বিনে বিদেশি ভাষা, মিটে কি আশা! by আবদুশ শাকুর ওয়াহেদ
স্নেহভাজন
ছাত্রী (ওর শিক্ষকদের শিক্ষক আমি) ফেসবুকে একটা ছবি দিয়েছে। নিতান্তই
সাধারণ ঘটনা। অসাধারণ কোনো ছবিও নয়। বেশ কিছু বছর হলো ওর কর্মস্থলটি কলেজ
থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। আর তুমুল উদ্দীপনাপূর্ণ পরিবেশে
একদল উচ্ছল তরুণ-তরুণী তাদের বিভাগের নবীনবরণ উদ্যাপন করছে। ওরা যে অসম্ভব
আনন্দ করছে সবাই মিলে, সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আর করবে না-ই বা
কেন? নতুনের আগমন মানেই তো প্রাণের আবির্ভাব। নতুনের আগমন মানেই পুরোনোকে
জানিয়ে দেওয়া যে তারা পুরোনো, তাদের সময় পেরিয়েছে। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি
কর...ওই নতুনের কেতন ওড়ে...।’ ওদের ছবি দেখে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাকল্যে এগারো বছর কাটিয়েছি। এর প্রথম সাড়ে সাত বছর ছাত্র
হিসেবে, জনৈক ‘বিশ্ববেহায়া’র কল্যাণে সাড়ে তিন বছর বোনাস হিসেবে পেয়েছিলাম।
বাদবাকি সময়টা শিক্ষক হিসেবে, তার কিছু সময় আবার ছাত্রদের অভিভাবক
হিসেবেও, হলের গৃহশিক্ষকরূপে। কী আনন্দের ছিল সেই সময়গুলো! অ্যানেক্সের
(কাজী মোতাহার হোসেন ভবন) কড়ইতলায় বসে আড্ডা দেওয়া, ইচ্ছা হলেই সুবীরদার
ক্যানটিনে চা খাওয়া, বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ছাদে উঠে রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে
বসে থাকা, পড়ন্ত বিকেলে শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের সিঁড়িতে বসে বন্ধুদের
সঙ্গে গল্প, রাতদুপুরে হলের সামনের মাঠে লম্বা কংক্রিটের টুলে শুয়ে
বন্ধুদের সঙ্গে আকাশের তারা গোনা—কী দিনগুলোই না কাটিয়েছি! আমরা ছুতো
খুঁজতাম কী করে দল বেঁধে ক্লাস না হওয়ার ব্যবস্থা (ফাঁকি দেওয়া না) করা
যায়! মনে আছে, মাস্টার্সে প্রাণ–পরিসংখ্যান বিষয়ের ক্লাস ছিল বেলা দেড়টায়।
একদিন দুই বন্ধু বলল, ওরা ক্লাস করবে না—হলে একটা বাংলা ছবি সাড়া জাগিয়ে
মুক্তি পেয়েছে—সেটা দেখতে যাবে। ক্লাস ফাঁকি দেওয়াটা আমার মনঃপূত না। আমি
ওদের বললাম, ‘তোরা একা যাবি কেন? চল সবাই মিলে যাই। চল আপার কাছে।’ আপা
আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সবাই মিলে তাঁকে গিয়ে বললাম, ‘আপা, আজকে আমরা ক্লাস
করব না।’
‘কেন?’
‘সিনেমা দেখতে যাব।’
‘মানেটা কী? ক্লাস করবে না, সিনেমা দেখতে যাবে?’
‘জি আপা।’
আপা কিছুক্ষণ সময় নিলেন। মনে হয় এমন আবদারে এতটাই ভড়কে গিয়েছিলেন যে কী বলবেন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর বললেন, ‘কী ছবি, আমাকে আগে বলতে, তাহলে আমিও যেতে পারতাম!’ ফার্মেসি কি প্রাণরসায়ন বিভাগের নবীনবরণ। সেলিম চৌধুরী গাইবেন গান। সেলিম ভাই আমাদের হলের ছাত্র। এটা তো মিস করা যায় না।
‘স্যার, আজকে ক্লাসটা ছুটি দেন।’
‘কেন?’
‘স্যার, জানেন আমাদের হলের বড় ভাই, সেলিম চৌধুরী, ওই যে স্যার, হুমায়ূন আহমেদ যাঁকে ব্রেক দিয়েছেন, উনি গান করবেন কার্জন হলে।’
‘তো কী?’
