খালেদা জিয়ার প্রতি কেন এমন আচরণ? by সৈয়দ আবদাল আহমদ
৮
ফেব্রুয়ারির অভিশপ্ত দিনটির নানা ঘটনাবলির কথা মনে পড়ছে। নানা রকম দৃশ্য
চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ভেসে উঠছে খালেদা জিয়ার নিষ্পাপ মায়াভরা মুখখানি।
বিচারের নামে সরকারি মহলের অবিচারের শিকার হয়েছেন তিনি। তার প্রতি হয়েছে কী
অমানবিক ও দুঃসহ আচরণ! আমার বাসা থেকে মাত্র কয়েকশ’ গজ দূরে পুরন ঢাকার
নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগার। জনমানবহীন এক নির্জন ভবন।
এই নির্জন কারাগারের এক ভুতুড়ে পরিবেশের মধ্যে একটি স্যাঁতসেঁতে ভবনেই
কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়াকে।
একটিবারের জন্যও ভাবা হয়নি তিনি তিনবারের নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী,
সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন। এ কথাও বিবেচনা করা হয়নি
তিনি ৭৩ বছর বয়স্ক একজন নারী, তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, তিনি একজন
স্বামীহারা, এক সন্তানহারা মানুষ। অস্থিরতায় শুধু ভাবছি তার প্রতি কেন এই
নিষ্ঠুর আচরণ? রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জন্য কারাবরণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রতি যে জুলুম করা হয়েছে তার কোনো নজির খুঁজে পাওয়া
যাবে না। ক্ষমতার প্রয়োজনে এরশাদকে আবারও লাগবে, তাকে খুশি করতে হবে। তাই
বহু আগে পরিত্যক্ত হওয়া সত্ত্বেও নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারকেই বেছে নেয়া
হলো খালেদা জিয়ার জন্য। তাকে সেখানেই বন্দী করে রাখা হলো। এ এক রাজনৈতিক
প্রতিহিংসা। একবারের জন্যও ক্ষমতাসীনদের বিবেকে বাঁধেনি একটি জনমানবহীন
নির্জন ভুতুড়ে ভবনে কীভাবে খালেদা জিয়ার মতো একজন রাজনীতিবিদকে রাখা যায়?
কিছু দিন আগেও এই কারাগারে অনেকের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর
সেখানেই তাকে একাকী রাখা হয়েছে। তিনি ছাড়া একজন বন্দীও সেখানে নেই। একজন
নারী হিসেবে সামান্য মর্যাদাও কী তার প্রাপ্য ছিল না? এ কী নির্দয় ব্যবহার?
বারবার মনে প্রশ্ন প্রশ্ন জাগে- খালেদা জিয়ার কী অন্যায়? কী তার অপরাধ?
দেশকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন, বাংলাদেশের জনগণ প্রাণ উজাড় করে তাকে
ভালোবাসে। এটাই কী তার অপরাধ? স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি বন্দিশিবিরে
ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে তার রয়েছে অবদান। তার স্বামী জিয়াউর রহমানের
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা শুনেছি, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রণাঙ্গনে
যুদ্ধ করেছেন, জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের উন্নয়নে অতুলনীয় ভূমিকা
রেখেছেন। এটাই কী অপরাধ? খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন গণতন্ত্রের জন্য
নিবেদিত। তিনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন
এবং সংসদীয় গণতন্ত্র এনেছেন। এটাই কি তার অপরাধ? এই দেশের বেশির ভাগ
উন্নয়নের সাথে তিনি ও তার স্বামী জিয়াউর রহমান সরাসরি সম্পৃক্ত। এই কি তার
অপরাধ? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে কতটা অমানবিক, হৃদয়হীন এবং
প্রতিহিংসাপরায়ণ খালেদা জিয়ার প্রতি এই জুলুমই তার নিকৃষ্ট উদাহরণ। ৮
ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়ের দিন নির্ধারিত ছিল। ওই দিনই
প্রধানমন্ত্রী বরিশালে জনসভা করেন। রায় ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার প্রতি
ছুড়ে দেন প্রতিহিংসার তীর। জনসভায় দম্ভের সাথেই উচ্চারণ করেন- কোথায় আজ
খালেদা জিয়া? পিতার যোগ্য উত্তরসূরিই বটে! তার পিতাও একদিন দম্ভোক্তি
করেছিলেন- কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? এই লেখা যখন লিখছি, তখন খালেদা জিয়ার
আইনজীবীরা কারাগারে তার সাথে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতি
সরকারের নানা অমানবিক আচরণের বিবরণ দেন। তাকে জেলে নেয়ার ডিভিশন তিনদিন
পর্যন্ত দেয়া হয়নি। একজন বন্দী হিসেবে প্রাপ্য সুবিধা তিনি পাননি। তার
সেবিকাকেও তার সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়নি। বয়োবৃদ্ধ এই রাজনীতিবিদ একজন সাধারণ
