অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও রাজনীতিতে পিছিয়ে গেছি : ইমতিয়াজ আহমেদ by মোকাম্মেল হোসেন
যুগান্তর : এবারের বিজয় দিবসের নতুন কোনো তাৎপর্য আপনি দেখছেন কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ : মূলত ডে অব সেলিব্রেশন হিসেবে দেশের মানুষ দিনটি উদযাপন করবে। তবে যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও কতগুলো বিষয়ের সমাধান হয়নি- যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অন্য কথায় নির্বাচনের বিষয়টি এখনও সমাধান হয়নি, তাই অনেকেরই আশা থাকবে- ১৬ ডিসেম্বরের পরে এটা একটা সমাধানের দিকে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে, না বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হবে, না আন্তর্জাতিক চাপের মুখে হবে, নাকি একসঙ্গে সব মিলে হবে- সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। যাই হোক, দেশবাসীর একটা বড় প্রত্যাশা থাকবে- যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে, ১৬ ডিসেম্বরের পর তার একটা সমাধান হবে। মানুষ যেন এ দিনটাকে ধরে চিন্তা করতে পারে, আমরা একটা ভালো ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি।
যুগান্তর : স্বাধীনতাকে কতটা অর্থবহ মনে করেন আপনি?
ই.আ. : এ প্রশ্নটা মাঝে মধ্যেই ওঠে। ওঠার কারণ- এন্ড অব ইমাজিনেশন। আমরা বোধহয় আর ভাবতে পারছি না জাতি হিসেবে কোথায় যাব? বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি- মনে হচ্ছে, যেন এটাই আমাদের নিয়তি। তবে এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে, নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটা কোনো ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়। জনগণের কৃতিত্ব। সেই হিসেবে আমি মনে করি, পেছনে চোখ রাখার চেয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারি- সেই ইমাজিনেশনটা তৈরি করা উচিত। সেই স্বপ্ন তৈরি করা উচিত। আমাদের স্বপ্নের অভাব রয়েছে। ঘুরেফিরে আমরা এক জায়গায় আটকে যাচ্ছি। শুধু আমরা নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াই আটকে গেছে। ভারত-পাকিস্তান যেমন ’৪৭-এ আটকে গেছে। আমরাও মনে হয় ’৭১-এ আটকে গেছি। বাংলাদেশ যে আরও বড় একটা জায়গায় যেতে পারে, আরও সাংঘাতিক একটা অবস্থান তৈরি করতে পারে- সেই বিশ্বাসটা খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে। এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মানুষ যা বলাবলি করছে, এ জায়গায় একটা পরিবর্তন আসা দরকার। ’৭১-এ বসে আমরা কিন্তু ভাবতে পারিনি, রেডিমেড গার্মেন্টে আমরা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নেব। ’৭১-এ বসে আমরা কিন্তু ভাবিনি- বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় এক নম্বর হয়ে থাকবে। আমরা ভাবিনি, বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় এনজিও তৈরি করতে পারবে। এর বাইরে নোবেল পুরস্কারসহ অন্যান্য কনট্রিবিউশন তো আছেই। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম দেশ। মানুষই তো বড় কথা। মানুষ যদি বড় হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ দেশ হল বাংলাদেশ। সেই সপ্তম বৃহৎ দেশের যে অহংকার, যে স্বপ্ন- সেটা আমি দেখি না। ঘুরেফিরে কতগুলো আলোচনা হয়- এখানে মনে হয় একটা পরিবর্তন আসা দরকার।
যুগান্তর : আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান বিরাজ করছে- এ কথা তো সত্য? ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব হবে?
ই.আ. : মনে করা হয়, একটা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থাগুলো একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের বেলায় কতগুলো এগিয়ে গেছে। কতগুলো পিছিয়ে গেছে। একসময় বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক এগিয়েছিল। রাজনীতি এগিয়েছিল বলেই এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল, বাংলাদেশ আলাদা দেশ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ- এটাও রাজনীতির বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেছে, রাজনীতির মধ্যে এমন কতগুলো সমস্যা তৈরি হয়েছে যার সমাধান হচ্ছে না। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে আছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কয়েকটি বিষয়ে আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু রাজনীতি, যেটা এগিয়েছিল, বিশেষ করে গণতন্ত্র-গণতন্ত্রায়ন, এ জায়গাটায় আমরা পিছিয়ে গেছি। এদিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন- এমন একটা ভাবনা আমাদের কাজ করে। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। নির্বাচন তো হিটলারও করেছিল, মুসোলিনিও করেছে। নরেন্দ্র মোদিও নির্বাচন করেই জিতেছে। কিন্তু চিন্তার জগতে গণতন্ত্রায়ন, সিভিল সোসাইটির গণতন্ত্রায়ন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রায়ন এসব ক্ষেত্রে আমরা একটা জায়গায় আটকে আছি। এ জায়গাটায় বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টি দিতে হবে।
যুগান্তর : আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো বিষয় কি সার্কে এখনও অবশিষ্ট আছে?
