মাটির টানে ফিরে চলা by ড. হারুন রশীদ
বাংলাদেশের
মানুষ ভাগ্যের সন্ধানে যেমন শহরে পাড়ি জমায়, তেমনি আবার উৎসবে-আনন্দে
গ্রামে যায়। বিশেষ করে দুই ঈদে মানুষের প্রিয়জনের সান্নিধ্যে যাওয়ার সে কী
প্রাণান্তকর চেষ্টা। বাসের ভাড়া বৃদ্ধি, রেলের টিকিটের জন্য রাতভর অপেক্ষা,
সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট ইত্যাকার নানা সমস্যা কাটিয়ে ঘরে ফেরার আনন্দই
যেন হয়ে ওঠে মুখ্য। ঠাঁই নেই, তবুও যেতে হবে। বাসে, ট্রেনের কামরার ভেতরে
দাঁড়িয়ে, সেখানে ঠাঁই না হলে ছাদে। লঞ্চেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্লোরে বসে,
ডেকে দাঁড়িয়ে এমনকি ছাদের ওপর বিছানা পেতে সেখানেই বসে পড়া। ঈদ সামনে রেখে
প্রতিবছর একই অবস্থা সৃষ্টি হয়। যেভাবেই হোক বাড়িতে পৌঁছতেই হবে। এ টান যে
বড় বেশি প্রাণের। এ টান নাড়ির। দুনিয়ার কোথাও কি মানুষ এভাবে ছুটে প্রাণের
টানে, শেকড়ের সন্ধানে? কীসের এত মায়া? কীসের জন্য মানুষের এই ঘরে ফেরার
আকুতি? সে কি কেবলই প্রিয়জনের সান্নিধ্য? নাকি তারও অতিরিক্ত কিছু?
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ হয় কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদণ্ড শান্তির’ জন্য এ যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসেন, তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি-রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ-বিলাস-আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এ শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার-ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাঁশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারিসারি, ভাটিয়ালির হƒদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ নেই, নেই এক চিলতে উঠোন। সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কি আর এত হিসাব-নিকাশ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলাম- এমনই তো। আটপৌরে বাঙালি। কোথায় আর যাবে। বেড়ানোর কি ফুরসত আছে? যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ-বিভুঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজ গ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে?
নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। সে জন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, সঙ্গে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট সংযোগ। মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে অতি দ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মৎস্যচাষী, পোলট্রি ফার্মের মালিক কিংবা সবজিচাষী মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? এর জন্য আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনও আশানুরূপ নয়। এজন্য ঘরমুখো মানুষজনকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। কিন্তু তাতে কী? যেতে তো হবেই।
শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠোপথের স্মৃতি, হা-ডু-ডু আর ফুটবল খেলার মাঠ কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ ফিরে দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে? পাশের বাড়ির সাপের ফণার মতো বেণী দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে?
এই শহরে নির্ভেজাল জীবনানন্দ কোথায়? এখানে যেন মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির রাজনীতির মধ্যে বসবাস। জীবন কোথায় এখানে? চারদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি (রাজনৈতিক দলগুলোও কি পার্টি না!)। কী নির্মম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ১০-১৫ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা গার্মেন্ট মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় হরিণ কিংবা ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস ইত্যাদি। অথচ গার্মেন্ট কর্মীদের তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিকমতো দিতে তারা গলদঘর্ম হয়ে যান।
ওই সব খেটে খাওয়া মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিংড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে, তখন ফেরার নিশ্চয়তাটুকুও নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। রেমিটেন্স প্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়, যা এ দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এসব জীবনযোদ্ধা দেশ গড়ছেন।
আসলে এই যে এত সব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা, এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে...’। দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? এবারের ঈদ এসেছে এমন এক সময়ে যখন একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা অনেকেই কারান্তরীণ। অনেকের বিচারের রায় হয়ে গেছে। এ আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না। যে মাটির টানে ফিরে চলা আমাদের, সেই মাটিতে মিশে আছে লাখ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। এবারের ঈদ হোক দেশকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে কলংকমুক্ত করার শপথ নেয়ার দিন। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সবার সম-অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে জন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে। মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দর্পণ। একটি দেশ তথা সমাজের সার্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র ও এই পাঠাগার। সমাজে বিত্তবান অনেকেই আছেন, যারা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। পাঠাগার হতে পারে এর জন্য উত্তম জায়গা। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা। এ জন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন, বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য। আজকের তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সমাজের সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব, ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। আর একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় উৎসব হবে আরও আনন্দময় ও অর্থপূর্ণ। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সার্থক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে। সবার ঘরে ফেরা নিশ্চিত ও নির্বিঘœ হোক।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলাম লেখক
কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ হয় কী মায়া গো, কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রামকে দেখার জন্য আকুতি? ইট-কাঠ-পাথরের এই শহর ছেড়ে মুক্তভাবে শ্বাস নেয়ার জন্য? নাকি জীবনানন্দের বনলতা সেনের মুখোমুখি বসার মতো ‘দুদণ্ড শান্তির’ জন্য এ যাত্রা? যারা গ্রাম থেকে শহরে আসেন, তাদের প্রাণটা আসলে পড়ে থাকে গ্রামেই। বিশেষ করে যারা গ্রামে বড় হয়েছেন। এই নাগরিক জীবন হয়তো অনেক কিছু দেয়। শিক্ষা-দীক্ষা, ভাত-কাপড়, রুটি-রোজগারের নিশ্চয়তা। অনেক উত্তেজনা। ভোগ-বিলাস-আনন্দ। কিন্তু জীবনের সব পাওয়া, সব তৃষ্ণা কি মেটে তাতে? কিছুই কি বাকি থাকে না?
