মধ্যবিত্তের ওপর চাপ বাড়বে যে কারণে by এম এম মাসুদ
সোয়া
পাঁচ লাখ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া
আসছে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিরোধী
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দেবে প্রস্তাবিত বাজেট।
গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে উচ্চ বিত্ত শ্রেণি বাজেটের সুবিধা পেলেও নিম্ন
এবং মধ্যবিত্তের জন্য কোন সুখবর নেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিম্ন ও মধ্য
বিত্ত শ্রেণির জন্য বাজেটে বিশেষ সুখবর না থাকাটাই বরং বড় দুঃসংবাদ। কারণ
এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই একটি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। একটি দেশের
উন্নয়ন অগ্রগতির মূল নিয়ামক। এই শ্রেণির মানুষ যদি গতিশীল হয় তাহলে দ্রুতই
অর্থনৈতিক অবস্থা বিকশিত হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য ভাল কিছু না থাকায় এ শ্রেণির মানুষরা অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকবে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানোর পাশপাশি নতুন করে যেসব পণ্যের দাম বাড়বে তারও খড়গ আসবে মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। এছাড়া উচ্চবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির জন্য সেসব সুবিধা ঘোষণা দেয়া হয়েছে বাজেটে তার সংস্থান করতে গিয়ে চাপ পড়বে সাধারণের ওপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও যাতায়াতের ব্যয় নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব খাতে যে ব্যয় সংস্থান ধরা হয়েছে তা একেবারেই গতানুগতিক। এসব খাতে ব্যয় করার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং সরকারি হিসেবেই এসব ক্ষেত্রে ৫.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যোগ হবে ব্যয়ের খাতে। বেসরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আরো বেশি হবে। যা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে কর ছাড়ে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের করদাতাদের এক বিন্দুও ছাড় দেয়া হয়নি। করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই আড়াই লাখ টাকাই রাখা আছে। চাপে থাকবেন তারা। এছাড়া বাজেটে গুঁড়ো দুধ, অপরিশোধিত চিনি, পরিশোধিত চিনি, স্মার্ট ফোন, আইসক্রিম, মোবাইল ফোনে কথা বলায় শুল্ক বাড়ানো ও সয়াবিন তেল, পাম ওয়েল, সান ফ্লাওয়ার তেল, সরিষার তেলের আমদানি পর্যায়ের ওপর মূসক আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। ইতিমধ্যেই এসব পণ্যের দাম বাড়া শুরু করেছে। আর এসব পণ্যেই বেশি ব্যবহার করেন মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ। অর্থাৎ নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী কর আদায়ের জন্য মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের গোষ্ঠীকেই বেছে নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু সেই তুলনায় মধ্যম ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় তেমন বাড়ছে না। বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটা আরো প্রকট হচ্ছে। তাদের মতে, বাজেটে প্রবৃদ্ধির কথা থাকে, খাতওয়ারি বরাদ্দ বাড়ে প্রতিবছর, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গৃহীত হয়। কিন্তু মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর মতো প্রত্যক্ষ কর্মসূচি তেমন থাকে না। অথচ অর্থনীতির বিকাশমান মধ্যবিত্তই হলো চালিকাশক্তি।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, রেস্তোরাঁয়: এসি বা নন-এসি, যেকোনো রেস্তোরাঁয় খাবার খেলেই সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এমনকি ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলেও ভ্যাট দিতে হবে।
এত দিন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম কিংবা অনলাইনে কেনাকাটা করলে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হতো। নতুন বাজেটে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে অনলাইনে কেনাকাটা করলে খরচ বাড়বে। ব্র্যান্ড বা নন-ব্র্যান্ড, যেকোনো দোকান থেকে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজসহ যেকোনো পোশাক কিনতে গেলে খরচ বাড়বে। আগে ভ্যাট ছিল ৫ শতাংশ। নতুন আইনে তা সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