ই.আ. : এবারের সার্ক নিয়ে সবারই একটা আশাবাদ ছিল- হয়তো একটা ব্রেকথ্রু আসবে। এর একটা বড় কারণ ছিল নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ায় এ আশাটা তৈরি হয়েছিল। সেই জায়গাটায় আশাভঙ্গ হয়েছে। দেখা গেছে, চিরাচরিতভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দিন তিনি হ্যান্ডশেকই করলেন না। দ্বিতীয় দিন করলেন। আমি যদি দ্বিতীয় দিন করি, তাহলে প্রথম দিন কেন নয়? ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছে, তারা ’৪৭ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। এখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আমরা সাব-রিজিওনাল করব। সার্ক নামটাই কিন্তু সাব-রিজিওনাল। কিন্তু যতই সাব করা হোক, রিজিয়নটা তো রাখতেই হবে। না রাখার মানে হল, আমি আমার একটা হাতের যত্ন নেব, অন্য হাতের দিকে তাকাবই না। এ জায়গাটায় সিরিয়াসলি চিন্তা করা উচিত। রিজিয়নের একটা জায়গা যদি অনুন্নত থাকে, জঙ্গিবাদ বিরাজ করে, তার প্রভাব কিন্তু অন্য জায়গায়ও পড়বে।
যুগান্তর : আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী চীনকে সার্কের সদস্য করার দাবি তুলেছেন।
ই. আ. : চীন নিজেও বলেছে, তারা এলিভেটেড হতে চায়। চীনের অবজারভার স্ট্যাটাস বাড়ানোর কথা নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, এমনকি শ্রীলংকাও বলেছে। মজার ব্যাপার হল, দিল্লিতে এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে- চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে আমি রাখব। আর তোমরা আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। এ মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার। দেখা হচ্ছে, সার্কের ব্যাপারে বড় কোনো দায়িত্বই এবার বাংলাদেশ নেয়নি। ভারত যা বলেছে, তাই বলা হয়েছে। ফরেন পলিসিতে একটা বিষয় সব সময় খেয়াল রাখতে হবে- আমি তখনই বড় আকারের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারব, যখন আমার অবস্থা খুব শক্তিশালী হবে। সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। তারা হয়তো ভাবছেন, নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষ্যাপালে তিনি সাপোর্ট নাও করতে পারেন। নিজের পায়ে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থায় সরকারের থাকলে একটা পদক্ষেপ নিতে পারত। ভারতের সঙ্গে চীনের অলরেডি ৬০ বিলিয়ন প্লাস একটা ট্রেডিং রেজিম হয়ে গেছে। লার্জেস্ট সিঙ্গেল কান্ট্রি ট্রেডিং রেজিম যদি আমরা ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে ভারতের। তার মানে, সে তো ’৫২-তে নেই। ভারতও ভালো করেই জানে, দিন দিন চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। কিন্তু ওই যে মানসিকতাটা আছে, বিশেষ করে তাদের আমলাতন্ত্রের মানসিকতা হল- প্রতিবেশীরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। চীনের সঙ্গে রাখবে না। এর বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ না থাকায় চীনের ব্যাপারে সেভাবে উদ্যোগী হয়নি। এতে কিন্তু পুরো উপমহাদেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। চীনের বড় ধরনের একটা সারপ্লাস ক্যাপিটেল আছে। সে ইনভেস্ট করার ক্ষমতা রাখে। স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দল দেখল, এটা তার জন্য একটা সুযোগ। তারা জানে, তাদেরও আন্তর্জাতিক সমর্থন দরকার। তখন তারা এগিয়ে গিয়ে বলল, চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ কাজটা যদি শেখ হাসিনা করে ফেলতেন, তাহলে হয়তো অপশন থাকত না। তারা চুপচাপ থাকত।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জলবায়ু পরিষদ’ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ই.আ.: এগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। এখানে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করার নেই। এ ধরনের সম্মেলনে কিছু জিনিস নিয়ে আসা হয়- এটাও নিয়ে আসা হয়েছে।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত ৬ দেশে অভিন্ন ভিসা পদ্ধতির উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন। জঙ্গিবাদ কি এক্ষেত্রে কোনো বাধা?
ই.আ.: আমাদের দিক থেকে এ ধরনের একটা দাবি ছিল। আমরা এটা নিয়ে কাজও করেছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা আছে- আমরা একটা পাসপোর্ট ইউনিয়ন করব। ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ আমরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা করি। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির বোধহয় একটা প্রস্তাব ছিল। আমাদের মন থেকে একটা জিনিস সরাতে হবে- জঙ্গিবাদের সঙ্গে ভিসা রেজিমের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি জঙ্গিবাদ করতে চায়, তাহলে ভিসা সে ভালো করেই পাবে। কারণ সে জানে ভিসা কিভাবে পেতে হয়?
যুগান্তর : কাঠমান্ডু ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো কিছু আছে কি?
ই.আ.: সার্কের এবারের ঘোষণা নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড হইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। সেই যে আগের পাকিস্তান-ভারতের যে বিষয়- এখানে হ্যান্ডশেকটাই হয়ে গেল বড় খবর।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশে সড়ক ও রেল ট্রানজিট হলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে?
ই.আ.: প্রথমত, সড়ক ও রেল ট্রানজিট হওয়ার জন্য যে অবকাঠামো দরকার, বাংলাদেশের সেটা নেই। ঢাকা বা চট্টগ্রামের ট্রাফিক সিস্টেমই আমরা ঠিক করতে পারিনি। কাজেই অবকাঠামো না হওয়া পর্যন্ত এটা সমস্যা হয়েই থাকবে। আরেকটা বিষয় দেখতে হবে- এটা বাংলাদেশের জনগণের কোনো উপকারে আসছে কিনা। দেশের মানুষ যদি এ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো উপকার না পায়, তাহলে এটা রাজনৈতিকভাবে একটা সমস্যা হয়ে থাকবে।
যুগান্তর : আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে। কেন?
ই.আ.: এখানে একটা বড় ডেফিসিট হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলকে পরিষ্কারভাবে অবহিত করার কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অগ্রসর হইনি। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সারা পৃথিবীকে জানানো এবং তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কনফারেন্স করে বোঝানোর গুরুত্বটা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি। ফলে যারা বিপক্ষ দল, এতে তাদের সুবিধা হয়ে গেছে। তারা তো বিদেশে গিয়ে ক্যাম্পেইনটা ঠিকই করে ফেলেছে।
যুগান্তর : অর্থাৎ আমাদের অস্পষ্টতার সুযোগ নেয়া হচ্ছে?
