ফরমালিন ভ্রান্তি: এত ফল কেন ধ্বংস? by শাহেদ শফিক
ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে ২০১৪ সালে এভাবেই ধ্বংস করা হয় আম (ফাইল ছবি) |
ফল
সারাবছরই চাষ হয় দেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে। চেনা ফলের সঙ্গে যোগাযোগ
ব্যবস্থার কল্যাণে অচেনা বা অল্প চেনা বিদেশি ফলও এখন ডালা ভরে শোভা বাড়ায়
শহর ছেড়ে মফস্বলের দোকানেও। সারা বছরই আছে এর বেচাকেনা। তবে বাংলাদেশে
মধুমাস অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এলেই ফলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন মানুষ, সেরা
জাতের ফলের দিকে যেমন চোখ থাকে ক্রেতাদের, পাশাপাশি চোখের তারায় থাকে
‘সন্দেহের নাচন’। গত আট-দশ বছরের চিত্র এটাই। এই সন্দেহটার নাম ‘ফরমালিন’।
কেনাবেচায় দরদাম আছে, দরদামে হারজিত আছে, তা নিয়ে ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকেও অল্প-বিস্তর, কিন্তু তারচেয়েও ক্রেতার বড় ক্ষোভ ফলে ‘ফরমালিন’ নিয়ে। প্রাণঘাতী এবং ক্যান্সারের উৎস বলে যে ফরমালডিহাইডকে চিহ্নিত করা হয়, তা ফলে মেশানো নিয়ে ক্রেতার সন্দেহ বিক্রেতার দিকে, বিক্রেতা হাত তুলে মাফ চেয়ে আঙুল তোলেন কৃষক কিংবা আমদানিকারকদের দিকে। আমদানিকারক হলে তিনি অস্বীকার করেন, বিদেশিদের ওপর দায় চাপান। আর দেশি ফল হলে কৃষক বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘ফলের বাগান করি মানুষকে খাওয়াতে, বিষ খাওয়াতে নয়।’ তবুও,ফলে ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্র (ফরমালিন কিট) লাগালে ফরমালিনের অস্তিত্ব মেলে। প্রতিবছর সারাদেশে কয়েক টন আম, জামসহ দেশি-বিদেশি ফল ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে ধ্বংস করা হয়। ২০১৪ সালে তো আমের রাজধানী রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে ধ্বংস করা হয় টনকে টন ফলমূল।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের সন্দেহ যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর, তখন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলেছে, ফলে ফরমালিন মেশালে তা সংরক্ষণে কোনও ভূমিকা রাখে না। এর পক্ষে স্বীকৃত সংস্থাগুলোর গবেষণা ও দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের অভিমত সামনে এনেছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। দেশের রসায়ন ও কৃষি বিজ্ঞানী এবং এসব বিষয়ের শিক্ষকরাও এখন জোরসে বলছেন, ফলে ফরমালিন মেশানোই কঠিন। মেশালে তা দীর্ঘসময় থাকে না। তাদের দাবি, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন শনাক্ত করা হতো ‘নাটের গুরু’ আসলে ওই যন্ত্রই। এর ভুল রিডিংয়ের কারণেই দেশজুড়ে ক্রেতাদের এত সন্দেহ, এত ফল ধ্বংস, কৃষক-বিক্রেতা-আমদানিকারকদের এত ভোগান্তি। এ কারণে এখন প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কেন বিপুল সংখ্যক ফল ধ্বংস করে ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী কৃষকের ক্ষতি করা হয়েছিল? ভবিষ্যতেও কি এমন অভিযান হবে?