এ শহরে তো দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ নেই, জোয়ার-ভাটায় দুলে ওঠা নদী নেই, বৃক্ষের শ্যামল ছায়া নেই, ধানের ক্ষেতে রোদ ও ছায়ার লুকোচুরি খেলা নেই, ঘাসের ডগায় শিশির নেই, রাখালের বাঁশের বাঁশি নেই, গোধূলির আলো নেই, বাউকুড়ানির ডগায় ঝরাপাতার নৃত্য নেই, পাখির কলকাকলি নেই, পিঠেপুলি পাটিসাপটার আয়োজন নেই, আউল, বাউল জারিসারি, ভাটিয়ালির হƒদয় উদাস করা সুর নেই, বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ নেই, নেই এক চিলতে উঠোন। সে জন্যই কি আমাদের ছুটে চলা? গ্রামছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথে পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটার জন্য? নাকি আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে এসব কথা? মানুষ কি আর এত হিসাব-নিকাশ করে চলে। কয়েকটা দিন ছুটি পেলাম আর কোথাও ঘুরে এলাম- এমনই তো। আটপৌরে বাঙালি। কোথায় আর যাবে। বেড়ানোর কি ফুরসত আছে? যে মাইনে আর রোজগার তাতে সংসারের হাঁড়ি টানতেই তো সব যায়। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয়। সে জন্য বিদেশ-বিভুঁই নয়, ‘ঘর হতেই আঙিনা বিদেশের মতো’ দেশের বাড়িতেই (নিজ গ্রাম) ঈদ করা। কিন্তু সেই গ্রামও কি আর আগের মতো আছে?
নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অনেকখানিই পাওয়া যায় এখন গ্রামে বসেই। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে বেশির ভাগ গ্রামেই। সে জন্য বাড়ি বাড়ি টেলিভিশন। এমনকি ডিশ লাইন থাকায় মুম্বাই-কলকাতা ঢাকার চেয়েও কাছের। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কম্পিউটার, সঙ্গে ওয়্যারলেস ইন্টারনেট সংযোগ। মফস্বলে দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখন হাতে লিখে, ফ্যাক্স করে সংবাদ পাঠান না। কম্পিউটারে কম্পোজ করে ইন্টারনেটে ই-মেইলের মাধ্যমে অতি দ্রুত তারা পাঠিয়ে দেন খবরাখবর। ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরও চলে মোবাইলে। মৎস্যচাষী, পোলট্রি ফার্মের মালিক কিংবা সবজিচাষী মোবাইলে জেনে নেন কেমন বাজার যাচ্ছে ঢাকায়। এভাবে ভার্চুয়াল একটা যোগাযোগ তো আছেই গ্রামের সঙ্গে শহরের। শহরের সঙ্গে গ্রামের। কিন্তু তাতেও তো সব হয় না। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? এর জন্য আসল দুধই চাই। আর সেটি পেতে হলে তো ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’র দেশে যেতে হবেই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখনও আশানুরূপ নয়। এজন্য ঘরমুখো মানুষজনকে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। কিন্তু তাতে কী? যেতে তো হবেই।
শিশির ভেজা সবুজ ঘাস, ছোট্টবেলার স্কুলে যাওয়ার মেঠোপথের স্মৃতি, হা-ডু-ডু আর ফুটবল খেলার মাঠ কিংবা টাকার অভাবে পড়তে না পারা স্কুলজীবনের সেই সহপাঠীর প্রিয়মুখ ফিরে দেখার আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে এই শহরে? পাশের বাড়ির সাপের ফণার মতো বেণী দুলানো দুরন্ত সেই কিশোরীর হাসি কোথায় মিলবে এই শহরে?
