আসুন, এখন দেখি প্রেম জিনিশটা কী? -আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর প্রেম থেকে

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
অনেকদিন ধরে আমি নানান অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছি, কিন্তু বক্তৃতা দেবার অস্বস্তি আজও গেল না। এই অস্বস্তি আমার নার্ভাস স্বভাবের জন্য। এ আমার জন্মগত। বহু চেষ্টা করেও এ থেকে রেহাই পাই নি। দেখুন (উঁচু করে গ্লাস দেখিয়ে) মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানোর আগে আমি কিন্তু পানির গ্লাসটা ঠিকই সঙ্গে এনেছি। না, তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে নয়; গলা শুকিয়ে গেলে দু-এক ঢোক গলায় ঢেলে সাহসটা ফিরিয়ে আনার জন্যে। দেখুন, এখনই, আমার বক্তব্যের সমর্থনে, আমি আপনাদের সামনেই এক ঢোক খেয়ে নিচ্ছি। [পানি খাওয়া ও সবার হাসি।] আমার নার্ভাস হওয়ার কথা শুনলে সবাই খেঁকিয়ে ওঠে।
বলে, নখরা। নার্ভাস হলে টিভিতে অমন চটাং চটাং কথা বল কী করে! আমি তাদের বলি: স্টুডিওতে একবার এলেই দেখতে পেতে প্রতিটা কাট্-এর ফাঁকে আমাকে ক-গ্লাস পানি খেতে হয়।

একবার অভিনেতা গোলাম মোস্তফা আমার স্টুডিওতে এসেছিলেন, আমি সত্যি নার্ভাস হই কিনা দেখার জন্যে। দেখার পরে স্বীকার করেছিলেন আমার নার্ভাস হওয়ার ব্যাপারটা শুধু গালগল্প নয়, আসলেই সত্যি। বলেছিলেন: আসলে ব্যাপারটা কী হয় জানেন? নার্ভাস হয়ে মরিয়া অবস্থায় মুখে যা আসে আপনি বলতে থাকেন। লোকে ভাবে, কথার তুবড়ি ছুটছে।

টেলিভিশনে যা-ই হোক, সভায় অনুষ্ঠানে কথা বলতে ভয় আমার আরও বেড়ে যায়। একে তো সেখানে মানুষ অনেক, তার ওপর যত মানুষ তার দ্বিগুণ সংখ্যক চোখ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে-এই চাপ আমি সহ্য করতে পারি না। আমার ভালো লাগে বন্ধুবান্ধব মিলে নিশ্চিন্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমজমাট আড্ডা দিতে। সুধীবৃন্দ, আপনাদের অনেকের মতো কর্মবীর বা জাগতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত আমি নই। আমার জীবনের অর্ধেক সময় নষ্ট হয়েছে অর্থহীন আড্ডায়। এতে আমার ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু তাতে আমার দুঃখ নেই। আড্ডার ফূর্তিতে জীবন মৌ মৌ করেছে।
আপনাদের অভিষেক অনুষ্ঠানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কী নিয়ে কথা বলি, তা নিয়ে আমিও ভেবেছি। কিন্তু বিষয় কী হবে বের করতে পারিনি। পরশু আপনাদের প্রেসিডেন্ট শাকুর চৌধুরী আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্ড দিতে গিয়েছিলেন। তাঁকে বললাম, সেদিন গিয়েছিলাম রোটারি ক্লাব অফ ঢাকা ওয়েস্ট-এর অভিষেকে। সেখানকার সবাই আমার মতো বুড়ো। তাদের কাছে বার্ধক্য বিষয়ে কথা বলেছি। আপনাদের এখানে কী নিয়ে বলি বলুন তো? উনি বললেন, অভিষেক তো উৎসবের দিন। সবাই থাকবে ফূর্তির মেজাজে। আর আমাদের মেম্বারদের বয়সও অল্প। ফূর্তির আমেজ বাড়ে এমন কিছু বলুন। আমি বললাম, সবার ফূর্তি বাড়ে এমন একটা বিষয়ই আছে পৃথিবীতে। তার নাম প্রেম। তাহলে প্রেম নিয়েই আপনাদের অনুষ্ঠানে কিছু বলি, কেমন? উনি রাজি হলেন। তাঁর নির্দেশে আমি এই অনুষ্ঠানে প্রেম নিয়ে বলছি।