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফরমালিন হলো অতি দ্রবণীয় ও উদ্বায়ী বস্তু। এটা ফলে মেশানো হলেও দীর্ঘ সময় থাকবে না। আর ফলমূল, শাকসবজি এগুলো হলো ফাইবার বা তন্তুজাতীয় খাদ্যবস্তু। এগুলোতে প্রোটিন বা আমিষের পরিমাণ একেবারেই কম। ফলে এখানে ফরমালিন দেওয়ার কোনও সুযোগই নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলমূল ও শাকসবজিতে ফরমালিন দেওয়া হয় এটা একটা ভুল ধারণা। কারণ, ফলে ফরমালিন দিলেও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনও কাজে আসবে না। এটা একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফরমালিন থাকে। ওটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলে ইথোপেন দেওয়া হয়। এই পদার্থ দিয়ে ফল পাকানো হয়। তাই আমরা বলি, ২৫ মে’র আগে যেসব আম বাজারে আসে সেগুলো ক্রয় করা পরিহার করুন।’
ফরমালিন টেস্টের পদ্ধতি এবং কিট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না। ওই যন্ত্রগুলো গাছ থেকে তাজা ফল পেড়ে পরীক্ষা করলে তাতেও ফরমালিনের সন্ধান দিতো।’
সম্প্রতি ফলমূল ও শাকসবজিতে ফরমালিন প্রয়োগ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনও ভূমিকা নেই। উপরন্তু, প্রকৃতিগতভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। অথচ এই অভিযোগেই ২০১৪ সালে বিপুল সংখ্যক ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছিল।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর সহযোগিতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ফলমূল, শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি স্ব-স্ব খাদ্যপণ্যের প্রাকৃতিক মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি গড়ে যে পরিমাণ ফরমালডিহাইড দৈনিক খাবার থেকে গ্রহণ করেন তা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক কম।
২০১৪ সালের দিকে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে যেসব ফলমূল ও শাকসবজি ধ্বংস করা হয়েছে তখনই এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া সেসময় যে মেশিন বা কিট দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলোও সঠিকভাবে ফলাফল দেয়নি। কিন্তু, এরপরেও ধ্বংস করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল।
জানা গেছে, ওই সময় যেসব যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হতো সেই যন্ত্রগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) উদ্ভাবিত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেই যন্ত্র দিয়েই ফরমালিন পরীক্ষা করতো। কিন্তু তখন এই যন্ত্রগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা আমলে নেয়নি কেউ। এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি বিসিএসআইআর’কে জানানো হলে এরপর যন্ত্রগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফলমূল বা শাকসবজিতে প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফরমালিন থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নেয়। কিন্তু, তারপরও সেটাতে দেখতে হবে প্রাকৃতিক মাত্রা অতিক্রম করছে কিনা। যদি তা করে তাহলে ধরে নিতে হবে ফরমালিন মেশানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে ফলমূলে ফরমালিন দিলেও লাভ নেই। কারণ, সেখানে প্রোটিন নেই। ফরমালিন প্রোটিন ছাড়া দীর্ঘক্ষণ টেকে না। এটা একটা ভুল ধারণা ছিল। এই ভুলের কারণে মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তারা ফলমূল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা এখন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যেসব যন্ত্র দিয়ে ফরমলিন পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটাও ভুল। ফরমালিন পরিমাপের একমাত্র যন্ত্র হচ্ছে- হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি (এইচপিএলসি)।
তার অভিযোগ, অথচ বর্তমানে এই যন্ত্র (এইচপিএলসি) বাদ দিয়ে ডিটেকশন কিট দিয়েই বিএসটিআই ফরমালিন পরীক্ষা করছে। এটা আসলে যথোপযুক্ত নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ফরমালিনের অভিযোগে যেসব ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছে সেটা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তখন নানা প্রশ্ন ওঠার পর আমরা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় ২৮টি খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করে দেখি। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ফলমূলে ফরমালিনের কোনও অস্তিত্ব নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফলে ফরমালিন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা কার্যকর হয় না।
