শৈশব বনাম গ্যাজেট by হাসান ইমাম
ডিজিটাল
বিশ্ব এখন বাস্তবতা। এ এমন এক বাস্তবতা, যাকে আঁকড়ে ধরা বা এড়িয়ে
যাওয়া—কোনোটাই আর কারো ইচ্ছাধীন নয়; মেনে নেওয়াই নিয়তি। এই ‘বিরাট’
বাস্তবের ছোট্ট উদাহরণ বুঝি হাতের মুঠোয় থাকা কয়েক ইঞ্চির স্ক্রিন (বা
পর্দা), যাতে ঠিক এঁটে গেছে গোটা বিশ্ব মায় বহির্বিশ্ব! আক্ষরিক অর্থেই
দুনিয়া আজ হাতের মুঠোয়। মানুষে মানুষে যোগাযোগ, আর্থিক লেনদেন, খবরাখবর,
তত্ত্বতালাশ থেকে শুরু করে নিখাদ বিনোদন—এমন কিছুই নেই, যার দায়িত্ব
স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপকে দেওয়া হয়নি।
প্রযুক্তি জীবনকে কতটা সহজ-সাবলীল, গতিশীল করেছে, তা নিক্তিতে হয়তো পরিমাপযোগ্য নয়। তবে তার ব্যাপকতা এতটাই যে, এখন জীবন অনেকটাই নির্ভার করেছে প্রযুক্তি। তাই বলে শিশুদের ভবিষ্যত্ গড়ার ভারও কি গ্যাজেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া চলে? সমাজ যেন সেই কাজটিই করছে; শৈশব সাজানোর দায়িত্ব গছিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তির কাঁধে।
প্রযুক্তিময় বিশ্বে এটা বলা অন্যায় হবে না যে, চোখ ফোটার পর থেকেই শিশু আসক্ত হচ্ছে গ্যাজেটে। তা সে অক্ষর চেনার জন্যই হোক, ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা বা খাবার গলাধঃকরণের জন্যই হোক। ভাবনা কী, আছে নির্ভাবনার গ্যাজেট! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মুশকিল-আসানের সহজ তরিকা কি অন্য কোনো জটিল মুসিবত ডেকে আনছে না?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যা বলছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার কারণ ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনা। সম্প্রতি সংস্থাটি তাদের হালনাগাদ পর্যালোচনায় সাফ বলেছে, দুই থেকে চার বছরের শিশুদের দিনে এক ঘণ্টার বেশি ডিজিটাল স্ক্রিনের সামনে থাকতে দেওয়া চলবে না; কোনো অজুহাতেই না। স্ক্রিন আছে এমন যে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া ঠিক হবে না আরো কমবয়সিদের, নাড়াচাড়া তো দূরের কথা। ডব্লিউএইচও তাদের গবেষণায় বলছে, বিশ্বের একটি বড়ো অংশের শিশুদের হাতে কোনো না কোনোভাবে স্মার্টফোনের মতো সহজলভ্য গ্যাজেট সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। যেকোনো সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাধানের পথে তো হাঁটছেই না, উলটো মনোযোগ দিচ্ছে হাতে থাকা স্ক্রিনে। ফলে শৈশব থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজছে আবেগের; মনোজগতের দুয়ার বন্ধই থাকছে।
শিশুর মানসিক বিকাশের এই পর্বে বিষয়টি যে অত্যন্ত উদ্বেগের, তাতে বোধ করি কারো ভিন্নমত থাকার কথা নয়। উপরন্তু, স্ক্রিনের সামনে টানা বসে থাকার প্রবণতায় বাড়ছে স্থূলতা। অনিদ্রার মতো সমস্যার বাড়বাড়ন্তও ঘটছে সমানতালে, যা একইসঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাত্, সমস্যা এতটাই প্রকট যে, চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমাদের উপেক্ষার মাশুল গুনবে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম।
মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা বা শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে তবু কিছু আলাপ-আলোচনা হয় বিভিন্ন ফোরাম, প্ল্যাটফরমসহ গণমাধ্যম বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। কিন্তু সমাজবিচ্ছিন্নতায় স্মার্টফোনের অবদান নিয়ে তেমন কোনো আওয়াজ কালেভদ্রেও তোলা হয় না। অথচ দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
