বাঁশিওয়ালার মাঝে বসন্তের হাওয়া by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সেদিন
বাতাসে ছিল ফাল্গুনের গুঞ্জরন। এক রাতেই শীতের পলায়ন। কোকিলের কাছে
ক্যালেন্ডার নেই। তবু গানের বিরতি নেই। সারা দিন ধরে। গীতবিতান খুলতে হয়নি,
আপন মনে গানগুলো গেয়ে চলেছি। এরপরেও আবার একটু শীতের হাওয়া। এর নাম জলবায়ু
পরিবর্তন। আটকে পড়লাম ‘বাঁশিওয়ালা’তে। অনেক দিন পড়েছি কবিতাটি। সেদিন লাগল
একদম ভিন্ন। কীভাবে, তা-ই বলছি। এই প্রথম একটি কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ
চিহ্নিত করছেন একজন কিশোরীকে, সে বলছে-‘আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।’ আমাকে
তুমি নতুন নামে ডাকো। হে কবি, আমি শুনতে চাই আমার নতুন নাম। ওগো কবি, তোমার
কাছে এটি আমার প্রথম চিঠি হতে পারে। কবি নিজেই লিখেছেন, কারণ এ দেশের মেয়ে
এত সুন্দর কবিতা লিখবে কেমন করে, যদিও পারে আবৃত্তি করতে এত সুন্দর করে,
যাতে পঙ্ক্তিমালা নিয়ে আসে নবব্যঞ্জনা, নব-উপলব্ধি। সেদিন সীমা ইসলামের
আবৃত্তি চয়নে ‘বাঁশিওয়ালা’ জীবন্ত হয়ে এল আমার চোখের সামনে। ১৩৪৩ সালের ২
আষাঢ়ে সম্ভবত শান্তিনিকেতনের সেই সুন্দর ঘরটিতে খুঁজে পান কবি বাংলাদেশের
সেই মেয়েকে। আমিও সেই ঘরে গিয়েছিলাম বইকি। বেশ খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে
দেখছিলাম ঘরটির বাইরে বানানো একটি কৃত্রিম হ্রদ, যেখানে বাঁধা একটি তরণি।
কবির সামনে কবিতা লেখার ডেস্ক, ঝরনা কলম, কয়েকটি সাদা পাতা। কালস্রোতের
বালুকাবেলায় কালো মেয়েটির চিহ্ন ভালো করে ফুটে ওঠেনি, যেন তাকে দেখা যায়
আবছা আলোয়। বিধাতা তাকে পুরোপুরি গড়তে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়েছিলেন। তাই সে
অদেখার আহ্বানে অধীর হয়ে উঠেছেন কবি। যাকে দেখা যায়নি, তাকে দেখতে চেয়েছে
অধীর কাঙাল মন। মেয়েটি ঝাপসা, যাকে কোনো দিন এ যুগের পারানি নৌকায় পা ফেলতে
দেখা যায়নি।
বিধাতার সময় হয়নি তাকে পূর্ণতা দিতে। তাতে কী? তরুণীর মনের
ভাবনা কলমের কালিতে বন্দী করেছেন কবি। বাঁশিওয়ালা কী বাজায়, তা যেমন তরুণী
জানতে পারেনি, তেমনি কবির মনে কী ব্যথা জেগে উঠেছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি
নবযৌবনের ভাটিয়ারিতে। পাহাড়তলির ঝিরঝিরে নদী কখনো এসে বুকের তলায় সৃষ্টি
করেছে শ্রাবণের বাদল রাত্রি, আর নদীতীরের জমানো পাথর ছড়িয়ে দিয়েছে অজস্র
স্রোতের ঘূর্ণি মাতন। রক্তে যে সুর বাজে, তা কেমন করে থামাবেন কবি? সব ডাক
একসঙ্গে এসে জড়ো হয়েছে। কী ডাক? কেন: ঝড়ের ডাক, বন্যার ডাক, আগুনের ডাক,
পাঁজরের পরে আছাড় খাওয়া মরণসাগরের ডাক, আছে উদাসী পথিকের
ঘরের-শিকল-নাড়ার-ডাক। এতগুলো ডাক কেমন করে অস্বীকার করবেন কবি? বিধাতা
