চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে তো! by ইয়াও ইয়াং
গত
অক্টোবরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম ন্যাশনাল কংগ্রেস উদ্বোধন করার সময়
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ঘোষণা দেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন ‘সম্পূর্ণ
আধুনিক’ অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ
উদ্যাপনের সময়, অর্থাৎ ২০৪৯ সালে দেশটি উচ্চ আয়ের দেশ হিসেবে নিজেকে
প্রতিষ্ঠা করবে। অনেকে মনে করেন, চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের
চেয়ে চিন পিং অনেক বেশি সফল। ১৯৬৪ সালে দেওয়া ভাষণে চৌ এন লাই বিংশ
শতাব্দীর শেষ নাগাদ চীন চারটি দিক থেকে ‘আধুনিক’ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
চৌ এন লাই যে চারটি বিষয়ে সংস্কার আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলো হলো
কৃষি, শিল্প, প্রতিরক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। তিনি তখন চীনের আয়ের
লক্ষ্যমাত্রা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি। তবে এটুকু বোঝা যায়, বিশ্বব্যাংকের
মান অনুযায়ী চীনের তৎকালীন নিম্ন-মধ্যম আয়কে তিনি উন্নীত করার কথা
বলেছিলেন। চীনের এখনকার অর্থনৈতিক গতিবিধি দেখে বোঝা যায়, দেশটির পক্ষে তার
লক্ষ্য অর্জন দুরূহ হবে না। দেশটির বর্তমান সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা
জিডিপির পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির ২৫ শতাংশের সমান। উচ্চ আয়ের
দেশগুলোর ক্লাব হিসেবে পরিচিত সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন
অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (ওইসিডি) চীনকে যোগ দিতে হলে এই উৎপাদন ৪৫ শতাংশে
উন্নীত করতে হবে। ২০৪৯ সাল নাগাদ ধনী দেশগুলোর ক্লাবে নাম লেখাতে হলে চীনকে
এখন থেকেই প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে গড়ে কমপক্ষে ১ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি
পয়েন্ট অর্জন করতে হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির
হার ২ শতাংশ ধরে রেখেছে। আর চীনকে তার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রতিবছর ৩
দশমিক ৭ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে হবে। চীনের বর্তমান প্রবৃদ্ধি ৬
দশমিক ৫ শতাংশ; তার মানে লক্ষ্য অর্জনে যা দরকার, তার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে
দেশটি। এই প্রবৃদ্ধির হার ২০৪৯ সাল নাগাদ কমতে কমতে যদি ২ শতাংশেও এসে
দাঁড়ায়, তাহলেও গড় প্রবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশের নিচে নামবে না। অর্থাৎ এই
সময়ের মধ্যে চীনের উচ্চ আয়ের দেশ হওয়া একরকম নিশ্চিত। কিন্তু ‘আধুনিক’ হতে
গেলে শুধু ধনী হলেই হবে না। এর জন্য অর্থের বাইরে আরও কিছু দরকার। এটি একটি
সমন্বিত ব্যবস্থা। আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, চীন যদি সত্যিই তাই হয়ে
ওঠে, তাহলে দেশটিকে অবধারিতভাবেই এমন একটি সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঢুকতে হবে,
যেখানে বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক দেশের মতোই মানুষ তার চলাফেরা, ব্যক্তিগত
অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাবে। এ কারণে আয়ের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব
হলেও চীনের জন্য ‘আধুনিক’ হওয়া খুব সহজ হবে না। আধুনিক হওয়ার শর্ত পূরণে
চীনকে প্রথমেই তার পরিবেশকে দূষণমুক্ত করার দিকে মন দিতে হবে। সাধারণ
চীনাদের কাছে এটি বিলাসিতাপূর্ণ চাওয়া নয়, এটি তাদের জন্য খুবই জরুরি হয়ে
পড়েছে। সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন বেইজিং ও তার
চারপাশের বায়ুদূষণ এবারের শীতকালে লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। শহরের চারপাশের
দূষণকারী কারখানা বন্ধ করে দেওয়া এবং ঘর গরম রাখার জন্য জ্বালানি কাঠের
বদলে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার চালু করার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এটি
করতে সরকারকে বিস্তর খরচ করতে হয়েছে। বিশেষ করে এতে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে
গেছে। অন্য শহরগুলোতেও বায়ু এবং নদী-নালায় দূষণ ঠেকাতে উদ্যোগ নিলে বিশাল
অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে। চীনের আধুনিক হওয়ার পথে দ্বিতীয় বৃহৎ চ্যালেঞ্জ
হলো শহর আর গ্রামের জীবনমানের তফাত কমিয়ে আনা। বর্তমানে শুধু উপার্জনের
দিক দিয়েই নয়, শিক্ষা, অবকাঠামো, সরকারি সেবাসহ নানা দিক থেকে শহরের
মানুষের তুলনায় গ্রামের মানুষ পিছিয়ে আছে। এই বাধা দূর করতে নগরায়ণ সহায়ক
হবে। কিন্তু এরপরও ২০৩৫ সালেও চীনের অন্তত ৩০ কোটি মানুষ এসব সুবিধাবঞ্চিত
হয়ে গ্রামে বাস করবে। এত লোককে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে কোনো দেশের
পক্ষে আধুনিক হওয়া সম্ভব নয়। ২০৪০ সাল নাগাদ সক্ষম নাগরিকের সংখ্যা ১০
শতাংশের বেশি কমে যাবে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি বাড়লেও শ্রমশক্তির ঘাটতি
দেখা দেবে। এটি সামাজিক নিরাপত্তার ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দেখা
দেবে। আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে দেশে জোরালোভাবে আইনের শাসন
প্রতিষ্ঠা দরকার। অবশ্য সি চিন পিং তাঁর ন্যাশনাল কংগ্রেসের ভাষণে প্রায় ২০
বার এই কথাটি উল্লেখ করেছেন। আরেকটি বড় অন্তরায় হলো চীনের রাজনৈতিক
মতাদর্শ। এখানে যে কারও পক্ষে সরকারবিরোধী কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু
আধুনিক রাষ্ট্রে এই অধিকার থাকা অপরিহার্য। তবে আশার কথা, এই গতিতে দেশটির
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে থাকলে মুক্তভাবে মত প্রকাশ করার পরিবেশ ধীরে ধীরে
প্রসারিত হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইয়াও ইয়াং: পিকিং ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চের পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইয়াও ইয়াং: পিকিং ইউনিভার্সিটির চায়না সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চের পরিচালক
No comments