পিচের দোষ দিয়ে লাভ নেই by পবিত্র কুন্ডু
আশার জায়গাটা বড় হতাশায় রূপ নিল। শনিবার
শেরেবাংলা স্টেডিয়াম একটা লম্বা সময়ের জন্য শোকে ডুবিয়ে দিয়ে গেল
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ লিগ ম্যাচে ও ফাইনালে হারের
ক্ষতটা দগদগে থাকতে থাকতেই টেস্ট সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচেও শ্রীলঙ্কার কাছে
বিধ্বস্ত বাংলাদেশ দল। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের চিরচেনা পিচ হঠাৎই
বাংলাদেশের কাছে রহস্যের জাল বিছিয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে অচেনা অন্ধকারে?
চিরচেনা বলছি বটে, সত্যিটা হলো শেরেবাংলার পিচ আমরা চিনেছি বছর আটেক হলো।
নির্দিষ্ট করে বললে ২০১০ সাল থেকে, যখন আমরা ড্যানিয়েল ভেট্টোরির
নিউজিল্যান্ডকে ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই করলাম। তার আগে ২০০৬ সাল থেকে
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে নতুন জীবন পাওয়া এ স্টেডিয়ামের পিচ
আমরা চিনতাম না। একেকটি দল এখানে খেলতে নামত। তারা আমাদের বিপক্ষে রাশি
রাশি রান করত আর মুড়ি মুড়কির মতো উইকেট তুলত। পরাজয়ই ছিল নিয়তি, বাংলাদেশের
জন্য টেস্ট ম্যাচ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তিন দিনের খেলা! ওয়ানডে হলে আমাদেরই হোক
বা প্রতিপক্ষের, একটা ইনিংসেই জয়-পরাজয় নিশ্চিত। আমরা বুঝতামই না কেমন
উইকেট বানালে আমাদের খেলোয়াড়েরা সেটির সুবিধা নিতে পারবেন। এখানেই ওঠে দলের
সামর্থ্যের প্রসঙ্গ। আমাদের ব্যাটসম্যানরা তখন বড় দলগুলোর সহজপাচ্য খাদ্য।
তাঁরা না পারতেন পেস বলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে, না পারতেন স্পিন
সামলাতে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা! অবস্থাটা বদলাল ২০০৯-১০ সালের
দিকে এসে। কয়েকজন ক্রিকেটার সামর্থ্যের সীমাটা বাড়িয়ে নিতে পারাতেই এই বদল।
সাকিব, তামিম, মুশফিক-এ রকম অগ্রগণ্য কয়েকটি নাম। এঁদের কল্যাণে আমরা শুধু
মিরপুর শেরেবাংলার উইকেটই নয়, চিনতে শুরু করলাম পুরো দেশেরই পিচগুলো।
পিচের সুবিধাটা কাজে লাগাতে শিখলাম আর কি! সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালেও
ওয়ানডে সিরিজে নিউজিল্যান্ড ধবলধোলাই। তবে সবাই বাংলাদেশ দলের সামর্থ্যের
চূড়াটা ছুঁল ২০১৫ বিশ্বকাপের পর। সেটি বেশি করে প্রকাশিত ৫০ ওভারের
ক্রিকেটেই। দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজে পরপর পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ
আফ্রিকার জয় দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বে একটু সম্ভ্রমও আদায় করল। আর তখনই
বলা গেল যে পিচগুলো আমরা চিনেছি। এই চেনাটাও আসলে উপমহাদেশীয় দলগুলোর
বিপক্ষে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। উপমহাদেশের দেশের বাইরের দলগুলোর বিপক্ষে
কিছুটা চিনতে পারা গেল টেস্ট ক্রিকেটেও। সে জন্যই ২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের
বিপক্ষে স্পিনিং উইকেট বানিয়ে জয় তুলে নেওয়া গেছে। গত বছর জয় এসেছে
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কিন্তু প্রতিপক্ষের নাম যখন ভারত, পাকিস্তান কিংবা
শ্রীলঙ্কা, তখন উইকেটগুলো চিনে নেওয়ার বাকি থেকে যায়। অস্ট্রেলিয়া,
ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাও উপমহাদেশীয় পরিবেশে
স্পিনের বিপক্ষে দুর্বল। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়
এসেছে স্পিন-কৌশল কাজে লাগিয়েই। ওদের সঙ্গে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে
মিলিয়ে ফেলাটা বোকামি। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ঠিক এই বোকামিই আমরা করলাম।