দেশি আসবাবপত্র কিনলে ভ্যাট বাড়বে। খাট, আলমারি, চেয়ার- টেবিলসহ আসবাবপত্র উৎপাদককে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। আবার শোরুম থেকে কেনার সময় ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।
অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ঘুরতে গেলে আপনাকে ভ্যাট দিতে হবে। এই ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ। রাজধানী ও এর আশপাশে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে প্রবেশ ও রাইডে চড়ার মাশুলের সঙ্গে এই ভ্যাটের টাকা কেটে রাখা হবে। সিনেমা দেখতে গেলে দিতে হবে ১০ শতাংশ ভ্যাট। দরজিপাড়ার দিকে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দরজির দোকানও ভ্যাটের আওতায় এসেছে। দরজির দোকান থেকে কোনো সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্টসহ অন্য যেকোনো জামা বানালে মজুরির ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। বাজেট ঘোষণার পর ইতোমধ্যে কিছু পন্যের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজেটে করের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরা যতটা সুযোগ পেয়েছে, সেই তুলনায় নিম্ন-মধ্যবিত্তরা পায়নি। করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো আড়াই লাখ টাকাই আছে। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। এর পর নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে, যদিও সবার ওপর বর্তাবে তবে এর চাপটা মধ্যবিত্তের ওপর পড়বে। আরেকটি হলো- কর জালের আওতায় বাড়িওয়ালারা আসছে। সেক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভাড়াটিয়াদের ওপর করের চাপটা আসবে। এছাড়া সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম সমন্বয় করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সরকার যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় তখন একই রকম চাপটা এসে পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। তিনি বলেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বচ্ছল উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুবিধা দেয়ায় দেশের মধ্যবিত্ত, বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত- এ থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না। এর ফলে সমাজে বৈষম্য আরো বাড়বে। বৈষম্য রেখে সমাজকে টেকসই করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাজেটের পর মধ্যবিত্তের জীবন আরো কঠিন চাপে পড়বে। তাদের খরচ বাড়বে। বাড়িভাড়া, পোশাক-আশাক, কেনাকাটা, প্রায় সব ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাড়িভাড়া, শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্য খাতে চলে যায় তাদের আয়ের বেশির ভাগ। ঢাকায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষরা এভাবেই তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
কথা হয় রাজধানীর নামী একটি বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শাহানা পারভীনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার মেয়ের শিক্ষা ব্যয়ের কথা। মেয়ে দুই শিক্ষকের কাছে কোচিং করছে ও দুজন শিক্ষক বাসায় এসে পড়াচ্ছেন। এ খরচের পাশাপাশি যাতায়াত, স্কুল খরচ, বই-খাতাসহ আনুষঙ্গিক মিলে মেয়ের পড়ালেখার পেছনেই মাসে ২০ হাজার টাকা চলে যায়। ফলে অন্য খরচ কাটছাঁট করে চলতে হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছর বেড়ে চললেও করমুক্ত আয়ের সীমা চার বছর ধরে আড়াই লাখ টাকাই আছে।
রাজধানীর মগবাজার একটি স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক সানোয়ার হোসাইন। তার মূল বেতন ২৩ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া তিনি বাড়িভাড়া বাবদ ১ হাজার টাকা ও মেডিক্যাল ভাতা বাবদ মাসে পান ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে মূল বেতনের সঙ্গে রাজধানীতে ৭০ শতাংশ বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাড়িভাড়া মাত্র ১ হাজার টাকা। অথচ এর পরও আমাদের আয়কর দিতে হয়। একজন আয়কর দাতা হয়েও নিজেই সংসার চালাতে পারছি না।
শফিউল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া-লেখা করে একটি সরকারি বালিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বলেন, আমি যা বেতন পাই তা দিয়ে চলা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, গ্রামের বাড়িতে মা-বাবাকে টাকা দেয়া ও স্ত্রীর লেখা-পড়ার খরচ ও একটি ঋণের কিস্তি, সবমিলিয়ে কোনো কোনো মাসে বেতনের বেশি ব্যয় হয়। পরের মাসে সেটা সমন্বয় করতে হয় বলে জানান তিনি। বলেন, সংসার চালিয়ে নিতেই হিমশিম খাচ্ছি। এর মধ্যে এবারের বাজেটে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেসব পণ্য ব্যবহার করি সেগুলোরই দাম শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
