রাশিয়া-চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি ট্রাম্পের! by মাহফুজার রহমান
সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের পর একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রায়
তিন দশক এই ভূমিকায় থাকা দেশটি গত কয়েক বছরে যেন কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে।
বিশেষ করে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া ও শি চিন পিংয়ের চীন মাথাব্যথার কারণ
হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়াশিংটনের। আর এটা ভালোই টের পাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের
যুক্তরাষ্ট্র। এ কারণেই কিনা ট্রাম্প প্রশাসন রাখঢাক না রেখেই নিজেদের
অবস্থানের কথা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তাদের নতুন জাতীয়
নিরাপত্তা কৌশলে ওয়াশিংটন বলছে, এখন আর সন্ত্রাসবাদ নয়, একক পরাশক্তি
হিসেবে অবস্থান ধরে রাখাই যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। এ জন্য রাশিয়া-চীনের
মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক
বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে। শুধু জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে লক্ষ্য বদলানোই
নয়, অস্ত্র আধুনিকায়নের প্রতিও জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সামরিক
বাহিনী মনে করে, তাদের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো ‘সেকেলে’। এগুলো আকারেও বড়।
তাই ছোট বোমার আকারে তৈরি করে পারমাণবিক অস্ত্র আরও আধুনিক করতে হবে। গত
কয়েক বছরে পুতিনের রাশিয়ার কাছে বেশ কয়েক জায়গায় মার খেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারাভিযানে রুশ হস্তক্ষেপের
অভিযোগ নিয়ে ওয়াশিংটনে এখনো তুলকালাম চলছে। সিরিয়ায় সরকারবিরোধী
বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে সরকারের পক্ষে অভিযানে অংশ
নিয়ে ওয়াশিংটনকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে রাশিয়া। তারও আগে রাশিয়া ইউক্রেনকে
নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করার সময় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র,
কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। এদিকে শি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে সব দিক থেকে এগিয়ে
যাচ্ছে বেইজিং। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই সামরিক দিক থেকে নিজেদের
শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে দেশটি। শুধু দক্ষিণ চীন সাগরের দিকে তাকালেই
সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। যুক্তরাষ্ট্রের বারবার হুঁশিয়ারি ও মার্কিন
যুদ্ধজাহাজ-যুদ্ধবিমানের টহল সত্ত্বেও সেখানে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে চীন।
ওই জলসীমায় যে কোনো মূল্যে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে মরিয়া বেইজিং।
মার্কিন নতুন নিরাপত্তা কৌশল প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস বলেন,
নতুন নিরাপত্তা কৌশলে নানা ইস্যুর কথা বলা আছে। আফগানিস্তানে অভিযানের
প্রসঙ্গ যেমন আছে, তেমনি উত্তর কোরিয়ার মতো ‘দুর্বৃত্ত’ দেশগুলোর বিরুদ্ধে
করণীয় সম্পর্কে বলা আছে। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে,
যুক্তরাষ্ট্র যেন বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের সেরা
অবস্থান ধরে রাখতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই অবস্থান তাঁর পূর্বসূরিদের
নিরাপত্তা কৌশলের মূল লক্ষ্য থেকে ভিন্ন। নাইন-ইলেভেনে নিউইয়র্কে ভয়াবহ
সন্ত্রাসী হামলার পর ওয়াশিংটনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় সন্ত্রাসবাদ দমন।
সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের নামেই আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালায়
যুক্তরাষ্ট্র। যার ঘানি এখনো টানছে দেশ দুটির জনগণ তথা সারা বিশ্বের মানুষ।
জন্ম নিয়েছে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো অনেক জঙ্গি সংগঠন। নানা ধরনের
হামলা চলছে বিভিন্ন দেশে। এ প্রসঙ্গে ম্যাটিসের ভাষ্য, সন্ত্রাসবাদের
বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবে। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ফোকাস আর
সন্ত্রাসবাদ নয়। পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতাই এখন প্রধান লক্ষ্য। এটাই
এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সঠিক কৌশল। যুক্তরাষ্ট্রের
পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা-ও রাশিয়াকে মাথায়
রেখেই। মার্কিন সামরিক বাহিনী মনে করে, রাশিয়া ইতিমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র
উন্নয়নের দিকে অনেক দূর এগিয়েছে। সেই তুলনায় ওয়াশিংটন পিছিয়ে রয়েছে।
পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নে প্রস্তাবের নথিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদের কৌশলের
মাধ্যমে রাশিয়াকে বুঝিয়ে দিতে হবে, যে কোনা মাত্রায় পারমাণবিক অস্ত্রের
ব্যবহার একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।’ ২০১০ সালের পর এই প্রথম মার্কিন বাহিনী
পারমাণবিক অস্ত্রের উন্নয়নের দিকে মনোযোগী হলো। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিচ
রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের দিক থেকে সবার
চেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। দেশটির অস্ত্র ভান্ডারে রয়েছে সাত হাজার
পারমাণবিক অস্ত্র। এর পরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। তাদের আছে ৬ হাজার ৮০০
পারমাণবিক অস্ত্র। তার পরে রয়েছে ফ্রান্স (৩০০), চীন (২৭০), যুক্তরাজ্য
(২১৫), পাকিস্তান (১৪০) ও ভারতের (১৩০) অবস্থান। এর বাইরে ইসরায়েলের ৮০টি ও
উত্তর কোরিয়ার ২০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। পারমাণবিক
অস্ত্রের এই হিসাব ও ট্রাম্পের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল অনুযায়ী বিশ্বের
অন্যতম পারমাণবিক শক্তিধর তিন দেশ মুখোমুখি হচ্ছে! আর স্বাভাবিকভাবে এই তিন
দেশের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেবে অন্যান্য দেশগুলো। তার মানে ট্রাম্প
প্রশাসন কী নতুন কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে?
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
mahfuzsarker@prothom-alo.info
মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
mahfuzsarker@prothom-alo.info
No comments