ই.আ.: ঠিক। আমার তো এখানে ঢেকে রাখার কিছু নেই। সংখ্যার বিতর্ক বাদ দিলেও গণহত্যার বিষয়টি তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেই জায়গাটায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো বিষয়টি যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে ঘাটতি রয়ে গেছে।
যুগান্তর : পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্ন উঠেছে। বিচার করা যাবে কি?
ই.আ.: যে চুক্তি হয়েছে, তাতে এটা একেবারেই সম্ভব নয়। কেবল পাকিস্তানের মধ্যে জনমত তৈরি করেই এটা করা সম্ভব। পাকিস্তানের জনগণ যখন দেখবে- এরা আসলেই যুদ্ধাপরাধী, তারা বেসামরিক মানুষকে মেরেছে, নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে, তখন পাকিস্তানের আইনস্বীকৃত অপরাধ হিসেবেই এর বিচার হবে। একটা ভুল হয়েছে, ১৯৫ জনের ট্রায়ালটা করা উচিত ছিল। তাহলে আমার হাতে প্রমাণ থাকত। অবশ্য তখন একটা কমপালশন ছিল, পাকিস্তানের স্বীকৃতির একটা ব্যাপার ছিল, বাংলাদেশীদের দেশে আনার একটা ব্যাপার ছিল। তারপরও আমরা যদি প্রমাণ রেখে দিতে পারতাম, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম দেখত যে, এরা আসলেই যুদ্ধাপরাধী।
যুগান্তর : কোন প্রেক্ষাপটে একটা দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়?
ই.আ. : বাংলাদেশে দুটি জিনিস ধরা পড়ছে। একটা হল, মাঝে মাঝেই আমরা দেখি- এখানে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, ওখানে পাওয়া যাচ্ছে- পরে ওই বিষয়ে আর কোনো আলোচনা দেখি না। তাতে সন্দেহ হয়, এসব খবর কেউ তৈরি করছে কিনা? মূলত এ ধরনের খবরগুলো তৈরি করা হয় সহানুভূতি পাওয়ার জন্য- যাতে বলা যায়, বাংলাদেশে এখনও সমস্যা রয়ে গেছে ইত্যাদি। একেক সময় একেক নিউজ দেয়া হচ্ছে। এভাবে বলতে থাকলে সত্যিকারের সমস্যার সময় মানুষ কিন্তু এসব বিশ্বাস করবে না।
যুগান্তর : রাখাল বালকের গল্পের মতো?
ই.আ. : ঠিক। বিষয়টা ওই রকমই হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশী কেউ এখানে এলে বা আসার আগে-পরে এ রকম একটা কিছু হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের বা পৃথিবীর বড় একটা অংশে অস্ত্র চোরাচালানের নেটওয়ার্ক আছে। অবৈধ অস্ত্রের একটা বিলিয়ন ডলারের মার্কেট কিন্তু বিশ্বব্যাপী রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ যে একটা চ্যানেল হবে না, এটা ভাবা ঠিক নয়।
যুগান্তর : দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্রের অভিযান বন্ধ থাকায় কি সন্ত্রাস বাড়ছে?
ই. আ. : যখন আমরা সন্ত্রাস বলি, তখন দুই ধরনের সন্ত্রাসের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। আগে যারা সন্ত্রাসী ছিল- পিচ্চি হান্নান, মুরগি মিলন, কালা জাহাঙ্গীর- এদের সন্ত্রাসটা যে প্যাটার্নের ছিল, সেখানে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। সন্ত্রাসীদের কাছে এখন একে-৪৭সহ অন্যান্য অস্ত্র চলে এসেছে। সন্ত্রাসীরা এখন আর ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাস করছে না। এই হল একটা দিক। দ্বিতীয় দিকটা হল, ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস হচ্ছে, যে অসহিষ্ণু ধারা তৈরি হয়েছে, তারাও কিন্তু বাজারে গেলে অস্ত্র পাচ্ছে।
যুগান্তর : অস্ত্রের সহজলভ্যতার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক কতটুকু?
ই.আ. : অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার জঙ্গিবাদের আগেও ছিল। এটা সহজে থামবে না। আমাদের মধ্যে যদি একটা অসহিষ্ণু ধারা বজায় থাকে, আমাদের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বড় দুই দল যে রকম চোখাচুখি অবস্থায় আছে, সেটা অব্যাহত থাকলে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মাধ্যমে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটালে রাজনৈতিক দল একে অন্যকে দোষারোপ করবে এবং সহজেই পার পেয়ে যাবে। তাই হচ্ছে। তার মানে হল, বড় দুই রাজনৈতিক দলের এ বিভাজন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের একটা শেড তৈরি করে দিচ্ছে।
যুগান্তর : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিস্তার দেশের জনশক্তি রফতানি বা অভিবাসনের ক্ষেত্রে কতটুকু সমস্যা তৈরি করবে?
ই.আ. : প্রতি মাসে আমি যদি ঘোষণা দিই, অমুক জায়গায় এ অস্ত্র পাওয়া গেছে, অমুক সংগঠন আছে। তারপর কাউকে মেরে ফেলার পর বলা হল- এটা অমুক সংগঠনের কাজ, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক মহলে একটা ইমেজ সংকট তৈরি হবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে যে কোনো দেশের বর্ডার পোস্টে বাংলাদেশীদের আসার ব্যাপারে একটা সন্দেহ জাগবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ইনডেক্স যদি দেখি- সেই ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩। ভারত ৬ ও পাকিস্তান ৩ নম্বরে আছে। আমাদের মিডিয়া পাকিস্তানের দিকে নজর দিল না, ভারত যে ৬ নম্বরে সেটাও কেউ দেখল না। সব নজর পড়ল প্রথম ১০-এর ঘরেও যে নেই, ২৩ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের ওপর। সবাই বলা শুরু করল, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হচ্ছে, সে দেশ দুটির ওপর আমি দৃষ্টি কেন দিলাম না, কেউ জানে না।
যুগান্তর : মিডিয়া তো খবর তৈরি করে না, সার্ভ করে। মিডিয়াকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা কি ঠিক?