কয়েদির মতো স্যাঁতসেঁতে পরিত্যক্ত নির্জন ভবনে একাকী বন্দী জীবনের অমানবিক
নির্যাতন সহ্য করছেন। তিনি যেনো জামিনে বেরিয়ে আসতে না পারেন সেজন্য
অন্যান্য মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর ষড়যন্ত্র চলছে। ইতোমধ্যে
কুমিল্লার একটি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। তার নামে ৩৪টি
মামলায় সচল করার অপচেষ্টা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার প্রতি এই নির্মমতায়
বাংলাদেশের মানুষ আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। বাংলাদেশের হৃদয়ই যেন ভেঙে গেছে।
মানুষের অন্তর কেঁদে উঠছে। নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের অন্ধকার
প্রকোষ্ঠে আজ শুধু একজন ব্যক্তি খালেদা জিয়াকেই বন্দী করা হয়নি, বন্দী করা
হয়েছে গণতন্ত্রকে।পাবলিক কোর্টে খালেদা জিয়ার বিচারের রায় হবে সবার সামনে।
সেখানে সবাই উপস্থিত থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। পাবলিক কোর্ট বলতে সেটাই
বোঝায়। সেজন্য সাংবাদিক হিসেবে ওই দিন কোর্টে উপস্থিত থাকার জন্য
গিয়েছিলাম। কিন্তু কোর্টে ঢুকতে পারিনি। আমার মতো বহু সাংবাদিককে কোর্টে
যেতে দেয়া হয়নি। যেতে দেয়া হয়নি আইনজীবীদের। কোর্টের প্রবেশমুখে ব্যারিকেড
দিয়ে আটকে দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকনের
গাড়িতে তার জুনিয়র আইনজীবীও ছিলেন। তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। ব্যারিস্টার খোকন
পুলিশকে প্রশ্ন করেন, এটা তো পাবলিক কোর্ট, ক্যামেরা ট্রায়াল নয়। কিন্তু
পুলিশের সাফ জবাব- নির্ধারিত কয়েকজন আইনজীবী ও সাংবাদিক ছাড়া আর কেউ ঢুকতে
পারবে না। মহানগর পুলিশ কমিশনার স্বয়ং এসে আইনজীবীদের শাসিয়ে যান- প্রয়োজনে
চেহারা পাল্টে দেয়া হবে। বেগম খালেদা জিয়া দুপুর একটা আটচল্লিশ মিনিটে
কোর্টে প্রবেশ করেন। কিন্তু সকাল ন’টা থেকেই ব্যারিকেডের সামনে অবস্থান
করছিলেন অসংখ্য আইনজীবী ও সাংবাদিক। হিজড়া সম্প্রদায়ের একজনের কথা বলি। তার
নাম কাজলী হিজড়া। খালেদা জিয়ার একজন ভক্ত। সকাল ন’টা থেকেই সেখানে
উপস্থিত। খালেদা জিয়ার জন্য তিনি রোজা রেখে এসেছেন। তাকে মা, মা বলে অঝোরে
কাঁদতে দেখেছি। তিনি শুধু বলছিলেন- ‘আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার মা খালেদা
জিয়াকে জেলে যেতে দেব না।’ ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালেদা জিয়ার জন্য তার এই
উৎকণ্ঠা উপস্থিত সবাইকে বিস্মিত করে। হয়তো খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার কোনো দিন
সাক্ষাৎই হয়নি। কিন্তু তার জন্য যে আহাজারি করতে তাকে দেখেছি, সে দৃশ্য
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কোর্টের পাশে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে
অনেককে দোয়া-দরুদ, মোনাজাত এবং কান্নাকাটি করতে দেখেছি। এটি খালেদা জিয়ার
প্রতি মানুষের ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের দৃশ্য সেদিন দেশজুড়েই ছিল।
অসংখ্য মানুষের এই আহাজারি, তাদের মোনাজাত নিশ্চয়ই বিফলে যাবে না। নির্দোষ
প্রমাণিত হয়ে বিজয়ের মালা গলায় নিয়েই একদিন জনগণের খালেদা জিয়া তাদের মাঝে
ফিরে আসবেন।
একতরফা নির্বাচনের দুরভিসন্ধি
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা স্পষ্টভাষায় বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত এই মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি মামলা। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে, জাল-জালিয়াতি করে এই মামলাটি করা হয়েছে। সরকার আদালতে এই মামলা প্রমাণ করতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্যই বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। সরকার কোর্টকে ব্যবহার করার জন্য এ ধরনেরই হীনপন্থা বেছে নিয়েছে। শুধু খালেদা জিয়ার আইনজীবীই নয়। দেশের বিশিষ্টজনেরা এবং বেশির ভাগ মানুষও এই কথা বিশ্বাস করে। টিভি টকশোতে ডক্টর সলিমুল্লাহ খান দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি কোর্টে একটি বিচার হয়েছে। দেশের মানুষ মনে করে এটি একটি রাজনৈতিক বিচার। প্রথম আলোতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। দেশে কত শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা বা সাজা হওয়ার কথা কমই শোনা যায়। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তেমন বড় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সমঝোতামূলক পরিস্থিতির কোনো আশাই দেখা যাচ্ছে না। দেশবাসী যে একটা ভালো নির্বাচন চায়, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা ক্রমান্বয়ে আরো দূরের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনও মনে হচ্ছে একতরফাই হবে। তার ফল হবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা। সেই প্রক্রিয়াই চলছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক অনাস্থা ও দূরত্ব আরো বাড়বে। সামনে নির্বাচন। বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। তাদের তো নির্বাচনে আসতে হবে। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি সরকার মারমুখী অবস্থানে রয়েছে। নির্বিচারে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) আ ন ম মনীরুজ্জামান বলেন, এই রায়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা সংশয় রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় এখনকার অবস্থা ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত। আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে তেমনই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, খালেদা জিয়ার বিচারটা এমনভাবে রাজনীতিকায়ন করা হয়েছে, যেন বিচারের পক্ষ রাষ্ট্র বনাম খালেদা জিয়া নন, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি। এতে পারস্পরিক অনাস্থা ও দূরত্ব আরো বাড়বে। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, আগামী ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন। এর এক সপ্তাহ পরেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তাকে জেলে নেয়ায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আসন্ন নির্বাচনেও শেখ হাসিনার পরাজয়ের কোনো ইচ্ছা নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, ঢাকায় বেশ জোর গুঞ্জন আছে যে, এই মুহূর্তে যদি বাংলাদেশে নির্বাচন হয়, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে হেরে যাবে।
প্রিয় খালেদা জিয়া অন্যায় করেননি
রায় ঘোষণার আগের দিন গুলশান কার্যালয়ে প্রিয় খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করেছেন। জনগণের উদ্দেশ্য বলেছেন, ‘আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। কোনো দুর্নীতি করেনি।’ বাংলাদেশের মানুষ তার এই কথা বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তিনি জুলুমের শিকার হয়েছেন। বড় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাকে জেলে নেয়া হয়েছে যাতে নির্বাচন করতে না পারেন। কারণ, তারা জানে খালেদা জিয়া বাইরে থাকলে এবার একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা ক্ষমতা ছাড়বে না। যে করেই হোক ক্ষমতায় থাকবে। এবারের নির্বাচনও তারা হাইজ্যাক করবে। সেজন্যই তাকে কারাগারে নিয়েছে, তার নামে দুর্নীতির অপবাদ দিয়েছে। আজ দেশে দুর্নীতি একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে। ব্যাংক বলতে এখন আর দেশে কিছু নেই। একটির পর একটি ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প বানিয়ে টাকা লুটের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়ে। আর দুর্নীতির অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার নামে! মানুষ সবই বোঝে এবং জানে। বাংলাদেশের মানুষ এও জানে- সুখ-শান্তিতে থাকতে চাইলে তার কোনো অভাব খালেদা জিয়ার হতো না। কিন্তু নিজের সুখ-শান্তিকে তিনি তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা তিনি ভেবেছেন। এ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে তিনি তার নিরিবিলি পারিবারিক জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সন্তানদের সময় দিতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকার আপনাকে গ্রেফতার করার পর আদালতে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আপনি বলেছিলেন, ‘ ‘বাংলাদেশই আমার ঠিকানা। এর বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশেই আমি মরতে চাই।
