মালদ্বীপে কেন সেনা পাঠায়নি ভারত? by সঞ্জয় পুলিপাকা
মালদ্বীপে পার্লামেন্ট দখলে নিয়েছে সেনাবাহিনী |
গভীর
এক রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে মালদ্বীপ। গত সপ্তাহে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ৯ জন
বিরোধী দলীয় নেতাকে মুক্তি ও ১২ জন আইনপ্রণেতাকে স্বপদে পুনর্বহাল করার
নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশের পর প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন উল্টো প্রধান
বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সহ বিরোধী দলীয় নেতারা এই পরিস্থিতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। সাম্প্রতিক এই ঘটনাপ্রবাহ মালদ্বীপের রাজনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতির কথাই ফের মনে করিয়ে দেয়। মালদ্বীপে সংকট যত ঘনীভূত হয়েছে, ভারত সরকার ঘরে তত সমালোচনার মুখে পড়েছে। সমালোচকরা বলছেন, মালদ্বীপের দুর্বল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ত্বরিত গতিতে সেনা পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত।
তবে শক্তি প্রয়োগে ভারত সরকারের বিলম্বের কারণ কিন্তু সহজেই অনুমেয়।
১৯৮৮ সালে ভারত যখন মালদ্বীপে ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ পরিচালনা করে, তখন ঝুঁকি ছিল সীমিত, যার পরিণতিও ছিল অনুমানযোগ্য। তখন আবদুল্লাহ লুথুফির নেতৃত্বে ও একটি ভাড়াটে বাহিনীর সহায়তায় অল্প কিছুসংখ্যক নাগরিক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। ভারত সরকার তখন ভাড়াটে বাহিনীর হুমকিতে থাকা বৈধ একটি সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সাড়া দেয়। আর তখন মালদ্বীপে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল অনুপস্থিত কিংবা খুবই সীমিত। কিন্তু আজ ভারতের সামনে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমত, এখন মালদ্বীপ প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন সরকার ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের নেতৃত্বে বিরোধী দলের লড়াই প্রত্যক্ষ করছে। মালদ্বীপ এখন এক অভ্যন্তরীণ পরস্পরধ্বংসী সংঘাতে পড়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কর্মকাণ্ড যতই খারাপ হোক না কেন, তাকে অন্তত আবদুল্লাহ লুথুফির ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একপাল্লায় মাপা কঠিন। যদি মালদ্বীপে ফের সৈন্য পাঠাতো ভারত, তাহলে তা হতো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সামিল। এই ধরনের হস্তক্ষেপ শুধু সংক্ষিপ্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয় নয়। হস্তক্ষেপ করে যদি কৌশলগতভাবে ব্যাপক লাভবান হওয়া যায়, তবেই এই হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে।
১৯৮৮ সালের তুলনায়, আঞ্চলিক রাজনীতিও এখন গুণগতভাবে একেবারে আলাদা। মালদ্বীপে এখন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা অনেক বেশি সক্রিয়, যাদের প্রত্যেকের মতলব আলাদা। মালদ্বীপের রাজনীতির বহু খেলোয়াড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে সৌদি আরব, পাকিস্তান ও চীন। তারা এক্ষেত্রে নিজ নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই এই সংকটের সময় নিজেদের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দূত এই তিন দেশ সফর করেছেন। ভারতে অনেকেই মালদ্বীপে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি কেউ কেউ এমন মতও দিয়েছেন যে, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপ হয়তো চীনা উপস্থিতি কমানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো।
সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপে বহু অবকাঠামোগত প্রকল্প পরিচালনা করে চলছে চীন। তার মানে, মালদ্বীপে এখন বহু চীনা নাগরিক কর্মরত। রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থা বিবেচনায় নিলে বলা যায় যে, ভারতীয় বাহিনী মালদ্বীপে অবতরণের পর তেমন প্রতিরোধের মুখেই পড়তো না। এমনকি প্রতিরোধ এলেও, ভারতীয় বাহিনী খুব দ্রুতই তা মোকাবিলা করতে পারতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এটি ভুলে যাওয়া চলবে না যে, এই অভিযান পরিচালিত হতো বহু চীনা নাগরিকের চোখের সামনে। ১৯৮৮ সালে পরিস্থিতি তা ছিল না। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা শিনহুয়া জানিয়েছে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দূত বলেছেন, মালদ্বীপে চীনের নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে পারবে সরকার।