সুধীবৃন্দ, প্রেমের ব্যাপারে আগ্রহ নেই পৃথিবীতে এমন মানুষ নেই। যার জীবনে প্রেম আসেনি তার এ-ব্যাপারে যেমন আগ্রহ, যার এসেছে তারও তেমনি; যার জীবনে প্রেম নেই, কোনোদিন আসবেও না তার আগ্রহও তেমনি। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন: ‘শুনেছি দন্তহীন বৃদ্ধ তার যৌবনের প্রেমকে নিয়ে পরিহাস করছে।’ কিন্তু আমার ধারণা, একটা ভালোরকম প্রেমের গল্প ফেঁদে বসতে পারলে সব দন্তহীন বৃদ্ধই তা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করবে।

আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন কোনো ঘুড্ডি যখন কাটা যায় তখন বহু লোক তা ধরার জন্যে পেছনে দৌড়ায়। কেন দৌড়ায় বোঝা ভার। ঘুড্ডি তো এমন কোহিনূর মণি নয় যা পেলে কোটিপতি হওয়া যাবে। তবু মানুষ দৌড়ায়। কারো দৌড়াতে মজা লাগে তাই দৌড়ায়, হয়ত সবাই দৌড়াচ্ছে তাই সবাই দৌড়ায়। হয়ত কেউ দৌড়ায় গৌরবের আশায়, স্বপ্নের জন্যে। যারাই ঘুড্ডিটা দেখে তারাই দৌড়ায়। কারো হাতে লম্বা সরু বাঁশ, যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে, কারো বাঁশ মাঝারি সাইজের, কারো হাতে শুধু ছোটখাটো লাঠি, কারো হাতে কিছুই নেই, শুধু খালি দুটো হাত-তবুও দৌড়াচ্ছে। সবারই আশা ঘুড্ডিটা সে-ই পাবে। প্রেম ওই ঘুড্ডিটার মতো বন্ধুরা। সবাই ভাবে: একে পাব। সবাই একে চায়। যার নেই সেও চায়, যার আছে সেও চায়। যার চলে গেছে, আর কোনোদিন আসবে না, সেও চায়; যার কখনো যাবে না, হয়ত আসবেও না, সে-ও চায়।

কিন্তু যেসব মানুষ দলে দলে ঘুড্ডির পেছনে দৌড়ায়, তাদের কাউকে কি কখনো সেই ঘুড্ডি পেতে দেখেছেন আপনারা? না, দেখেন নি। আসলে ওই ঘুড্ডি কেউ পায় না। (সে যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা)। হয়ত মাটিতেই পড়ে না ঘুড্ডি, উঁচু গাছের আগায় আটকে যায়, নয়ত পড়ে গিয়ে কোনো পানা-পুকুরের একেবারে মাঝখানে, নয়তো কেউ পেলেও বাকিরা একসঙ্গে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে ছিঁড়ে ফেলে। কাউকে পেতে দেয় না কেউ। পায় না কেউ শেষ পর্যন্ত। প্রেমও এমনি। একে কেউ পায় না, কেবল পাওয়ার জন্যে ছোটে। ছোটে আর কাঁদে। এ বড় দুঃখের জিনিশ বন্ধুরা। ভুল করেই মানুষ ভাবে এ সুখের। হিন্দি-উর্দুওয়ালারা প্রেমের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে, এ হচ্ছে ‘দিল্লিকা লাড্ডু, যো খায়া ও ভি পস্তায়া, যো নেহি খায়া ও ভি পস্তায়া।’ খাও আর না-খাও পস্তানো এতে আছেই। যেন প্রেমের যত সাধ, যত আকুলতা শুধু হাহাকারের জন্যেই।