দেননি ডানা কাউকেই। কবিকেও না। গান দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নে। সব কবিকে উজাড়
করে দিয়েছেন ফাল্গুন সমাগমে উড়ো প্রাণের মাতলামি। যারা ভালোবাসার কবিকে
কাছে নিয়ে আসতে চাই, তারাও অনুভব করি বাঁশিকে। ওই বাঁশি নাহলে চেনা যাবে না
ভালোবাসা, চেনা যাবে না বিরহানুভূতি, চেনা যাবে না ফাল্গুন। ‘বাঁশির সুরে
হরিল পরান, কেমনে ঘরে থাকি রে’। মৈমনসিংহ গীতিকা জুড়ে বাঁশিওয়ালার গান। কেউ
শুনেছেন কি? না শুনলে, বাঁশিওয়ালা চিনবেন কেমন করে? এ এমন বাঁশিওয়ালা,
কোথায় না নিয়ে যান-ঘর থেকে অমর্ত্যলোকে। ফাল্গুন বিরহের প্রতীক জানা ছিল
না। জানতাম সে মিলন ডেকে আনে। এখন ভাবছি, কৃষ্ণচূড়া ডেকে আনে বাঁশিওয়ালার
অস্ফুট বাঁশরি, এমন মানবীর ছবি, যাকে দেখা যায় অর্ধেক, অর্ধেক দেখা যায় না।
কবি লিখছেন, ‘দোসর হারা আষাঢ়ে ঝিল্লি ঝনক রাত্রে।’ নারী সে তো ছায়ার দোসর।
তাকে তো দেখা যায় না। সে শুধু বাঁশিওয়ালা হয়ে চমকিত প্রহরের নির্জন
নিঃসঙ্গ সঙ্গী। তবু কবি তাকেই মালা পরিয়ে দেন। সে মালাও দেখা যায় না। ওটা
যে ছন্দের মালা, যে মালার সুর শুকোয় না। এই ঘোমটাখসা নারীই হঠাৎ চমক আনে
গানে, ফাল্গুনে-বৈশাখে। তার ঠিকানাই সারা জীবন খুঁজে ফিরি। আজ সকালে সেই
বাঁশিওয়ালার সুরে খুঁজে পেলাম আরেক অদেখা নারীকে। যাকে চিনিনি, জানিনি। আজ
নতুন চোখে পেলাম বিদ্রোহিনীকে, যার তীক্ষ্ণ চোখে ঘৃণা চারদিকের কুটিল
কাপুরুষতাকে। সবই আবৃত্তির গুণে। তাই কবিতা আবৃত্তির এত আয়োজন। আজকে মেলায়
মেলায় যে নপুংসকদের আবির্ভাব, তাদের তির্যক চোখে প্রহার করেছেন কবি। আজ
ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে কোথায় খুঁজে পাব সেই বাঁশিওয়ালাকে, শ্যামলীতে নেই,
নেই ‘ইচ্ছামতী’ নদীর তীরে, নেই ‘শেষ চিঠিতে’, নেই ‘ছুটির আয়োজনে’। এমনকি
স্বহস্তলিপিতে। কখনোবা চকিতে চিনতে পারি সেই অধরার ঠিকানা, যেখানে
বাংলাদেশের সেই মেয়ে ‘যে বিপরীত তুমি ললিতে কঠোরে, মিশ্রিত তোমার প্রকৃতি
পুরুষে নারীতে’। কবি তাকে দেখতে আসেননি কোনো মোহ নিয়ে এই সভায়। ‘স্নিগ্ধ
তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী, তুমি নিত্য নবীনা’। ১১ ও ১২ ফাল্গুন কবিগুরুকে
গান শোনাতে যাব। পিতা তাঁকে গান শোনাতে যাননি, যদিও আমন্ত্রণ ছিল। কাজী
নজরুল ইসলাম বললেন, ‘আব্বাস, তুমি যেও। তিনি তোমার প্রতীক্ষায়। তোমার
কল্পনা হার মানবে তাঁর কাছে।’ পিতা বললেন, ‘না, আমি তাঁকে যে বাঁশির সুরে
রচনা করেছি, তা আমার একান্ত নিজস্ব কল্পনায় সৃষ্টি।’ আজ আমি বাঁশিওয়ালার
আহ্বান শুনতে পাচ্ছি। এবারই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার দেখা।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্যিক ও সংগীত ব্যক্তিত্ব
No comments