‘তার মতো এমন মানবদরদি খুবই বিরল’ by আশরাফুল ইসলাম
আইভি
রহমান। পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি। ২১শে আগস্টে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু
এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি। ঢাকার
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৪শে আগস্ট আজন্ম
রাজনৈতিক এই নেতা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। তার চির প্রস্থানে জন্মস্থান ভৈরবের
মানুষ হারায় তার একান্ত সুহৃদ, প্রিয় আইভি আপাকে। পৈশাচিক গ্রেনেড হামলায়
প্রিয় আইভি আপার গুরুতর আহত হওয়ার খবর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে
অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে পুরো ভৈরব। পরদিন ২২শে আগস্ট ভৈরবে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল
ডাকা হয়। হরতালে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান আবদুল কুদ্দুস (৩২) নামে এক
আওয়ামী লীগ কর্মী।
নিহত কুদ্দুসের পরিবার বিচার না পেলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা হয় ৩টি মিথ্যা মামলা।
ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক মানবজমিন-এর ভৈরব প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২২শে আগস্ট দিনটি ভৈরববাসীর জন্য এক কালোদিন। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান আহতসহ হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে ২২শে আগস্ট ভৈরবে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এ হরতাল আহ্বান করে। হরতালের সমর্থনে ভোর থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজার আওয়ামী লীগ অফিসে জড়ো হন। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনটি ভৈরব বাজার রেলজংশনের মনমরা রেলসেতুর কাছে পিকেটারদের কবলে পড়ে। উত্তেজিত জনতা ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ আওয়ামী লীগ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ও টিয়ার শেল ছোড়ে। গুলিতে আবদুল কুদ্দুস নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। ঘটনার পর উত্তাল হয়ে পড়ে ভৈরব। এ ঘটনায় পুলিশ ভৈরবের ২ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩টি মিথ্যা মামলা করে। মিথ্যা মামলা করায় আওয়ামী লীগ লাগাতার কর্মসূচি দেয়। পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালায়। গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও হয়রানির আশঙ্কায় অনেকে ভৈরব ছাড়তে বাধ্য হন। পুলিশ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ অফিস অবরুদ্ধ করে রাখে।
সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বদা পরিশ্রমী, অক্লান্ত ছুটে চলা আইভি রহমান আজ স্মৃতির সাদা ফ্রেমে বাঁধা নিশ্চুপ ছবি হলেও, ভৈরববাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কাছে তিনি জীবন্ত, চলমান। তিনি বেঁচে আছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে।
ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক উলফাত আরা জাহান জানান, ১৯৯৬ সালে তিনি যখন ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, আইভি রহমান তখন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান। ভৈরবে আসলেই তিনি ডাকতেন। কথা ও কাজে এক ছিলেন তিনি। দেশীয় খাবার খেতে পছন্দ করতেন তিনি। শুঁটকির ভর্তা ছিল তার প্রিয় খাবার। ১৯৯৮ সালে মহিলা সংস্থার অফিস নির্মাণ ছাড়াও মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনি ভৈরব বাজারে মহিলা সমবায় মার্কেটের জন্য জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উলফাত আরা জাহান বলেন, নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার এমন মানুষ আর দেখা যায় না। গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেও তিনি ভৈরবে এসেছিলেন।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উলফাত আরা জাহান বলেন, ওই বছর ভৈরবে বন্যা হয়েছিল। নিজ এলাকার দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জলাবদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়ি বাড়ি ছুটে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ত্রাণসামগ্রী। জন্মস্থান ভৈরবে তিনি আজীবন এভাবে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ও জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে এখানকার নারীদের উন্নয়ন এবং সমাজের অবহেলিত শিশু, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তিনি ব্যাপক কাজ করেন। সেসব অসহায় মানুষের কাছে আইভি রহমান এখনো দেবীতুল্য। উলফাত আরা জাহান জানান, একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন আইভি রহমান। পরতেন সুতির শাড়ি। আমৃত্যু মানুষকে ভালোবেসে গেছেন, তাদের ভালোবাসা পেয়েছেন। মানুষকে অকাতরে দান করলেও সেসব প্রচার করতেন না তিনি। তার মতো এমন মানবদরদি খুবই বিরল।