ই.আ.: না, আমি মিডিয়াকে এখানে দোষ দেব না। আমার মনে হয়, আমাদের এখানে যে ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা পলিটিক্যাল সার্কেল আছে, সেখানটায় সমস্যাটা রয়ে গেছে। আমাদের সিকিউরিটি সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী দেশ যা বলছে, আমরা সেটাই মেনে নিচ্ছি। অথচ বিদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিসফুল। তারা বলে, হোয়াই পিপলস টকিং অ্যাবাউট সিকিউরিটি প্রবলেম অব বাংলাদেশ? এদেশে যেটাকে রিস্ক বলা হচ্ছে, সেটা কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের কারণে। জঙ্গিবাদের কারণে নয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে।
যুগান্তর : তাহলে আমরা এর প্রতিবাদ করছি না কেন?
ই. আ.: প্রতিবাদ হচ্ছে না পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করার কারণে। এক দল আরেক দলের ওপর দোষ চাপানোর কারণে। এখানে একটা পরিবর্তন আসা দরকার। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার নিজেই এসব করে থাকে। সরকার নিজেই যদি প্রচার করে, তাহলে সেটার প্রতিবাদ কেমন করে হবে? আমি তো অবাক হয়ে গেছি- ভারতের এনআইএস ঘুরে গেল প্রথমে, আমরা অবশ্য পরে গেছি হৈচৈ হওয়ায়। কিন্তু হোয়াই ডু ইউ কাম টু মি? তুমি তো বিশ্বে ৬ নম্বর ঝুঁকির জায়গায় আছ। তোমার অবস্থার কারণেই আমার অবস্থা খারাপ।
যুগান্তর : আমাদের যাওয়া উচিত তাদের অবস্থা দেখতে?
ই. আ. : ঠিক। কিছুদিন আগে মাওবাদীরা ভারতের ১৯ জন পুলিশকে মেরে ফেলল। সেই নিউজ এসেছে পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায়, মাত্র ৪ লাইনে। আমাদের এখানে একটা সামান্য ঘটনা ঘটলেও সেটা বিশাল আকারে প্রকাশিত হয়। অথচ ভারতে ১৯ জন পুলিশ মেরে ফেলা হল, আমরা এটাকে নিউজই মনে করলাম না। আমরা ভাবলাম, হেডলাইন তো পরের কথা, নিউজ করাটাই বোধহয় ঠিক হবে না।
যুগান্তর : আপনি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ সম্পর্কে বলুন।
ই.আ. : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ’৭১ সালে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে- কর্তৃপক্ষ মনে করল এ নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হওয়া দরকার। সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এ লক্ষ্যেই গড়ে উঠেছে। এটা ফ্যাকাল্টি অব সোশ্যাল সায়েন্সের অধীনে তিন মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করছে।
যুগান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কি তুলে ধরতে পারবে?
ই.আ. : এটা গবেষণার বিষয়। আমরা এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।
যুগান্তর : আপনার কি মনে হয়নি, স্বাধীনতার পরপরই এ ধরনের একটি সেন্টার গড়ে তোলা উচিত ছিল আমাদের?
ই.আ. : আমি একটু অবাক হয়েছি- এটা কেন তখন কেউ চিন্তা করেনি? আমরাও বলতে গেলে অনেক পরে চিন্তা করেছি।
যুগান্তর : সঙ্গে সঙ্গে করলে ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের সুযোগ থাকত না!
ই.আ. : হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে করা গেলে আজকে যেসব ডকুমেন্ট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, সেটা হতো না। সেগুলো উদ্ধার করতে গিয়ে এখন অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে।
যুগান্তর : সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড়।
ই.আ. : একজাক্টলি। তবে আমি মনে করি, শুরু তো করা গেছে। লেট ইজ বেটার দ্যান নাথিং।
যুগান্তর : করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা বলুন তো!
ই.আ. : করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের জন্য আমাকে কী-নোট পেপার দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। এর সঙ্গে ’৭১-এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি রাজি হয়েছিলাম। পাকিস্তান হাইকমিশন আমাকে ৬ মাসের ভিসাও দিয়েছিল। দু’দিন পর করাচি বিশ্ববিদ্যালয় জানাল- আমরা দুঃখিত, তোমার আসাটা বন্ধ করতে হবে। পরে জেনেছি, একটা ছাত্র সংগঠন ভিসিকে বলেছে, অধ্যাপক আহমেদকে আমরা এখানে আসতে দেব না। কেন দেব না- কারণ সে ’৭১-এর গণহত্যার ওপর কাজ করে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে ধরার জন্য অধ্যাপক আহমেদের বই ব্যবহার করা হয়েছে। ইত্যাদি। একজন বাংলাদেশী ’৭১ নিয়ে লিখবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া একটা অসহিষ্ণুতার জায়গায় চলে যাচ্ছে।
যুগান্তর : চিন্তা-চেতনার দিক থেকে পাকিস্তান এখনও একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে- এ কথা বলা অন্যায় হবে কি?
ই.আ. : মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। এ নিয়ে ওদের মধ্যেও অস্বস্তিকর একটা ভাব তৈরি হয়েছে। আমি বলব- বিষয়টা নিয়ে তারা যেন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন। যারা গবেষণা করেন বা কথা বলেন, অন্তত সেসব জায়গায় যেন কোনো বাধা না আসে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ই. আ. : আপনাকেও ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ : মূলত ডে অব সেলিব্রেশন হিসেবে দেশের মানুষ দিনটি উদযাপন করবে। তবে যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও কতগুলো বিষয়ের সমাধান হয়নি- যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অন্য কথায় নির্বাচনের বিষয়টি এখনও সমাধান হয়নি, তাই অনেকেরই আশা থাকবে- ১৬ ডিসেম্বরের পরে এটা একটা সমাধানের দিকে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে, না বিরোধী দলের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হবে, না আন্তর্জাতিক চাপের মুখে হবে, নাকি একসঙ্গে সব মিলে হবে- সেটা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। যাই হোক, দেশবাসীর একটা বড় প্রত্যাশা থাকবে- যে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে, ১৬ ডিসেম্বরের পর তার একটা সমাধান হবে। মানুষ যেন এ দিনটাকে ধরে চিন্তা করতে পারে, আমরা একটা ভালো ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছি।
যুগান্তর : স্বাধীনতাকে কতটা অর্থবহ মনে করেন আপনি?