২০১৪ সালের ‘ফরমালিনযুক্ত ফল ধ্বংস’ কাণ্ডের পর ২০১৬ সালে ২৮টি পণ্য নিয়ে এফএও’র অধীনে গবেষণা এবং ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পৃথক আরেকটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ফলে ফরমালিন দিলেও তা কাজে আসে না। এখন কেউ যদি বলে ফলে ফরমালিন দিলে কাজে আসে তাহলে সে মূর্খ ছাড়া আর কিছুই না। কারণ, বিজ্ঞানকে তো স্বীকার করতে হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য ও ফলমূল পরীক্ষার জন্য সঠিক ফরমালিন যন্ত্র নির্বাচন এবং সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু এরপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সঠিক যন্ত্র আমদানি করতে পারেনি বাংলাদেশ।
কেনাবেচায় দরদাম আছে, দরদামে হারজিত আছে, তা নিয়ে ক্ষোভ-আক্ষেপ থাকেও অল্প-বিস্তর, কিন্তু তারচেয়েও ক্রেতার বড় ক্ষোভ ফলে ‘ফরমালিন’ নিয়ে। প্রাণঘাতী এবং ক্যান্সারের উৎস বলে যে ফরমালডিহাইডকে চিহ্নিত করা হয়, তা ফলে মেশানো নিয়ে ক্রেতার সন্দেহ বিক্রেতার দিকে, বিক্রেতা হাত তুলে মাফ চেয়ে আঙুল তোলেন কৃষক কিংবা আমদানিকারকদের দিকে। আমদানিকারক হলে তিনি অস্বীকার করেন, বিদেশিদের ওপর দায় চাপান। আর দেশি ফল হলে কৃষক বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘ফলের বাগান করি মানুষকে খাওয়াতে, বিষ খাওয়াতে নয়।’ তবুও,ফলে ফরমালিন পরীক্ষার যন্ত্র (ফরমালিন কিট) লাগালে ফরমালিনের অস্তিত্ব মেলে। প্রতিবছর সারাদেশে কয়েক টন আম, জামসহ দেশি-বিদেশি ফল ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে ধ্বংস করা হয়। ২০১৪ সালে তো আমের রাজধানী রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সারাদেশে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে ধ্বংস করা হয় টনকে টন ফলমূল।
এমন পরিস্থিতিতে মানুষের সন্দেহ যখন গাঢ় থেকে গাঢ়তর, তখন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলেছে, ফলে ফরমালিন মেশালে তা সংরক্ষণে কোনও ভূমিকা রাখে না। এর পক্ষে স্বীকৃত সংস্থাগুলোর গবেষণা ও দেশি-বিদেশি বিজ্ঞানীদের অভিমত সামনে এনেছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। দেশের রসায়ন ও কৃষি বিজ্ঞানী এবং এসব বিষয়ের শিক্ষকরাও এখন জোরসে বলছেন, ফলে ফরমালিন মেশানোই কঠিন। মেশালে তা দীর্ঘসময় থাকে না। তাদের দাবি, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন শনাক্ত করা হতো ‘নাটের গুরু’ আসলে ওই যন্ত্রই। এর ভুল রিডিংয়ের কারণেই দেশজুড়ে ক্রেতাদের এত সন্দেহ, এত ফল ধ্বংস, কৃষক-বিক্রেতা-আমদানিকারকদের এত ভোগান্তি। এ কারণে এখন প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কেন বিপুল সংখ্যক ফল ধ্বংস করে ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারী কৃষকের ক্ষতি করা হয়েছিল? ভবিষ্যতেও কি এমন অভিযান হবে?
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ফরমালিন হলো অতি দ্রবণীয় ও উদ্বায়ী বস্তু। এটা ফলে মেশানো হলেও দীর্ঘ সময় থাকবে না। আর ফলমূল, শাকসবজি এগুলো হলো ফাইবার বা তন্তুজাতীয় খাদ্যবস্তু। এগুলোতে প্রোটিন বা আমিষের পরিমাণ একেবারেই কম। ফলে এখানে ফরমালিন দেওয়ার কোনও সুযোগই নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলমূল ও শাকসবজিতে ফরমালিন দেওয়া হয় এটা একটা ভুল ধারণা। কারণ, ফলে ফরমালিন দিলেও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনও কাজে আসবে না। এটা একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাছাড়া ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফরমালিন থাকে। ওটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফলে ইথোপেন দেওয়া হয়। এই পদার্থ দিয়ে ফল পাকানো হয়। তাই আমরা বলি, ২৫ মে’র আগে যেসব আম বাজারে আসে সেগুলো ক্রয় করা পরিহার করুন।’
ফরমালিন টেস্টের পদ্ধতি এবং কিট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ফরমালিন টেস্টের নামে যেসব কিট এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল, ওই কিটগুলো ঠিক ছিল না। ওই যন্ত্রগুলো গাছ থেকে তাজা ফল পেড়ে পরীক্ষা করলে তাতেও ফরমালিনের সন্ধান দিতো।’