এই শহরে নির্ভেজাল জীবনানন্দ কোথায়? এখানে যেন মানুষ নয়, শোষক আর শোষিত, আমলা আর কামলা (মজুর), মালিক-শ্রমিক, পুঁজিপতি আর নিঃস্ব, হাইরাইজ বিল্ডিং বনাম রেললাইনের পাশের বস্তির বিস্তর ব্যবধানের মধ্যে সরকার কিংবা বিরোধী দলের শিলপাটার ঘষাঘষির রাজনীতির মধ্যে বসবাস। জীবন কোথায় এখানে? চারদিকে ঠগ, প্রবঞ্চক, প্রতারক, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি (রাজনৈতিক দলগুলোও কি পার্টি না!)। কী নির্মম, কী পাশবিক এই জীবনধারা। যানজট আর জনজটে রাস্তায় চলাই দায়। ঘুষখোর কর্মকর্তা ইলিশ কেনে ১০-১৫ হাজার টাকা হালি, আর সাধারণের পুঁটি কিনতেই নাভিশ্বাস। নব্য গজিয়ে ওঠা গার্মেন্ট মালিকের ড্রয়িংরুমে শোভা পায় হরিণ কিংবা ডোরাকাটা বাঘের চামড়া, লাখ লাখ টাকার শোপিস ইত্যাদি। অথচ গার্মেন্ট কর্মীদের তিন হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঠিকমতো দিতে তারা গলদঘর্ম হয়ে যান।
ওই সব খেটে খাওয়া মানুষের জীবনেও ঈদ আসে। তারাও ঘরে ফেরে। শরীরের প্রায় শেষ শ্রমটুকু নিংড়ে দিয়ে তাদের যখন ছুটি মেলে, তখন ফেরার নিশ্চয়তাটুকুও নেই। মধ্যরাত পর্যন্ত বাক্স-পেটরা হাতে রাস্তার পাশে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অথচ এদের ঘাম-শ্রমের বিনিময়েই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। রেমিটেন্স প্রবাহ জিডিপির হার বাড়ায়, যা এ দেশকে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন আর এখন এসব জীবনযোদ্ধা দেশ গড়ছেন।
আসলে এই যে এত সব ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করে ঘরে ফেরা, এটাও তো দেশপ্রেমেরই অংশ। আমরা তো আমাদের মায়ের কাছেই ফিরি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ফিরে চল মাটির টানে যে মাটি/যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে...’। দেশও তো মায়ের সমতুল্যই। মা ছাড়া আর কারও জন্য কি এভাবে জীবন বাজি রাখা যায়? এবারের ঈদ এসেছে এমন এক সময়ে যখন একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীরা অনেকেই কারান্তরীণ। অনেকের বিচারের রায় হয়ে গেছে। এ আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জিততে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না। যে মাটির টানে ফিরে চলা আমাদের, সেই মাটিতে মিশে আছে লাখ লাখ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। এবারের ঈদ হোক দেশকে যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে কলংকমুক্ত করার শপথ নেয়ার দিন। মনে রাখা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ উন্নত একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল সবার সম-অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সে জন্যই আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে হবে। মূলে, দেশের জন্মসূত্র একাত্তরে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে পাঠাগার। গ্রন্থাগার হচ্ছে লেখক, পুস্তক ও পাঠকের সম্মিলনস্থল। সভ্যতার দর্পণ। একটি দেশ তথা সমাজের সার্বিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র ও এই পাঠাগার। সমাজে বিত্তবান অনেকেই আছেন, যারা তাদের অর্জিত অর্থের একটা অংশ বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করেন। পাঠাগার হতে পারে এর জন্য উত্তম জায়গা। সমাজকে এগিয়ে নিতে হলে, তার থেকে অন্ধকার দূর করতে হলে পাঠাগার হতে পারে অন্যতম আলোকবর্তিকা। এ জন্য ঈদে যারা গ্রামে ফিরবেন, বিশেষ করে বিত্তবান মানুষরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন নিজ নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য। আজকের তরুণ-তরুণী যেন বইয়ের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠতে পারে, সে জন্য পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সমাজের সৌহার্দ্য আর সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করার জন্য সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে পাঠাগার। কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে আমরা আমাদের সমাজটাকে যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধাররূপে গড়ে তুলতে পারব, ততই সমাজ এগিয়ে যাবে। আর একটি উন্নত সমাজ ব্যবস্থায় উৎসব হবে আরও আনন্দময় ও অর্থপূর্ণ। শেকড়ের টানে ঘরে ফেরাও তখন সার্থক হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেই দিকে। সবার ঘরে ফেরা নিশ্চিত ও নির্বিঘœ হোক।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলাম লেখক
No comments