প্রযুক্তির রমরমা এই ‘আধুনিক-প্লাস’ বিশ্বে শিশুরা বড়োই একা। যৌথ পরিবারের ধারণা আমাদের মনোজগত্ থেকে এখন ‘মাইনাস’ হয়েছে। ছোটো হতে হতে পরিবার এখন স্রেফ মা ও বাবায় সীমাবদ্ধ। তার ওপর তাদের উভয়ের কর্মজীবন, উদয়াস্ত ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার গ্রাফ। যে নিরাপদ পারিবারিক বেষ্টনী শিশুকে এযাবত্ কাল ঘিরে রাখত পরম যত্নে, তা ক্রমে ভেঙে পড়ছে। এমন ‘অরক্ষিত’ শিশুই শিকার হচ্ছে গ্যাজেটের। অর্থাত্, গ্যাজেটে মগ্ন-মত্ত শিশু আরও বেশি সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নিঃসঙ্গ হচ্ছে।
দুটি কারণ পাশাপাশি একটি অন্যটিকে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে। দরকারি সাহচর্য, বিনোদন, শিক্ষা—সবকিছুই স্ক্রিনে পেয়ে পারস্পরিক মেলামেশা ও লেনাদেনার তাগিদ হারাচ্ছে শিশু। কোনো কিছুই আর অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শিখছে না সে। অন্যদিকে, তার বৌদ্ধিক বিকাশও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সঙ্গে ফাউ হিসেবে শারীরিক ক্ষতি তো আছেই।
স্ক্রিনসর্বস্ব জীবনে শিশু নিজের কল্পনা ঝালিয়ে নেওয়ার অবসর পায় না, সুযোগও ঘটে না। স্ক্রিনটিই নানা রঙিন মোড়কে তার কল্পনাটিকে বাস্তবে এনে ফেলে। ফলে স্ক্রিনে দেখা গল্পকে, ভাবনাকেই সে নিজস্ব কল্পনা বলে ভাবতে থাকে। বছর কয়েক আগেও ঠাকুমার ঝুলি, দৈত্যদানো বা লালকমল-নীলকমলের গল্প শুনে সে নিজের মনে কতগুলো অবয়ব রচনা করত। যে কোনো গল্পের সার্থকতাও সেখানে।
কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে সেই গল্পের বাহারি ভিডিও শিশুর নিজস্ব কল্পনার জগিটকে স্রেফ গুম করে ফেলছে। শিশুমন কল্পনা আর বাস্তবের ফারাক করতে পারছে না। কাগুজে ধারণা হয়ে থাকছে শিশুর কল্পনাশক্তির উন্মেষ, মনোজগতের বিস্তার। আগামী প্রজন্মের একটা বড়ো অংশকে কি আমরা এমন ‘জড়ভরত’ হিসেবে দেখতে চাই?
>>>লেখক :সাংবাদিক
প্রযুক্তি জীবনকে কতটা সহজ-সাবলীল, গতিশীল করেছে, তা নিক্তিতে হয়তো পরিমাপযোগ্য নয়। তবে তার ব্যাপকতা এতটাই যে, এখন জীবন অনেকটাই নির্ভার করেছে প্রযুক্তি। তাই বলে শিশুদের ভবিষ্যত্ গড়ার ভারও কি গ্যাজেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া চলে? সমাজ যেন সেই কাজটিই করছে; শৈশব সাজানোর দায়িত্ব গছিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তির কাঁধে।
প্রযুক্তিময় বিশ্বে এটা বলা অন্যায় হবে না যে, চোখ ফোটার পর থেকেই শিশু আসক্ত হচ্ছে গ্যাজেটে। তা সে অক্ষর চেনার জন্যই হোক, ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা বা খাবার গলাধঃকরণের জন্যই হোক। ভাবনা কী, আছে নির্ভাবনার গ্যাজেট! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই মুশকিল-আসানের সহজ তরিকা কি অন্য কোনো জটিল মুসিবত ডেকে আনছে না?