ই.আ. : এ প্রশ্নটা মাঝে মধ্যেই ওঠে। ওঠার কারণ- এন্ড অব ইমাজিনেশন। আমরা বোধহয় আর ভাবতে পারছি না জাতি হিসেবে কোথায় যাব? বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি- মনে হচ্ছে, যেন এটাই আমাদের নিয়তি। তবে এ কথা তো স্বীকার করতেই হবে, নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটা কোনো ব্যক্তির কৃতিত্ব নয়। জনগণের কৃতিত্ব। সেই হিসেবে আমি মনে করি, পেছনে চোখ রাখার চেয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আমরা কতদূর যেতে পারি- সেই ইমাজিনেশনটা তৈরি করা উচিত। সেই স্বপ্ন তৈরি করা উচিত। আমাদের স্বপ্নের অভাব রয়েছে। ঘুরেফিরে আমরা এক জায়গায় আটকে যাচ্ছি। শুধু আমরা নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াই আটকে গেছে। ভারত-পাকিস্তান যেমন ’৪৭-এ আটকে গেছে। আমরাও মনে হয় ’৭১-এ আটকে গেছি। বাংলাদেশ যে আরও বড় একটা জায়গায় যেতে পারে, আরও সাংঘাতিক একটা অবস্থান তৈরি করতে পারে- সেই বিশ্বাসটা খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে। এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মানুষ যা বলাবলি করছে, এ জায়গায় একটা পরিবর্তন আসা দরকার। ’৭১-এ বসে আমরা কিন্তু ভাবতে পারিনি, রেডিমেড গার্মেন্টে আমরা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নেব। ’৭১-এ বসে আমরা কিন্তু ভাবিনি- বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় এক নম্বর হয়ে থাকবে। আমরা ভাবিনি, বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় এনজিও তৈরি করতে পারবে। এর বাইরে নোবেল পুরস্কারসহ অন্যান্য কনট্রিবিউশন তো আছেই। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর সপ্তম দেশ। মানুষই তো বড় কথা। মানুষ যদি বড় হয়ে থাকে, তাহলে পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ দেশ হল বাংলাদেশ। সেই সপ্তম বৃহৎ দেশের যে অহংকার, যে স্বপ্ন- সেটা আমি দেখি না। ঘুরেফিরে কতগুলো আলোচনা হয়- এখানে মনে হয় একটা পরিবর্তন আসা দরকার।
যুগান্তর : আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান বিরাজ করছে- এ কথা তো সত্য? ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব হবে?
ই.আ. : মনে করা হয়, একটা দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক অবস্থাগুলো একসঙ্গে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের বেলায় কতগুলো এগিয়ে গেছে। কতগুলো পিছিয়ে গেছে। একসময় বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক এগিয়েছিল। রাজনীতি এগিয়েছিল বলেই এদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল, বাংলাদেশ আলাদা দেশ হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ- এটাও রাজনীতির বিষয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেখা গেছে, রাজনীতির মধ্যে এমন কতগুলো সমস্যা তৈরি হয়েছে যার সমাধান হচ্ছে না। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে আছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কয়েকটি বিষয়ে আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু রাজনীতি, যেটা এগিয়েছিল, বিশেষ করে গণতন্ত্র-গণতন্ত্রায়ন, এ জায়গাটায় আমরা পিছিয়ে গেছি। এদিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন- এমন একটা ভাবনা আমাদের কাজ করে। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচন নয়। নির্বাচন তো হিটলারও করেছিল, মুসোলিনিও করেছে। নরেন্দ্র মোদিও নির্বাচন করেই জিতেছে। কিন্তু চিন্তার জগতে গণতন্ত্রায়ন, সিভিল সোসাইটির গণতন্ত্রায়ন, রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্রায়ন এসব ক্ষেত্রে আমরা একটা জায়গায় আটকে আছি। এ জায়গাটায় বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টি দিতে হবে।
যুগান্তর : আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো বিষয় কি সার্কে এখনও অবশিষ্ট আছে?
