এনাফ

আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। মারামারি-কাটাকাটি আর কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করতে সব পক্ষের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি বলেছেন, তা না হলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। পিলখানার বর্বরতা বিডিআর সদস্যরাই সংঘটিত করেছে। ফুল স্টপ। এখানে কোনো ইফ বা  বাট নাই। কোনো বাহিনীকে অবমূল্যায়ন না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, আক্রমণ করবেন না। উপদেশ দেন। তা আমরা গ্রহণ করবো।

মঙ্গলবার ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ উপলক্ষে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে ‘পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাতবরণকারী শহীদ অফিসারদের স্মরণে’ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

বক্তব্যের শুরুতে শহীদ সেনাকর্মকর্তাদের স্মরণ করেন সেনাপ্রধান। তিনি শহীদদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, এখানে আসার পথে তাদের ছবিগুলো দেখছিলাম। আপনারা এগুলো ছবিতে দেখছেন। আমরা কিন্তু এসব চাক্ষুস দেখেছি, বর্বরতার। একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে। এই বর্বরতা কিন্তু কোনো সেনাসদস্য করেননি। সম্পূর্ণটাই তদানীন্তন বিডিআর সদস্য দ্বারা সংঘটিত। ফুল স্টপ। এখানে কোনো ইফ এবং বাট নাই। এখানে যদি ইফ এবং বাট আনেন, এই যে বিচারিক কার্যক্রম এতদিন ধরে হয়েছে ১৬-১৭ বছর ধরে- যারা জেলে আছে, যারা কনভিকটেড সেই বিচারিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। এই জিনিসটা আমাদের খুব পরিষ্কার করে মনে রাখা প্রয়োজন। এই বিচারিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবেন না। যে সমস্ত সদস্য শাস্তি পেয়েছে তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। এখানে কোনো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর মধ্যে উপস্থিত বা ইনভলভ ছিল কিনা এর জন্য কমিশন করা হয়েছে, কমিশনের চেয়ারম্যান এখানে আছেন। তিনি এটা বের করবেন এবং আপনাদের জানাবেন।

বটমলাইন হচ্ছে, সেনাসদস্য যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তারা প্রাণ হারিয়েছেন তদানীন্তন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে। আমরা নিজেরা এই সমস্ত জিনিস নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছি কেউ কেউ। এই জিনিসটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। এটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আজকে আমি কিছু উপদেশ দিয়ে যাবো। সেটা যদি আপনারা গ্রহণ করেন আপনারা লাভবান হবেন। এটা আপনাদের নিশ্চিত করছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা নিজেরা ভেদাভেদ সৃষ্টি না করি। আমরা নিজেরা ইউনাইটেড থাকি। আমাদের মধ্যে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, কোনো ব্যত্যয় থেকে থাকে, কোনো বিভাজন থেকে থাকে সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবো। এটার জন্য ডানে-বামে দৌড়ে কোনো লাভ হবে না, নিজের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হবে না। আমি আপনাদের এই জিনিসটা নিশ্চিত করে দিচ্ছি।

তিনি বলেন, কিছু কিছু সদস্যের দাবি, তারা ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন শাস্তি পেয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন, তারা অযাচিতভাবে শাস্তি পেয়েছেন। এটার জন্য আমি একটা বোর্ড করে দিয়েছি। একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সেই বোর্ডের সদস্য। প্রথম ধাপে ৫১ জন সদস্যের ব্যাপারে আমার কাছে রেকমেন্ডেশন নিয়ে এসেছে। রেকমেন্ডেশনের অধিকাংশ আমি গ্রহণ করেছি। এবং আরও বেশি আমি দিয়েছি। নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীও তাদের এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমার স্ট্যান্ডপয়েন্ট হচ্ছে, যদি কেউ অপরাধ করে থাকে, সেটার জন্য কোনো ছাড় হবে না, বিন্দুমাত্র ছাড় নাই। আমি আপনাদের স্পষ্ট করে দিচ্ছি। এটা একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্স, ডিসিপ্লিনড ফোর্সকে ডিসিপ্লিনে থাকতে দেন।