শাহেদ কায়সার একটি এনজিওতে ১২ হাজার টাকায় মধ্যম সারির একটি পদে কাজ শুরু করেন। তার পরিবারে বর্তমান চারজন সদস্য। ভাড়া থাকেন রামপুরায়। তিন রুমের যে বাসায় তিনি ভাড়া থাকেন ১ দশক আগে সেখানে আট হাজার টাকায় উঠেছিলেন। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে এক দশকে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার। এ সময়ে শাহেদের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৬ হাজার। কিন্তু বেতন তিনগুণ বৃদ্ধি পেলেও এই টাকায় মাস চালাতে হিমশিম খান শাহেদ। তার নেই কোনো সঞ্চয়। বেতনের উল্লেখযোগ্য অংশই চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। খাবারের জন্য তাকে মাসে আরও খরচ করতে হয় ১৫ হাজার টাকা। দুই বাচ্চার লেখাপড়ার জন্য দুই হাজার। আর অবশিষ্ট তিন হাজার টাকা অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহার করেন।
আবদুল হালিম। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন সর্বসাকুল্যে ৪০ হাজার টাকা। থাকেন ঢাকার বাসাবো এলাকায়।
দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে অষ্টম আর মেয়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ভালো ফলের জন্য দু’জনেরই প্রয়োজন প্রাইভেট টিউটরের। প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছে তাদের জন্য। প্রতি মাসে ছেলেমেয়েদের স্কুল ও প্রাইভেট টিউটরের বেতন মিলিয়ে খরচ ১০ হাজার টাকা। বাসাভাড়া দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। অসুস্থ মায়ের ও নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে যায় ৩ হাজার টাকা। পানি, গ্যাস বিদ্যুৎ, নাইটগার্ড, ডিশ অ্যান্টেনা, ময়লা পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের বিলসহ অন্যান্য মিলিয়ে ইউটিলিটি চার্জ দেন আড়াই হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত ও দুপুরের খাবার হিসেবে নিজের হাত খরচ রাখেন মাসে ৩ হাজার টাকা। অবশিষ্ট থাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তা দিয়ে পরিবারের সবার খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাসের বাজার ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় আবদুল হালিমকে। নিজের সংসারের হিসাব তুলে ধরে উল্টো জানতে চান- ‘কী খাই, তা আপনিই বলেন?’ এ অবস্থায় সামনে খরচ বাড়লে জীবন চলবে কি করে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী এখন ব্যয় বেশি। এই ব্যয় মেটানোর আয় নেই মানুষের। আর মধ্যবিত্তরা তো আছেন মহাবিপদে। তারা কোথাও যেতেও পারেন না। বাসায় ভালো খেতেও পারেন না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য ভাল কিছু না থাকায় এ শ্রেণির মানুষরা অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকবে। মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানোর পাশপাশি নতুন করে যেসব পণ্যের দাম বাড়বে তারও খড়গ আসবে মধ্যবিত্তের ঘাড়ে। এছাড়া উচ্চবিত্ত ও ধনিক শ্রেণির জন্য সেসব সুবিধা ঘোষণা দেয়া হয়েছে বাজেটে তার সংস্থান করতে গিয়ে চাপ পড়বে সাধারণের ওপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও যাতায়াতের ব্যয় নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন। প্রস্তাবিত বাজেটে এসব খাতে যে ব্যয় সংস্থান ধরা হয়েছে তা একেবারেই গতানুগতিক। এসব খাতে ব্যয় করার কোন সম্ভাবনা নেই। বরং সরকারি হিসেবেই এসব ক্ষেত্রে ৫.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যোগ হবে ব্যয়ের খাতে। বেসরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আরো বেশি হবে। যা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে কর ছাড়ে মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের করদাতাদের এক বিন্দুও ছাড় দেয়া হয়নি। করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই আড়াই লাখ টাকাই রাখা আছে। চাপে থাকবেন তারা। এছাড়া বাজেটে গুঁড়ো দুধ, অপরিশোধিত চিনি, পরিশোধিত চিনি, স্মার্ট ফোন, আইসক্রিম, মোবাইল ফোনে কথা বলায় শুল্ক বাড়ানো ও সয়াবিন তেল, পাম ওয়েল, সান ফ্লাওয়ার তেল, সরিষার তেলের আমদানি পর্যায়ের ওপর মূসক আরোপ করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। ইতিমধ্যেই এসব পণ্যের দাম বাড়া শুরু করেছে। আর এসব পণ্যেই বেশি ব্যবহার করেন মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ। অর্থাৎ নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী কর আদায়ের জন্য মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের গোষ্ঠীকেই বেছে নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতি আর আগের মতো নেই। প্রতিবছর বাজেটের আকার বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু সেই তুলনায় মধ্যম ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় তেমন বাড়ছে না। বরং আয় বৈষম্য, ধনের বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এটা আরো প্রকট হচ্ছে। তাদের মতে, বাজেটে প্রবৃদ্ধির কথা থাকে, খাতওয়ারি বরাদ্দ বাড়ে প্রতিবছর, বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গৃহীত হয়। কিন্তু মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানোর মতো প্রত্যক্ষ কর্মসূচি তেমন থাকে না। অথচ অর্থনীতির বিকাশমান মধ্যবিত্তই হলো চালিকাশক্তি।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, রেস্তোরাঁয়: এসি বা নন-এসি, যেকোনো রেস্তোরাঁয় খাবার খেলেই সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এমনকি ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলেও ভ্যাট দিতে হবে।
এত দিন ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম কিংবা অনলাইনে কেনাকাটা করলে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হতো। নতুন বাজেটে তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। এতে অনলাইনে কেনাকাটা করলে খরচ বাড়বে। ব্র্যান্ড বা নন-ব্র্যান্ড, যেকোনো দোকান থেকে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজসহ যেকোনো পোশাক কিনতে গেলে খরচ বাড়বে। আগে ভ্যাট ছিল ৫ শতাংশ। নতুন আইনে তা সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
দেশি আসবাবপত্র কিনলে ভ্যাট বাড়বে। খাট, আলমারি, চেয়ার- টেবিলসহ আসবাবপত্র উৎপাদককে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। আবার শোরুম থেকে কেনার সময় ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।
অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ঘুরতে গেলে আপনাকে ভ্যাট দিতে হবে। এই ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ। রাজধানী ও এর আশপাশে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে প্রবেশ ও রাইডে চড়ার মাশুলের সঙ্গে এই ভ্যাটের টাকা কেটে রাখা হবে। সিনেমা দেখতে গেলে দিতে হবে ১০ শতাংশ ভ্যাট। দরজিপাড়ার দিকে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দরজির দোকানও ভ্যাটের আওতায় এসেছে। দরজির দোকান থেকে কোনো সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্টসহ অন্য যেকোনো জামা বানালে মজুরির ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। বাজেট ঘোষণার পর ইতোমধ্যে কিছু পন্যের দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজেটে করের ক্ষেত্রে উচ্চবিত্তরা যতটা সুযোগ পেয়েছে, সেই তুলনায় নিম্ন-মধ্যবিত্তরা পায়নি। করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো আড়াই লাখ টাকাই আছে। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর চাপ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। এর পর নতুন ভ্যাট আইন চালু হলে, যদিও সবার ওপর বর্তাবে তবে এর চাপটা মধ্যবিত্তের ওপর পড়বে। আরেকটি হলো- কর জালের আওতায় বাড়িওয়ালারা আসছে। সেক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভাড়াটিয়াদের ওপর করের চাপটা আসবে। এছাড়া সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম সমন্বয় করবে বলে শোনা যাচ্ছে। সরকার যদি বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় তখন একই রকম চাপটা এসে পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। তিনি বলেন, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে স্বচ্ছল উচ্চ আয়ের মানুষকে অনেক বেশি সুবিধা দেয়ায় দেশের মধ্যবিত্ত, বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত- এ থেকে খুব বেশি উপকৃত হবে না। এর ফলে সমাজে বৈষম্য আরো বাড়বে। বৈষম্য রেখে সমাজকে টেকসই করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাজেটের পর মধ্যবিত্তের জীবন আরো কঠিন চাপে পড়বে। তাদের খরচ বাড়বে। বাড়িভাড়া, পোশাক-আশাক, কেনাকাটা, প্রায় সব ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বাড়িভাড়া, শিক্ষা, পরিবহন ও স্বাস্থ্য খাতে চলে যায় তাদের আয়ের বেশির ভাগ। ঢাকায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষরা এভাবেই তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
