রমজানে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ চাই

রমজান মাসের আগমনকে পঁুজি করে একশ্রেণির কালোবাজারি অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও পণ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ান৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে খাদ্যপণ্য মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে ও সংকটের আবহ সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা অমানবিক, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার শামিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান অপর মুসলমানের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা গ্রহণপূর্বক ক্রয়-বিক্রয় করে ধোঁকা দিল, সে পাপী।’ (আন-নিহায়া) এমন অতিরিক্ত মুনাফাকে সুদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ‘পণ্যের মূল্য জানে না এমন ক্রেতার কাছ থেকে আদায়কৃত মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা সুদের নামান্তর।’ (মাজমুউ ফাতওয়া) অথচ দেশে সুযোগসন্ধানী মজুতদার, মুনাফাখোর ও অসৎ ব্যবসায়ীরা পণ্যদ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য মজুত রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। এমন পরিস্থিতি দেশের সীমিত আয়ের মানুষের জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ব্যবসায়ীদের এমন বিবেকহীন ও অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের কারণে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পড়ে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বাজার-প্রক্রিয়াকে রক্ষার জন্য ইসলাম মজুতদারি, মুনাফাখোির, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও দালালির মতো কার্যক্রমকে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এদের স্বরূপ উন্মোচন করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মজুতদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায় তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি মূল্য বেড়ে যায় তবে আনন্দিত হয়।’
(মিশকাত) মজুতদারি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কখনো পণ্যদ্রব্যের দাম তাদের ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে দেয়। যখন মাহে রমজান আগত হয়, তখনই মুনাফাখোর চক্রটি তৎপর হয়ে পড়ে। ফলে জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। তাই রমজান মাসে বাজাের দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে সতর্ক করে বলেছেন, ‘কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে, তবে আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামাির ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজা ও বায়হািক) তা সত্ত্বেও রমজান মাসে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধ ব্যবসায় মেতে মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে এবং পরে অধিক হারে মুনাফা লুটে নেয়। তাদের মূল লক্ষ্য হলো ব্যবসা। অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা দরিদ্র মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়। বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। অথচ পণ্যসামগ্রী মজুত করে অহেতুক দাম বৃদ্ধি বা অধিক মুনাফা করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) সমকালীন বাজারব্যবস্থাকে তদারকি বা মনিটরিং করার জন্য ‘হিজর’ নামে একটি আলাদা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রধান কাজ ছিল অসাধু ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাজারে খাদ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী মজুতদারকে কঠোরভাবে দমন করা। রমজান মাসে ধর্মপ্রাণ মানুষকে যেন কষ্ট বরণ করতে না হয় এবং একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট থেকে নজরদারি ব্যবস্থা চালু করে বাজারকে কলুষমুক্ত,
পরিচ্ছন্ন ও বিশেষ গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে ‘ন্যায্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সেল’ গঠন করে শহর, নগর, বন্দর, গ্রাম সর্বত্রই সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের নজরদারির আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল্যপ্রবাহকে কেউ যেন ঊর্ধ্বমুখী করে না তোলে, সে ক্ষেত্রে ইসলামে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনায় হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটালে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা আগুনের হাঁড়ের ওপর তাকে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (তিরমিজি) যেহেতু মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ক্রয়-বিক্রয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মজুতদাির সম্পর্কে ইসলািম দৃষ্টিকোণ রয়েছে, সেহেতু খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি করতে পারেন না। যদি কেউ এমনটি করে থাকে, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মসাৎকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। মাহে রমজানের প্রাক্কালে যখন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্যের স্ফীতি ঘটাতে চান, তখন সরকার দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। সরকার কর্তৃক ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ-প্রক্রিয়াকে আরবিতে ‘তাসয়ির’ বলা হয়। ব্যবসায়ীদের নীতি-নৈতিকতা, জবাবদিহি ও ইসলামসম্মত জনসেবামূলক ভূমিকা মাহে রমজানে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এ জন্য সমাজের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ব্যবসায়ীকে সৎমনোভাবাপন্ন, নির্লোভ, মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা দরকার। মজুতদারি, ধোঁকাবাজি, সুদি লেনদেনসহ সব ধরনের প্রতারণামূলক ইসলামি আদর্শবিবর্জিত কার্যাবলি রোধ করা প্রয়োজন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.