বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি ছাত্রলীগ কারিগর
১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শাশ্বত সুন্দরের দূত উদ্বেলিত-উচ্ছ্বসিত-আবেগাপ্লুত। যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে আদৌ শরিক ছিলেন না, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বাম ও ডানের যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে পথে বাঁকে বাঁকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন, সমর্থন করেন নি, এমনকি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেও কট্টরভাবে সক্রিয় ছিলেন; জনান্তিকে জানিয়ে রাখি- তখন সংগঠন হিসেবে জন্মলাভ না করলেও শিকড়বিহীন, জনবিচ্যুত বিএনপি নির্লজ্জভাবে দম্ভোক্তি করে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু ২৫শে মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বর তার পরিসমাপ্তি। বাঙালির চেতনার উন্মেষ-বিকাশ-ব্যাপ্তি, দীর্ঘ পথপরিক্রমণের মধ্যে আন্দোলনের একেকটি সোপান উত্তরণের মধ্য দিয়ে ৭০-এর নির্বাচনে অভূতপূর্ব ম্যান্ডেট; তাকে হৃদয়ঙ্গম করার মতো রাজনৈতিক মানসিকতার দৈন্যদশার এটি সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। প্রাপ্তি-প্রত্যাশার একটা মারাত্মক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, দীনতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও ক্ষমতার প্রতি নির্লজ্জ লোভ আমাদের গোটা জাতিকে তার কাঙিক্ষত সৈকতে পৌঁছে দিতে না পারলেও বাঙালি জাতীয় চেতনায় আবীর মাখানো ভাষা আন্দোলন- পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের এবং স্বাধীনতার প্রসূতিকাগার।
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ’৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব বাংলার মানুষ ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনা ও মননশীলতায় ছিল বাঙালি। ধর্মের প্রতি তাদের অনুভূতি ও হৃদয় যতই সিক্ত হোক না কেন, তাদের অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশ্বাসের আঙ্গিক ছিল- ‘এ মাটি আমার সোনা আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা।’ তাদের হৃদয়ের চিরন্তন স্পন্দন ছিল- ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার এই প্রবহমান চেতনাকে উচ্ছ্বসিত উর্মিমালার মতো মানুষকে উদ্বেলিত করে ৭০-এর নির্বাচনের অবিশ্বাস্য বিজয়কে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট হিসেবে এনে দেয়। ৬ দফার মোড়কে স্বাধীনতা অর্জনের যে সফলতা সেটা অকস্মাৎ আসেনি।
আমরা জানতাম ১৪০০ মাইলের শুধু সীমানার ব্যবধান নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কুচক্রীদের শোষণের চারণক্ষেত্র ছিল। মহান বিজয়ের দিনে আমি নিষ্কলুষ চিত্তে বলতে চাই- আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওরা আমাদের জমে ওঠা ঐক্যকে অনুধাবন করতে পারে নি। পারলে অবশ্যই এ নির্বাচন হতে দিতো না। আর তাহলেই নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটের বদৌলতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আমাদের এত সুচারু, নিরবচ্ছিন্ন এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারতো না। বিশ্বসমর্থনও আমাদের পক্ষে এত শাশ্বত হতো না। ৩রা মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনটি যে তারা করতে দেবে না এটিও অবহিত ছিলাম। সেদিনের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদৌলতে স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ ওদের আঘাতকে শুধু প্রতিহতই নয়, প্রত্যাখ্যাত করার লক্ষ্যে তিল তিল করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। আমি বারবার এই সত্যটি উচ্চারণ করেছি, ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা সমগ্র জাতিকে একটি অবিস্মরণীয় প্রত্যয়দৃঢ় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিলাম বলেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২৫শে মার্চ যে আঘাতটি তারা হানে, অর্থ এবং অস্ত্রে ও শক্তিতে বলীয়ান পাকিস্তানিরা মনে করেছিল- ২৫শে মার্চের আক্রমণের মাধ্যমে আমাদেরকে নিস্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় করে দেবে। ওদের শক্তির উৎস অর্থ এবং অস্ত্র হলেও তার চাইতেও সুতীক্ষ্ন ছিল বাঙালির শাণিত প্রত্যয়বোধ।
