চীন-ভারত উভয়কে খুশি রাখার চেষ্টা by মনির হোসেন
ঢাকা
স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শেয়ার বিক্রি ইস্যুতে চীন ও ভারত উভয়কে খুশি
রাখার চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ
কমিশন (বিএসইসি)। এক্ষেত্রে ভারতকে অবশ্যই শেয়ারের দাম বাড়াতে হবে। তবে
প্যারাডাইস পেপার্সে নাম থাকায় ভারতীয় কনসোর্টিয়ামে থাকা ফ্রন্ট্রিয়ার
বাংলাদেশ কোনো শেয়ার পাবে না। অন্যদিকে স্টক এক্সচেঞ্জের মেম্বাররা এখনও
শুধু চীনের কাছে শেয়ার বিক্রির অবস্থানে অনঢ় রয়েছেন। প্রয়োজনে তারা
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইবেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি এ ব্যাপারে চূড়ান্ত
সিদ্ধান্ত জানা যাবে। স্টক এক্সচেঞ্জ ও সরকারের ঊর্ধ্বতনসূত্র বিষয়টি
নিশ্চিত করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু শেয়ারবাজার নয়, সাম্প্রতিক সময়ে
দেশের আর্থিক খাতে অন্যতম গরম ইস্যু এটি। জানতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যান
খায়রুল হোসেন বুধবার বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব এখনও আমাদের কাছে
আসেনি। প্রস্তাব এলে সবকিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ তিনি বলেন,
‘যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দেশ, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং স্টক
এক্সচেঞ্জের মেম্বারদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হবে।’ তার মতে, ‘বিষয়টি
দেশের জন্য অত্যন্ত খুশির খবর। কারণ চীন ও ভারতের মতো দেশের স্টক এক্সচেঞ্জ
বাংলাদেশের স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার কিনতে আগ্রহী। অর্থাৎ দেশের শেয়ারবাজার
ওই মানে পৌঁছেছে।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ ব্যাপারে যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজার
একটি স্পর্শকাতর জায়গা। ফলে বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে কোনো বিতর্কিত
প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রি করা হলে এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের
আস্থা থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের
কাছে ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই। ১০ ফেব্রুয়ারি এ
ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ। স্টক এক্সচেঞ্জের
ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা আলাদাকরণ) শর্ত অনুসারে
কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে তাদের কাছে এই শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম ২২ টাকা দিচ্ছে চীনা
প্রতিষ্ঠান। এতে শেয়ারের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৯৯২ কোটি টাকা। এছাড়া আরও ৩০৭
কোটি টাকার কারিগরি সহায়তা দেবে চীন। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্টক
এক্সচেঞ্জ অব ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে একটি কনসোর্টিয়াম এই শেয়ারের দাম ১৫ টাকা
প্রস্তাব করেছে। এতে মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬৬৫ কোটি টাকা। তবে চীনকে শেয়ার
দেয়ার সিদ্ধান্তের পর ভারত দাম বাড়িয়েও শেয়ার কিনতে আগ্রহ জানিয়েছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ভারতকে শেয়ার দিতে চায়। ফলে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। শেষ
পর্যন্ত দু’পক্ষকেই খুশি রাখার উপায় খোঁজা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে মেম্বারদের
মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে চীনকেই অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। আর
ভারতকে অন্তর্ভুক্তির জন্য দুটি বিকল্প অপশন নিয়ে ভাবছেন নীতি-নির্ধারকরা।
প্রথমত চীনের প্রস্তাব করা দামে ভারতকেও শেয়ার দেয়া হবে এই সিদ্ধান্তে স্টক
এক্সচেঞ্জ মেম্বার এবং চীনকে রাজি করানো। এক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে
একজন বাদ দিয়ে দুই কনসোর্টিয়াম থেকে দু’জন পরিচালক নেয়া হবে। আর এই
প্রস্তাবে মেম্বররা এবং চীন রাজি না হলে দরপত্র বাতিল করে পুনঃদরপত্র
আহ্বান করা হবে।
সেক্ষেত্রে যেই গ্রুপ বেশি দাম দেবে তারা পাবে। এছাড়াও ২৫
শতাংশ শেয়ারের পুরোটা নয়, আপাতত ৫ থেকে ১৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হবে।
বাকি শেয়ার হাতে রাখা হবে। তবে কোনো কিছুতেই বিএসইসি দায় নেবে না।
আন-অফিসিয়ালি আলোচনা চূড়ান্ত হবে। এরপর স্টক এক্সচেঞ্জের বোর্ড থেকে
প্রস্তাব গেলে বিএসইসি তা কার্যকর করবে। ভারতীয় কনসোর্টিয়ামে থাকা
ব্রামার্স পার্টনার্স অ্যান্ড এসেট ম্যানেজমেন্ট (ফ্রন্টিয়ার বাংলাদেশ)
লিমিটেড ডিএসইর ৩ শতাংশ শেয়ার কিনতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের প্রস্তাবিত
মূল্য ৮১ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছরের নভেম্বরের প্যারাডাইস পেপার্স
কেলেঙ্কারিতে তাদের নাম আসে। ওই তালিকায় ১০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে
শেয়ারবাজারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ব্রামার্স। সংসদেও ওই নামগুলো উচ্চারণ
করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাদেরকে অর্থপাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতদিন
বিষয়টি চাপা থাকলেও কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে শেয়ার কেনার আবেদন করায়
বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ফলে শেয়ার ভাগ হলেও আপাতত তারা কোনো শেয়ার পাচ্ছে
না। সূত্র বলছে, ব্রামার্সের কাছে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করছে শেয়ারবাজারের
প্রভাবশালী একটি গ্রুপ। ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের মতো কমপ্লায়েন্স
প্রতিষ্ঠানকেও বিতর্কিত করছে ওই গ্রুপটি। জানতে চাইলে ব্রামার্সের প্রধান
নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ কাদের যুগান্তরকে বলেন, প্যারাডাইস পেপার্সের
বিষয়টি আপনারা খোঁজ নেন। এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। তিনি বলেন,
‘আমরা একটি কনসোর্টিয়ামে যোগ দিয়ে শেয়ার কেনার প্রস্তাব করেছি মাত্র।’
প্রতিষ্ঠানটির অন্য কর্মকর্তা মোয়াল্লেম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন,
প্যারাডাইস পেপার্সে নাম থাকার তথ্য সঠিক নয়। মূল পেপার্সে বাংলাদেশের কোনো
কোম্পানির নাম নেই। জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক
ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, প্যারাডাইস পেপার্সে যেসব কোম্পানির
নাম এসেছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তিনি বলেন,
প্রতিষ্ঠানটি যদি শেয়ারবাজারে ব্যবসা করে, তবে তাদেরকে আপাতত নিবিড়ভাবে
নজরদারি (ক্লোজলি মনিটরিং) করা উচিত। কোনো অনিয়ম পেলে তাৎক্ষণিকভাবে
ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তবে চীনকে
শেয়ার দেয়ার ব্যাপারে অনঢ় অবস্থানে স্টক এক্সচেঞ্জের নেতারা। এ নিয়ে তারা
দফায় দফায় বৈঠক করছেন।
No comments