এই কথা নিয়ে আরও চিন্তা ভাবনার দরকার আছে। ভারতের হস্তক্ষেপে চীনা কোনো নাগরিকের ক্ষতি হলে, অনভিপ্রেত ফল দেখা দিতে পারে। ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে হয়তো কোনো চীনা নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন না। কিন্তু, এমনও হতে পারে যে, ভারতের ওপর দায় চাপাতে, মালদ্বীপের অন্য কোনো গোষ্ঠী হয়তো চীনা স্বার্থে আঘাত হানতে পারে।
মালদ্বীপে চীনের কোনো নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, জাতীয়তাবাদী অনুভূতি থেকে তাড়িত হয়েও চীন সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কড়া নিন্দা জানাবে। পাশাপাশি, এরপর চীন হয়তো দোকলাম সহ ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে।
মালদ্বীপের পরিস্থিতি থেকে এই ইঙ্গিত মিলে যে, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ভারতের জন্য গুরুতর নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এখন থেকে ভারতকে সবসময়ই নিজ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে চীনের উপস্থিতির কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যেসব দেশ রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদের উচিত নিজেদের ঘরোয়া রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা নিজেরাই পূরণ করে ফেলা। তা না করে, ভারতের প্রভাবে ভারসাম্য আনতে চীনকে ডেকে আনলে যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে অনেক রাজনৈতিক খেলোয়াড় হয়তো অগণতান্ত্রিক শাসনের রূপরেখা এগিয়ে নিতে সাহস পান। মালদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি সেই সাক্ষ্যই দেয়। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা মোহাম্মদ নাশিদ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীনকে তার দেশে দূতাবাস খুলতে দেন ও তৎপরতা বৃদ্ধির সুযোগ দেন। আজ মোহাম্মদ নাশিদ হয়তো আরও দীর্ঘমেয়াদি কারাভোগ বা নিজ সহকর্মীদের প্রাণের ওপর আঘাত আসতে পারে বলে উদ্বিগ্ন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কাছ থেকে সহায়তাও চেয়েছেন। ভারতের শ্লথ তৎপরতা দেখে নাশিদ ও তার সমর্থকরা হয়তো হতাশ। কিন্তু নাশিদ ও তার দলই চীনের উপস্থিতি বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করে ভারতের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
মালদ্বীপ সংকট থেকে নতুন চারপক্ষীয় রূপরেখার একটি পরীক্ষা হয়ে যাবে। মালদ্বীপের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে। তবে যেকোনো নিষেধাজ্ঞা সফল করতে হলে, তা হতে হয় সর্বাত্মক ও সর্বজনীন। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ একজোট হয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে পারে। নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনের ওপর কড়াকড়ি আরোপের প্রয়োজন হয়। তাই বৃটেন, যেখানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল অবস্থিত, সেটিও নিষেধাজ্ঞায় শামিল হয়ে মালদ্বীপের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এই দেশগুলোর সমন্বিত উদ্যোগেই কার্যকর ফল বয়ে আনতে পারে। অপরদিকে, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে অবস্থানরত ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের যেকোনো ত্বরিত পদক্ষেপের বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারবে।
মালদ্বীপ নিয়ে ভারতের অবস্থানই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মালদ্বীপের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অপরাপর বৈশ্বিক শক্তির উচিত এই বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া যে, মালদ্বীপের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বৃহৎ শক্তিসমূহ যদি মালদ্বীপকে দূরবর্তী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বহীন দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে ভারতকে একাই এগোতে হবে। ১৯৮৮ সালে কিছু না হলেও, এবার সশস্ত্র কোনো হস্তক্ষেপের দরুন এলোমেলো ফলাফল আসতে পারে। কিন্তু এলোমেলো ফলের আশঙ্কা কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত করা থেকে ভারতকে বিরত রাখবে? এই উত্তর আমরা শিগগিরই পাবো।
(সঞ্জয় পুলিপাকা নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন (ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশন্স (আইসিআরআইইআর)-এর জ্যেষ্ঠ পরামর্শক। তার এই নিবন্ধ ভারতের ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে।)
সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সহ বিরোধী দলীয় নেতারা এই পরিস্থিতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। সাম্প্রতিক এই ঘটনাপ্রবাহ মালদ্বীপের রাজনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতির কথাই ফের মনে করিয়ে দেয়। মালদ্বীপে সংকট যত ঘনীভূত হয়েছে, ভারত সরকার ঘরে তত সমালোচনার মুখে পড়েছে। সমালোচকরা বলছেন, মালদ্বীপের দুর্বল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ত্বরিত গতিতে সেনা পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত।
তবে শক্তি প্রয়োগে ভারত সরকারের বিলম্বের কারণ কিন্তু সহজেই অনুমেয়।
১৯৮৮ সালে ভারত যখন মালদ্বীপে ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ পরিচালনা করে, তখন ঝুঁকি ছিল সীমিত, যার পরিণতিও ছিল অনুমানযোগ্য। তখন আবদুল্লাহ লুথুফির নেতৃত্বে ও একটি ভাড়াটে বাহিনীর সহায়তায় অল্প কিছুসংখ্যক নাগরিক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। ভারত সরকার তখন ভাড়াটে বাহিনীর হুমকিতে থাকা বৈধ একটি সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সাড়া দেয়। আর তখন মালদ্বীপে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল অনুপস্থিত কিংবা খুবই সীমিত। কিন্তু আজ ভারতের সামনে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমত, এখন মালদ্বীপ প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন সরকার ও সাবেক প্রেসিডেন্ট নাশিদের নেতৃত্বে বিরোধী দলের লড়াই প্রত্যক্ষ করছে। মালদ্বীপ এখন এক অভ্যন্তরীণ পরস্পরধ্বংসী সংঘাতে পড়েছে। ফলে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কর্মকাণ্ড যতই খারাপ হোক না কেন, তাকে অন্তত আবদুল্লাহ লুথুফির ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে একপাল্লায় মাপা কঠিন। যদি মালদ্বীপে ফের সৈন্য পাঠাতো ভারত, তাহলে তা হতো অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সামিল। এই ধরনের হস্তক্ষেপ শুধু সংক্ষিপ্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয় নয়। হস্তক্ষেপ করে যদি কৌশলগতভাবে ব্যাপক লাভবান হওয়া যায়, তবেই এই হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে।
১৯৮৮ সালের তুলনায়, আঞ্চলিক রাজনীতিও এখন গুণগতভাবে একেবারে আলাদা। মালদ্বীপে এখন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা অনেক বেশি সক্রিয়, যাদের প্রত্যেকের মতলব আলাদা। মালদ্বীপের রাজনীতির বহু খেলোয়াড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে সৌদি আরব, পাকিস্তান ও চীন। তারা এক্ষেত্রে নিজ নিজ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই এই সংকটের সময় নিজেদের পক্ষে সমর্থন বাড়াতে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দূত এই তিন দেশ সফর করেছেন। ভারতে অনেকেই মালদ্বীপে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি কেউ কেউ এমন মতও দিয়েছেন যে, ভারত মহাসাগরে অবস্থিত কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভারতের সশস্ত্র হস্তক্ষেপ হয়তো চীনা উপস্থিতি কমানোর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো।
সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপে বহু অবকাঠামোগত প্রকল্প পরিচালনা করে চলছে চীন। তার মানে, মালদ্বীপে এখন বহু চীনা নাগরিক কর্মরত। রাজনৈতিক উত্তাল অবস্থা বিবেচনায় নিলে বলা যায় যে, ভারতীয় বাহিনী মালদ্বীপে অবতরণের পর তেমন প্রতিরোধের মুখেই পড়তো না। এমনকি প্রতিরোধ এলেও, ভারতীয় বাহিনী খুব দ্রুতই তা মোকাবিলা করতে পারতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এটি ভুলে যাওয়া চলবে না যে, এই অভিযান পরিচালিত হতো বহু চীনা নাগরিকের চোখের সামনে। ১৯৮৮ সালে পরিস্থিতি তা ছিল না। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তাসংস্থা শিনহুয়া জানিয়েছে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্টের দূত বলেছেন, মালদ্বীপে চীনের নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে পারবে সরকার।
এই কথা নিয়ে আরও চিন্তা ভাবনার দরকার আছে। ভারতের হস্তক্ষেপে চীনা কোনো নাগরিকের ক্ষতি হলে, অনভিপ্রেত ফল দেখা দিতে পারে। ভারতীয় বাহিনীর গুলিতে হয়তো কোনো চীনা নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেন না। কিন্তু, এমনও হতে পারে যে, ভারতের ওপর দায় চাপাতে, মালদ্বীপের অন্য কোনো গোষ্ঠী হয়তো চীনা স্বার্থে আঘাত হানতে পারে।