চট্টগ্রামে ব্যাটিং স্বর্গ বানিয়ে কোনোক্রমে টেস্টটা ড্র করা গেল মূলত
মুমিনুল-লিটনের ব্যাটিং বীরত্বে। ঢাকায় দ্বিতীয় টেস্টে বানিয়ে বসলাম
স্পিনিং উইকেট। আমরা ভুলে গেলাম কিংবা ঔদ্ধত্য দেখিয়ে সত্যকে অস্বীকার
করলাম যে স্পিনের বিপক্ষে ব্যাটিংটা ওরা আমাদের চেয়ে ভালো জানে। ত্রিদেশীয়
সিরিজের ফাইনালে হারের পর যদি শ্রীলঙ্কান পিচ কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার
দিকে আঙুল উঠতে পারে, তাহলে টেস্ট সিরিজ হারেও তাঁর দিকে ছুটে যাবে
সমালোচনার তির। কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলেও জানে, কিউরেটর পিচ বানান স্বাগতিক
দলের চাহিদা মেনে। যেটিকে বলে ডিজাইনার পিচ। খেলার আগেই কিউরেটরকে জানিয়ে
দেওয়া হয়, আমাদের এমন পিচ চাই। উচ্চ বেতনধারী গামিনি ডি সিলভাকে সেটি
জানানো হয়নি, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এটাও কেউ মানবে না যে বোর্ড বা টিম
ম্যানেজমেন্টের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে তিনি নিজের খেয়ালমতো পিচ বানিয়েছেন।
গামিনিকে ‘নন্দঘোষ’ বানানোর কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ পিচের কারণে হারেনি।
প্রথমত, হেরেছে কথিত ইতিবাচক ব্যাটিংয়ের আড়ালে ব্যাটসম্যানদের পাগলাটে
ব্যাটিংয়ের কারণে। হেরেছে অদূরদর্শিতার কারণে। অপরিণত টিম ম্যানেজমেন্ট
নিজেদের সামর্থ্যকে ঠিকঠাক মাপতে পারেনি বলে। যে রকম পিচে
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াকে হারানো গেছে, তেমন পিচ বানিয়ে শ্রীলঙ্কাকে হারানো
যাবে, এমনটি যাঁরা ভাবেন, বোকার স্বর্গেই তাঁদের বসবাস। দলনায়ক এবং বিশ্বের
সেরা স্পিনিং অলরাউন্ডারটি নেই জেনেও স্পিনবান্ধব উইকেট বানানোর
নির্দেশদাতাদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত সিদ্ধান্তের কারণে। মাত্র আড়াই দিনেই
ঢাকা টেস্টটা গো-হারা হেরেছে নির্বাচকদের নির্বুদ্ধিতার কারণে। মোসাদ্দেক
হোসেন হয়তো ভীষণ রকম উজ্জ্বল কিছু করতে পারেননি, তবে চট্টগ্রাম টেস্টটা যে
খাদে পড়েও ড্র করা গেল, তাতে তাঁর ৫৩ বলে অপরাজিত ৮ রানের ভূমিকা ছিল। সেই
মোসাদ্দেককে বাদ দিয়ে কিনা নেওয়া হলো ফর্ম হারানো সাব্বির রহমানকে। যিনি
দুই ইনিংস মিলিয়ে ৫টি বল খেলে করতে পেরেছেন মাত্র ১ রান, স্লিপে দাঁড়িয়ে
ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে তিনটি ক্যাচ ছেড়েছেন। বারবার শৃঙ্খলাভঙ্গের
অভিযোগে অভিযুক্ত যে ক্রিকেটার সর্বশেষ অসদাচরণের দায়ে ২০ লাখ টাকা জরিমানা
দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে বাদ পড়েছেন এবং ঘরোয়া ক্রিকেটে ৬ মাস
নিষিদ্ধ হয়েছেন, এমন একজন ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু থাকে না।
কিন্তু বিসিবির প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন দিলেন হাস্যকর যুক্তি, ১৫
ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে সাব্বিরকে নিয়ে
যেহেতু দলের পরিকল্পনা আছে, তাঁকে অনুশীলনের সুযোগ তো করে দিতে হবে! টেস্ট
তাহলে একজন ফর্ম হারানো ব্যাটসম্যানের অনুশীলনের জায়গা! কবে আমরা পরিণত হব?
ত্রিদেশীয় সিরিজে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে আমরা শ্রীলঙ্কা
দলটিকে যেন প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিনি। টেস্ট সিরিজে প্রতিপক্ষ হিসেবে
শ্রীলঙ্কা তো ছিলই, প্রতিপক্ষ ছিল আমাদের অপরিণত ক্রিকেট-বোধ। বিপক্ষ
ড্রেসিংরুমে বসে এই সত্যটা ধরিয়ে দিলেন হাথুরুসিংহে। দোহাই আপনাদের, হারের
জন্য শুধু পিচের অজুহাত দেবেন না।
পবিত্র কুন্ডু: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
পবিত্র কুন্ডু: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
No comments