৮৩ হানাদার বধের নায়ক লোকমান by রিপন আনসারী
ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ করেছি, কিন্তু মনের ক্ষুধা মিটছিল না। কখন বড় অপারেশনে নামবো ঠিক সেই সুবর্ণ সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। দেরি না করে সুকৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম পাকসেনাদের ওপর। গেরিলা হামলা চালিয়ে খতম করলাম ৮৩ পাকসেনাকে। এক সঙ্গে এতোগুলো পাকসেনা খতম করতে পেরে সে কি আনন্দ ছিল সেদিন তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ৯ মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা পেলাম। কিন্তু পতাকা পেলেও প্রকৃত স্বাধীনতা পেলাম না। যে হাতে অস্ত্র চালিয়েছি আজ সে হাতেই তুলতে হয়েছে জীবন সংগ্রামের জন্য নৌকার বৈঠা। পরিবার নিয়ে দু’বেলা খেতে পারছি না, পরতে পারছি না, সুখ-শান্তি কাকে বলে জানি না। আবেগ প্লাবিত কণ্ঠে বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক নায়ক টাইগার লোকমান হোসেন। বললেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও এ দেশের অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু মানিকগঞ্জের গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক টাইগার লোকমানের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। হতভাগা এই যোদ্ধা আজও দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছেন। বর্ষার সময় ট্রলার নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও সারা বছর থাকেন বেকার। এক সময় পেটের তাগিদে মাটি কেটেছেন, করেছেন রাজমিস্ত্রির কাজ এমনকি দিনমজুরি পর্যন্ত। ছেলের সামান্য একটা পিয়নের চাকরির জন্য ঘুরেছেন সবখানেই। শুধু আশ্বাসের বাণীই শুনিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট তাদের কাছে তুচ্ছ। ছয় মাস পর পর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা যা পাই তা দিয়ে ধারদেনা সেরে হাতে একটি টাকাও থাকে না। উল্টো ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হয় তাকে। টাইগার লোকমান জীবন সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত এই কাহিনী শেষ করতে না করতেই হঠাৎ তার চোখ লাল হয়ে যায়। ভেসে উঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক বিজয়ের ছবি। ১৯৭১ সালের ২৮শে অক্টোবর মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধ। এখানে যুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক টাইগার লোকমান হোসেন বলেন, ছোট ছোট অনেক যুদ্ধ করেছি কিন্তু মনের ক্ষুধা মিটছিল না। রক্ত টগবগিয়ে উঠতো। ৭টি বড় বড় নৌকাভর্তি পাকসেনা নদী পথে আসছে। হাঁপাতে হাঁপাতে এ খবর দেয় আমাদের এক সোর্স কিসমত মুন্সি। তোবারক হোসেন লুডুর নেতৃত্বে আমরা কেউ একবারের জন্যও সরে যাওয়ার কথা ভাবিনি। শত্রুর সংখ্যা এবং অস্ত্র শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য অগ্রবর্তী দল পাঠাই দ্রততার সঙ্গে। খবরও পাই যথাসময়ে। মর্টার, মেশিনগান সজ্জিত কয়েকশ’ পাকসেনা আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। এ খবরে কৌশল পাল্টে গেরিলা কায়দায় হামলার প্রস্তুতি নেই। ধলেশ্বরী নদী থেকে গোলাইডাঙ্গা খাল হয়ে পাকসেনারা পৌঁছে যায় আমাদের গোলাইডাঙ্গা স্কুলের ক্যাম্পে। তারা আমাদের ক্যাম্পে আসার আগেই আমরা সেখান থেকে বের হয়ে যাই। এসময় গোলাইডাঙ্গা নূর আলী খালের কুম এলাকায়, সেখানে খালের দুই পাড়ে অস্ত্রসহ বসে আছি আমিসহ নবাবগঞ্জের মনছুরের মতো সাহসী যোদ্ধারা। শত্রু সেনাদের নৌকা আসামাত্র গর্জে উঠে আমাদের আগ্নেয়াস্ত্রসহ গোলা বারুদ। আমাদের অস্ত্রের বিস্ফোরণে শত্রুদের ৬টি নৌকা কোন কিছু বোঝার আগে ডুবে যায়। এসময় একটি নৌকার শত্রুরা প্রাণে বেঁচে গেলেও ৬টি নৌকার ৮৩ পাকসেনা খতম হয়। এরপর ঘণ্টা যেতে না যেতেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকবাহিনী বিমানযোগে হামলা চালায়। আকাশ পথ থেকে তারা বিমানযোগে ফসফরাস বোমায় জ্বালিয়ে দেয় আশেপাশের গ্রাম। যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে যাদের বাড়ি ছিল তাদের অনেকেই সরে যাওয়ার সময় পায়নি। ওই এলাকার অনেকে গোপনে লুকিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল পাকসেনাদের মৃতদেহ তুলে নেয়ার দৃশ্য। পরে হানাদাররা গানবোট নিয়ে এসে উদ্ধারকারী বাহিনী তুলে নিয়ে যায় মৃতদেহগুলো। এ কাজে তারা ডুবুরি ব্যবহার করেছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন শেষে ফিরে যাওয়ার সময় হস্তগত করেছিল মর্টার, চাইনিজ রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমান বলেন, দুঃখ হয় যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি তারই আজ বড় বড় মুক্তিযোদ্ধা।
No comments