ই.আ. : এবারের সার্ক নিয়ে সবারই একটা আশাবাদ ছিল- হয়তো একটা ব্রেকথ্রু আসবে। এর একটা বড় কারণ ছিল নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ায় এ আশাটা তৈরি হয়েছিল। সেই জায়গাটায় আশাভঙ্গ হয়েছে। দেখা গেছে, চিরাচরিতভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম দিন তিনি হ্যান্ডশেকই করলেন না। দ্বিতীয় দিন করলেন। আমি যদি দ্বিতীয় দিন করি, তাহলে প্রথম দিন কেন নয়? ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছে, তারা ’৪৭ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। এখন অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আমরা সাব-রিজিওনাল করব। সার্ক নামটাই কিন্তু সাব-রিজিওনাল। কিন্তু যতই সাব করা হোক, রিজিয়নটা তো রাখতেই হবে। না রাখার মানে হল, আমি আমার একটা হাতের যত্ন নেব, অন্য হাতের দিকে তাকাবই না। এ জায়গাটায় সিরিয়াসলি চিন্তা করা উচিত। রিজিয়নের একটা জায়গা যদি অনুন্নত থাকে, জঙ্গিবাদ বিরাজ করে, তার প্রভাব কিন্তু অন্য জায়গায়ও পড়বে।
যুগান্তর : আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী চীনকে সার্কের সদস্য করার দাবি তুলেছেন।
ই. আ. : চীন নিজেও বলেছে, তারা এলিভেটেড হতে চায়। চীনের অবজারভার স্ট্যাটাস বাড়ানোর কথা নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, এমনকি শ্রীলংকাও বলেছে। মজার ব্যাপার হল, দিল্লিতে এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে- চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে আমি রাখব। আর তোমরা আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। এ মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার। দেখা হচ্ছে, সার্কের ব্যাপারে বড় কোনো দায়িত্বই এবার বাংলাদেশ নেয়নি। ভারত যা বলেছে, তাই বলা হয়েছে। ফরেন পলিসিতে একটা বিষয় সব সময় খেয়াল রাখতে হবে- আমি তখনই বড় আকারের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারব, যখন আমার অবস্থা খুব শক্তিশালী হবে। সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। তারা হয়তো ভাবছেন, নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষ্যাপালে তিনি সাপোর্ট নাও করতে পারেন। নিজের পায়ে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থায় সরকারের থাকলে একটা পদক্ষেপ নিতে পারত। ভারতের সঙ্গে চীনের অলরেডি ৬০ বিলিয়ন প্লাস একটা ট্রেডিং রেজিম হয়ে গেছে। লার্জেস্ট সিঙ্গেল কান্ট্রি ট্রেডিং রেজিম যদি আমরা ধরি তাহলে দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে ভারতের। তার মানে, সে তো ’৫২-তে নেই। ভারতও ভালো করেই জানে, দিন দিন চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। কিন্তু ওই যে মানসিকতাটা আছে, বিশেষ করে তাদের আমলাতন্ত্রের মানসিকতা হল- প্রতিবেশীরা আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। চীনের সঙ্গে রাখবে না। এর বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহ না থাকায় চীনের ব্যাপারে সেভাবে উদ্যোগী হয়নি। এতে কিন্তু পুরো উপমহাদেশেরই ক্ষতি হচ্ছে। চীনের বড় ধরনের একটা সারপ্লাস ক্যাপিটেল আছে। সে ইনভেস্ট করার ক্ষমতা রাখে। স্বাভাবিকভাবে বিরোধী দল দেখল, এটা তার জন্য একটা সুযোগ। তারা জানে, তাদেরও আন্তর্জাতিক সমর্থন দরকার। তখন তারা এগিয়ে গিয়ে বলল, চীনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ কাজটা যদি শেখ হাসিনা করে ফেলতেন, তাহলে হয়তো অপশন থাকত না। তারা চুপচাপ থাকত।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জলবায়ু পরিষদ’ গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ই.আ.: এগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। এখানে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করার নেই। এ ধরনের সম্মেলনে কিছু জিনিস নিয়ে আসা হয়- এটাও নিয়ে আসা হয়েছে।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত ৬ দেশে অভিন্ন ভিসা পদ্ধতির উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন। জঙ্গিবাদ কি এক্ষেত্রে কোনো বাধা?
ই.আ.: আমাদের দিক থেকে এ ধরনের একটা দাবি ছিল। আমরা এটা নিয়ে কাজও করেছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে যেসব দেশের অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা আছে- আমরা একটা পাসপোর্ট ইউনিয়ন করব। ভুটান, নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ আমরা অন-অ্যারাইভাল ভিসা করি। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির বোধহয় একটা প্রস্তাব ছিল। আমাদের মন থেকে একটা জিনিস সরাতে হবে- জঙ্গিবাদের সঙ্গে ভিসা রেজিমের কোনো সম্পর্ক নেই। কেউ যদি জঙ্গিবাদ করতে চায়, তাহলে ভিসা সে ভালো করেই পাবে। কারণ সে জানে ভিসা কিভাবে পেতে হয়?
যুগান্তর : কাঠমান্ডু ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো কিছু আছে কি?
ই.আ.: সার্কের এবারের ঘোষণা নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড হইনি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। সেই যে আগের পাকিস্তান-ভারতের যে বিষয়- এখানে হ্যান্ডশেকটাই হয়ে গেল বড় খবর।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশে সড়ক ও রেল ট্রানজিট হলে বাংলাদেশ কতটুকু লাভবান হবে?
ই.আ.: প্রথমত, সড়ক ও রেল ট্রানজিট হওয়ার জন্য যে অবকাঠামো দরকার, বাংলাদেশের সেটা নেই। ঢাকা বা চট্টগ্রামের ট্রাফিক সিস্টেমই আমরা ঠিক করতে পারিনি। কাজেই অবকাঠামো না হওয়া পর্যন্ত এটা সমস্যা হয়েই থাকবে। আরেকটা বিষয় দেখতে হবে- এটা বাংলাদেশের জনগণের কোনো উপকারে আসছে কিনা। দেশের মানুষ যদি এ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো উপকার না পায়, তাহলে এটা রাজনৈতিকভাবে একটা সমস্যা হয়ে থাকবে।
যুগান্তর : আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে। কেন?
ই.আ.: এখানে একটা বড় ডেফিসিট হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলকে পরিষ্কারভাবে অবহিত করার কোনো পরিকল্পনা নিয়ে আমরা অগ্রসর হইনি। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সারা পৃথিবীকে জানানো এবং তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কনফারেন্স করে বোঝানোর গুরুত্বটা আমরা উপলব্ধি করতে পারিনি। ফলে যারা বিপক্ষ দল, এতে তাদের সুবিধা হয়ে গেছে। তারা তো বিদেশে গিয়ে ক্যাম্পেইনটা ঠিকই করে ফেলেছে।
যুগান্তর : অর্থাৎ আমাদের অস্পষ্টতার সুযোগ নেয়া হচ্ছে?
