এই বর্বরতার ব্যাখ্যা কী?
গত বৃহস্পতিবার ২৮৩ জন যাত্রী ও ১৫ জন ক্রু নিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৭৭ (এমএইচ ফ্লাইট ১৭) উড়োজাহাজ পূর্ব ইউক্রেনের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যে হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হলো, এমনটি নিকট অতীতে আর ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। ইউক্রেনের রাশিয়া সীমান্তবর্তী ওই অঞ্চলে প্রায় ছয় মাস ধরে যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে পৃথিবীর অন্য একাধিক অঞ্চলে। ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে এবং ২০০৩ সাল থেকে ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আর গ্রায় তিন বছর ধরে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। ইসরায়েলেও মাঝেমধ্যেই ভয়াবহ সংঘাত বেঁধে যাচ্ছে; উভয় পক্ষে রকেট ছোড়াছুড়ি চলছে। এসব অঞ্চলের আকাশসীমা দিয়ে বিভিন্ন দেশের যাত্রীবাহী বিমান চলাচল করছে। কিন্তু কোথাও কোনো পক্ষ যাত্রীবাহী কোনো উড়োজাহাজে আঘাত হানেনি। তাই ইউক্রেনের আকাশে সংঘটিত এই ট্র্যাজেডিকে এমন এক বর্বর গণহত্যা বলে মনে হয়, যা বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করেছে। প্রশ্ন জাগে, ঘটনাটি যারাই ঘটিয়ে থাকুক, তারা কি আসলে মানুষ? কী করে তারা ২৯৮ জন আরোহীসহ একটি বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমান লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়তে পারল, রাশিয়া-ইউক্রেন বিবাদের সঙ্গে যে মানুষগুলোর কোনো সম্পর্কই ছিল না? বিমানটির ধ্বংসাবশেষ এবং নিহত আরোহীদের ছিন্নভিন্ন দেহ ও দেহাংশ ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ব ইউক্রেনের দানিয়েৎস্ক শহর থেকে কিছু দূরে ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে।ওই অঞ্চলটি এখন রয়েছে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে, যারা অঞ্চলটিকে দানিয়েৎস্কায়া নারোদনায়া রিসপুবলিকা (দানিয়েৎস্ক পিপলস রিপাবলিক) হিসেবে ঘোষণা করেছে।ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগের তির নিক্ষেপ করেছে তাদের দিকেই।কিন্তু স্বঘোষিত দানিয়েৎস্ক রিপাবলিকের ‘প্রধানমন্ত্রী’ আলেকসান্দর বারাদোই সে অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘ওই বিমান লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপের ইচ্ছা আমাদের ছিল না, সে রকম সামর্থ্যও আমাদের নেই।’
কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য হালে পানি পাচ্ছে না।বিশেষত পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে তাদেরই দায়ী করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে যে বিমানটিকে মিসাইল নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করার সামর্থ্য তাদের আছে। আমেরিকান সামরিক গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে নিউইর্য়ক টাইমস লিখেছে, বিমানটিতে আঘাত হেনেছে এসএ-১১ নামের একটি মিসাইল, যা রাশিয়ার তৈরি।ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ও রাডার-নিয়ন্ত্রিত এই মিসাইলের দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ১৮ ফুট এবং তা ৭২ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু দিয়ে উড়ে যাওয়া লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, আর মালয়েশীয় বিমানটি উড়ে যাচ্ছিল ৩৩ হাজার ফুট ওপর দিয়ে। এসএ-১১ মিসাইল অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসমৃদ্ধ ওয়ারহেড বহন করে এবং তা ছোটে শব্দের বেগের চেয়ে তিন গুণ বেশি দ্রুতবেগে।এটি নিক্ষেপ করার জন্য বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যা কেবল রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীগুলোর সদস্যদের থাকে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, এই মিসাইল রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কাছে যেমন আছে, তেমনি আছে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভান্ডারেও।পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছেও এগুলো আছে। তারা এ রকম দাবি করছে মার্কিন গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। গোড়া থেকেই মার্কিন কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে আসছে, ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে রাশিয়া। কিন্তু তারা বলছে না যে ইউক্রেনের রুশবিদ্বেষী উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর কাছেও এই মিসাইল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং এ ঘটনা তাদের দ্বারাও ঘটে থাকতে পারে। এ ঘটনার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন পক্ষের সংশ্লিষ্টদের জানা ছিল যে পূর্ব ইউক্রেনের রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধাদের কাছে আছে ম্যানপ্যাড নামে পরিচিত একধরনের মিসাইল, যা কাঁধে রেখে নিক্ষেপ করা যায়। এই মিসাইল সর্বোচ্চ ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।সে কারণে ওই অঞ্চলের সব ধরনের আকাশযান চলাচল করছিল ১২ হাজার ফুটের ওপর দিয়ে।
কিন্তু গত সপ্তাহে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী একটি আন্তনোভ-২৬ বিমান ২১ হাজার ফুট উঁচু থেকে ভূপাতিত করলে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে তাদের হাতে আরও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইল আছে। তখন ইউক্রেন সরকার নিরাপদ আকাশসীমা নির্ধারণ করে দেয় ৩২ হাজার ফুট উচ্চতা।রাশিয়াও ঘোষণা করে যে এখন থেকে তাদের সব ধরনের আকাশযান ইউক্রেনের ওই অঞ্চল পার হবে ৩২ হাজার ফুটের বেশি উঁচু দিয়ে। যদিও এই উচ্চতা বেসামরিক যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য প্রযোজ্য ছিল না, তবু মালয়েশিয়ার বিমানটি ওই অঞ্চল অতিক্রম করতে যাচ্ছিল আরও এক হাজার ফুট উঁচু দিয়ে। তা সত্ত্বেও যখন বিমানটি মিসাইলের আঘাতে ধ্বংস হলো, তখন আমেরিকানরা দাবি করতে লাগল যে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে এখন এসএ-১১ মিসাইল আছে। ঘটনাটির অল্প পরেই ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করে গোপনে আড়ি পেতে রেকর্ড করা দুটি টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ করে। রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী এক যোদ্ধা ও রাশিয়ার একজন সামরিক কর্মকর্তার মধ্যে এক সংলাপে এক বিচ্ছিন্নতাবাদীকে রুশ ভাষায় বলতে শোনা যায়, ‘আমরা এইমাত্র একটা এএন-২৬ বিমান ভূপাতিত করেছি।’ উল্লেখ্য, এএন-২৬ বিমান আছে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর। আরেক টেলিফোন সংলাপে শোনা যায়, দুই রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী রুশ ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে রাশিয়ার এসএ-১১ মিসাইল নিয়ে, যেটি পাঠানো হয়েছে মালয়েশীয় বিমানটি আক্রান্ত হওয়ার অল্প সময় আগেই। আমেরিকান গোয়েন্দা সদস্যরা বলেছেন, এ দুটি টেলিফোন সংলাপের সত্যতা নিয়ে তাঁদের কোনো সন্দেহ নেই। যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে, ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ওই মালয়েশীয় বিমানটিকে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর বিমান মনে করে মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল।
উল্লেখ করা যেতে পারে, মালয়েশীয় বিমানটি যে পথে উইক্রেনের আকাশসীমা অতিক্রম করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে, ওই একই পথে জার্মানির লুফথানসা, হল্যান্ডের কেএলএম, থাই এয়ারওয়েজসহ আরও অনেক দেশের বিমান সংস্থার বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল করছিল। কিন্তু অন্য সব বিমান বাদ দিয়ে হামলাকারীরা কেন মালয়েশীয় বিমানটিকে বেছে নিয়েছিল, তার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমগুলোর কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারে সুবিধা হয়েছে। মস্কো থেকে রুশ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ‘রাশিয়া ২৪’-এর বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি লিখেছে, ঘটনাটি আসলে ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে হত্যা করার ব্যর্থ প্রয়াস। মালয়েশীয় বিমানটি যে সময় ও যে আকাশপথ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নিয়ে একটি জেট বিমানও সেই সময়ে একই আকাশপথে লাতিন আমেরিকা থেকে মস্কো ফিরছিল। মালয়েশীয় বিমানটির পাখায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের যে লোগো আছে, তা নাকি দূর থেকে দেখতে রুশ ফেডারেশনের তিন রঙা পতাকার মতোই। এই জল্পনাকে জোরালো করতে ওই টিভি চ্যানেল থেকে ইউক্রেনের সাবেক উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিরক্ষামন্ত্রী আনাতোলি গ্রিৎসেনকোর একটা পুরোনো উক্তির ফুটেজ পুনঃপ্রচার করা হয়, যেটিতে তিনি বলেন, ‘কারও উচিত পুতিনকে হত্যা করা।’ কিন্তু এসব জল্পনা-কল্পনা প্রচার করে ক্রেমলিন খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। পুতিনসহ রুশ নেতৃত্ব বড়ই বেকায়দায় পড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার সকালেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পুতিনকে ফোন করে প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলেছেন। রাশিয়া ইউক্রেনের রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে—এই অভিযোগ তিনি পুতিনের মুখের ওপর সরাসরি করেছেন। তারপর আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নতুন অবরোধ আরোপ করেছে। এটা সাধারণভাবে বোধগম্য যে এই রোমহর্ষক ঘটনা যারাই ঘটাক, শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার ওপরই দায় বর্তানোর কথা। ইউক্রেনের সরকার,
সামরিক বাহিনী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর এটা ভালো করে জানা ছিল। তবে তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেছে, এটা মনে হয় না। রাশিয়া ও রুশপন্থী ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে তাদের আচরণ আক্রমণাত্মক নয়, বরং বেশ রক্ষণাত্মক। রুশবিদ্বেষী ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মাথাগরম কিছু লোক যদিও আছে, তবু এটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না যে তারা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে হত্যা করার কথা ভাবতে পারে। রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরও অজানা থাকার কথা নয় যে এ ঘটনার জন্য বিশ্ববাসী অভিযোগের আঙুল তাক করবে ক্রেমলিনের দিকেই। ঘটনা ঘটার পরে নয়, আগে থেকেই জানা থাকার কথা। আর ক্রেমলিনের উপলব্ধি সম্ভবত সবচেয়ে প্রবল। এ ঘটনা ঘটার পরপরই প্রেসিডেন্ট পুতিন পূর্ব ইউক্রেনে সহিংসতা বন্ধ করার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্তের কাজে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দলকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। কিন্তু ২৯৮টি নিরীহ প্রাণ ঝরে পড়ার মধ্য দিয়ে যে ক্ষতি হয়ে গেছে, তা আর কোনো কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়। বিমানটির ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা গেছে বলে খবরে প্রকাশ। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনার তদন্ত করছে। আসলে কী ঘটেছে, কাদের দ্বারা কীভাবে ঘটেছে তা হয়তো সব তদন্তের পরে জানা যাবে। নানা যুক্তি বিবেচনা করে এমন অনুমান করা যায় যে ঘটনাটি রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারাই ঘটে থাকতে পারে এবং সেটা ভুলবশত। তারা ইউক্রেনীয় সামরিক বিমান ভেবেই যাত্রীবাহী মালয়েশীয় বিমানটি লক্ষ্য করে মিসাইল ছুড়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই অনুমানই যেন সত্য হয়। তাহলে এই ট্র্যাজেডির একটা ব্যাখ্যা মিলবে, যদিও সেই ব্যাখ্যায় এ ঘটনার দুর্বহ দুঃখভার লাঘব হওয়ার নয়।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@prothom–alo.info
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@prothom–alo.info
No comments