সেনাপ্রধান বলেন, আজকে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সমস্ত বাহিনী সমস্ত অর্গানাইজেশন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। খালি সেনাবাহিনী টিকে আছে। বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী টিকে আছে। কেন? বিকজ অব ডিসিপ্লিন। আমি আমার অফিসারদের আদেশ দিয়েছি, যদি সামান্যতম কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে যে কারও বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হয়েছে, অপরাধী কি-না, যদি সামান্য কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে, সেটা তাদের ফেবারে যাবে। এটা হচ্ছে আমার ঢালাও নির্দেশ।

সেই হিসেবে আমার কাছে অনেক প্রস্তাব এসেছে। কোনো কোনো প্রস্তাবে আমি নিজে থেকে যোগ করে আরও বেশি আমি দিয়েছি। ্‌এভাবে পর্যায়ক্রমে অফিসাররা অ্যাপিয়ার করবে, আসবে। তাদের এই জিনিসগুলো আমরা দেখবো। দেখে যদি মনে হয় যে আমাদের কিছু করার আছে আমরা করবো। আমরা ন্যায় নীতিতে প্রতিষ্ঠিত থাকবো ইনশাআল্লাহ।

জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আপনারা কিছু মনে করবেন না। আজকে আমি একটু পরিষ্কার করে কথা বলতে চাই। আপনাদের সবার হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এটা যদি গ্রহণ করেন, আপনারা লাভবান হবেন। কোনো ক্ষতি হবে না।

আমার অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নাই, একটাই আকাঙ্ক্ষা। দেশ এবং জাতিটাকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে ছুটিতে যাওয়া।  

আই হ্যাড এনাফ, লাস্ট সেভেন-এইট মান্থস আই হ্যাড এনাফ। আমি চাই দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় রেখে আমরা সেনানিবাসে ফেরত আসবো।

তিনি বলেন, আরেকটা জরুরি বিষয়, আমি ভাবলাম যে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। দেশের এই আইনশৃঙ্খলা খারাপ হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে।

প্রথম কারণটা হচ্ছে, আমরা নিজেরা হানাহানির মধ্যে ব্যস্ত। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে ব্যস্ত। এটা একটা চমৎকার সুযোগ অপরাধীদের জন্য।

যেহেতু আমরা একটা অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছি, তারা খুব ভালোভাবেই জানে এই সময় যদি এই সমস্ত অপরাধ করা যায়, তাহলে এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। সে কারণে এই অপরাধগুলো হচ্ছে। আমরা যদি সংগঠিত থাকি, একত্রিত থাকি, তাহলে অবশ্যই সম্মিলিতভাবে এটা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই সব সংস্থাই অতীতে দেশের জন্য ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ কাজ করেছে। খারাপ কাজের সঙ্গে অসংখ্য ভালো কাজ করেছে।

আজকে দেশের যে স্থিতিশীলতা, দেশটাকে যে এত বছর স্থিতিশীল রাখা হয়েছে, এটার কারণ হচ্ছে এই সশস্ত্র বাহিনীর বহু সদস্য, সিভিলিয়ান সবাই মিলে এই অর্গানাইজেশনগুলোকে ইফেক্টিভ রেখেছে। সেজন্য আজকে এতদিন ধরে একটা সুন্দর পরিবেশ পেয়েছি।

এর মধ্যে যারা কাজ করেছে, যদি অপরাধ করে থাকে তার শাস্তিও হতে হবে, না হলে সেই জিনিস আবার ঘটবে। আমরা সেটাকে বন্ধ করতে চাই চিরতরে। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, আমরা এমনভাবে কাজটা করবো, এই সমস্ত অর্গানাইজেশনগুলোকে যেন আন্ডারমাইন করা না হয়।
আজকে পুলিশ সদস্য কাজ করছে না, একটা বিশাল বড় কারণ হচ্ছে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা, অনেকে জেলে।

র‌্যাব, বিজিবি, ডিজিএফআই, এনএসআই প্যানিকড, গুম-খুনসহ ‘বিভিন্ন দোষোরোপের’ তদন্ত চলছে। অবশ্যই তদন্ত হবে। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে, যেন এ অর্গানাইজেশনগুলো আন্ডারমাইন্ড না হয়।

এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন করে যদি আপনারা মনে করেন যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না। সেটা সম্ভব না, আমি আপনাদের স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি।

