একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর কান্না by মাহবুব খান বাবুল
মালেখা খাতুন (৬৮)। বাড়ি সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের ভিটঘর গ্রামে। স্বামী মৃত সামছুল হক। গ্রামের ওই বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিসৌধের জন্য জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছে স্বামীহারা মালেখা খাতুন। ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল সারা দেশ। সংসারের অবস্থা নুন আনতে ফুরায়। মেয়ে নূরজাহানের বয়স ৫ বছর। ছেলে আমিল হকের বয়স ২০-২৫ দিন। দু’টি অবুঝ শিশুসন্তানকে নিয়ে দিশাহারা মালেখা ও তার স্বামী। চারদিকে গুলির শব্দ। পাকিস্তানি বাহিনীর শেলের আঘাতে চোখের সামনে ঝরছে তাজা প্রাণ। প্রকম্পিত হচ্ছে আকাশ-বাতাস। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযোদ্ধারা লড়ছে শত্রুর সঙ্গে। দেশমাতৃকার টানে যুদ্ধে যেতে চায় সামছুল হক। একদিকে দেশ, অন্যদিকে স্ত্রী-সন্তান। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে থেকেই সামছুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে থাকেন। ১৫ই অক্টোবর রোববার ১৩ রমজান। ঠিক সন্ধ্যায়। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। পুরোগ্রামের লোকজন ইফতার করছে। বিকট শব্দে কাঁপছে ভিটঘর গ্রাম। পাশের দুটি গ্রাম বড়ুইবাড়ি ও সিতাহরণেও চলছে হানাদার বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও তা-ব। ইফতার করা হলো না কারও। জীবন বাঁচানোর জন্য লোকজন চারদিকে ছোটাছুটি করছে। একদল নরপশু, ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রামটিকে ঘিরে আক্রমণ চালাচ্ছে। চোখের সামনে পশুর মতো লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাঞ্জাবিরা। স্ত্রী-সন্তানরা চিৎকার করে কাঁদছে। কি হৃদয়বিদারক দূশ্য! ঘাতক পাকিস্তানি সেনারা ৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে গেল। কাপড় দিয়ে তাদের চোখ বেঁধে গ্রামের পাশের খালি জায়গায় নিয়ে এক লাইনে দাঁড় করালো। ব্রাশফায়ার করে তাদের হত্যা করলো। পরে মাটি দিয়ে লাশগুলো ঢেকে দেয়া হলো। ভয়াল সেই রাতে স্বামীকে হারিয়ে বিধবার কাপড় পরেছিলেন মালেখা। তারপর পাকিস্তানি বাহিনীর অসহনীয় নির্যাতন। এতিম দুই শিশুসন্তান নূরজাহান ও আমিল হককে নিয়ে দিশাহারা ছিলেন তিনি। অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েকে লালন-পালন করেছেন। স্বামীসহ ৭৪ শহীদের স্মৃতিকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার স্বপ্ন দেখেন মালেখা। পেটের আহারের কথা চিন্তা করেননি। নিজে কোথায় থাকবেন তাও ভাবেননি। তিনি ১৮ বছর আগে একটি স্মতিসৌধ নির্মাণের জন্য নিজের বাড়ির পাশের মূল্যবান ১৫ শতক জায়গা জেলা প্রশাসকের নামে লিখে দেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পেরিয়ে গেলেও স্বামীহারা মালেখার আশা পূরণ হয়নি। আজও জায়গাটিতে গড়ে উঠেনি কোন শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ। কবে হবে তাও অজানা। তাই ডিসেম্বর মাস এলেই ওই বধ্যভূমিতে দিন-রাত দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলেন তিনি। বয়সের ভারে নতজানু মালেখা এখন আর কাঁদতেও পারেন না। তবে মৃত্যুর আগে জায়গাটিতে স্মৃতিসৌধ দেখে যেতে পারলে তিনি শান্তি পাবেন। শান্তি পাবেন মালেখার স্বামী সামছুল হকসহ ৭৪ শহীদের আত্মা। বর্তমানে এ বধ্যভূমিটি রয়েছে সম্পূর্ণ অযত্ন-অবহেলায় অরক্ষিত। এখানে গরু ছাগল চড়ানো হয়। মালেখা আক্তারের ইচ্ছা বিজয়ের দিনে এখানে বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থী ও সাধারণ লোকজন ফুল দেবেন। স্বাধীনতা ও বিটঘর বধ্যভূমির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বধ্যভূমির ইতিহাস জানবে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মালেখা আক্তার বলেন, সরকারকে জায়গা দেয়ার মূল লক্ষ্য আদৌ পূরণ হয়নি। মৃত্যুর আগে দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না। ১৯৯৬ সালে সরাইল আওয়ামী লীগের নেতারা মাটি রক্ষার দেয়ালটি করেছিলেন। আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কত লোক আসে ছবি তুলে লিখে নেয় কিন্তু কিছু তো হচ্ছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকা- স্বচোক্ষে দেখেছিলেন ভিটঘর গ্রামের বাসিন্ধা আশকর আলী। কৌশলে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে আশকর আলী নিজের জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন ঠিকই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। দুঃসহ সেই স্মৃতি কল্পনা করতে করতে তিনি এখন পাগল হয়ে গেছেন। সেই আশকর আলীর খবরও কেউ রাখে না। পানিশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মো. নূরুল হক বলেন, আমার অনেক সাথীকে এখানে নির্মমভাবে খুন করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। ৪৩ বছর পরও স্থানটিতে কিছুই হয়নি। অরক্ষিতই রয়ে গেছে বধ্যভূমি।
No comments