২৫শে মার্চ রাতে সশস্ত্র আক্রমণের প্রাক্কালেও আমরা (কে. এম. ওবায়দুর রহমান, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শেখ শহীদ, কাজী ফিরোজ, মহসীন, মাসুদ, রঞ্জু, গুলজারসহ ১৭-১৮ জন) ৩২ নম্বরে ছিলাম। রাত ১০টা বা সোয়া ১০টা হবে, বঙ্গবন্ধু অচঞ্চল ও প্রশান্ত চিত্তে আমাদেরকে নির্দেশনা দিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে রেখেছিলাম (এই রোডম্যাপের পরিকল্পনাটি ওবায়েদ ভাইয়ের পূর্বজ্ঞাত ছিল না)। মুজিব ভাই আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হন নি। এখন মনে হয়, তাঁর সেদিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ, রবাহূতের মতো ভারতে গেলে দেশের অভ্যন্তরে একটি বিভ্রান্তি আসতো। তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতাও খাটো হতো। আমাকে ইকবাল হলের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে অবস্থান নেয়ার নির্দেশনা দিলেন। আমার মনে একটি সংশয় আজও কাজ করে, ওই রাতে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পাকিস্তানি হায়েনাদের পাশবিকতা ও বীভৎসতার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি কি হতে পারতো- হয়তো তাঁর ভাবনায় ছিল না। আমরা সবাই সে রাতে ধানমন্ডিতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ২৩ নম্বরের বাসায় আশ্রয় নিলাম। বেতারকেন্দ্র থেকে কারফিউয়ের ঘোষণা শুনলাম। আমাদের আগেরই সিদ্ধান্ত ছিল- এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা কলাইতলী গ্রামে জনাব রতন-গগনদের বাসায় গিয়ে মিলিত হবো এবং পরবর্তী কর্মসূচি সেখান থেকে নির্ধারণ করবো। ২৭ তারিখে কারফিউ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হলে আমরা নির্ধারিত স্থানে মিলিত হই। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, কে. এম. ওবায়দুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হেনা ভাইসহ অনেক রাজনৈতিক নেতার উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হলো- ৪টি জোনে ভাগ করে আমরা জনমত সংগঠিত করে ওদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। পদ্মার চর ঘেঁষে গ্রামীণ রাস্তার উপর দিয়ে আমরা ফরিদপুরের কাছাকাছি জায়গায় পদ্মা পাড়ি দিলাম। ফরিদপুর তখন অবমুক্ত। মিহির ভাই ফরিদপুরের এসপি। ওবায়েদ ভাই প্রশাসক। মিহির ভাই তখন হয়ে গেলেন সেনাধ্যক্ষ।
আমরা একটি ডাকবাংলো থেকে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুরসহ যশোর, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। ২রা এপ্রিল সর্বজনাব শাহজাহান সিরাজ, ব্যারিস্টার সুবেদ আলী টিপু, মোস্তফা মহসীন মন্টুসহ আরও কয়েকজন নেতাকর্মী ফরিদপুরে আমাদের সঙ্গে একত্রিত হলেন। তখন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছিল ফরিদপুরের দখল আমাদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাহজাহান সিরাজ, মন্টু, আমিসহ উপস্থিত সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা রাজবাড়ী হয়ে চুয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেবো। কারণ, ওখানে ইপিআর ইউনিটের সকলেই মেজর ওসমানের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গায় শক্ত ঘাঁটি গেড়েছেন, যার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয় পরিষদের সদস্য হেদা ভাই। শুধু ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে আমরা রাজবাড়ীতে কিছুক্ষণ অবস্থান