল। সরকারবিরোধী ঝাঁজালো স্লোগান দিচ্ছিল মিছিলকারী অবরোধ-সমর্থকেরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল থেকে বৃষ্টির মতো ককটেল ফাটাতে লাগল রাস্তার ওপর। মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়া রিকশা, স্কুটার ও টেম্পো লক্ষ্য করেও ছোড়া হলো ককটেল। বিকট শব্দ আর ধোঁয়ায় কিংকর্তব্য হারিয়ে আমরা বিমূঢ়! এর মধ্যেই রিকশাওয়ালা বাহন ঘুরিয়ে সাঁই সাঁই করে পেছন দিকে ছুটল। কেবলই মনে হতে লাগল—এই বুঝি ককটেল রিকশার ওপর এসে পড়ে, যার পরিণতিতে মাটির নিচে রচিত হতে পারে আমাদের চিরস্থায়ী আবাস কিংবা পঙ্গু হয়ে কাটাতে হতে পারে পরনির্ভরশীল জীবন।
এমন উদ্বেগের মধ্যেই রিকশাওয়ালা বসুন্ধরা সিটির পেছনের গলিতে রিকশা ঢুকিয়ে দিল। পেছনে শুনতে পেলাম পুলিশের মুহুর্মুহু বাঁশি আর গুলির শব্দ। পরে শুনেছি, মিছিলকারী শিবিরের দুজন কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় প্রথমেই আমার মনে হলো, আমরা এখন কোথায় বাস করছি? এটা কি আমাদের স্বপ্নের সেই স্বাধীন বাংলাদেশ, নাকি কোনো পরাধীন ভূখণ্ড?
এই ভীতিকর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সুদূর শৈশবের কিছু ঝাপসা স্মৃতির মিল খুঁজে পাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গভীর রাতে বাবা আমাদের নিয়ে প্রায়ই বাড়ির পেছনে একটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে গভীর পরিখার ভেতর আশ্রয় নিতেন। কাঁচা ঘুম থেকে জেগে চোখ ডলতে ডলতে ঠাওরানোর চেষ্টা করতাম, এ কোন অন্ধকার গহ্বর? মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে শুনতাম দূর থেকে আসা গুলির শব্দ।
ওই সময় ভয় পেলেও তা নিয়ে নাড়াচাড়া করার মতো বুদ্ধি ছিল না। এখন ভাবনার অথই সাগরে খাবি খেতে খেতে ভাবি, এই হরতাল-অবরোধ আর সরকারের ভূমিকা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের?
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দিনকে দিন যেমন সমস্যার জঞ্জাল তৈরি করছে, তেমনি দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ এগিয়ে চলেছে গন্তব্যহীন এক অজানা পরিণতির দিকে।
বাজার এখন চরম অস্থিতিশীল। কোথাও চাহিদা আছে, সরবরাহ নেই। আবার কোথাও চাহিদার কথা ভেবে বাড়তি মাল তুলে মার খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেদিন কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখি, পরিচিত সবজিবিক্রেতার কাছে তিন রকমের শসা। দোকানি বললেন, ‘দেশি নিলে এইটা নেন, বিদেশি নিলে ওইটা।’
কিন্তু একটা ঝাঁকায় স্তূপ হয়ে থাকা লালচে শসার কথা কিছুই বলল না। আমি কৌতূহল দেখাতেই তিনি বললেন, ‘এইগুল্যান মাগনা দেওনের জন্য রাখছি। অবরোধের কথা ভাইবা বেশি কইরা কিনছিলাম। কিন্তু বিক্রি হয় নাই। এহন পইচ্যা যাইতাছে।’
এমন দুরবস্থার কারণ আছে। অনেক নিয়মিত ক্রেতা এখন বাজারবিমুখ। দুদিন আগে পাড়ার পরিচিত এক ভদ্রলোক জানালেন, ইদানীং পারতপক্ষে বাইরে বের হন না। অফিসটা কোনোমতে সেরে এসে বাসায়ই গ্যাঁট হয়ে থাকেন। আশপাশে হাতের নাগালে যা পান, হকাররা যা নিয়ে আসে, তা-ই কিনে খান।
ভদ্রলোক অকপটে স্বীকার করলেন যে তিনি ভীরু। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা তিনি। বাসায় পাঁচ-ছয়জন পুষ্যি। গ্রামেও মাকে টাকা পাঠাতে হয়। বাজার-টাজার করতে গিয়ে পথে বোমা বা ককটেলে তাঁর কিছু হয়ে গেলে পরিবারের দায় নেবে কে?
