রাষ্ট্র ও শিক্ষা- উচ্চশিক্ষায় নানামুখী সংকট by আবদুল মান্নান
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজ হাতে
‘শ্রদ্ধেয় স্যার’ লিখে ‘খ্যাতিমান শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট
ব্যক্তিদের’ নিয়ে সম্প্রতি একটি সভা আহ্বান করেছিলেন তাঁর মন্ত্রণালয়ে।
সেই সভায় অন্যদের সঙ্গে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। মন্ত্রিসভায় যে কজন
যোগ্য ও সৎ মন্ত্রী আছেন, তাঁদের মধ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ একজন। ইদানীং
লক্ষ করেছি, একধরনের সমালোচক আছেন, তাঁরা দাবি করেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ বা
মতিয়া চৌধুরী শতভাগ খাঁটি আওয়ামী লীগার নন, তাই তাঁদের স্থলে ‘শতভাগ’
খাঁটি আওয়ামী লীগার বসানো উচিত। তাঁরা ভুলে যান যে অযোগ্য ও অপদার্থ
‘শতভাগ’ খাঁটি আওয়ামী লীগার দেশের ও দলের দুই শ ভাগ ক্ষতি করতে পারেন, যার
উৎকৃষ্ট উদাহরণ নারায়ণগঞ্জ অথবা ফেনী।
আগের লেখায় আমি কেন নারায়ণগঞ্জ নিয়ে কিছু উল্লেখ করিনি, তার জন্য অনেকে সমালোচনার নামে আমাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন। তাঁদের বোঝা উচিত, আক্রমণ আর সমালোচনা এক জিনিস নয়। যাক, সেটি অন্য প্রসঙ্গ। সময়মতো সেই সভায় উপস্থিত হয়ে কিছুটা বিস্মিত হই, কারণ কদাচিৎ কোনো সভায় এত বিশিষ্টজনের উপস্থিতি দেখেছি। যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই রাজনীতিরও তেমন সম্পর্ক নেই। অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক অনুপম সেন, অধ্যাপক হারুন উর রশিদ, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, লেখিকা সেলিনা হোসেন—কেউ বাদ যাননি।
তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন সময় সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করেন। কদিন আগে অনুজপ্রতিম মুহম্মদ জাফর ইকবাল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ করেছেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, শিক্ষামন্ত্রী এই সভা সম্ভবত এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আহ্বান করেছেন। সভায় উপস্থিত থেকে বুঝতে পারলাম, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হলেও শিক্ষার অন্য দিকগুলোও বাদ যায়নি। অভিজ্ঞতা বলে, সব আওয়ামী লীগ সরকারই শিক্ষাবান্ধব ছিল। প্রাইমারি শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলেজ, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন, কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে প্রায় ৩১ কোটি বই স্কুলশিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া—এসব কাজই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়েছে। তবে কেউ যদি মনে করেন যে এই কাজগুলোর সবটাই শতভাগ সঠিকভাবে হয়েছে, তাহলে তা সত্যের অপলাপ হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সরকারের সদিচ্ছা ছিল কি না।
সেদিন শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হলেও সব বিষয়ে স্বল্প পরিসরে পত্রিকার পাতায় আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, কারণ এই পর্যায়ে শিক্ষার সঙ্গে আমি নিজে চার দশকের বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত। সেটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন দেশে শুধু ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, যার মধ্যে বিশেষায়িত ছিল দুটি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি নয়। বর্তমানে দেশে ৩৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এ ছাড়া দেশের গাজীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এবং চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন নামে দুটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনের (বিমক) ২০১২ সালের হিসাবমতে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এক লাখ ৯৭ হাজার ২৭৮ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ৫৫ শতাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদে)। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার যে চরম সংকট চলছে, তা নিয়ে সেদিন কিছু আলাপ হলেও তা অসম্পূর্ণ ছিল৷ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার সংকট সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উভয় ক্ষেত্রেই প্রকট।
একটা সময় ছিল, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চাইতেন। সেটি এখন আর হয় না, কারণ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যে বেতন পান, তা অনেক ক্ষেত্রে একজন গাড়িচালকের বেতনের চেয়েও কম। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর জন্য তাঁর সহকর্মীরা এক দিনের বেতন দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে একটি পা হারিয়েছেন। তাঁর একটি কৃত্রিম পা সংযোজন করতে প্রায় এক লাখ টাকার প্রয়োজন। অর্থ–সহায়তা চেয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বরাবর আবেদন জানিয়ে অপেক্ষা করছেন। প্রায় সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল আছে, নেই শুধু বাংলাদেশে। অন্য শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কারণ, তাঁরা মানুষ গড়ার কারিগর।