মালদ্বীপে চীনের কোনো নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হলে, জাতীয়তাবাদী অনুভূতি থেকে তাড়িত হয়েও চীন সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কড়া নিন্দা জানাবে। পাশাপাশি, এরপর চীন হয়তো দোকলাম সহ ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে।
মালদ্বীপের পরিস্থিতি থেকে এই ইঙ্গিত মিলে যে, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ভারতের জন্য গুরুতর নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এখন থেকে ভারতকে সবসময়ই নিজ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে চীনের উপস্থিতির কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও এ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যেসব দেশ রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাদের উচিত নিজেদের ঘরোয়া রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যতা নিজেরাই পূরণ করে ফেলা। তা না করে, ভারতের প্রভাবে ভারসাম্য আনতে চীনকে ডেকে আনলে যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। চীনের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে অনেক রাজনৈতিক খেলোয়াড় হয়তো অগণতান্ত্রিক শাসনের রূপরেখা এগিয়ে নিতে সাহস পান। মালদ্বীপের বর্তমান পরিস্থিতি সেই সাক্ষ্যই দেয়। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা মোহাম্মদ নাশিদ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীনকে তার দেশে দূতাবাস খুলতে দেন ও তৎপরতা বৃদ্ধির সুযোগ দেন। আজ মোহাম্মদ নাশিদ হয়তো আরও দীর্ঘমেয়াদি কারাভোগ বা নিজ সহকর্মীদের প্রাণের ওপর আঘাত আসতে পারে বলে উদ্বিগ্ন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কাছ থেকে সহায়তাও চেয়েছেন। ভারতের শ্লথ তৎপরতা দেখে নাশিদ ও তার সমর্থকরা হয়তো হতাশ। কিন্তু নাশিদ ও তার দলই চীনের উপস্থিতি বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করে ভারতের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
মালদ্বীপ সংকট থেকে নতুন চারপক্ষীয় রূপরেখার একটি পরীক্ষা হয়ে যাবে। মালদ্বীপের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে। তবে যেকোনো নিষেধাজ্ঞা সফল করতে হলে, তা হতে হয় সর্বাত্মক ও সর্বজনীন। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ একজোট হয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে পারে। নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনের ওপর কড়াকড়ি আরোপের প্রয়োজন হয়। তাই বৃটেন, যেখানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থল অবস্থিত, সেটিও নিষেধাজ্ঞায় শামিল হয়ে মালদ্বীপের বিরুদ্ধে চাপ বাড়াতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে এই দেশগুলোর সমন্বিত উদ্যোগেই কার্যকর ফল বয়ে আনতে পারে। অপরদিকে, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে অবস্থানরত ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের যেকোনো ত্বরিত পদক্ষেপের বিপরীত শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারবে।
মালদ্বীপ নিয়ে ভারতের অবস্থানই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প মালদ্বীপের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অপরাপর বৈশ্বিক শক্তির উচিত এই বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া যে, মালদ্বীপের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বৃহৎ শক্তিসমূহ যদি মালদ্বীপকে দূরবর্তী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বহীন দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে ভারতকে একাই এগোতে হবে। ১৯৮৮ সালে কিছু না হলেও, এবার সশস্ত্র কোনো হস্তক্ষেপের দরুন এলোমেলো ফলাফল আসতে পারে। কিন্তু এলোমেলো ফলের আশঙ্কা কি প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নিজ স্বার্থ সুরক্ষিত করা থেকে ভারতকে বিরত রাখবে? এই উত্তর আমরা শিগগিরই পাবো।
(সঞ্জয় পুলিপাকা নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন (ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশন্স (আইসিআরআইইআর)-এর জ্যেষ্ঠ পরামর্শক। তার এই নিবন্ধ ভারতের ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছে।)
No comments