সমস্যা যে কত, তা বলে শেষ করা যাবে না। চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে বড় বড় সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় নিয়মিত পণ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে স্তূপ হয়ে আছে ৮০ হাজার টন পণ্য। সেগুলো স্থানান্তরের জন্য পরিবহন নেই। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বস্তা বস্তা পেঁয়াজসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। আক্রা লাগা পেঁয়াজের বাজার যে আরও ঝাঁজ ছড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বন্দরে অচলাবস্থা থাকায় সেখানে দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত শত শত কর্মী-শ্রমিকের জীবন-জীবিকাও থমকে গেছে। অন্যান্য স্থলবন্দরেরও একই অবস্থা।
পর্যাপ্ত যানবাহনের সংকট ও রেলে নাশকতার কারণে চট্টগ্রাম থেকে আসতে পারছে না নিত্যব্যবহার্য অনেক জিনিস। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে।
যে পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে সমঝোতা না হবে, রাজনৈতিক অঙ্গন স্বাভাবিক না হবে, দিন দিন আরও অবনতি হবে পরিস্থিতির।
সংশোধিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ অবলম্বন করে ১৪-দলীয় জোট যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পন্থা নয়। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, অনেকের কাছে তা ‘রসাত্মক নাটক’ বলে মনে হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৪ জন প্রার্থী নির্বাচিতও হয়ে গেছেন। নজিরবিহীন এই নির্বাচনের বাকি ফলাফল পরিষ্কার। এই জোটই থেকে যাচ্ছে ক্ষমতায়।
এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছে বিরোধী ১৮-দলীয় জোট। আন্দোলন বলতে এখন যা ঘটছে, তা হচ্ছে হরতাল-অবরোধের নামে রাস্তাঘাটে যানবাহন ভাঙচুর করা আর আগুন দেওয়া। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরা আলাদা কেউ নয়, যারা হামলা চালাচ্ছে, তাদেরই ভাই-বোন। তাদেরই আপনজন। তারা যে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেই ভোটদাতা এরাই। কাজেই এসব হামলা ও সহিংসতা প্রকারান্তরে আত্মঘাতী হামলারই শামিল।
বিরোধী জোটের এই আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে সে রকম কোনো সুরক্ষা দিচ্ছে না। যেখানে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের মামলার সাক্ষী নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের হামলায় খুন হচ্ছেন, বিচারকদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটা, তা পরিষ্কার।
গণতান্ত্রিক একটি দেশে সরকারের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধান। তেমনি বিরোধী জোট বা দলের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিপন্ন না করে আন্দোলন করা। অথচ উভয়ের কাছেই তা উপেক্ষিত।
এদিকে আমজনতা পড়ে গেছে জটিল ঘূর্ণিপাকে। দশম নির্বাচন যে সঠিক গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে এগোচ্ছে না, তাদের কাছে তা পরিষ্কার হলেও বিকল্প পথ এখানে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সরকার থেকে চোখ সরিয়ে কার দিকে নজর দেবে তারা?