-----২-----
আসুন, এখন দেখি প্রেম জিনিশটা কী?
ছেলেবেলায় আমাদের বাসায় মাঝেমধ্যে লাল ডুরে-শাড়িপরা এক পাগলি আসত। তার মাথা কামানো। মাথায় ইয়া বড় ঘোমটা। এসেই উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রথমে একচোট বকবক করে নিত সে। তারপর হঠাৎ করেই গান ধরত:
লাইলি কান্দে বনে বনে
মজনু কান্দে ফুলবাগানে
কেন দেখা হয় না রে?...
প্রথম দুটো লাইন সে কবিতার মতো করেই বলত। কিন্তু তৃতীয় লাইনটা এলেই তার আবেগ এসে যেত। ডানহাতে ঘোমটার প্রান্ত ধরে একটা পুরো চক্কর ঘুরে সে সুর করে গেয়ে উঠত: ‘কেন দেখা হয় না রে?’ সুধীবৃন্দ, এই-যে দুজনের দেখা হয় না, এই-যে একজন থাকে বনে, একজন ফুলবাগানে, দুজন দুজনকে দেখতে না পেয়ে কাঁদে-এই কান্নাই প্রেম। এই-যে দূরত্ব, এই-যে বিচ্ছেদ, এই বিচ্ছেদই প্রেম। যতক্ষণ পাওয়া যায়নি ততক্ষণই প্রেম। নজরুলের কবিতার মধ্যে আছে:
হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর
আজকে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার!
এই-যে সপ্তপারাবারের বিচ্ছিন্নতা, এই বিচ্ছিন্নতার জন্যেই না এ প্রেম হয়েছে! রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় লিখেছেন:
এমন দিনে তারে    বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
কাকে বলা যায়? সে কি কাছে না সপ্তপারাবারের ওপারে? সে দূরে, অনেক দূরে। দূরে বলেই তার জন্যে এত কষ্ট। বিচ্ছিন্নতার এই যন্ত্রণা আর দীর্ঘশ্বাসই হল প্রেম। আসলে প্রেম মানেই না-পাওয়া। কেন লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদের মধ্যে এত প্রেম? কারণ তারা একজন আরেকজনকে পায়নি। পায়নি বলেই পরস্পরের জন্যে এত আকুলতা। পায়নি বলেই এত কবিতা, এত গান, এত মোনালিসা, তাজমহল, মেঘদূত। পেয়ে গেলে সব কষ্ট, সব মাধুরী চলে যেত। বিয়ের পর সাতদিনও পার হত না, তারা ঝগড়া করত।

অনেকেই বলবেন, ‘না-পাওয়ার মধ্যে প্রেমের তীক্ষè ছোবল টের পাওয়া যায় এটুকু না হয় মানলাম, কিন্তু পাওয়ার মধ্যে প্রেম থাকবে না এটা কেমন কথা! দুজন কাছাকাছি হলেই কি প্রেম চলে যাবে? প্রেমিক-প্রেমিকারা যখন দুজন দুজনকে বুকের ভেতর পায় তখন কি তাদের প্রেম চলে যায়? বিবাহিত জীবনে প্রেম দুর্লভ মানি, তবু এমন অনেক দম্পতিও কি নেই যাদের মধ্যে গভীর প্রেম রয়েছেÑজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যারা পরস্পরের জন্যে উন্মুখ হয়ে কাটায়?’ তাঁদের কথার উত্তরে আমি আগের কথাটাকে ফিরিয়ে এনেই বলব, ‘মানুষের প্রেম আসলে না-পাওয়াতেই। দুজনের দূরত্বেই প্রেমের বসবাস। যদি পাওয়ার মধ্যে কোথাও প্রেম দেখা যায় তবে বুঝতে হবে ওই পাওয়ার মধ্যেও, কোথাও-না-কোথাও ‘না-পাওয়ার’ যন্ত্রণা কাজ করছে। কাছে থাকলেও তাদের মধ্যে রয়েছে এমন এক অসীম দূরত্ব যাকে তারা কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছে না। এই জন্যেই এত মরিয়া আর উৎকণ্ঠিত হয়ে রয়েছে পরস্পরের জন্যে।’

মধ্যযুগের কবিতা থেকে একটা উদাহরণ দিই। কবিতাটা কবি বল্লভের। সুধীবৃন্দ, কবিতাটা বাংলা-হিন্দি মেশানো ব্রজবুলি ভাষার। আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে বলে এর প্রতিটি লাইনের মানে বলে-বলে বোঝাতে চেষ্টা করব। কবিতাটায় কৃষ্ণের প্রতি রাধা তার ভালোবাসার কথা বললেও আসলে সে বলছে কী? বলছে তার আর তার প্রিয়তমের মাঝখানকার অন্তহীন দূরত্বের কথা। বলছে প্রিয়তমকে এত কাছে পাওয়া হল, তবু কিছুতেই তাকে পুরোপুরি পাওয়া গেল না। সে চির-অধরা চির-অপ্রাপণীয় হয়ে রইল।

জনম অবধি হাম    রূপ নেহারলুঁ
নয়ন না তিরপিত ভেল।
‘জন্ম থেকে তার রূপ দেখে আসছি কিন্তু চোখ তবু আরও তৃপ্ত হল না।’ (অর্থাৎ এত দেখা, তবু সে অ-দেখা হয়েই রইল)।
সোই মধু বোল    শ্রবনহি সুনলু
শ্রুতিপথ পরশ না গেল।
‘তার মধুর বচন আমার শ্রবণকে বিনোদিত করল কিন্তু আমার শ্রুতি পথ পর্যন্ত পৌঁছাল না।’ অতৃপ্তির কী অপরূপ প্রকাশ! এর পরে বলছেন সবচেয়ে অনবদ্য কথাগুলো:

কত মধু যামিনি    রভসে গোঁয়াইলুঁ
    ন বুঝলুঁ কৈছন কেল।
লাখ লাখ যুগ    হিয়ে হিয়ে রাখলুঁ
    তবু হিয়া জুড়ন ন গেল।
‘কত মধুময় রাত আমরা আনন্দ-মত্ততায় উদ্যাপন করলাম কিন্তু সে কেমন তা বুঝতে পারলাম না। লাখ লাখ যুগ হৃদয় রেখে জেগে রইলাম, তবু হৃদয় আমার আজও জুড়াল না।’

এরা দেবদাস-পার্বতীর মতো দূরে নেই। দুজন রয়েছে দুজনের খুবই কাছে। হৃদয়ে হৃদয় রেখে। তবু দেখুন রাধার মধ্যে কী অসীম না-পাওয়ার অস্থিরতা কেন এই না-পাওয়া? না-পাওয়া কৃষ্ণের অমিত বিপুল ঐশ্বর্যময়তার কারণে এত অন্তহীন আর অপরিমেয় রকমে সে বৈভবশালী ও বিভামন্ডিত যে, সেই অসীমতার বিস্ময় সে শেষ করতে পারছে না। কাছে পেয়েও তাকে মনে হচ্ছে অনেক দূরে, যেন পাওয়ার সে বাইরে। এই-যে অপ্রাপ্তির অনুভূতি, এই-যে পেয়েও না-পাওয়া এটাও প্রেম। কাজেই প্রেম দুরকম হতে পারে: না-পেয়েও হতে পারে, আবার পাওয়ার ভেতর না-পাওয়ার অনুভূতি দিয়েও হতে পারে। এই দ্বিতীয় ধরনের প্রেমের কথা বলতে গিয়ে গোবিন্দ দাস লিখেছেন:
দুহুঁ কোড়ে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।

দুজন আছে দুজনের কোলে। তবু দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলছে ভেবে কাঁদছে। কাজেই কাছে থাকা মানেই পাওয়া নয়। ভুক্তভোগীরা জানেন, কাছে থাকার মধ্যেও থাকতে পারে কত লক্ষ যোজনের ব্যবধান। যদি থাকে তবে তাও হবে এক ধরনের না-পাওয়া। থেকেও না-পাওয়া। কাজেই তখন তা আমাদের ভেতর প্রেমের অনুভূতি জাগাবে। যে কাছে নেই তার ব্যাপারে না-পাওয়ার অনুভূতি থাকা খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু যে রয়েছে কাছে, বুকের একান্ত ভেতরে, তাকে নিয়েও কোন না-পাওয়ার অনুভূতি মানুষের মনে? কেন মনে হয় সে নেই? কেন প্রেমে প্রতিমুহূর্তে এমন হারাই-হারাই ভাব? এত উৎকণ্ঠা? এত আতঙ্ক? কেন সবকিছু পাওয়ার পরেও মনে হয়:
ও কি এল, ও কি এল না,
বোঝা গেল না, গেল না।

------৩-----
সুধীবৃন্দ, এই বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাই প্রেমের যন্ত্রণা। এই আগুনই প্রেমের আগুন। একই সঙ্গে সে অসহ্য সুখ, অকথ্য কষ্ট। সুখ, যাকে ভালোবাসি সে কাছে আছে বলে; যন্ত্রণা: এমন দুর্লভ মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় আছি বলে। চন্ডীদাসের মতে এ হল সেই শাঁখের করাত যা ‘আসিতে যাইতে কাটে’। প্রেমে তাই পেলেও দুঃখ, না-পেলেও দুঃখ। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণার আগুনে জ্বলে জ্বলে ছাই হয়েছিল যাযাবর-এর ‘দৃষ্টিপা’ বইয়ের ‘হতভাগ্য চারুদত্তহ আধারকার’, শেক্সপিয়ারের ‘ওথেলো’। এ যুগের গানেও যে শোনা যায়: ‘লোকে বলে প্রেম আর আমি বলি জ্বালা’Ñএ কি এমনি?
প্রেমের এই দুধারী করাত যে কেমন, একটা গল্প বলে বোঝাই। গল্পটা গোপাল ভাঁড়ের।

গোপাল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ভাঁড়। তার চাকরি হল রাজাকে হাসানো। রাজা যখন রাজকার্যের দুরূহ সমস্যা নিয়ে গম্ভীর আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন তখন রঙ্গরসের জোগান দিয়ে তাঁকে খোশমেজাজে রাখা। তো, একদিন একটা সমস্যা নিয়ে রাজার মেজাজ সত্যি সত্যি খিঁচড়ে আছে। এমন খারাপ যে, হাসির কথাও তাঁর অসহ্য। ঠিক সেই সময় গোপাল গেছে রাজাকে হাসাতে। আর যায় কোথায়! রাজা একেবারে গ্রেনেডের মতো ফেটে পড়লেন। কদর্যভাবে ধমকে বললেন, ‘যাও! যাও আমার সামনে থেকে, যাও! তোমার মুখ যেন আর কোনোদিন না দেখি!’ বলে তাকে প্রায় কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেন।

গোপাল ভাঁড় রাজার বয়স্য, বন্ধু। তাই এভাবে তাঁর কাছ থেকে অপমানিত হওয়ায় তার মনে খুবই চোট লাগল। সে ঠিক করল চাতুরির মাধ্যমে রাজাকে সমুচিত শিক্ষা দেবে। বাড়ি গিয়ে সে একটা লোক ভাড়া করল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে গোপাল লোকটাকে কিছুক্ষণ পরপর একেকটা কথা শিখিয়ে দেয় আর লোকটা মহারাজের কাছে গিয়ে তাই বলে আসে। প্রথমে লোকটা গিয়ে মহারাজকে বলল, ‘মহারাজ, গোপালকে আপনি কী সব বলেছেন, সেই দুঃখে গোপাল ঠিক করেছে সে আর এ দেশেই থাকবে না। গোপালের মালপত্র বাঁধাছাদা শুরু হয়ে গেছে মহারাজ!’ গোপালের ওপর মহারাজের রাগ তখনও পড়েনি। তাই বললেন, ‘যাক, ও যেখানে খুশি যাক। বলে দিস, আমার সামনে যেন আর কোনোদিন না আসে।’ ঘণ্টাখানে পরে লোকটা আবার মহারাজের সামনে এসে হাজির, ‘জিনিশপত্র বাঁধাছাদা শেষ মহারাজ! গাড়ির জন্যে লোক পাঠানো হয়েছে। গাড়ি এলেই রওনা হয়ে যাবে।’ হাজার হলেও মহারাজ তো গোপালকে ভালোবাসেন। তাই এ খবরে তিনি ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সত্যিই চলে যাচ্ছে না কি গোপাল।

কিন্তু মুখে উদাসীন ভাব অটুট রেখে বললেন, ‘যেতে চাইলে যাবে। ওকে কী আমার পায়ে ধরে রাখতে হবে নাকি!’ কথার সুর কিছুটা নরম। আরও ঘণ্টাখানেক পরে লোকটা এসে বলল, ‘মহারাজ, মালপত্র গাড়িতে ওঠানো শেষ, গোপাল কিন্তু সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে।’

এবার মহারাজ সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। গোপালের মতো প্রিয় বন্ধুকে এভাবে কী হারানো যায়। লোকটাকে বললেন, ‘শিগগির গোপালকে ডেকে আন। বল, আমি ওকে ডাকছি।’ বিজয়ের হাসি হাসতে হাসতে গোপাল মহারাজের সামনে এসে হাজির। মহারাজ বললেন, ব্যাপারটা কি বলতো গোপাল! তোমাকে দেখলেও যে খারাপ লাগে আবার না-দেখলেও যে খারাপ লাগে!’ একগাল হেসে গোপাল বলল, ‘মহারাজ বুঝিবা আমার প্রেমে পড়েছেন।’

প্রেমের এর চেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা আর কি হয়? প্রেম এমনি একটা ব্যাপার। সত্যি এ আসিতে যাইতে কাটে। এখানে পেলেও যন্ত্রণা, না-পেলেও তা-ই। দেখলেও খারাপ লাগে, না-দেখলেও জীবন বাঁচে না।      ( চলবে )

No comments

Powered by Blogger.