সংস্কার নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপি’র বিরোধ নেই

সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে, এই ধরনের প্রশ্ন তুলে জনমনে বিভ্রান্তি   সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে মন্তব্য করে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে বিএনপি’র কোনো বিরোধ নেই। সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে, যারা এই ধরনের প্রশ্ন তুলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন। বিএনপি মনে করে সংস্কার কার্যক্রম এটি কোনো শেষ হওয়ার বিষয় নয়। একজন সংস্কার কার্যক্রম শুরু করলে আরেকজন প্রয়োজনীয় সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যায়। কারণ সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। লন্ডন থেকে তারেক রহমান ভার্র্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠানে যুক্ত হন।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সরকারে কিংবা সরকারের বাইরে আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা দরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত উত্তরণ ছাড়া পুঁথিগত সংস্কার অনেকটা অকার্যকর। সংস্কার কার্যক্রমকে কার্যকর করতে চাইলে সবার আগে জনগণের নিত্যদিনের দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা করা দরকার, জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে সংস্কার কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না।

তিনি বলেন, বিতাড়িত স্বৈরাচারের পলায়নের পর গণতন্ত্রকামী জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এক বিশাল দায়িত্ব নিয়ে আজকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তি ও সাংবাদিক সমাজকে সতর্ক থাকা দরকার। আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে চলমান যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে কিন্তু এরই ভেতরে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আজকের সভায় অনেক বক্তা তাদের বক্তব্যে তা তুলে ধরেছেন। বিতাড়িত স্বৈরাচার ও তাদের দোসরচক্র নানা কৌশলে আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার অপচেষ্টা শুরু করেছে। অপশক্তি দেশের ভেতরে এবং বাইরে থেকে বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত। তবে সবাই যদি সতর্ক থাকি বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপরে গুম-হত্যা-নির্যাতনের কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, শহীদদের আকাঙ্ক্ষা একটি গণতান্ত্রিক মানবিক বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের দায়িত্ব। একই সঙ্গে পলাতক স্বৈরাচার ও তার দোসররা যাতে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে না পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করাও কিন্তু আমাদের কর্তব্য। এজন্য যথাযথ আইনগত ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। পলাতক মাফিয়াদের পুনর্বাসন ঠেকাতে তাদেরকে একদিকে আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। অপরদিকে তাদেরকে অবশ্যই জনগণের রাজনৈতিক বিচারের প্রত্যাখাত হওয়ার পরিস্থিতিতে ফেলতে হবে। যদি এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটাতে পারি আমরা- আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, গণবিরোধী বিতাড়িত অপশক্তি বাংলাদেশে রাজনীতিতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হবে না।

তিনি বলেন, খুনি, লুটেরা, মাফিয়া এবং স্বৈরাচারী রাজনৈতিক অপশক্তিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে হলে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। ভোটের অধিকারের সুযোগ পেলে জনগণ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে গণহত্যাকারী, খুনি, লুটেরা, পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদেরকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করে দিতে সক্ষম হবে। বিএনপি মনে করে সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান অবশ্যই প্রয়োজন।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের আগের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ কিংবা ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের আগে দেড় দশকের বাংলাদেশ বর্তমান প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা এক সঙ্গে যায় না। আওয়ামী লীগ আর গণতন্ত্র একে অপরের শত্রু। অপরদিকে বিএনপি’র কাছে গণতন্ত্র বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরাপদ।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতি বিদ্যমান অবস্থা-ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২২ সালে বিএনপি প্রথম ২৭ দফা সংস্কার উপস্থাপন করেছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ২০২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে বিএনপি। বিএনপি’র উপস্থাপিত সংস্কার প্রস্তাবে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অভিজ্ঞ মিডিয়া ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মিডিয়া কমিশনের কথা বলা হয়েছে। আপনারা দেখেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে কাজ করছি, সেখানে সাগর-রুনির বিচারের ব্যাপারে রাষ্ট্র উদাসীন থাকবে না, নিশ্চিত থাকবে মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। এই লক্ষ্য অর্জনে আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই।

সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা প্রয়োজন উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আমরা দেখেছি, ফ্যাসিবাদের আমলে গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী কিংবা যেকোনো মানুষের মধ্যেই যেকোনো বিষয়ে যেকোনো ইস্যুতে দ্বিমত ভিন্নমত থাকবে, থাকতেই পারে। এটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য। ভিন্নমত অথবা দ্বিমতকে শত্রুতা কিংবা নির্লজ্জ দলাদলিতে পরিণত করলে কী পরিণতি হতে পারে গত দেড় দশকে দেশের জনগণ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। পলাতক স্বৈরাচারের সঙ্গে তার অবৈধ মন্ত্রী, এমপি, বুদ্ধিজীবী বা বিচারপতি, বায়তুল মোকাররমের খতিব, প্রেস ক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কিংবা কতিপয় সাংবাদিকের পলায়নের মধ্যদিয়ে আবারো প্রমাণিত হয়েছে অবৈধ রাষ্ট্র শক্তি নয়, বরং শেষ পর্যন্ত জনগণের রায়ই কিন্তু চূড়ান্ত।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে ‘স্বাধীন ও মুক্ত পরিবেশে’ সম্মেলন অনুষ্ঠান হচ্ছে উল্লেখ করে তারেক রহমান তার বক্তব্যের শুরুতে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজীসহ অভ্যুত্থানে নিহতের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। ফ্যাসিবাদী আমলে চাকরিচ্যুত সাংবাদিকদের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

সভায় সার্চ কমিটি গঠনের সমালোচনা করে বাংলাদেশ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা মনে করি এই অন্তর্বর্তী সরকারের সকল সিদ্ধান্ত, সকল নীতি, সকল ভূমিকার মধ্যে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকা উচিত। কিন্তু তিন মাস অতিবাহিত হচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করছি-দুর্ভাগ্যজনক হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো নীতি, কোনো কোনো সিদ্ধান্ত গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলছে না। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।  

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা সংস্কারে অনেকগুলো কমিটি গঠন করেছেন, অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। আপনারা তখন সংস্কার বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু হঠাৎ করে সার্চ কমিটি গঠন করা হলো। সেখানে কি জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে? নির্বাচন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট আসার আগেই একটি সার্চ কমিটি গঠন করলেন। আমরা সেটাকেও ইতিবাচকভাবে দেখছি। কিন্তু আপনারা তো আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া পদ্ধতি দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করলেন।
বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদের প্রথম টার্গেট হচ্ছে গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক। ডিক্টেটররা কখনো এই চতুর্থ স্তম্ভ মেনে নিতে পারে না বলেই প্রথমে এখানেই ধাক্কা দেয়। অনেক সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করেছে। অনেক পত্রিকা-টেলিভিশন বন্ধ করে দিয়েছে। আর এগুলো বন্ধ করেছে, যাতে তারা (আওয়ামী লীগ) অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি-বিদেশে টাকা পাচার করলে তাদের তথ্য ফাঁস না হয়।

ডিইউজে’র সভাপতি মোহাম্মদ শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খানের সঞ্চালনায় সভায় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুল, বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি এম আবদুল্লাহ, বর্তমান মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, ডিইউজে’র সাবেক সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম সহ সভাপতি রাশেদুল হক বক্তব্য রাখেন। এ ছাড়া সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.