সম্প্রতি ফলমূল ও শাকসবজিতে ফরমালিন প্রয়োগ বিষয়ে বিভ্রান্তি দূর করতে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনও ভূমিকা নেই। উপরন্তু, প্রকৃতিগতভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। অথচ এই অভিযোগেই ২০১৪ সালে বিপুল সংখ্যক ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছিল।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বলছেন, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর সহযোগিতায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ফলমূল, শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ফরমালডিহাইডের উপস্থিতি স্ব-স্ব খাদ্যপণ্যের প্রাকৃতিক মাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি গড়ে যে পরিমাণ ফরমালডিহাইড দৈনিক খাবার থেকে গ্রহণ করেন তা সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক কম।
২০১৪ সালের দিকে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে যেসব ফলমূল ও শাকসবজি ধ্বংস করা হয়েছে তখনই এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া সেসময় যে মেশিন বা কিট দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হয়েছিল, সেগুলোও সঠিকভাবে ফলাফল দেয়নি। কিন্তু, এরপরেও ধ্বংস করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার মাছ, শাকসবজি ও ফলমূল।
জানা গেছে, ওই সময় যেসব যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হতো সেই যন্ত্রগুলো বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) উদ্ভাবিত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সেই যন্ত্র দিয়েই ফরমালিন পরীক্ষা করতো। কিন্তু তখন এই যন্ত্রগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তা আমলে নেয়নি কেউ। এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি বিসিএসআইআর’কে জানানো হলে এরপর যন্ত্রগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফলমূল বা শাকসবজিতে প্রাকৃতিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফরমালিন থাকে যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নেয়। কিন্তু, তারপরও সেটাতে দেখতে হবে প্রাকৃতিক মাত্রা অতিক্রম করছে কিনা। যদি তা করে তাহলে ধরে নিতে হবে ফরমালিন মেশানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে ফলমূলে ফরমালিন দিলেও লাভ নেই। কারণ, সেখানে প্রোটিন নেই। ফরমালিন প্রোটিন ছাড়া দীর্ঘক্ষণ টেকে না। এটা একটা ভুল ধারণা ছিল। এই ভুলের কারণে মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তারা ফলমূল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা এখন গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েই মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যেসব যন্ত্র দিয়ে ফরমলিন পরীক্ষা করা হচ্ছে সেটাও ভুল। ফরমালিন পরিমাপের একমাত্র যন্ত্র হচ্ছে- হাই পারফরম্যান্স লিকুইড ক্রোমাটোগ্রাফি (এইচপিএলসি)।
তার অভিযোগ, অথচ বর্তমানে এই যন্ত্র (এইচপিএলসি) বাদ দিয়ে ডিটেকশন কিট দিয়েই বিএসটিআই ফরমালিন পরীক্ষা করছে। এটা আসলে যথোপযুক্ত নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ফরমালিনের অভিযোগে যেসব ফলমূল ধ্বংস করা হয়েছে সেটা ছিল একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তখন নানা প্রশ্ন ওঠার পর আমরা জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় ২৮টি খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করে দেখি। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ফলমূলে ফরমালিনের কোনও অস্তিত্ব নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফলে ফরমালিন দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা কার্যকর হয় না।
২০১৪ সালের ‘ফরমালিনযুক্ত ফল ধ্বংস’ কাণ্ডের পর ২০১৬ সালে ২৮টি পণ্য নিয়ে এফএও’র অধীনে গবেষণা এবং ২০১৮ সালেও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পৃথক আরেকটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ফলে ফরমালিন দিলেও তা কাজে আসে না। এখন কেউ যদি বলে ফলে ফরমালিন দিলে কাজে আসে তাহলে সে মূর্খ ছাড়া আর কিছুই না। কারণ, বিজ্ঞানকে তো স্বীকার করতে হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্য ও ফলমূল পরীক্ষার জন্য সঠিক ফরমালিন যন্ত্র নির্বাচন এবং সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু এরপর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সঠিক যন্ত্র আমদানি করতে পারেনি বাংলাদেশ।
বিশেষ অভিযানে কেমিক্যালযুক্ত আম ধ্বংস (ফাইল ছবি) |
No comments