নিলাম। মরহুম হেদা ভাই (কাজী হেদায়েতুল্লাহ) রাস্তায় খরচের জন্য আমাদের কিছু অর্থ সহায়তা দিলেন। চুয়াডাঙ্গায় ওসমান সাহেব, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী সাহেব (তিনি মেহেরপুর থেকে পুলিশসহ ওসমান সাহেবের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন), জনাব হেদা ভাই ও ওখানকার স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সেলুনসহ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আমরা অগ্রগামী দল হিসেবে (শাহজাহান সিরাজ, মন্টু, টিপু ও আমিসহ ১২-১৩ জন) গেদে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করবো। গেদে সীমান্তে পার হওয়ার সময় বাংলাদেশের সীমানার উপর দাঁড়িয়ে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- বাংলা মায়ের মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছি, হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার তৌফিক দিও। আমাদের সবার কান্না এত সুতীব্র ও মর্মস্পর্শী ছিল যে, বিএসএফের অফিসার, জোয়ানরাও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা ওখান থেকে ট্রেনে চড়ে শিয়ালদা স্টেশনে নামি। রাত তখন ১০টা। নকশালবাহিনীর আক্রমণের আতঙ্কে কলকাতা তখন থরথর করে কাঁপতো। ডা-াবেড়ির মতো পুলিশের শরীরে শিকল দিয়ে রাইফেল কাঁধে তালা দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে রেখে দেয়া হতো যাতে নকশালরা রাইফেল ছিনিয়ে নিতে না পারে। আমরা শিয়ালদার কোন হোটেলের কলাপসিবল গেট খোলাতে পারলাম না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বেকার হোস্টেলের গেটে গিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও ঢুকতে পারলাম না। অবশেষে ওখানকার একটি মসজিদের বারান্দায় মুসাফিরের মতো আশ্রয় নিলাম। তখন রাত প্রায় ৩টা। এক-দেড় ঘণ্টা পরেই মুয়াজ্জিন আমাদেরকে তুলে দিলো। আবার আমরা আশ্রয়ের খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তাঘাট সবই অজানা। উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলছি, যে কোন সময় পড়ে যেতে পারি এমন অবস্থা। কলেজ স্ট্রিটে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রদের জন্য একটি ছোটখাটো হোস্টেল ছিল। তারা বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে অবগত ছিল। ফলে তাদের বুঝতে কষ্ট হলো না - আমরা শরণার্থী। আমাদের কাছে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা আমাদের জন্য দু’তিনটি রুম খালি করে দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলো। ৩রা এপ্রিল বিকেল ৩টায় ঘুম থেকে জাগিয়ে ওরা আমাদের জানালো যে, ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের বাসাকে কার্যালয় বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক শক্তি নামে একটি সংগঠন জন্মলাভ করেছে। তারাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যান। ওই খানে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং যাদের সঙ্গে আমার অতি সখ্য গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে লোকসভার সদস্য অধ্যাপক সমর গুহ অন্যতম। উনারা শাহজাহান সিরাজ ও আমাকে কিট স্ট্রিট এমপি হোস্টেলে এবং অন্যদেরকেও বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এ সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্দ্ব্বিধায় বলা যায়, এপ্রিলের ২ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতের কোন যোগাযোগ ছিল না। যারা নিউক্লিয়াসের কথা বলেন, তাদের মধ্যে শাহজাহান সিরাজকে তাহলে সেদিন আমার সঙ্গে মসজিদে ঘুমাতে হতো না। সৌভাগ্যক্রমে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় (যথাক্রমে সর্বভারতীয় যুবপরিষদ ও সর্বভারতীয় ছাত্রপরিষদের তৎকালীন নেতা) থাকতেন ২/১৩-তে আর আমরা থাকতাম ২/১৪-তে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পূর্ব-সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও শুধু ছিন্নমূল শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া নয়, পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় জনমত আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয় প্রবাসী সরকার গঠন ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে। ১৫ই এপ্রিল শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সম্মেলনে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, যার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন। কোনরকম কটাক্ষ না করেও বলা যায়, ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলেও আবেগ-উত্তেজনা ম্রিয়মাণ ছিল। মিছিলে ও সভায় স্লোগান আমাদের মতো বজ্রনির্ঘোষ হতো না। তাই মেহেরপুর আম্রকাননে ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানটি শুধু অনাড়ম্বরই ছিল না, এতটাই নিষ্প্রভ ছিল যে, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, ওদের সভা-সমিতি ও মিছিলের আদলটাই ছিল এমন যে তাতে আবেগের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ থাকে না। আগরতলা-ভিত্তিক মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব তাজউদ্দীন সাহেবের প্রবাসী সরকারকে মেনে নিতে পারে নি বলেই এবং মুজিববাহিনীর সঙ্গে আমারও যোগসূত্র না থাকার কারণে তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে আমার মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে একটা সুদৃঢ় রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি হয়। তাজউদ্দীন ভাইয়ের মতো আমিও নিশ্চিত ছিলাম- স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে আমরা অবশ্যই ফেরত পাবো। আর মুজিববাহিনীর একাংশের লালিত বিশ্বাস ছিল, দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফেরত পাওয়া যাবে না এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একটি বিপ্লব সংঘটিত করে তারা প্রবাসী সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করবে। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাই অতি দক্ষতার সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর গোচরীভূত করতে সক্ষম হন। আল্লাহর শোকর, প্রবাসে একটিই সরকার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। এর ব্যতিক্রম হলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম এবং আমাদের পরিণতি বিভিন্ন দেশের অতিবিপ্লবীদের মতোই হতো, যা নিশ্চিতভাবে একটি সংঘাত সৃষ্টি করতো। ২৩ বছরের ক্লান্তিবিহীন প্রত্যয়দৃপ্ত সংগ্রামের চিরভাস্বর এই স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন সংগ্রহের মূল পটভূমিটিই সৃষ্টি করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ভিত্তিক আন্দোলন। আজ জীবন সায়াহ্নে, ৪৩ বছর পরে রাষ্ট্রীয় জীবনের দৈন্যদশা, দুর্নীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার নির্লজ্জ তৎপরতা, দেশকে দেয়ার চাইতে নিংড়ে মুচড়ে সবকিছু নিঃশেষ করার এই হীন তৎপরতা ও চরম অনিশ্চয়তার মুহূর্তে রক্ত-অশ্রু, বেদনা ও আত্মত্যাগের মূল্যে অর্জিত এই স্বাধীনতা নতুন প্রজন্ম সার্থক করবে ইনশাআল্লাহ।
আমরা জানতাম ১৪০০ মাইলের শুধু সীমানার ব্যবধান নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কুচক্রীদের শোষণের চারণক্ষেত্র ছিল। মহান বিজয়ের দিনে আমি নিষ্কলুষ চিত্তে বলতে চাই- আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওরা আমাদের জমে ওঠা ঐক্যকে অনুধাবন করতে পারে নি। পারলে অবশ্যই এ নির্বাচন হতে দিতো না। আর তাহলেই নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটের বদৌলতে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো আমাদের এত সুচারু, নিরবচ্ছিন্ন এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারতো না। বিশ্বসমর্থনও আমাদের