ই.আ.: ঠিক। আমার তো এখানে ঢেকে রাখার কিছু নেই। সংখ্যার বিতর্ক বাদ দিলেও গণহত্যার বিষয়টি তো প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেই জায়গাটায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো বিষয়টি যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে ঘাটতি রয়ে গেছে।
যুগান্তর : পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্ন উঠেছে। বিচার করা যাবে কি?
ই.আ.: যে চুক্তি হয়েছে, তাতে এটা একেবারেই সম্ভব নয়। কেবল পাকিস্তানের মধ্যে জনমত তৈরি করেই এটা করা সম্ভব। পাকিস্তানের জনগণ যখন দেখবে- এরা আসলেই যুদ্ধাপরাধী, তারা বেসামরিক মানুষকে মেরেছে, নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে, তখন পাকিস্তানের আইনস্বীকৃত অপরাধ হিসেবেই এর বিচার হবে। একটা ভুল হয়েছে, ১৯৫ জনের ট্রায়ালটা করা উচিত ছিল। তাহলে আমার হাতে প্রমাণ থাকত। অবশ্য তখন একটা কমপালশন ছিল, পাকিস্তানের স্বীকৃতির একটা ব্যাপার ছিল, বাংলাদেশীদের দেশে আনার একটা ব্যাপার ছিল। তারপরও আমরা যদি প্রমাণ রেখে দিতে পারতাম, পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম দেখত যে, এরা আসলেই যুদ্ধাপরাধী।
যুগান্তর : কোন প্রেক্ষাপটে একটা দেশে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়?
ই.আ. : বাংলাদেশে দুটি জিনিস ধরা পড়ছে। একটা হল, মাঝে মাঝেই আমরা দেখি- এখানে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে, ওখানে পাওয়া যাচ্ছে- পরে ওই বিষয়ে আর কোনো আলোচনা দেখি না। তাতে সন্দেহ হয়, এসব খবর কেউ তৈরি করছে কিনা? মূলত এ ধরনের খবরগুলো তৈরি করা হয় সহানুভূতি পাওয়ার জন্য- যাতে বলা যায়, বাংলাদেশে এখনও সমস্যা রয়ে গেছে ইত্যাদি। একেক সময় একেক নিউজ দেয়া হচ্ছে। এভাবে বলতে থাকলে সত্যিকারের সমস্যার সময় মানুষ কিন্তু এসব বিশ্বাস করবে না।
যুগান্তর : রাখাল বালকের গল্পের মতো?
ই.আ. : ঠিক। বিষয়টা ওই রকমই হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, বিদেশী কেউ এখানে এলে বা আসার আগে-পরে এ রকম একটা কিছু হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের বা পৃথিবীর বড় একটা অংশে অস্ত্র চোরাচালানের নেটওয়ার্ক আছে। অবৈধ অস্ত্রের একটা বিলিয়ন ডলারের মার্কেট কিন্তু বিশ্বব্যাপী রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ যে একটা চ্যানেল হবে না, এটা ভাবা ঠিক নয়।
যুগান্তর : দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্রের অভিযান বন্ধ থাকায় কি সন্ত্রাস বাড়ছে?
ই. আ. : যখন আমরা সন্ত্রাস বলি, তখন দুই ধরনের সন্ত্রাসের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। আগে যারা সন্ত্রাসী ছিল- পিচ্চি হান্নান, মুরগি মিলন, কালা জাহাঙ্গীর- এদের সন্ত্রাসটা যে প্যাটার্নের ছিল, সেখানে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। সন্ত্রাসীদের কাছে এখন একে-৪৭সহ অন্যান্য অস্ত্র চলে এসেছে। সন্ত্রাসীরা এখন আর ক্ষুদ্র অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাস করছে না। এই হল একটা দিক। দ্বিতীয় দিকটা হল, ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস হচ্ছে, যে অসহিষ্ণু ধারা তৈরি হয়েছে, তারাও কিন্তু বাজারে গেলে অস্ত্র পাচ্ছে।
যুগান্তর : অস্ত্রের সহজলভ্যতার সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক কতটুকু?
ই.আ. : অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার জঙ্গিবাদের আগেও ছিল। এটা সহজে থামবে না। আমাদের মধ্যে যদি একটা অসহিষ্ণু ধারা বজায় থাকে, আমাদের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে বড় দুই দল যে রকম চোখাচুখি অবস্থায় আছে, সেটা অব্যাহত থাকলে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মাধ্যমে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটালে রাজনৈতিক দল একে অন্যকে দোষারোপ করবে এবং সহজেই পার পেয়ে যাবে। তাই হচ্ছে। তার মানে হল, বড় দুই রাজনৈতিক দলের এ বিভাজন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের একটা শেড তৈরি করে দিচ্ছে।
যুগান্তর : সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিস্তার দেশের জনশক্তি রফতানি বা অভিবাসনের ক্ষেত্রে কতটুকু সমস্যা তৈরি করবে?
ই.আ. : প্রতি মাসে আমি যদি ঘোষণা দিই, অমুক জায়গায় এ অস্ত্র পাওয়া গেছে, অমুক সংগঠন আছে। তারপর কাউকে মেরে ফেলার পর বলা হল- এটা অমুক সংগঠনের কাজ, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক মহলে একটা ইমেজ সংকট তৈরি হবে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে যে কোনো দেশের বর্ডার পোস্টে বাংলাদেশীদের আসার ব্যাপারে একটা সন্দেহ জাগবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ইনডেক্স যদি দেখি- সেই ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩। ভারত ৬ ও পাকিস্তান ৩ নম্বরে আছে। আমাদের মিডিয়া পাকিস্তানের দিকে নজর দিল না, ভারত যে ৬ নম্বরে সেটাও কেউ দেখল না। সব নজর পড়ল প্রথম ১০-এর ঘরেও যে নেই, ২৩ নম্বরে থাকা বাংলাদেশের ওপর। সবাই বলা শুরু করল, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বেড়ে যাচ্ছে। যেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হচ্ছে, সে দেশ দুটির ওপর আমি দৃষ্টি কেন দিলাম না, কেউ জানে না।
যুগান্তর : মিডিয়া তো খবর তৈরি করে না, সার্ভ করে। মিডিয়াকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা কি ঠিক?