‘এটা কি মিস করা যায় স্যার? আপনিও যেতে পারেন স্যার। ভদ্র ছেলে, আপনি বললে হয়তো আমাদের নবীনবরণেও নিয়ে আসা যাবে, স্যার।’
‘আচ্ছা তোমরা যাও, আমার যেতে হবে না।’
নবীনবরণ, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বনভোজন, বিতর্ক—এসব কখন আসবে, সে আশায় বসে থাকতাম আমরা। এর মধ্যে নবীনবরণ ছিল সবার বেশ প্রিয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা হতো এ সময়েই—বাইরের ও ভেতরের শিল্পীরা মিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা একেকটা নতুন মুখে বিস্তৃত স্বপ্নের ছবিগুলো মনে করিয়ে দিত আমাদের সেই দিনগুলোকে। সে যাক। পুরোনো সে দিনের কথা বলতে গেলে নির্ঘাত খেই হারিয়ে ফেলব। শুরুর কথায় ফিরে যাই। ওদের নবীনবরণের অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে আমার চক্ষুস্থির। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, নবীনদের বরণ করার জন্য যে মঞ্চ সাজানো হয়েছে, তার পেছনের ব্যানারটিতে পুরো বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে
FRESHER’s RECEPTION
DEPARTMENT OF …. . , …. . UNIVERSITY
CHIEF GUEST: …. , Vice-chancellor, …. . University,
এবং আরও অনেক বিশেষ অতিথি এবং অনুষ্ঠানটির সভাপতির নাম ইংরেজি অক্ষরে লেখা। আমার বিস্ময়ের কারণ অনেকের বোধকরি বোধগম্য না-ও হতে পারে। কারণ ব্যক্তিগত আলোচনায় যা বুঝলাম, তাতে এটাই নাকি আজকাল রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বলছিলাম ব্যানারটিতে ইংরেজি শব্দের আধিক্যের(!) কথা। একটা বাংলা বর্ণ চোখে পড়েনি পুরো ব্যানারটিতে। আমরা বাংলাকে এত ভালোবাসি যে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছি। পাছে অতিব্যবহারে বিনষ্ট হয়! ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ওটাকে নামাব, তকতকে ঝকঝকে করে মুছব, বিভিন্ন রঙের বাহারি আলপনা এঁকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাব। সালাম-বরকতেরা আমাদের সাজানো-গোছানো বাহারি বর্ণমালার সারি দেখে তাঁদের আত্মত্যাগ যে বৃথা যায়নি, সে নিয়ে আত্মতুষ্টি অনুভব করবেন আর আমরা গর্বভরে ফেসবুকে আমাদের বাণী দেব: ‘Happy International Mother Language Day!’ বিনে বিদেশি ভাষা, মিটে কি আশা! এটাকে মন্ত্র বানিয়েই কি আমাদের অগ্রযাত্রা তাহলে? বিদেশে থাকি প্রায় বিশ বছর। অধ্যাপনার কারণে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান করছি দিনের পর দিন। কিন্তু প্রতিদিনই মনে হয় কিসের যেন তৃষ্ণা, কোথায় যেন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে পাঠদানে। প্রতিদিনই ভাবি আর দিনের শেষে সিদ্ধান্তে আসি, নিজের ভাষায় শিক্ষাদানের যে আনন্দ, তা অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। তাই তো! রামনিধি গুপ্ত তো বলেইছিলেন:
‘নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পুরে কি আশা?’
না, আশা পুরে না। নবীনবরণের কথা দিয়ে শুরু, তাই দিয়েই শেষ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে প্রথম বর্ষে আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল ইরান থেকে উড়ে আসা আলিয়া। বেচারার ত্রাহি অবস্থা—ও ইংরেজি একটু-আধটু জানে, বাংলার তো ধারেকাছেই নেই। নবীনবরণ অনুষ্ঠান মঞ্চের ব্যানারটির সব লেখাই তখন বাংলায়। অনুষ্ঠান শেষে আমরা বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম, ওর জন্য হলেও আমাদের ছোট করে ইংরেজিতে কিছু লেখা উচিত ছিল। বুঝতে পারছি দিনকাল পাল্টেছে। আমাদের এখন নিজেদের জন্যই বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে লিখতে হচ্ছে। একটু-আধটু বাংলা রাখলে কি খুব বেশি দোষের কিছু হয়ে যাবে?
অনুরোধটা কি একটু বেশি সেকেলে ঠেকছে?
আবদুশ শাকুর ওয়াহেদ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের প্রাণ-পরিসংখ্যানের অধ্যাপক
‘কেন?’
‘সিনেমা দেখতে যাব।’
‘মানেটা কী? ক্লাস করবে না, সিনেমা দেখতে যাবে?’
‘জি আপা।’
আপা কিছুক্ষণ সময় নিলেন। মনে হয় এমন আবদারে এতটাই ভড়কে গিয়েছিলেন যে কী বলবেন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারপর বললেন, ‘কী ছবি, আমাকে আগে বলতে, তাহলে আমিও যেতে পারতাম!’ ফার্মেসি কি প্রাণরসায়ন বিভাগের নবীনবরণ। সেলিম চৌধুরী গাইবেন গান। সেলিম ভাই আমাদের হলের ছাত্র। এটা তো মিস করা যায় না।
‘স্যার, আজকে ক্লাসটা ছুটি দেন।’
‘কেন?’
‘স্যার, জানেন আমাদের হলের বড় ভাই, সেলিম চৌধুরী, ওই যে স্যার, হুমায়ূন আহমেদ যাঁকে ব্রেক দিয়েছেন, উনি গান করবেন কার্জন হলে।’
‘তো কী?’
‘এটা কি মিস করা যায় স্যার? আপনিও যেতে পারেন স্যার। ভদ্র ছেলে, আপনি বললে হয়তো আমাদের নবীনবরণেও নিয়ে আসা যাবে, স্যার।’
‘আচ্ছা তোমরা যাও, আমার যেতে হবে না।’
নবীনবরণ, অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বনভোজন, বিতর্ক—এসব কখন আসবে, সে আশায় বসে থাকতাম আমরা। এর মধ্যে নবীনবরণ ছিল সবার বেশ প্রিয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা হতো এ সময়েই—বাইরের ও ভেতরের শিল্পীরা মিলে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা একেকটা নতুন মুখে বিস্তৃত স্বপ্নের ছবিগুলো মনে করিয়ে দিত আমাদের সেই দিনগুলোকে। সে যাক। পুরোনো সে দিনের কথা বলতে গেলে নির্ঘাত খেই হারিয়ে ফেলব। শুরুর কথায় ফিরে যাই। ওদের নবীনবরণের অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা ছবিতে এসে আমার চক্ষুস্থির। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, নবীনদের বরণ করার জন্য যে মঞ্চ সাজানো হয়েছে, তার পেছনের ব্যানারটিতে পুরো বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে
FRESHER’s RECEPTION
DEPARTMENT OF …. . , …. . UNIVERSITY
CHIEF GUEST: …. , Vice-chancellor, …. . University,
এবং আরও অনেক বিশেষ অতিথি এবং অনুষ্ঠানটির সভাপতির নাম ইংরেজি অক্ষরে লেখা। আমার বিস্ময়ের কারণ অনেকের বোধকরি বোধগম্য না-ও হতে পারে। কারণ ব্যক্তিগত আলোচনায় যা বুঝলাম, তাতে এটাই নাকি আজকাল রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বলছিলাম ব্যানারটিতে ইংরেজি শব্দের আধিক্যের(!) কথা। একটা বাংলা বর্ণ চোখে পড়েনি পুরো ব্যানারটিতে। আমরা বাংলাকে এত ভালোবাসি যে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখে দিয়েছি। পাছে অতিব্যবহারে বিনষ্ট হয়! ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ওটাকে নামাব, তকতকে ঝকঝকে করে মুছব, বিভিন্ন রঙের বাহারি আলপনা এঁকে শহীদ মিনারে নিয়ে যাব। সালাম-বরকতেরা আমাদের সাজানো-গোছানো বাহারি বর্ণমালার সারি দেখে তাঁদের আত্মত্যাগ যে বৃথা যায়নি, সে নিয়ে আত্মতুষ্টি অনুভব করবেন আর আমরা গর্বভরে ফেসবুকে আমাদের বাণী দেব: ‘Happy International Mother Language Day!’ বিনে বিদেশি ভাষা, মিটে কি আশা! এটাকে মন্ত্র বানিয়েই কি আমাদের অগ্রযাত্রা তাহলে? বিদেশে থাকি প্রায় বিশ বছর। অধ্যাপনার কারণে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষাদান করছি দিনের পর দিন। কিন্তু প্রতিদিনই মনে হয় কিসের যেন তৃষ্ণা, কোথায় যেন ফাঁকা থেকে যাচ্ছে পাঠদানে। প্রতিদিনই ভাবি আর দিনের শেষে সিদ্ধান্তে আসি, নিজের ভাষায় শিক্ষাদানের যে আনন্দ, তা অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। তাই তো! রামনিধি গুপ্ত তো বলেইছিলেন:
‘নানান দেশের নানান ভাষা।
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পুরে কি আশা?’
না, আশা পুরে না। নবীনবরণের কথা দিয়ে শুরু, তাই দিয়েই শেষ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে প্রথম বর্ষে আমাদের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল ইরান থেকে উড়ে আসা আলিয়া। বেচারার ত্রাহি অবস্থা—ও ইংরেজি একটু-আধটু জানে, বাংলার তো ধারেকাছেই নেই। নবীনবরণ অনুষ্ঠান মঞ্চের ব্যানারটির সব লেখাই তখন বাংলায়। অনুষ্ঠান শেষে আমরা বন্ধুরা মিলে গল্প করছিলাম, ওর জন্য হলেও আমাদের ছোট করে ইংরেজিতে কিছু লেখা উচিত ছিল। বুঝতে পারছি দিনকাল পাল্টেছে। আমাদের এখন নিজেদের জন্যই বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে লিখতে হচ্ছে। একটু-আধটু বাংলা রাখলে কি খুব বেশি দোষের কিছু হয়ে যাবে?
অনুরোধটা কি একটু বেশি সেকেলে ঠেকছে?
আবদুশ শাকুর ওয়াহেদ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের প্রাণ-পরিসংখ্যানের অধ্যাপক
No comments