পক্ষে এত শাশ্বত হতো না। ৩রা মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অধিবেশনটি যে তারা করতে দেবে না এটিও অবহিত ছিলাম। সেদিনের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বদৌলতে স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ ওদের আঘাতকে শুধু প্রতিহতই নয়, প্রত্যাখ্যাত করার লক্ষ্যে তিল তিল করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। আমি বারবার এই সত্যটি উচ্চারণ করেছি, ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আমরা সমগ্র জাতিকে একটি অবিস্মরণীয় প্রত্যয়দৃঢ় ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিলাম বলেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। ২৫শে মার্চ যে আঘাতটি তারা হানে, অর্থ এবং অস্ত্রে ও শক্তিতে বলীয়ান পাকিস্তানিরা মনে করেছিল- ২৫শে মার্চের আক্রমণের মাধ্যমে আমাদেরকে নিস্তব্ধ ও নিষ্ক্রিয় করে দেবে। ওদের শক্তির উৎস অর্থ এবং অস্ত্র হলেও তার চাইতেও সুতীক্ষ্ন ছিল বাঙালির শাণিত প্রত্যয়বোধ।
২৫শে মার্চ রাতে সশস্ত্র আক্রমণের প্রাক্কালেও আমরা (কে. এম. ওবায়দুর রহমান, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শেখ শহীদ, কাজী ফিরোজ, মহসীন, মাসুদ, রঞ্জু, গুলজারসহ ১৭-১৮ জন) ৩২ নম্বরে ছিলাম। রাত ১০টা বা সোয়া ১০টা হবে, বঙ্গবন্ধু অচঞ্চল ও প্রশান্ত চিত্তে আমাদেরকে নির্দেশনা দিলেন। আমরা বঙ্গবন্ধুকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে রেখেছিলাম (এই রোডম্যাপের পরিকল্পনাটি ওবায়েদ ভাইয়ের পূর্বজ্ঞাত ছিল না)। মুজিব ভাই আমাদের সঙ্গে যেতে রাজি হন নি। এখন মনে হয়, তাঁর সেদিনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ, রবাহূতের মতো ভারতে গেলে দেশের অভ্যন্তরে একটি বিভ্রান্তি আসতো। তাঁর ব্যক্তিত্বের উচ্চতাও খাটো হতো। আমাকে ইকবাল হলের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে গিয়ে অবস্থান নেয়ার নির্দেশনা দিলেন। আমার মনে একটি সংশয় আজও কাজ করে, ওই রাতে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পাকিস্তানি হায়েনাদের পাশবিকতা ও বীভৎসতার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি কি হতে পারতো- হয়তো তাঁর ভাবনায় ছিল না। আমরা সবাই সে রাতে ধানমন্ডিতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ২৩ নম্বরের বাসায় আশ্রয় নিলাম। বেতারকেন্দ্র থেকে কারফিউয়ের ঘোষণা শুনলাম। আমাদের আগেরই সিদ্ধান্ত ছিল- এরূপ পরিস্থিতিতে আমরা কলাইতলী গ্রামে জনাব রতন-গগনদের বাসায় গিয়ে মিলিত হবো এবং পরবর্তী কর্মসূচি সেখান থেকে নির্ধারণ করবো। ২৭ তারিখে কারফিউ সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হলে আমরা নির্ধারিত স্থানে মিলিত হই। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, কে. এম. ওবায়দুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হেনা ভাইসহ অনেক রাজনৈতিক নেতার উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হলো- ৪টি জোনে ভাগ করে আমরা জনমত সংগঠিত করে ওদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। পদ্মার চর ঘেঁষে গ্রামীণ রাস্তার উপর দিয়ে আমরা ফরিদপুরের কাছাকাছি জায়গায় পদ্মা পাড়ি দিলাম। ফরিদপুর তখন অবমুক্ত। মিহির ভাই ফরিদপুরের এসপি। ওবায়েদ ভাই প্রশাসক। মিহির ভাই তখন হয়ে গেলেন সেনাধ্যক্ষ।
আমরা একটি ডাকবাংলো থেকে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুরসহ যশোর, কুষ্টিয়ার বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম। ২রা এপ্রিল সর্বজনাব শাহজাহান সিরাজ, ব্যারিস্টার সুবেদ আলী টিপু, মোস্তফা মহসীন মন্টুসহ আরও কয়েকজন নেতাকর্মী ফরিদপুরে আমাদের সঙ্গে একত্রিত হলেন। তখন ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছিল ফরিদপুরের দখল আমাদের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শাহজাহান সিরাজ, মন্টু, আমিসহ উপস্থিত সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা রাজবাড়ী হয়ে চুয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেবো। কারণ, ওখানে ইপিআর ইউনিটের সকলেই মেজর ওসমানের নেতৃত্বে চুয়াডাঙ্গায় শক্ত ঘাঁটি গেড়েছেন, যার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন জাতীয় পরিষদের সদস্য হেদা ভাই। শুধু ট্রেনের ইঞ্জিন নিয়ে আমরা রাজবাড়ীতে কিছুক্ষণ অবস্থান নিলাম। মরহুম হেদা ভাই (কাজী হেদায়েতুল্লাহ) রাস্তায় খরচের জন্য আমাদের কিছু অর্থ সহায়তা দিলেন। চুয়াডাঙ্গায় ওসমান সাহেব, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী সাহেব (তিনি মেহেরপুর থেকে পুলিশসহ ওসমান সাহেবের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন), জনাব হেদা ভাই ও ওখানকার স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সেলুনসহ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- আমরা অগ্রগামী দল হিসেবে (শাহজাহান সিরাজ, মন্টু, টিপু ও আমিসহ ১২-১৩ জন) গেদে সীমান্ত পার হয়ে কলকাতায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করবো। গেদে সীমান্তে পার হওয়ার সময় বাংলাদেশের সীমানার উপর দাঁড়িয়ে এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- বাংলা মায়ের মাটি ছুঁয়ে যাচ্ছি, হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার তৌফিক দিও। আমাদের সবার কান্না এত সুতীব্র ও মর্মস্পর্শী ছিল যে, বিএসএফের অফিসার, জোয়ানরাও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। আমরা ওখান থেকে ট্রেনে চড়ে শিয়ালদা স্টেশনে নামি। রাত তখন ১০টা। নকশালবাহিনীর আক্রমণের আতঙ্কে কলকাতা তখন থরথর করে কাঁপতো। ডা-াবেড়ির মতো পুলিশের শরীরে শিকল দিয়ে রাইফেল কাঁধে তালা দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে রেখে দেয়া হতো যাতে নকশালরা রাইফেল ছিনিয়ে নিতে না পারে। আমরা শিয়ালদার কোন হোটেলের কলাপসিবল গেট খোলাতে পারলাম না। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বেকার হোস্টেলের গেটে গিয়ে অনেক অনুনয়-বিনয় করেও ঢুকতে পারলাম না। অবশেষে ওখানকার একটি মসজিদের বারান্দায় মুসাফিরের মতো আশ্রয় নিলাম। তখন রাত প্রায় ৩টা। এক-দেড় ঘণ্টা পরেই মুয়াজ্জিন আমাদেরকে তুলে দিলো। আবার আমরা আশ্রয়ের খোঁজে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তাঘাট সবই অজানা। উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলছি, যে কোন সময় পড়ে যেতে পারি এমন অবস্থা। কলেজ স্ট্রিটে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রদের জন্য একটি ছোটখাটো হোস্টেল ছিল। তারা বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে অবগত ছিল। ফলে তাদের বুঝতে কষ্ট হলো না - আমরা শরণার্থী। আমাদের কাছে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তারা আমাদের জন্য দু’তিনটি রুম খালি করে দিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলো। ৩রা এপ্রিল বিকেল ৩টায় ঘুম থেকে জাগিয়ে ওরা আমাদের জানালো যে, ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের বাসাকে কার্যালয় বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক শক্তি নামে একটি সংগঠন জন্মলাভ করেছে। তারাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যান। ওই খানে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং যাদের সঙ্গে আমার অতি সখ্য গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে লোকসভার সদস্য অধ্যাপক সমর গুহ অন্যতম। উনারা শাহজাহান সিরাজ ও আমাকে কিট স্ট্রিট এমপি হোস্টেলে এবং অন্যদেরকেও বিভিন্ন জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এ সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্দ্ব্বিধায় বলা যায়, এপ্রিলের ২ তারিখের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতের কোন যোগাযোগ ছিল না। যারা নিউক্লিয়াসের কথা বলেন, তাদের মধ্যে শাহজাহান সিরাজকে তাহলে সেদিন আমার সঙ্গে মসজিদে ঘুমাতে হতো না। সৌভাগ্যক্রমে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও সুব্রত মুখোপাধ্যায় (যথাক্রমে সর্বভারতীয় যুবপরিষদ ও সর্বভারতীয় ছাত্রপরিষদের তৎকালীন নেতা) থাকতেন ২/১৩-তে আর আমরা থাকতাম ২/১৪-তে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, পূর্ব-সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও শুধু ছিন্নমূল শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া নয়, পশ্চিমবঙ্গকে কেন্দ্র করে সর্বভারতীয় জনমত আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয় প্রবাসী সরকার গঠন ও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে। ১৫ই এপ্রিল শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সম্মেলনে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়, যার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন। কোনরকম কটাক্ষ না করেও বলা যায়, ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলেও আবেগ-উত্তেজনা ম্রিয়মাণ ছিল। মিছিলে ও সভায় স্লোগান আমাদের মতো বজ্রনির্ঘোষ হতো না। তাই মেহেরপুর আম্রকাননে ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানটি শুধু অনাড়ম্বরই ছিল না, এতটাই নিষ্প্রভ ছিল যে, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, ওদের সভা-সমিতি ও মিছিলের আদলটাই ছিল এমন যে তাতে আবেগের উচ্ছ্বসিত প্রকাশ থাকে না। আগরতলা-ভিত্তিক মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব তাজউদ্দীন সাহেবের প্রবাসী সরকারকে মেনে নিতে পারে নি বলেই এবং মুজিববাহিনীর সঙ্গে আমারও যোগসূত্র না থাকার কারণে তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে আমার মতের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে একটা সুদৃঢ় রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি হয়। তাজউদ্দীন ভাইয়ের মতো আমিও নিশ্চিত ছিলাম- স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে আমরা অবশ্যই ফেরত পাবো। আর মুজিববাহিনীর একাংশের লালিত বিশ্বাস ছিল, দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধুকে জীবিত ফেরত পাওয়া যাবে না এবং স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একটি বিপ্লব সংঘটিত করে তারা প্রবাসী সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করবে। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাই অতি দক্ষতার সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের, বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর গোচরীভূত করতে সক্ষম হন। আল্লাহর শোকর, প্রবাসে একটিই সরকার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়। এর ব্যতিক্রম হলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাম এবং আমাদের পরিণতি বিভিন্ন দেশের অতিবিপ্লবীদের মতোই হতো, যা নিশ্চিতভাবে একটি সংঘাত সৃষ্টি করতো। ২৩ বছরের ক্লান্তিবিহীন প্রত্যয়দৃপ্ত সংগ্রামের চিরভাস্বর এই স্বাধীনতার স্থপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। দেশের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন সংগ্রহের মূল পটভূমিটিই সৃষ্টি করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা ভিত্তিক আন্দোলন। আজ জীবন সায়াহ্নে, ৪৩ বছর পরে রাষ্ট্রীয় জীবনের দৈন্যদশা, দুর্নীতি, প্রতিহিংসার রাজনীতি, ক্ষমতা আঁকড়ে রাখা ও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার নির্লজ্জ তৎপরতা, দেশকে দেয়ার চাইতে নিংড়ে মুচড়ে সবকিছু নিঃশেষ করার এই হীন তৎপরতা ও চরম অনিশ্চয়তার মুহূর্তে রক্ত-অশ্রু, বেদনা ও আত্মত্যাগের মূল্যে অর্জিত এই স্বাধীনতা নতুন প্রজন্ম সার্থক করবে ইনশাআল্লাহ।
No comments