অপারেশন সাকসেসফুল কিন্তু রোগী মারা গেছে by মাহফুজ আনাম
সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণাটি খুবই ইতিবাচক, কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান এমন একজনকে হতে হবে, যার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সবার কাছে।
ব্যাপারটি যেন এমন না হয়, অপারেশন খুব সফল হয়েছে, কিন্তু অপারেশনের পরপরই রোগী মারা গেছে।
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা মনে করছেন যে, নির্বাচনী অপারেশনটা ভালোভাবেই সেরে ফেলা যাবে। কিন্তু সেই ‘নবনির্বাচিত’ পার্লামেন্টটি স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সেই ‘নতুন’ সরকারের জনসমর্থন থাকবে কি না, তাও ভাবতে হবে। একটি অনির্বাচিত সরকারের ‘প্রধান’ হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে চিরজীবনের জন্য কলঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকি নেবেন কি?
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের কয়েকটি শতক পার হওয়ার পরও আমাদের উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ২৪ বছরের লড়াই; এরপর স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর এক দশকের বেশি সময় ধরে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, তারপর গণতন্ত্র। ইতিমধ্যে আমরা ২২টি বছর গণতন্ত্র চর্চা করে ফেলেছি। কিন্তু গণতন্ত্র কী, তা কি আমরা জানতে পেরেছি? একটি গণতান্ত্রিক সরকারের গঠনকাঠামো কেমন, অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জনগণের অধিকার কী, তা কি আমরা এখনো পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছি?
এসব প্রশ্ন করার কারণ খুবই সাধারণ। শেখ হাসিনা, তার সরকার ও দল আমাদের এসব প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে যে, আমরা কি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আছি, নাকি একটি নির্বাচিত ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ ব্যবস্থার মধ্যে আছি।
যদি আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই থেকে থাকি, তাহলে আমরা কি এমন একটি সরকার পাব না, যে সরকার আমাদের প্রভু বা মালিক না হয়ে সেবাদানকারী হবে। সংসদ সদস্য কি তারাই হবেন না, যাদের আমরা পছন্দ করব? আমরা কি ব্যালট পেপারের মাধ্যমে আমাদের ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটাব না? আমরা কি ভোটের মাধ্যমে একটি সরকারকে নির্বাচিত করব না?
গণতন্ত্র ও অন্যান্য সরকারব্যবস্থার মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থেকে থাকে, তাহলে সেটি হলো দেশের প্রত্যেক ভোটারের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থাকবে। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় আর যা-ই হোক, ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেয়া হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এর মানে হলো, নয় কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ ভোটারকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাদবাকি ১৪৬টি আসনে যে ‘নির্বাচনে’র আয়োজন করা হচ্ছে, তা খুবই লজ্জাজনক। কারণ, যেসব প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন, তারা অল্প কয়েক হাজার করে ভোট পেতে পারেন। এখানেও ভোটাররা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। কেননা, ভোটাররা তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছেন না। এর মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, দশম জাতীয় সংসদ জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই গঠিত হতে যাচ্ছে। অথচ কিনা, গণতন্ত্রে জনগণই হচ্ছে সব ক্ষমতার উৎস।
জনগণ যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, তাহলে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাওয়া যাবে না, ফলে কোনো নির্বাচিত সরকারও পাব না আমরা। আর আমরা যদি একটি নির্বাচিত সরকার না পাই, তাহলে আগামী ৫ জানুয়ারির পর যে সরকার গঠিত হবে, তার সঙ্গে আশির দশকের এরশাদ সরকারের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
আমরা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগকে বলতে চাই যে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখন বিষয়টি দাঁড়িয়ে গেছে ভোটার ও অনির্বাচিত সংসদের মধ্যে। এ রকম অনির্বাচিত একটি সংসদ জনগণ মেনে নেবে না।
(২০ ডিসেম্বর ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদক মাহফুজ আনামের ‘দ্য থার্ড ভিউ’ কলামের সংক্ষেপিত অনুবাদ।)
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা মনে করছেন যে, নির্বাচনী অপারেশনটা ভালোভাবেই সেরে ফেলা যাবে। কিন্তু সেই ‘নবনির্বাচিত’ পার্লামেন্টটি স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সেই ‘নতুন’ সরকারের জনসমর্থন থাকবে কি না, তাও ভাবতে হবে। একটি অনির্বাচিত সরকারের ‘প্রধান’ হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসে চিরজীবনের জন্য কলঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকি নেবেন কি?
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের কয়েকটি শতক পার হওয়ার পরও আমাদের উপমহাদেশের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ২৪ বছরের লড়াই; এরপর স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর এক দশকের বেশি সময় ধরে সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, তারপর গণতন্ত্র। ইতিমধ্যে আমরা ২২টি বছর গণতন্ত্র চর্চা করে ফেলেছি। কিন্তু গণতন্ত্র কী, তা কি আমরা জানতে পেরেছি? একটি গণতান্ত্রিক সরকারের গঠনকাঠামো কেমন, অথবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জনগণের অধিকার কী, তা কি আমরা এখনো পরিষ্কারভাবে জানতে পেরেছি?
এসব প্রশ্ন করার কারণ খুবই সাধারণ। শেখ হাসিনা, তার সরকার ও দল আমাদের এসব প্রশ্ন করতে বাধ্য করছে যে, আমরা কি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে আছি, নাকি একটি নির্বাচিত ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ ব্যবস্থার মধ্যে আছি।
যদি আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই থেকে থাকি, তাহলে আমরা কি এমন একটি সরকার পাব না, যে সরকার আমাদের প্রভু বা মালিক না হয়ে সেবাদানকারী হবে। সংসদ সদস্য কি তারাই হবেন না, যাদের আমরা পছন্দ করব? আমরা কি ব্যালট পেপারের মাধ্যমে আমাদের ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটাব না? আমরা কি ভোটের মাধ্যমে একটি সরকারকে নির্বাচিত করব না?
গণতন্ত্র ও অন্যান্য সরকারব্যবস্থার মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য থেকে থাকে, তাহলে সেটি হলো দেশের প্রত্যেক ভোটারের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার থাকবে। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় আর যা-ই হোক, ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেয়া হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এর মানে হলো, নয় কোটি ১৯ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ ভোটারকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাদবাকি ১৪৬টি আসনে যে ‘নির্বাচনে’র আয়োজন করা হচ্ছে, তা খুবই লজ্জাজনক। কারণ, যেসব প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন, তারা অল্প কয়েক হাজার করে ভোট পেতে পারেন। এখানেও ভোটাররা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। কেননা, ভোটাররা তাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছেন না। এর মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে, দশম জাতীয় সংসদ জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই গঠিত হতে যাচ্ছে। অথচ কিনা, গণতন্ত্রে জনগণই হচ্ছে সব ক্ষমতার উৎস।
জনগণ যদি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারে, তাহলে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাওয়া যাবে না, ফলে কোনো নির্বাচিত সরকারও পাব না আমরা। আর আমরা যদি একটি নির্বাচিত সরকার না পাই, তাহলে আগামী ৫ জানুয়ারির পর যে সরকার গঠিত হবে, তার সঙ্গে আশির দশকের এরশাদ সরকারের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
আমরা প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগকে বলতে চাই যে, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু এখন বিষয়টি দাঁড়িয়ে গেছে ভোটার ও অনির্বাচিত সংসদের মধ্যে। এ রকম অনির্বাচিত একটি সংসদ জনগণ মেনে নেবে না।
(২০ ডিসেম্বর ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদক মাহফুজ আনামের ‘দ্য থার্ড ভিউ’ কলামের সংক্ষেপিত অনুবাদ।)
No comments