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যা বলছে, তাতে শঙ্কিত হওয়ার কারণ ষোলো আনা ছাড়িয়ে আঠারো আনা। সম্প্রতি সংস্থাটি তাদের হালনাগাদ পর্যালোচনায় সাফ বলেছে, দুই থেকে চার বছরের শিশুদের দিনে এক ঘণ্টার বেশি ডিজিটাল স্ক্রিনের সামনে থাকতে দেওয়া চলবে না; কোনো অজুহাতেই না। স্ক্রিন আছে এমন যে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেওয়া ঠিক হবে না আরো কমবয়সিদের, নাড়াচাড়া তো দূরের কথা। ডব্লিউএইচও তাদের গবেষণায় বলছে, বিশ্বের একটি বড়ো অংশের শিশুদের হাতে কোনো না কোনোভাবে স্মার্টফোনের মতো সহজলভ্য গ্যাজেট সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। যেকোনো সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাধানের পথে তো হাঁটছেই না, উলটো মনোযোগ দিচ্ছে হাতে থাকা স্ক্রিনে। ফলে শৈশব থেকে বিদায়ঘণ্টা বাজছে আবেগের; মনোজগতের দুয়ার বন্ধই থাকছে।
শিশুর মানসিক বিকাশের এই পর্বে বিষয়টি যে অত্যন্ত উদ্বেগের, তাতে বোধ করি কারো ভিন্নমত থাকার কথা নয়। উপরন্তু, স্ক্রিনের সামনে টানা বসে থাকার প্রবণতায় বাড়ছে স্থূলতা। অনিদ্রার মতো সমস্যার বাড়বাড়ন্তও ঘটছে সমানতালে, যা একইসঙ্গে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অর্থাত্, সমস্যা এতটাই প্রকট যে, চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমাদের উপেক্ষার মাশুল গুনবে ভবিষ্যত্ প্রজন্ম।
মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা বা শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে তবু কিছু আলাপ-আলোচনা হয় বিভিন্ন ফোরাম, প্ল্যাটফরমসহ গণমাধ্যম বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। কিন্তু সমাজবিচ্ছিন্নতায় স্মার্টফোনের অবদান নিয়ে তেমন কোনো আওয়াজ কালেভদ্রেও তোলা হয় না। অথচ দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।
প্রযুক্তির রমরমা এই ‘আধুনিক-প্লাস’ বিশ্বে শিশুরা বড়োই একা। যৌথ পরিবারের ধারণা আমাদের মনোজগত্ থেকে এখন ‘মাইনাস’ হয়েছে। ছোটো হতে হতে পরিবার এখন স্রেফ মা ও বাবায় সীমাবদ্ধ। তার ওপর তাদের উভয়ের কর্মজীবন, উদয়াস্ত ব্যস্ততা, ক্যারিয়ার গ্রাফ। যে নিরাপদ পারিবারিক বেষ্টনী শিশুকে এযাবত্ কাল ঘিরে রাখত পরম যত্নে, তা ক্রমে ভেঙে পড়ছে। এমন ‘অরক্ষিত’ শিশুই শিকার হচ্ছে গ্যাজেটের। অর্থাত্, গ্যাজেটে মগ্ন-মত্ত শিশু আরও বেশি সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, নিঃসঙ্গ হচ্ছে।
দুটি কারণ পাশাপাশি একটি অন্যটিকে পুষ্টি জুগিয়ে চলেছে। দরকারি সাহচর্য, বিনোদন, শিক্ষা—সবকিছুই স্ক্রিনে পেয়ে পারস্পরিক মেলামেশা ও লেনাদেনার তাগিদ হারাচ্ছে শিশু। কোনো কিছুই আর অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে শিখছে না সে। অন্যদিকে, তার বৌদ্ধিক বিকাশও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সঙ্গে ফাউ হিসেবে শারীরিক ক্ষতি তো আছেই।
স্ক্রিনসর্বস্ব জীবনে শিশু নিজের কল্পনা ঝালিয়ে নেওয়ার অবসর পায় না, সুযোগও ঘটে না। স্ক্রিনটিই নানা রঙিন মোড়কে তার কল্পনাটিকে বাস্তবে এনে ফেলে। ফলে স্ক্রিনে দেখা গল্পকে, ভাবনাকেই সে নিজস্ব কল্পনা বলে ভাবতে থাকে। বছর কয়েক আগেও ঠাকুমার ঝুলি, দৈত্যদানো বা লালকমল-নীলকমলের গল্প শুনে সে নিজের মনে কতগুলো অবয়ব রচনা করত। যে কোনো গল্পের সার্থকতাও সেখানে।
কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে সেই গল্পের বাহারি ভিডিও শিশুর নিজস্ব কল্পনার জগিটকে স্রেফ গুম করে ফেলছে। শিশুমন কল্পনা আর বাস্তবের ফারাক করতে পারছে না। কাগুজে ধারণা হয়ে থাকছে শিশুর কল্পনাশক্তির উন্মেষ, মনোজগতের বিস্তার। আগামী প্রজন্মের একটা বড়ো অংশকে কি আমরা এমন ‘জড়ভরত’ হিসেবে দেখতে চাই?
>>>লেখক :সাংবাদিক
No comments