উত্তর প্রদেশের সম্ভলে কেন রক্তক্ষয়ী সংঘাত

মিষ্টির দোকানি ৩৫ বছর বয়সের নাঈম আহমদ গত রোববার সকালে ভোজ্যতেল কিনতে বের হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ছোট ভাই তাসলিমের মুঠোফোনে একটি কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন নাঈম।

তাসলিম বলেন, ‘আমি কখনো ওই ফোনের কথা ভুলতে পারব না। পুলিশ দিনদুপুরে আমার ভাইকে গুলি করে মেরে ফেলেছে।’

গত রোববার সকালে ভারতের উত্তর প্রদেশের শহর সম্ভলে রক্তক্ষয়ী এক সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছিল।

মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত শাহি জামা মসজিদ ঘিরে ওই সংঘাত হয়েছে। একটি পিটিশনের ভিত্তিতে সম্প্রতি স্থানীয় একটি আদালত ১৫২৯ সালে তৈরি ওই মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ অনুসারে সরকারি কর্মকর্তারা গত রোববার সকালে শাহি জামা মসজিদে সমীক্ষা করতে এসেছিলেন। স্থানীয় লোকজন এ কাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাত শুরু হয়।

সংঘাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। নিহতদের পরিবার এবং অন্য বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশের গুলিতেই তাঁরা সবাই নিহত হয়েছেন।

অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘দুর্বৃত্তরা’ গুলি ছুড়েছে। কোথা থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, সেটা তাঁরা ‘তদন্ত’ করে দেখছেন।

গত রোববারের ওই ভয়াবহ সংঘাতের পর জেলা কর্তৃপক্ষ শহরে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সব স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে এবং বাইরে থেকে কাউকে শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্দেশ না থাকলেও আতঙ্কে স্থানীয় লোকজন দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। পুলিশ ধরপাকড় চালাচ্ছে। সেখানে কারফিউর মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে রক্তক্ষয়ী এই বিক্ষোভের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে আল–জাজিরা।
কেন সম্ভলে বিক্ষোভ?

তিন বছরের বেশি সময় ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নানা দল এবং তাদের কর্মীরা আদালতে একের পর এক পিটিশন করে যাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, ভারতে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করে মুসলিমদের মসজিদসহ নানা ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে তোলা হয়েছে।

গত ১৯ নভেম্বর সম্ভলের স্থানীয় একটি আদালত এমন একটি পিটিশনের শুনানি করেন। পিটিশনে দাবি করা হয়, একটি হরিহর মন্দির ভেঙে সেই স্থানে ১৫২৯ সালে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁরা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) ওই স্থান ‘ব্যবস্থাপনা করার’ এবং ‘সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার’ নির্দেশ দেওয়ার আবেদন করেন।

আদালত সেদিনই মসজিদ প্রাঙ্গণে সমীক্ষার নির্দেশ দেন। সমীক্ষা দল ১৯ নভেম্বর সমীক্ষার জন্য যায়, কিন্তু সেদিন কাজ শেষ করতে পারেনি। গত রোববার সকালে দলটি তাদের বাকি কাজ শেষ করতে আবার মসজিদ প্রাঙ্গণে যায়।

কিন্তু সেদিনের সমীক্ষা নিয়ে ‘শহরে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে’ বলে জানান সমীক্ষা দলের উপদেষ্টা মাসুদ আলী ফারুকী।

মাসুদ বলেন, ‘সমীক্ষা দল মসজিদের ভেতরে খোঁড়াখুঁড়ি করবে, এমন গুজব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর মানুষ মসজিদের চারপাশে জড়ো হন।’

সেখানে সমীক্ষা দল প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের মতো কিছু খুঁজে পায়নি বলেও জানান মাসুদ।

কিন্তু সমীক্ষা দলের সঙ্গে থাকা হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলোর কয়েকজন সদস্য তাদের পক্ষে স্লোগান দিতে শুরু করেন। মাসুদ আলী বলেন, ‘তাদের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ডের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়।’

শাহি জামা মসজিদ ‘সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ’। ফলে এ মসজিদের আইনি সুরক্ষা আছে। তারও আগে ভারত সরকার এই মসজিদকে ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ’ বলে ঘোষণা করেছে।
শাহি জামা মসজিদে সমীক্ষা কি বৈধ?

১৯৯১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে ‘দ্য প্লেস অব অরশিপ অ্যাক্ট’ (প্রার্থনার স্থান আইন) পাস হয়। প্রাথমিকভাবে ওই আইনে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতে ধর্মীয় উপাসনার স্থানগুলো যেমন ছিল, সেগুলো তেমনই থাকবে। স্বাধীন ভারতে সেগুলোতে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না।

সে সময় ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের দাবি ছিল, মোগল আমলে একটি মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বিজেপির ওই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন।

ওই বিক্ষোভের জেরেই ‘দ্য প্লেস অব অরশিপ অ্যাক্ট’ পাস হয়। কিন্তু ওই আইন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভাঙা আটকাতে পারেনি।

সম্ভলের মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতরও তাঁদের মসজিদ ভেঙে ফেলা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন নাদিম খান। তিনি অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটসের (এপিসিআর) জাতীয় সম্পাদক। সম্ভলে ঠিক কী ঘটেছে, তা অনুসন্ধান করছে সংগঠনটি।

নাদিম বলেন, ‘সমীক্ষার পর তাদেরকে মসজিদ হারাতে হবে। সেখানকার মুসলিমদের মধ্যে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল।’

এদিকে সম্ভলে নিজেদের ছোট্ট বাড়িতে বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে শোক পালন করছেন তাসলিম। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই বিক্ষোভ করতে যাননি। তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন না। তারপরও পুলিশ তাঁকে হত্যা করেছে। এখন আমরা কার কাছে বিচার চাইব?’

উত্তর প্রদেশের সম্ভলে গত রোববার সংঘাতের পর শাহি জামা মসজিদের সামনে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৫ নভেম্বর, ২০২৪
উত্তর প্রদেশের সম্ভলে গত রোববার সংঘাতের পর শাহি জামা মসজিদের সামনে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.