একতরফা নির্বাচনের দুরভিসন্ধি
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা স্পষ্টভাষায় বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট সংক্রান্ত এই মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি মামলা। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে, জাল-জালিয়াতি করে এই মামলাটি করা হয়েছে। সরকার আদালতে এই মামলা প্রমাণ করতে পারেনি। খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্যই বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে। সরকার কোর্টকে ব্যবহার করার জন্য এ ধরনেরই হীনপন্থা বেছে নিয়েছে। শুধু খালেদা জিয়ার আইনজীবীই নয়। দেশের বিশিষ্টজনেরা এবং বেশির ভাগ মানুষও এই কথা বিশ্বাস করে। টিভি টকশোতে ডক্টর সলিমুল্লাহ খান দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি কোর্টে একটি বিচার হয়েছে। দেশের মানুষ মনে করে এটি একটি রাজনৈতিক বিচার। প্রথম আলোতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে। দেশে কত শত শত কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। সেগুলো নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা বা সাজা হওয়ার কথা কমই শোনা যায়। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তেমন বড় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সমঝোতামূলক পরিস্থিতির কোনো আশাই দেখা যাচ্ছে না। দেশবাসী যে একটা ভালো নির্বাচন চায়, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা ক্রমান্বয়ে আরো দূরের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনও মনে হচ্ছে একতরফাই হবে। তার ফল হবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা। সেই প্রক্রিয়াই চলছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়ার ঘটনায় রাজনৈতিক অনাস্থা ও দূরত্ব আরো বাড়বে। সামনে নির্বাচন। বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। তাদের তো নির্বাচনে আসতে হবে। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতি সরকার মারমুখী অবস্থানে রয়েছে। নির্বিচারে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব:) আ ন ম মনীরুজ্জামান বলেন, এই রায়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা সংশয় রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় এখনকার অবস্থা ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ হিসেবে অভিহিত। আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে তেমনই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, খালেদা জিয়ার বিচারটা এমনভাবে রাজনীতিকায়ন করা হয়েছে, যেন বিচারের পক্ষ রাষ্ট্র বনাম খালেদা জিয়া নন, আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি। এতে পারস্পরিক অনাস্থা ও দূরত্ব আরো বাড়বে। দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, আগামী ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন। এর এক সপ্তাহ পরেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দিয়ে তাকে জেলে নেয়ায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আসন্ন নির্বাচনেও শেখ হাসিনার পরাজয়ের কোনো ইচ্ছা নেই। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, ঢাকায় বেশ জোর গুঞ্জন আছে যে, এই মুহূর্তে যদি বাংলাদেশে নির্বাচন হয়, শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে হেরে যাবে।
প্রিয় খালেদা জিয়া অন্যায় করেননি
রায় ঘোষণার আগের দিন গুলশান কার্যালয়ে প্রিয় খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করেছেন। জনগণের উদ্দেশ্য বলেছেন, ‘আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। কোনো দুর্নীতি করেনি।’ বাংলাদেশের মানুষ তার এই কথা বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তিনি জুলুমের শিকার হয়েছেন। বড় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। তাকে জেলে নেয়া হয়েছে যাতে নির্বাচন করতে না পারেন। কারণ, তারা জানে খালেদা জিয়া বাইরে থাকলে এবার একতরফা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা ক্ষমতা ছাড়বে না। যে করেই হোক ক্ষমতায় থাকবে। এবারের নির্বাচনও তারা হাইজ্যাক করবে। সেজন্যই তাকে কারাগারে নিয়েছে, তার নামে দুর্নীতির অপবাদ দিয়েছে। আজ দেশে দুর্নীতি একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হচ্ছে। ব্যাংক বলতে এখন আর দেশে কিছু নেই। একটির পর একটি ব্যাংক লুট হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় প্রকল্প বানিয়ে টাকা লুটের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়ে। আর দুর্নীতির অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার নামে! মানুষ সবই বোঝে এবং জানে। বাংলাদেশের মানুষ এও জানে- সুখ-শান্তিতে থাকতে চাইলে তার কোনো অভাব খালেদা জিয়ার হতো না। কিন্তু নিজের সুখ-শান্তিকে তিনি তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা তিনি ভেবেছেন। এ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে তিনি তার নিরিবিলি পারিবারিক জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। সন্তানদের সময় দিতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকার আপনাকে গ্রেফতার করার পর আদালতে তিনি একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আপনি বলেছিলেন, ‘ ‘বাংলাদেশই আমার ঠিকানা। এর বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশেই আমি মরতে চাই।
বলেছিলেন- আমার, আমাদের পরিবার ও
আমাদের ছেলেদের অর্থের কোনো লোভ নেই, অর্থের কোনো প্রয়োজন নেই। জনগণের
ভালোবাসা আমরা পেয়েছি এবং পাচ্ছি। এটাই আমার সব।’ তিনি বলেছিলেন - ‘আমি
রাজনীতি করতে চাইনি। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর এ দেশের মা, বোন,
ছাত্র-জনতার আহবানে, বিএনপির স্বার্থে এবং মানুষের কল্যাণার্থেই আপনাকে
রাজনীতিতে আসতে হয়েছে।’ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি ন’বছর আন্দোলন করেছেন।
তাকে কয়েকবার গৃহবন্দী করা হয়েছে। দেশের মানুষের ভোটে ক্ষমতায় এসে আপনি
ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। বাংলাদেশের যত জায়গায় তিনি গেছেন, আর কেউ সম্ভবত
যায়নি। দেশে বন্যা হলে, টর্নেডো হলে, ঘূর্ণিঝড় হলে তিনি ছুটে গেছেন।
মানুষের বিপদে-আপদে তাদের পাশে থেকেছেন। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে তার দুটি
পা পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে গেছে। আর আজ তাকে জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। সংবাদ
সম্মেলনে তিনি সরকারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, যেকোনো
পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত আছেন। জুলুম সহ্য করে অপরিসীম ত্যাগ আপনি স্বীকার
করছেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আপনার ত্যাগ
বৃথা যাবে না। ক্ষমতাকে তিনি তুচ্ছ জ্ঞান করেন। ক্ষমতা বারবার তার কাছে
এসেছে। কিন্তু জনগণের কল্যাণকে তিনি বড় করে দেখেছেন। এরশাদের স্বৈরশাসনের
বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় ১৯৮৬ সালে যুবদলের সভায় তিনি বলেছিলেন- ‘ক্ষমতা
চাইলে এখানে, ঠিক এখানে এসে হাজির হবে। কিন্তু ক্ষমতা নয়, সংগ্রাম। ক্ষমতায়
আমরা ছিলাম। আবার ক্ষমতায় যাব। কিন্তু এমনভাবে, যেন আমাদের বিজয় জনগণের
বিজয় হয়ে ওঠে।’ তিনি সফল হয়েছিলেন। এরশাদের পতনের পর জনগণ আপনাকেই ক্ষমতায়
এনেছিল। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মর্যাদা দিয়েছিল।
ওয়ান-ইলেভেনে মইন-ফখরুদ্দিনের কারাগারেও তাকে জরুরি সরকারের কুশীলবরা
ক্ষমতার প্রলোভন দিয়েছিল। কিন্তু তিনি সে প্রলোভনে পা দেননি। বারবার
বলেছেন, আগে জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হোক। নির্বাচন দেয়া হোক। বাংলাদেশের
লাখো কোটি আশাবাদী মানুষের সঙ্গে আমরাও বিশ্বাস করি এই সংগ্রামেও বেগম জিয়া
সফল হবেন। বিজয়ী হবেন। ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন হবে। অন্ধকার দূরীভূত হবে।
আপনার প্রাপ্য সম্মান আপনি অবশ্যই ফিরে পাবেন। জনগণ জাগছে। রাজপথে মানুষ
নেমে আসছে। সোমবার প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে জনতার জোয়ার নেমেছে। জনগণ
আপনার মুক্তির দাবিতে রাজপথ কাঁপিয়ে তুলছে। কবি নজরুলের ভাষায় জনগণ
সমস্বরে উচ্চারণ করছে ‘লাথি মার, ভাঙরে তালা! আগুন-জ্বালা, ফেল উপাাড়ি।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
No comments