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু ও ব্যাংকের টাকা লুটপাটসহ সম্পদের পাহাড় গড়ার মতো একগাদা অভিযোগ থাকলেও নৈতিকভাবে সবল কোনো দল বা জোট সামনে নেই।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে এবারের ভারতের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ইতিহাস সৃষ্টি করা আম আদমি পার্টির (এএপি) কথা বলা যায়। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে এই দলটি দিল্লিতে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসন দখল করেছে। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র আটটি আসন। বিজেপি এএপির চেয়ে তিনটি আসন বেশি পেয়েছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসর মন্ত্রী-সাংসদসহ বিভিন্ন নেতার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অতিষ্ঠ আমজনতা এএপির ওপরই ভরসা খুঁজে পেয়েছে।
সে তুলনায় এ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ভিন্ন। সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া দূরে থাক, দূর থেকেও জনতার দাবি ও সমস্যাকে পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। এর চেয়ে বরং ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়াই দুই বড় দলের কাছে মুখ্য।
সকালে স্ত্রীসহ রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলাম। নয়টার দিকে যখন ফার্মগেটের গ্রিনভিউ সুপার মার্কেট পার হয়েছি, এমন সময় কোত্থেকে উদয় হলো এক মিছিল। পান্থপথের ওদিকে থেকে আসছিল। সরকারবিরোধী ঝাঁজালো স্লোগান দিচ্ছিল মিছিলকারী অবরোধ-সমর্থকেরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিছিল থেকে বৃষ্টির মতো ককটেল ফাটাতে লাগল রাস্তার ওপর। মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়া রিকশা, স্কুটার ও টেম্পো লক্ষ্য করেও ছোড়া হলো ককটেল। বিকট শব্দ আর ধোঁয়ায় কিংকর্তব্য হারিয়ে আমরা বিমূঢ়! এর মধ্যেই রিকশাওয়ালা বাহন ঘুরিয়ে সাঁই সাঁই করে পেছন দিকে ছুটল। কেবলই মনে হতে লাগল—এই বুঝি ককটেল রিকশার ওপর এসে পড়ে, যার পরিণতিতে মাটির নিচে রচিত হতে পারে আমাদের চিরস্থায়ী আবাস কিংবা পঙ্গু হয়ে কাটাতে হতে পারে পরনির্ভরশীল জীবন।
এমন উদ্বেগের মধ্যেই রিকশাওয়ালা বসুন্ধরা সিটির পেছনের গলিতে রিকশা ঢুকিয়ে দিল। পেছনে শুনতে পেলাম পুলিশের মুহুর্মুহু বাঁশি আর গুলির শব্দ। পরে শুনেছি, মিছিলকারী শিবিরের দুজন কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
এ ঘটনায় প্রথমেই আমার মনে হলো, আমরা এখন কোথায় বাস করছি? এটা কি আমাদের স্বপ্নের সেই স্বাধীন বাংলাদেশ, নাকি কোনো পরাধীন ভূখণ্ড?
এই ভীতিকর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সুদূর শৈশবের কিছু ঝাপসা স্মৃতির মিল খুঁজে পাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গভীর রাতে বাবা আমাদের নিয়ে প্রায়ই বাড়ির পেছনে একটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে গভীর পরিখার ভেতর আশ্রয় নিতেন। কাঁচা ঘুম থেকে জেগে চোখ ডলতে ডলতে ঠাওরানোর চেষ্টা করতাম, এ কোন অন্ধকার গহ্বর? মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে শুনতাম দূর থেকে আসা গুলির শব্দ।
ওই সময় ভয় পেলেও তা নিয়ে নাড়াচাড়া করার মতো বুদ্ধি ছিল না। এখন ভাবনার অথই সাগরে খাবি খেতে খেতে ভাবি, এই হরতাল-অবরোধ আর সরকারের ভূমিকা কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের?
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দিনকে দিন যেমন সমস্যার জঞ্জাল তৈরি করছে, তেমনি দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ এগিয়ে চলেছে গন্তব্যহীন এক অজানা পরিণতির দিকে।
বাজার এখন চরম অস্থিতিশীল। কোথাও চাহিদা আছে, সরবরাহ নেই। আবার কোথাও চাহিদার কথা ভেবে বাড়তি মাল তুলে মার খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সেদিন কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখি, পরিচিত সবজিবিক্রেতার কাছে তিন রকমের শসা। দোকানি বললেন, ‘দেশি নিলে এইটা নেন, বিদেশি নিলে ওইটা।’
কিন্তু একটা ঝাঁকায় স্তূপ হয়ে থাকা লালচে শসার কথা কিছুই বলল না। আমি কৌতূহল দেখাতেই তিনি বললেন, ‘এইগুল্যান মাগনা দেওনের জন্য রাখছি। অবরোধের কথা ভাইবা বেশি কইরা কিনছিলাম। কিন্তু বিক্রি হয় নাই। এহন পইচ্যা যাইতাছে।’
এমন দুরবস্থার কারণ আছে। অনেক নিয়মিত ক্রেতা এখন বাজারবিমুখ। দুদিন আগে পাড়ার পরিচিত এক ভদ্রলোক জানালেন, ইদানীং পারতপক্ষে বাইরে বের হন না। অফিসটা কোনোমতে সেরে এসে বাসায়ই গ্যাঁট হয়ে থাকেন। আশপাশে হাতের নাগালে যা পান, হকাররা যা নিয়ে আসে, তা-ই কিনে খান।
ভদ্রলোক অকপটে স্বীকার করলেন যে তিনি ভীরু। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাও দিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা তিনি। বাসায় পাঁচ-ছয়জন পুষ্যি। গ্রামেও মাকে টাকা পাঠাতে হয়। বাজার-টাজার করতে গিয়ে পথে বোমা বা ককটেলে তাঁর কিছু হয়ে গেলে পরিবারের দায় নেবে কে?