সম্প্রতি এডিবি প্রকাশিত জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সূচকের তলায় আছে বাংলাদেশ। আমাদের নিচে মিয়ানমার। এই সূচক আমাদের মানবসম্পদের মানের অবস্থা নির্ণয় করে। বাংলাদেশে অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এক হাজার ৬৮৭টি কলেজ আছে, যার অনেকগুলোতেই মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষাদান করা হয়, কিন্তু এসব কলেজে না আছেন কোনো উন্নত মানের শিক্ষক, না আছে কোনো গ্রন্থাগার অথবা পরীক্ষাগার। আমার সুযোগ হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন পর্যায়ে মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে বসতে। গড়ে সেখানে যে মানের প্রার্থীরা হাজির হন, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। শিক্ষার্থীদের এই অজ্ঞতার দায়ভার তো তাঁদের নয়; বরং তাঁদের শিক্ষকদের তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। শিক্ষক না শেখালে শিক্ষার্থী কোথা থেকে শিখবে? এসব কলেজের অধিকাংশই বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। আবার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত মানের শিক্ষক না পাওয়ার কারণ অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অথবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কতিপয় শিক্ষক। এই শিক্ষকদের অনেকেই নির্বাচনী বোর্ডে অথবা বিভাগের পরিকল্পনা কমিটিতে থাকেন। তাঁদের সব সময় চেষ্টা থাকে, কীভাবে তাঁদের অনুগত একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিভাগের বারোটা বাজানো যায়। এ রকম একাধিক শিক্ষককে প্রায়ই দেখি বিভিন্ন টিভির টক শোতে জাতিকে নসিহত করছেন।
অন্যদিকে আছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পৌনঃপুনিক বাজেট বরাদ্দে সব সরকারেরই ভয়াবহ কৃপণতা। গত ৪০ বছরে এই পর্যায়ে বরাদ্দের পরিমাণ শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দের এক ভাগের বেশি কখনো হয়নি। সরকার বলে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হবে। তা কী উপায়ে সম্ভব, তা বলা হয় না। কোনোভাবেই ছাত্রদের বেতন বাড়ানো সম্ভব নয়। দুই টাকা বাড়ানোর চেষ্টা করা হলে উপাচার্যের জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। একশ্রেিণর ছাত্র মনে করেন, শিক্ষা কোনো দান নয়, তাঁদের অধিকার। কিন্তু এই কথাটি প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি শিক্ষার বেলায় শতভাগ সত্য, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নয়৷ উচ্চশিক্ষা সব সময় নির্বাচিতদের জন্য। সরকারের উচিত কারিগরি শিক্ষায় যতটুকু সম্ভব ভর্তুকি দিয়ে সেই শিক্ষাকে উৎসাহিত করা আর যাঁরা মেধাবী কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ার মতো সক্ষমতা নেই, তাঁদের নিখরচায় পড়ার সুযোগ করে দেওয়া। যে ছাত্রটি পকেটে অর্ধলক্ষ টাকার স্মার্টফোন নিয়ে ঘোরেন, তাঁকে কেন ২০ টাকা মাসিক বেতনে পড়তে দিতে হবে?
এ তো গেল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা। গত দুই দশকে দেশে ৭৯টি বেসরকারি পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এটি ভালো লক্ষণ৷ তবে এখানের সমস্যাগুলো ভিন্নমাত্রার। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সত্যিকার অর্থেই সার্টিফিকেট-বাণিজ্য করে, কিন্তু তাদের আইনের আওতায় আনার সক্ষমতা বিমকের নেই। এই ঢাকা শহরেই একাধিক হাইপ্রোফাইল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, বাজারে যাদের প্রচুর ‘সুনাম’। কিন্তু কজনে জানেন এগুলোর অনেকটাই ‘ওপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট’? এ অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী এগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা, যাঁরা একটি মুদি দোকান আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অক্ষম। তবে এসবের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বেশ কটি মানসম্পন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তা স্বীকার করতেই হবে।
সরকার ২০১০ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করেছে। তার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু এই আইনে অনেক অসংগতি রয়েছে। বাংলাদেশে জমির পরিমাণ যেখানে এমনিতে কম, সেখানে বলা হয়েছে যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য এক একর অখণ্ড জমি থাকতে হবে। এটি একেবারেই একটি অপ্রয়োজনীয় ধারা। বিশ্বের সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র অনুপাতে বর্গফুট মাপা হয়, জমির পরিমাণ নয়। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় তাঁর সঙ্গে জাপানের দ্বিতীয় পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওসাদায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ হাজার ছাত্র আর সাড়ে ছয় হাজারের ওপরে শিক্ষক আছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, কোনো এক একর জায়গার ওপর নয়। সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশে বৈষম্যমূলক শর্তে শাখা ক্যাম্পাস অথবা কোচিং সেন্টার খোলার অনুমতি দিয়েছে। এটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে। এসব বিষয়ে সেদিনের সভায় কম-বেশি আলোচনা হয়েছে৷ তবে তা কতটুকু ফল বয়ে আনবে, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর সরকারের ওপর নির্ভর করে।
শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন থাকবে, তাঁর সেদিনের ডাকা সভাটি যেন নিষ্ফল না হয়, সেদিকে তিনি লক্ষ রাখবেন।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments