শ্যাম শরনের দৃষ্টিতে বিশ্ব এবং তাতে ভারতের স্থান by স্বপ্ন কনা নাইডু
ভারতীয়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে স্মৃতিকথা
লিখছেন। এগুলো যেমন তাদের সময়ের অসাধারণ রাজনৈতিক ভাষ্য, একইভাবে এগুলোর
বিশেষ সাহিত্যিক মূল্যও রয়েছে। এই দিক থেকে রাষ্ট্রদূত শ্যাম শরন তার সময়কে
ধরে রেখেছেন। গোপনীয়তার আবরণে মোড়া পেশাগত জীবনে কী বললেন, আর কী বললেন
না, উভয়টারই বিপুল তাৎপর্য রয়েছে। এ ধরনের স্মৃতিকথা তাই কিছুটা বিতর্ক
সৃষ্টি করবেই। আবার অনেক না-জানা কাহিনীর প্রকাশ ঘটাবে। অবশ্য ভারত কোন
দৃষ্টিতে বিশ্বকে দেখে তা ব্যক্তিগত জীবনের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীন। এ
কারণে বইটি প্রকাশের পরও শরন নিজে অজানা থেকে গেছেন।
সম্প্রতি ইংলিশ হিস্টরিক্যাল জার্নালে ভ্রমণ কাহিনী লেখার দক্ষতা নেই এমন কূটনীতিকদের ভ্রমণকাহিনী লেখা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু শ্যাম শরনের বইটি ওই সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে শরনের চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা সত্যিকারের প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। এতে চীনা শিনজিয়াংয়ের কাশগরে ভারতীয় মুদ্রা নিয়ে গল্প রয়েছে, তার চিনি বাগ সফরের কথা আছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ম্যান্ডারিন শিক্ষকের সাথে তার আলাপচারিতা। এখানে সময় সম্পর্কে চীনা ধারণা প্রচলিত মতকে উল্টে দেয়। তাতে দেখা যায়, অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতকে দেখতে পাই না বলে, সেটি আছে পেছনে।
শরন নানা গুরুভার বহন করেছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা। তিনি অনেক দিন ধরেই চাপে থাকার ধারণাটি বাদ দিয়ে আমরা আরো ভালো করতে পারি- ধারণাটি গ্রহণের কথা বলে আসছিলেন। বিষয়টি তিনি বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। এই দিক থেকে বইটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
তবে এই বইটির প্রকৃত মূল্য সম্ভবত নিহিত রয়েছে এর মূল প্রতিবাদ্যকে ধারণা করা বিষয়ে। তিনি ঋগবেদ, কৌটিল্য, তুকিডিদেস, ওটো ভন বিসমার্ক, জন স্ট্রেসি, ওয়াল্টার রাসেল মিড, হেনরি কিসিঞ্জার ও অমর্ত্য সেনের মতো বিভিন্ন উৎসের ওপর আলোকপাত করেছেন। তিন ধারার রচনাকে এক ঐতিহ্যের অংশের মতো করে তুলে ধরেছেন। তিনি তার বইয়ের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক তত্ত্বকে ২০ শতকের পাশ্চাত্য ঘরানার বিশ্ব রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন।
এই বইয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কূটনৈতিক তত্ত্বের ওপরও আলোকপাত করেছে। লেখক বলেছেন, কূটনীতির ধারণাটি কেবল রাজনীতির হাতিয়ারই নয়, বরং এটি রাজনীতির আকারও গড়ে দেয়। কারণ আমরা জানি, কূটনীতি পরিচালনা করেন কূটনীতিবিদেরা। এর মাধ্যমে তারা বিশ্ব রাজনীতির স্বরূপই উন্মোচন করেন।
বইটিতে এমনসব বিষয় রয়েছে, যা আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। পাকিস্তানের সাথে কিংবা চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো কি আমরা দূরে সরিয়ে রাখতে পারি?