১৯৪৪ সালের ৭ই জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চণ্ডিবের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সভ্রান্ত এক পরিবারে তার জন্ম। পিতা মরহুম জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। ৮ বোন ও ৪ ভাইয়ের মধ্যে আইভি পঞ্চম। ছেলেবেলা থেকেই আইভি ছিলেন শান্ত স্বভাবের, তবে প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের জন্য তাকে বাইরে থেকে খুব কঠিন মনে হলেও, আদতে তিনি ছিলেন খুবই দরদি মনের মানুষ। যারা মিশেছে, কাছে গেছে তারাই পেয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা, আদর, মমতা আর সহযোগিতা। প্রথম দর্শনেই আইভিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে নবম শ্রেণি পড়ুয়া আইভির সঙ্গে ১৯৫৮ সালের ২৭শে জুন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমানের বিয়ে হলে নামের পরে ‘রহমান’ যুক্ত হয়। এ নামেই তিনি পরিচিতি পান দেশব্যাপী। শুধু আওয়ামী রাজনীতির জন্য নয়, আইভি রহমান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে পারিবারিকভাবেও জড়িত ছিলেন। তার বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি। একমাত্র ছেলে বিসিবি সভাপতি ও সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন, দুই মেয়ে তানিয়া বখ্ত ও তনিমা রহমান ময়না এবং তাদের ছেলেমেয়ে ও স্বামী জিল্লুর রহমানকে নিয়ে তার পারিবারিক জীবন ছিল খুবই গোছানো। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে আইভি রহমানের মৃত্যুর পর তাই বিষাদভরা কণ্ঠে মো. জিল্লুর রহমান জানিয়েছিলেন, ‘আইভিকে ছাড়া আমি জীবন্মৃত।’ ভৈরবের বাড়ির ‘গৃহকোণ’ নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আইভি ভবন’। এই বাড়িটিতে ভৈরববাসীর সঙ্গে আইভি রহমানের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইভির অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই সঙ্গে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে আইভি রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আইভি রহমান চলে গেছেন বার বছর হলো। কিন্তু ভৈরবে ‘আইভি ভবন’ আছে আগের মতোই। সেখানে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এসে অশ্রু-পুষ্পে ভৈরববাসী স্মরণ করেন তাদের প্রিয় নেত্রী আইভি রহমানকে। বাংলার এই কৃতী সন্তানের স্মরণে ভৈরবের কমলপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ‘আইভি রহমান গেইট’। চণ্ডিবের গ্রামের নিজ বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। ভৈরব জিল্লুর রহমান সরকারি মহিলা কলেজের একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। আইভি রহমান নিহত হওয়ার পর তার নামে ভৈরবে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিল এলাকাবাসী। কিন্তু সেটি আজও উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
নিহত কুদ্দুসের পরিবার বিচার না পেলেও স্থানীয় নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা হয় ৩টি মিথ্যা মামলা।
ওই সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক মানবজমিন-এর ভৈরব প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২২শে আগস্ট দিনটি ভৈরববাসীর জন্য এক কালোদিন। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমান আহতসহ হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে ২২শে আগস্ট ভৈরবে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এ হরতাল আহ্বান করে। হরতালের সমর্থনে ভোর থেকে নেতাকর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজার আওয়ামী লীগ অফিসে জড়ো হন। এ সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনটি ভৈরব বাজার রেলজংশনের মনমরা রেলসেতুর কাছে পিকেটারদের কবলে পড়ে। উত্তেজিত জনতা ট্রেনটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ আওয়ামী লীগ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ও টিয়ার শেল ছোড়ে। গুলিতে আবদুল কুদ্দুস নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। ঘটনার পর উত্তাল হয়ে পড়ে ভৈরব। এ ঘটনায় পুলিশ ভৈরবের ২ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩টি মিথ্যা মামলা করে। মিথ্যা মামলা করায় আওয়ামী লীগ লাগাতার কর্মসূচি দেয়। পুলিশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালায়। গ্রেপ্তার আতঙ্ক ও হয়রানির আশঙ্কায় অনেকে ভৈরব ছাড়তে বাধ্য হন। পুলিশ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ অফিস অবরুদ্ধ করে রাখে।
সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেন, সর্বদা পরিশ্রমী, অক্লান্ত ছুটে চলা আইভি রহমান আজ স্মৃতির সাদা ফ্রেমে বাঁধা নিশ্চুপ ছবি হলেও, ভৈরববাসী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার কাছে তিনি জীবন্ত, চলমান। তিনি বেঁচে আছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে।
ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক উলফাত আরা জাহান জানান, ১৯৯৬ সালে তিনি যখন ভৈরব মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন, আইভি রহমান তখন কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান। ভৈরবে আসলেই তিনি ডাকতেন। কথা ও কাজে এক ছিলেন তিনি। দেশীয় খাবার খেতে পছন্দ করতেন তিনি। শুঁটকির ভর্তা ছিল তার প্রিয় খাবার। ১৯৯৮ সালে মহিলা সংস্থার অফিস নির্মাণ ছাড়াও মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনি ভৈরব বাজারে মহিলা সমবায় মার্কেটের জন্য জায়গা বরাদ্দের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উলফাত আরা জাহান বলেন, নারী উন্নয়ন ও নারী অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার এমন মানুষ আর দেখা যায় না। গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগেও তিনি ভৈরবে এসেছিলেন।
সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উলফাত আরা জাহান বলেন, ওই বছর ভৈরবে বন্যা হয়েছিল। নিজ এলাকার দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। ত্রাণসামগ্রী নিয়ে জলাবদ্ধ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়ি বাড়ি ছুটে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ত্রাণসামগ্রী। জন্মস্থান ভৈরবে তিনি আজীবন এভাবে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ও জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতির অবৈতনিক প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে এখানকার নারীদের উন্নয়ন এবং সমাজের অবহেলিত শিশু, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে তিনি ব্যাপক কাজ করেন। সেসব অসহায় মানুষের কাছে আইভি রহমান এখনো দেবীতুল্য। উলফাত আরা জাহান জানান, একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করতেন আইভি রহমান। পরতেন সুতির শাড়ি। আমৃত্যু মানুষকে ভালোবেসে গেছেন, তাদের ভালোবাসা পেয়েছেন। মানুষকে অকাতরে দান করলেও সেসব প্রচার করতেন না তিনি। তার মতো এমন মানবদরদি খুবই বিরল।
১৯৪৪ সালের ৭ই জুলাই কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব শহরের চণ্ডিবের গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সভ্রান্ত এক পরিবারে তার জন্ম। পিতা মরহুম জালাল উদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ। মা হাসিনা বেগম ছিলেন আদর্শ গৃহিণী। ৮ বোন ও ৪ ভাইয়ের মধ্যে আইভি পঞ্চম। ছেলেবেলা থেকেই আইভি ছিলেন শান্ত স্বভাবের, তবে প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাবের জন্য তাকে বাইরে থেকে খুব কঠিন মনে হলেও, আদতে তিনি ছিলেন খুবই দরদি মনের মানুষ। যারা মিশেছে, কাছে গেছে তারাই পেয়েছে অপরিসীম ভালোবাসা, আদর, মমতা আর সহযোগিতা। প্রথম দর্শনেই আইভিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে নবম শ্রেণি পড়ুয়া আইভির সঙ্গে ১৯৫৮ সালের ২৭শে জুন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমানের বিয়ে হলে নামের পরে ‘রহমান’ যুক্ত হয়। এ নামেই তিনি পরিচিতি পান দেশব্যাপী। শুধু আওয়ামী রাজনীতির জন্য নয়, আইভি রহমান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে পারিবারিকভাবেও জড়িত ছিলেন। তার বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি। একমাত্র ছেলে বিসিবি সভাপতি ও সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন, দুই মেয়ে তানিয়া বখ্ত ও তনিমা রহমান ময়না এবং তাদের ছেলেমেয়ে ও স্বামী জিল্লুর রহমানকে নিয়ে তার পারিবারিক জীবন ছিল খুবই গোছানো। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে আইভি রহমানের মৃত্যুর পর তাই বিষাদভরা কণ্ঠে মো. জিল্লুর রহমান জানিয়েছিলেন, ‘আইভিকে ছাড়া আমি জীবন্মৃত।’ ভৈরবের বাড়ির ‘গৃহকোণ’ নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আইভি ভবন’। এই বাড়িটিতে ভৈরববাসীর সঙ্গে আইভি রহমানের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আইভির অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বর্ণাঢ্য জীবনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। একই সঙ্গে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে আইভি রহমান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ভারতে গিয়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী হন। ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আইভি রহমান চলে গেছেন বার বছর হলো। কিন্তু ভৈরবে ‘আইভি ভবন’ আছে আগের মতোই। সেখানে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এসে অশ্রু-পুষ্পে ভৈরববাসী স্মরণ করেন তাদের প্রিয় নেত্রী আইভি রহমানকে। বাংলার এই কৃতী সন্তানের স্মরণে ভৈরবের কমলপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে নির্মাণ করা হয়েছে ‘আইভি রহমান গেইট’। চণ্ডিবের গ্রামের নিজ বাড়িতে স্থাপন করা হয়েছে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। ভৈরব জিল্লুর রহমান সরকারি মহিলা কলেজের একটি ছাত্রীনিবাসের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। আইভি রহমান নিহত হওয়ার পর তার নামে ভৈরবে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিল এলাকাবাসী। কিন্তু সেটি আজও উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
No comments