ঐতিহ্য- গয়ঘর খোজার মসজিদ by আকমল হোসেন
প্রাচীন
স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন মৌলভীবাজারের ঐতিহাসিক গয়ঘর খোজার মসজিদ।
৫০০ বছরের বেশি আগে নির্মিত এ মসজিদ নিয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে আছে নানা
কাহিনি। কিন্তু অপরিকল্পিত সংস্কারকাজে এর স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে।
মৌলভীবাজার শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে মোস্তফাপুর ইউনিয়নের
গয়ঘর গ্রামে একটি টিলার মতো স্থানে খোজার মসজিদের অবস্থান। দেয়ালের শুভ্র
রঙে দূর থেকেও জ্বলজ্বল করে মসজিদটি। এর মেঝে ও গম্বুজে টাইলস লাগানো।
তিনটি বড় দরজা ও ছয়টি ছোট দরজা। ভেতরে পূর্ব দিকের স্তম্ভে ‘বাঘের পায়ের
ছাপ’। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, এ মসজিদ যখন নির্মাণ করা হচ্ছিল, তখন ঘন
জঙ্গলে পূর্ণ ছিল এ এলাকা। বিচরণ ছিল বাঘের। হয়তো সে সময়ই কোনো বাঘ
মসজিদের কাঁচা দেয়ালে থাবা বসিয়েছিল। কয়েক শ বছর ধরে টিকে আছে সেই
চিহ্ন। দেয়ালের ওপরের দিকে আরবি লেখা; ফুল-লতার ছবি আঁকা। পশ্চিমের
দেয়ালে কৃষ্ণ পাথরের বহু পুরোনো একটি শিলালিপি। চুরি ঠেকাতে লোহার খাঁচার
বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে এতে। দেয়ালের ইটের গাঁথুনি অনেক পুরু। মূল মসজিদ
দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ২৪ হাত করে। গম্বুজ ১৮ ফুট উঁচু। ঐতিহাসিক ও
সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপনা হওয়ায় অনেক মানুষই দেখতে আসেন মসজিদটি। অনেকে একে
গায়েবি মসজিদও বলে থাকেন। স্থানীয় লোকজন জানান, মসজিদের বাইরে দুটি বড়
কষ্টিপাথর ছিল। প্রচলিত আছে, এগুলো রাতের আঁধারে ঘোরাফেরা করত। তাই মানুষ
পাথর দুটিকে মনে করত জীবন্ত। পাথরে হাত দিয়ে অনেকে সে হাত লাগাতেন
মুখে-বুকে। ভক্তি করে পাথর ধোয়া পানিও খেতেন। পাথর নিয়ে হেলাফেলা করলে
সেগুলো কেউ তুলতে পারতেন না। একটি পাথর একসময় ‘মারা গেলে’ সেটি পাশের
দিঘিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অপরটি পরে চুরি হয়ে যায়। খোজার মসজিদ নির্মাণ
করা হয় সুলতান বরবক শাহের ছেলে সুলতান শামসউদ্দীন ইউছুফ শাহর আমলে। হাজি
আমীরের পৌত্র ও সেই সময়ের মন্ত্রী মজলিস আলম ১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ
করেন এটি। সিলেটের হজরত শাহজালালের মসজিদ ও খোজার মসজিদের শিলালিপিতে
উল্লেখ থাকা মজলিস আলম একই ব্যক্তি। মসজিদ দুটি নির্মিত হয়েছিল চার বছরের
ব্যবধানে। খোজার মসজিদের নামকরণ নিয়ে পরিষ্কার তথ্য মেলে না। তবে প্রচলিত
আছে, মানসিংহের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে পথে পাঠান বীর খাজা উসমান
মসজিদটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই থেকে খাজা নামের অপভ্রংশ ‘খোজা’ থেকে এর
নামকরণ। মসজিদ কমিটির সাবেক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন জানান, ১৯৩৮-১৯৪০ সালের
মধ্যে আজম শাহ নামের একজন কামেল পীর এ মসজিদে আসেন। ১৯৪০ সালের দিকে
মসজিদের গম্বুজ ভেঙে পড়ে। তখন তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে টাকা
সংগ্রহ করে হবিগঞ্জের বানিয়াচং থেকে ইসমাইল মিস্ত্রি নামে পরিচিত একজনকে
দিয়ে সংস্কার করান। ১৯৬০ সালে আরও একবার মসজিদটি সংস্কার করান তিনি।
সংস্কারের পর আজম শাহ চলে গেলে এটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ঝোপজঙ্গলে ছেয়ে
যায় স্থান। গম্বুজে বটের চারা, লতাপাতা গজিয়ে ওঠে। জয়নাল আবেদীন আরও
জানান, ১৯৮৪ সালের পর অপরিকল্পিতভাবে সংস্কার শুরু হয় এ মসজিদের।
মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হয় না বলে পূর্ব দিকে মসজিদের জায়গা বাড়ানো
হয়। প্রাচীন স্থাপত্যকলার নিদর্শন হিসেবে যথাযথ রীতি মেনে যেভাবে এর
সংস্কার দরকার ছিল, তা করা হয়নি। ১৯৯৩ সালে মসজিদটি সংরক্ষণে সংস্কৃতি
মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। পরে লোকজন এসে মাপজোখ করে যান। কিন্তু
কিছুই করা হয়নি। এখন মসজিদের পুরোনো সৌন্দর্যের অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান বলেন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংরক্ষণে
কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। উদ্যোগ না নিয়ে থাকলে
উদ্যোগ নেওয়া হবে।
No comments