কথা হয় রাজধানীর নামী একটি বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শাহানা পারভীনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তার মেয়ের শিক্ষা ব্যয়ের কথা। মেয়ে দুই শিক্ষকের কাছে কোচিং করছে ও দুজন শিক্ষক বাসায় এসে পড়াচ্ছেন। এ খরচের পাশাপাশি যাতায়াত, স্কুল খরচ, বই-খাতাসহ আনুষঙ্গিক মিলে মেয়ের পড়ালেখার পেছনেই মাসে ২০ হাজার টাকা চলে যায়। ফলে অন্য খরচ কাটছাঁট করে চলতে হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছর বেড়ে চললেও করমুক্ত আয়ের সীমা চার বছর ধরে আড়াই লাখ টাকাই আছে।
রাজধানীর মগবাজার একটি স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষক সানোয়ার হোসাইন। তার মূল বেতন ২৩ হাজার ১০০ টাকা। এ ছাড়া তিনি বাড়িভাড়া বাবদ ১ হাজার টাকা ও মেডিক্যাল ভাতা বাবদ মাসে পান ৫০০ টাকা। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিতে মূল বেতনের সঙ্গে রাজধানীতে ৭০ শতাংশ বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বাড়িভাড়া মাত্র ১ হাজার টাকা। অথচ এর পরও আমাদের আয়কর দিতে হয়। একজন আয়কর দাতা হয়েও নিজেই সংসার চালাতে পারছি না।
শফিউল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়া-লেখা করে একটি সরকারি বালিক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি বলেন, আমি যা বেতন পাই তা দিয়ে চলা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, গ্রামের বাড়িতে মা-বাবাকে টাকা দেয়া ও স্ত্রীর লেখা-পড়ার খরচ ও একটি ঋণের কিস্তি, সবমিলিয়ে কোনো কোনো মাসে বেতনের বেশি ব্যয় হয়। পরের মাসে সেটা সমন্বয় করতে হয় বলে জানান তিনি। বলেন, সংসার চালিয়ে নিতেই হিমশিম খাচ্ছি। এর মধ্যে এবারের বাজেটে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেসব পণ্য ব্যবহার করি সেগুলোরই দাম শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
শাহেদ কায়সার একটি এনজিওতে ১২ হাজার টাকায় মধ্যম সারির একটি পদে কাজ শুরু করেন। তার পরিবারে বর্তমান চারজন সদস্য। ভাড়া থাকেন রামপুরায়। তিন রুমের যে বাসায় তিনি ভাড়া থাকেন ১ দশক আগে সেখানে আট হাজার টাকায় উঠেছিলেন। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে এক দশকে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার। এ সময়ে শাহেদের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৬ হাজার। কিন্তু বেতন তিনগুণ বৃদ্ধি পেলেও এই টাকায় মাস চালাতে হিমশিম খান শাহেদ। তার নেই কোনো সঞ্চয়। বেতনের উল্লেখযোগ্য অংশই চলে যায় বাড়ি ভাড়ার পেছনে। খাবারের জন্য তাকে মাসে আরও খরচ করতে হয় ১৫ হাজার টাকা। দুই বাচ্চার লেখাপড়ার জন্য দুই হাজার। আর অবশিষ্ট তিন হাজার টাকা অন্যান্য প্রয়োজনে ব্যবহার করেন।
আবদুল হালিম। তিনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। মাসে বেতন সর্বসাকুল্যে ৪০ হাজার টাকা। থাকেন ঢাকার বাসাবো এলাকায়।
দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে অষ্টম আর মেয়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। ভালো ফলের জন্য দু’জনেরই প্রয়োজন প্রাইভেট টিউটরের। প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছে তাদের জন্য। প্রতি মাসে ছেলেমেয়েদের স্কুল ও প্রাইভেট টিউটরের বেতন মিলিয়ে খরচ ১০ হাজার টাকা। বাসাভাড়া দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। অসুস্থ মায়ের ও নিজেদের প্রয়োজনীয় ওষুধের পেছনে যায় ৩ হাজার টাকা। পানি, গ্যাস বিদ্যুৎ, নাইটগার্ড, ডিশ অ্যান্টেনা, ময়লা পরিষ্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের বিলসহ অন্যান্য মিলিয়ে ইউটিলিটি চার্জ দেন আড়াই হাজার টাকা। অফিসে যাতায়াত ও দুপুরের খাবার হিসেবে নিজের হাত খরচ রাখেন মাসে ৩ হাজার টাকা। অবশিষ্ট থাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। তা দিয়ে পরিবারের সবার খাওয়া-দাওয়ার জন্য মাসের বাজার ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় আবদুল হালিমকে। নিজের সংসারের হিসাব তুলে ধরে উল্টো জানতে চান- ‘কী খাই, তা আপনিই বলেন?’ এ অবস্থায় সামনে খরচ বাড়লে জীবন চলবে কি করে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জীবনযাত্রার মান অনুযায়ী এখন ব্যয় বেশি। এই ব্যয় মেটানোর আয় নেই মানুষের। আর মধ্যবিত্তরা তো আছেন মহাবিপদে। তারা কোথাও যেতেও পারেন না। বাসায় ভালো খেতেও পারেন না।
No comments