তিনি বলেন, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সেনাবাহিনীর না। দুই লাখ পুলিশ আছে, বিজিবি আছে, র‌্যাব আছে, আনসার ভিডিপি আছে। আমার আছে ৩০ হাজার সৈন্য। আমি ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে কীভাবে এটা পূরণ করবো? ৩০ হাজার থাকে, তারা চলে যায় ক্যান্টনমেন্টে, আরও ৩০ হাজার আসে। এটা দিয়ে আমরা দিন রাত চেষ্টা করে যাচ্ছি।

এখানে যে সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল কাজ হয়েছে এগুলো আমাদের নিজস্ব তৈরি। এটা আমাদের নিজস্ব ম্যানুফ্রাকচার, এটা আমরা নিজেরা তৈরি করেছি। এই বিপরীতমুখী কাজ করলে দেশে কখনো শান্তিশৃঙ্খলা আসবে না। জিনিসটা আপনাদের মনে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, আমরা দেশে ফ্রি ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ একটা নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি। তার আগে যে সমস্ত সংস্কার করা প্রয়োজন অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবেন। আমি যতবার ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছি তিনি সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন। আমি প্রথমেই বলেছিলাম ১৮ মাসের মধ্যে একটা নির্বাচন। আমার মনে হয়, সরকার সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে। ড. ইউনূস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশটাকে ইউনাইটেড রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। উনাকে আমাদের সাহায্য করতে হবে, উনি যেন সফল হতে পারেন। সেদিকে আমরা সবাই চেষ্টা করবো। আমরা একসঙ্গে ইনশাআল্লাহ কাজ করে যাবো।
তিনি বলেন, আসেন আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি না করে, দেশ জাতি যেন একসঙ্গে থাকতে পারি সেভাবে কাজ করি। আমাদের মধ্যে মতের বিরোধ থাকতে পারে, চিন্তা-চেতনার বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে যেন আমরা সবাই দেশ ও জাতির দিকে খেয়াল করে সবাই যেন এক থাকতে পারি।

তাহলেই এ দেশ উন্নত হবে, সঠিকপথে পরিচালিত হবে। না হলে আমরা আরও সমস্যার মধ্যে পড়তে যাবো। আমরা ওইদিকে যেতে চাই না। আমি আপনাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। পরে বলবেন সতর্ক করিনি। আপনারা যদি নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে কাজ না করতে পারেন, নিজেরা যদি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন। মারামারি কাটাকাটি করেন, এই দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে।

সেনাপ্রধান বলেন, আমি আজকে বলে দিলাম, না হলে বলবেন যে আপনাদের সতর্ক করিনি, আমি সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের। এই দেশ আমাদের সবার। আমরা সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে চাই। আমরা চাই না হানাহানি, মারামারি কাটাকাটি। আমরা সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমাদের সেনাবাহিনীর উপরে আক্রমণ কইরেন না। একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি। সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারও কারও। কী কারণে আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।

আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফরমে। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আমরা সবাই।

আমাদেরকে সাহায্য করেন, আমাদেরকে আক্রমণ কইরেন না। আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেন, আমাদেরকে উপদেশ দেন। কোনো একটা সমস্যা হলে আমি জেনারেল নুরুদ্দিন স্যারের শরণাপন্ন হই। উনি আমাদের উপদেশ দেন। সিনিয়র জেনারেলদের আমি শরণাপন্ন হই। উনারা আমাকে উপদেশ দেন। আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করবো। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই। দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

সেনাপ্রধান বলেন, আজকে একটু মন খুলে কথা বললাম। এতদিন যে কথা মনের মধ্যে ছিল। সব সময় প্রকাশ করতে পারি না। প্রকাশ করাও যায় না। আজকে প্রকাশ করে ফেললাম। সবার সামনে আমি আমার মনের কথাটা প্রকাশ করে ফেললাম। কাউকে যদি দুঃখ দিয়ে থাকি, আমাকে ক্ষমা করবেন। আসেন আমরা একসঙ্গে কাজ করি। দেশ এবং জাতিকে একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই। এখানেই আমাদের ছেলেমেয়েরা বাস করবে। তাদের জন্য এমন কোনো স্থান আমরা রেখে না যাই, যেখানে হানাহানি, কাটাকাটি মারামারি হবে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.