সমস্যা যে কত, তা বলে শেষ করা যাবে না। চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে বড় বড় সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক না থাকায় নিয়মিত পণ্য সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে স্তূপ হয়ে আছে ৮০ হাজার টন পণ্য। সেগুলো স্থানান্তরের জন্য পরিবহন নেই। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বস্তা বস্তা পেঁয়াজসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। আক্রা লাগা পেঁয়াজের বাজার যে আরও ঝাঁজ ছড়াবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বন্দরে অচলাবস্থা থাকায় সেখানে দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত শত শত কর্মী-শ্রমিকের জীবন-জীবিকাও থমকে গেছে। অন্যান্য স্থলবন্দরেরও একই অবস্থা।
পর্যাপ্ত যানবাহনের সংকট ও রেলে নাশকতার কারণে চট্টগ্রাম থেকে আসতে পারছে না নিত্যব্যবহার্য অনেক জিনিস। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে।
যে পর্যন্ত সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে সমঝোতা না হবে, রাজনৈতিক অঙ্গন স্বাভাবিক না হবে, দিন দিন আরও অবনতি হবে পরিস্থিতির।
সংশোধিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ অবলম্বন করে ১৪-দলীয় জোট যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পন্থা নয়। জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, অনেকের কাছে তা ‘রসাত্মক নাটক’ বলে মনে হয়েছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন জোটের ১৫৪ জন প্রার্থী নির্বাচিতও হয়ে গেছেন। নজিরবিহীন এই নির্বাচনের বাকি ফলাফল পরিষ্কার। এই জোটই থেকে যাচ্ছে ক্ষমতায়।
এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছে বিরোধী ১৮-দলীয় জোট। আন্দোলন বলতে এখন যা ঘটছে, তা হচ্ছে হরতাল-অবরোধের নামে রাস্তাঘাটে যানবাহন ভাঙচুর করা আর আগুন দেওয়া। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরা আলাদা কেউ নয়, যারা হামলা চালাচ্ছে, তাদেরই ভাই-বোন। তাদেরই আপনজন। তারা যে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সেই ভোটদাতা এরাই। কাজেই এসব হামলা ও সহিংসতা প্রকারান্তরে আত্মঘাতী হামলারই শামিল।
বিরোধী জোটের এই আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, তা সাধারণ মানুষকে সে রকম কোনো সুরক্ষা দিচ্ছে না। যেখানে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের মামলার সাক্ষী নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের হামলায় খুন হচ্ছেন, বিচারকদের বাড়িতে হামলা হচ্ছে, সেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কতটা, তা পরিষ্কার।
গণতান্ত্রিক একটি দেশে সরকারের মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিধান। তেমনি বিরোধী জোট বা দলের দায়িত্ব সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিপন্ন না করে আন্দোলন করা। অথচ উভয়ের কাছেই তা উপেক্ষিত।
এদিকে আমজনতা পড়ে গেছে জটিল ঘূর্ণিপাকে। দশম নির্বাচন যে সঠিক গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে এগোচ্ছে না, তাদের কাছে তা পরিষ্কার হলেও বিকল্প পথ এখানে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। সরকার থেকে চোখ সরিয়ে কার দিকে নজর দেবে তারা?
বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু ও ব্যাংকের টাকা লুটপাটসহ সম্পদের পাহাড় গড়ার মতো একগাদা অভিযোগ থাকলেও নৈতিকভাবে সবল কোনো দল বা জোট সামনে নেই।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে এবারের ভারতের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ইতিহাস সৃষ্টি করা আম আদমি পার্টির (এএপি) কথা বলা যায়। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে এই দলটি দিল্লিতে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসন দখল করেছে। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র আটটি আসন। বিজেপি এএপির চেয়ে তিনটি আসন বেশি পেয়েছে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসর মন্ত্রী-সাংসদসহ বিভিন্ন নেতার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অতিষ্ঠ আমজনতা এএপির ওপরই ভরসা খুঁজে পেয়েছে।
সে তুলনায় এ দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট ভিন্ন। সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া দূরে থাক, দূর থেকেও জনতার দাবি ও সমস্যাকে পাত্তা দিচ্ছে না কেউ। এর চেয়ে বরং ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়াই দুই বড় দলের কাছে মুখ্য।
No comments