শরনের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টতই বিপুল বিস্তৃত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তিনি যত্ন করে তুলে ধরেছেন।
চীনা কূটনৈতিক বিভাগে ছোট একটি বিদ্রোহ, পরমাণু সরবরাহ গ্রুপে আলোচনা কিংবা জলবায়ু নিয়ে জাতিসংঘ কাঠামোগত কনভেশনের মতো বিষয় রয়েছে বইটিতে। এসব বিষয়ে ফলাফল কী হয়েছিল, আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু নেপথ্যে কী কী ঘটেছিল, সেসব অজানা কাহিনীই এই বইতে স্থান পেয়েছে।
বইটিতে শরন দুটি থিমের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে কোনো বিষয়েই বিস্তারিত বর্ণনার দিকে পা বাড়াননি। প্রতিটি অধ্যায়ে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছেন। কিন্তু কোনোটিতেই বিস্তারিত বিবরণ দেননি।
এই বইয়ে সবচেয়ে উদ্দীপ্ত এবং পূর্ণ সম্ভাবনাময় বিষয় হলো শরনের এই ‘গভীর উপলব্ধি যে কোনো জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন অবশ্যই স্বকীয়তার বাইরেও কিছু বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।’ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের লোকজনের কাছে এটি সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। বইটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভারতীয় কূটনৈতিক কোরের রয়েছে বিপুল ঐতিহ্য।
এই বইয়ে বলা হয়েছে, একুশ শতকের ভারতকে অবশ্যই তার উচ্চাভিলাষকে জাগাতে হবে। তবে তাকে সেইসাথে এটিও স্বীকার করে নিতে হবে, বিশ্ব এখন নতুন এবং অপরিচিত ধরনের বিপদের মুখে রয়েছে। এই ধরনের যুক্তিকে অপছন্দ করা কঠিন। আর শরনের প্রিয় হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, সত্য বলার মধ্যে বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে।
লেখক: বর্তমান এলএসই আইডিইএএস, লন্ডনে অনাবাসিক ফেলো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা সমীক্ষা, শান্তিরক্ষা এবং ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে।
সম্প্রতি ইংলিশ হিস্টরিক্যাল জার্নালে ভ্রমণ কাহিনী লেখার দক্ষতা নেই এমন কূটনীতিকদের ভ্রমণকাহিনী লেখা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু শ্যাম শরনের বইটি ওই সমালোচনা উড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে শরনের চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা সত্যিকারের প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। এতে চীনা শিনজিয়াংয়ের কাশগরে ভারতীয় মুদ্রা নিয়ে গল্প রয়েছে, তার চিনি বাগ সফরের কথা আছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ম্যান্ডারিন শিক্ষকের সাথে তার আলাপচারিতা। এখানে সময় সম্পর্কে চীনা ধারণা প্রচলিত মতকে উল্টে দেয়। তাতে দেখা যায়, অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতকে দেখতে পাই না বলে, সেটি আছে পেছনে।
শরন নানা গুরুভার বহন করেছেন। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করা। তিনি অনেক দিন ধরেই চাপে থাকার ধারণাটি বাদ দিয়ে আমরা আরো ভালো করতে পারি- ধারণাটি গ্রহণের কথা বলে আসছিলেন। বিষয়টি তিনি বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। এই দিক থেকে বইটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
তবে এই বইটির প্রকৃত মূল্য সম্ভবত নিহিত রয়েছে এর মূল প্রতিবাদ্যকে ধারণা করা বিষয়ে। তিনি ঋগবেদ, কৌটিল্য, তুকিডিদেস, ওটো ভন বিসমার্ক, জন স্ট্রেসি, ওয়াল্টার রাসেল মিড, হেনরি কিসিঞ্জার ও অমর্ত্য সেনের মতো বিভিন্ন উৎসের ওপর আলোকপাত করেছেন। তিন ধারার রচনাকে এক ঐতিহ্যের অংশের মতো করে তুলে ধরেছেন। তিনি তার বইয়ের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক তত্ত্বকে ২০ শতকের পাশ্চাত্য ঘরানার বিশ্ব রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন।
এই বইয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কূটনৈতিক তত্ত্বের ওপরও আলোকপাত করেছে। লেখক বলেছেন, কূটনীতির ধারণাটি কেবল রাজনীতির হাতিয়ারই নয়, বরং এটি রাজনীতির আকারও গড়ে দেয়। কারণ আমরা জানি, কূটনীতি পরিচালনা করেন কূটনীতিবিদেরা। এর মাধ্যমে তারা বিশ্ব রাজনীতির স্বরূপই উন্মোচন করেন।
বইটিতে এমনসব বিষয় রয়েছে, যা আমরা কোনোভাবেই এড়াতে পারি না। পাকিস্তানের সাথে কিংবা চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক, কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো কি আমরা দূরে সরিয়ে রাখতে পারি?
শরনের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্টতই বিপুল বিস্তৃত। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তিনি যত্ন করে তুলে ধরেছেন।
চীনা কূটনৈতিক বিভাগে ছোট একটি বিদ্রোহ, পরমাণু সরবরাহ গ্রুপে আলোচনা কিংবা জলবায়ু নিয়ে জাতিসংঘ কাঠামোগত কনভেশনের মতো বিষয় রয়েছে বইটিতে। এসব বিষয়ে ফলাফল কী হয়েছিল, আমরা সবাই তা জানি। কিন্তু নেপথ্যে কী কী ঘটেছিল, সেসব অজানা কাহিনীই এই বইতে স্থান পেয়েছে।
বইটিতে শরন দুটি থিমের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। তবে কোনো বিষয়েই বিস্তারিত বর্ণনার দিকে পা বাড়াননি। প্রতিটি অধ্যায়ে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছেন। কিন্তু কোনোটিতেই বিস্তারিত বিবরণ দেননি।
এই বইয়ে সবচেয়ে উদ্দীপ্ত এবং পূর্ণ সম্ভাবনাময় বিষয় হলো শরনের এই ‘গভীর উপলব্ধি যে কোনো জাতির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন অবশ্যই স্বকীয়তার বাইরেও কিছু বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।’ রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের লোকজনের কাছে এটি সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। বইটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভারতীয় কূটনৈতিক কোরের রয়েছে বিপুল ঐতিহ্য।
এই বইয়ে বলা হয়েছে, একুশ শতকের ভারতকে অবশ্যই তার উচ্চাভিলাষকে জাগাতে হবে। তবে তাকে সেইসাথে এটিও স্বীকার করে নিতে হবে, বিশ্ব এখন নতুন এবং অপরিচিত ধরনের বিপদের মুখে রয়েছে। এই ধরনের যুক্তিকে অপছন্দ করা কঠিন। আর শরনের প্রিয় হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, সত্য বলার মধ্যে বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে।
লেখক: বর্তমান এলএসই আইডিইএএস, লন্ডনে অনাবাসিক ফেলো। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা সমীক্ষা, শান্তিরক্ষা এবং ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ে তার আগ্রহ রয়েছে।
No comments