ই.আ.: না, আমি মিডিয়াকে এখানে দোষ দেব না। আমার মনে হয়, আমাদের এখানে যে ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা পলিটিক্যাল সার্কেল আছে, সেখানটায় সমস্যাটা রয়ে গেছে। আমাদের সিকিউরিটি সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী দেশ যা বলছে, আমরা সেটাই মেনে নিচ্ছি। অথচ বিদেশে বলা হয়, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক পিসফুল। তারা বলে, হোয়াই পিপলস টকিং অ্যাবাউট সিকিউরিটি প্রবলেম অব বাংলাদেশ? এদেশে যেটাকে রিস্ক বলা হচ্ছে, সেটা কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতনের কারণে। জঙ্গিবাদের কারণে নয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে।
যুগান্তর : তাহলে আমরা এর প্রতিবাদ করছি না কেন?
ই. আ.: প্রতিবাদ হচ্ছে না পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করার কারণে। এক দল আরেক দলের ওপর দোষ চাপানোর কারণে। এখানে একটা পরিবর্তন আসা দরকার। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার নিজেই এসব করে থাকে। সরকার নিজেই যদি প্রচার করে, তাহলে সেটার প্রতিবাদ কেমন করে হবে? আমি তো অবাক হয়ে গেছি- ভারতের এনআইএস ঘুরে গেল প্রথমে, আমরা অবশ্য পরে গেছি হৈচৈ হওয়ায়। কিন্তু হোয়াই ডু ইউ কাম টু মি? তুমি তো বিশ্বে ৬ নম্বর ঝুঁকির জায়গায় আছ। তোমার অবস্থার কারণেই আমার অবস্থা খারাপ।
যুগান্তর : আমাদের যাওয়া উচিত তাদের অবস্থা দেখতে?
ই. আ. : ঠিক। কিছুদিন আগে মাওবাদীরা ভারতের ১৯ জন পুলিশকে মেরে ফেলল। সেই নিউজ এসেছে পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায়, মাত্র ৪ লাইনে। আমাদের এখানে একটা সামান্য ঘটনা ঘটলেও সেটা বিশাল আকারে প্রকাশিত হয়। অথচ ভারতে ১৯ জন পুলিশ মেরে ফেলা হল, আমরা এটাকে নিউজই মনে করলাম না। আমরা ভাবলাম, হেডলাইন তো পরের কথা, নিউজ করাটাই বোধহয় ঠিক হবে না।
যুগান্তর : আপনি সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এ সম্পর্কে বলুন।
ই.আ. : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ’৭১ সালে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে- কর্তৃপক্ষ মনে করল এ নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হওয়া দরকার। সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এ লক্ষ্যেই গড়ে উঠেছে। এটা ফ্যাকাল্টি অব সোশ্যাল সায়েন্সের অধীনে তিন মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স পরিচালনা করছে।
যুগান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কি তুলে ধরতে পারবে?
ই.আ. : এটা গবেষণার বিষয়। আমরা এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি।
যুগান্তর : আপনার কি মনে হয়নি, স্বাধীনতার পরপরই এ ধরনের একটি সেন্টার গড়ে তোলা উচিত ছিল আমাদের?
ই.আ. : আমি একটু অবাক হয়েছি- এটা কেন তখন কেউ চিন্তা করেনি? আমরাও বলতে গেলে অনেক পরে চিন্তা করেছি।
যুগান্তর : সঙ্গে সঙ্গে করলে ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের সুযোগ থাকত না!
ই.আ. : হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে করা গেলে আজকে যেসব ডকুমেন্ট নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, সেটা হতো না। সেগুলো উদ্ধার করতে গিয়ে এখন অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে।
যুগান্তর : সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের নয় ফোঁড়।
ই.আ. : একজাক্টলি। তবে আমি মনে করি, শুরু তো করা গেছে। লেট ইজ বেটার দ্যান নাথিং।
যুগান্তর : করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা বলুন তো!
ই.আ. : করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের জন্য আমাকে কী-নোট পেপার দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। এর সঙ্গে ’৭১-এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি রাজি হয়েছিলাম। পাকিস্তান হাইকমিশন আমাকে ৬ মাসের ভিসাও দিয়েছিল। দু’দিন পর করাচি বিশ্ববিদ্যালয় জানাল- আমরা দুঃখিত, তোমার আসাটা বন্ধ করতে হবে। পরে জেনেছি, একটা ছাত্র সংগঠন ভিসিকে বলেছে, অধ্যাপক আহমেদকে আমরা এখানে আসতে দেব না। কেন দেব না- কারণ সে ’৭১-এর গণহত্যার ওপর কাজ করে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীকে ধরার জন্য অধ্যাপক আহমেদের বই ব্যবহার করা হয়েছে। ইত্যাদি। একজন বাংলাদেশী ’৭১ নিয়ে লিখবেন- এটাই তো স্বাভাবিক। আমার মনে হয়, শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া একটা অসহিষ্ণুতার জায়গায় চলে যাচ্ছে।
যুগান্তর : চিন্তা-চেতনার দিক থেকে পাকিস্তান এখনও একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে- এ কথা বলা অন্যায় হবে কি?
ই.আ. : মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাকিস্তানের মিডিয়াগুলো আমার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। এ নিয়ে ওদের মধ্যেও অস্বস্তিকর একটা ভাব তৈরি হয়েছে। আমি বলব- বিষয়টা নিয়ে তারা যেন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেন। যারা গবেষণা করেন বা কথা বলেন, অন্তত সেসব জায়গায় যেন কোনো বাধা না আসে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ই. আ. : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments