রংপুর- পরিকল্পনাহীন উন্নয়নকাজ by তুহিন ওয়াদুদ
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে রংপুর
পৌরসভার মর্যাদা লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি
অনুযায়ী সরকার ২০১২ সালের ২৮ জুন রংপুরকে সিটি করপোরেশনের মর্যাদা দিয়ে
প্রজ্ঞাপন জারি করে। সিটি করপোরেশনের প্রজ্ঞাপন জারির দিন রংপুরে শুধু
মিষ্টি উৎসবই হয়নি, সেদিন শহরজুড়ে আনন্দের বন্যায় ভেসেছিলেন রংপুরবাসী।
গত দুই বছরে সেই আনন্দ হতাশায় রূপ নিতে চলেছে।
নির্বাচিত নগরপিতা শরফুদ্দীন আহমেদ গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে প্রায় ছয় মাস প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হাসান আহমেদ। চলতি জুন মাসে রংপুর সিটি করপোরেশন দুই বছর পূর্ণ করছে। রংপুর বিভাগ এবং সিটি করপোরেশন হওয়ার কারণে রংপুরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু জীবনযাত্রার মান বাড়েনি। রংপুরে পৌরসভা ছিল ৫০ বর্গকিলোমিটারের। সিটি করপোরেশন হয়েছে ২০৭ বর্গকিলোমিটারের। দুই বছরেও এই সিটি করপোরেশনের অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত হয়নি। জনবলকাঠামোসহ অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়নি। ফলে সিটি করপোরেশন চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. গোলাম কবির ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘পৌরসভার আদলেই চলছে সিটি করপোরেশন এবং বৃহৎ পরিসরের নাগরিক সুবিধা দিতে গিয়ে পুরোনো পৌরসভার সুযোগ-সুবিধাও ব্যাহত হচ্ছে।’
রংপুর বিভাগ ঘোষণার পর শহরের সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করার কাজ শুরু হয়েছে প্রায় তিন বছর। এখন পর্যন্ত সেই সড়কের কাজ শেষ হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতেই এখন অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা যায়। সড়কের দুই ধারে অসংখ্য প্রাচীন গাছ ছিল। সড়ক সম্প্রসারণের জন্য সেই গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। গত তিন বছরে সেই গাছ আর লাগানো হয়নি। প্রধান সড়কগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ সড়ক বিভাগের হওয়ার কারণে সিটি করপোরেশন নগরের ছোট ছোট সড়কে ১১ হাজার গাছ রোপণ করলেও প্রধান সড়কগুলোতে কোনো গাছ রোপণ করতে পারছে না। অথচ যেকোনো বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দিলেই গাছ লাগানো সম্ভব।
সিটি করপোরেশনের অবস্থা জানার জন্য সম্প্রতি গিয়েছিলাম নগরপিতার কার্যালয়ে। তিনি রংপুরকে নিয়ে তঁার অনেক স্বপ্নের কথা শোনালেন; বললেন, রংপুরকে অচল করে দিয়ে হলেও রংপুরের মানুষের জন্য তিনি সরকারকে গ্যাস দিতে বাধ্য করবেন। কিন্তু নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে তঁার কণ্ঠে শোনা গেল কিছুটা হতাশার সুর। ২০৭ বর্গকিলোমিটারের রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান করার কাজ প্রায় চূড়ান্ত। সেই মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি। সিটি করপোরেশনে চারটি নতুন থানা হবে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী যেখানে থানাগুলোর জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে সেগুলো হচ্ছে না বলে জানালেন তিনি। একই সঙ্গে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অধিকাংশ কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না বলেও তঁার আশঙ্কা।
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক বছর তিন মাসের মধ্যে এই সিটি করপোরেশন ১৪৮টি সড়ক এবং ৩৭টি ড্রেনের কাজ করেছে। নতুন অর্থবছরে আরও অনেক কাজের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন নগরপিতা। বেসরকারি সংস্থা জাইকা নগর উন্নয়নে বৃহৎ কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তারা প্রায় ২৯১ কোটি টাকার কাজ করার জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। নগরপিতার ভাষ্য অনুযায়ী এই অর্থ পঁাচ কোটিও হতে পারে। জাইকার কাজের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, তারা মূল শহরে ৮২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে তাদের উন্নয়ন-পরিধি সীমাবদ্ধ রেখেছে। অবশিষ্ট অংশে উন্নয়ন হবে না। অথচ এই এলাকাগুলোতে উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি জরুির। অনেক এলাকায় সড়ক কঁাচা, সড়কবাতি নেই, পল্লী বিদ্যুৎ দিনের অধিকাংশ সময়ে থাকে না। এদিকে নতুন এলাকাগুলোতে নাগরিক সুবিধা দিতে না পারার কারণে কর্তৃপক্ষ নতুন কর আরোপও করতে পারছে না। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রংপুর ওয়াসা গড়ে ওঠেনি।
নগর ভবনের জন্য এখনো স্থান নির্দিষ্ট হয়নি। নগর ভবনের জন্য উপজেলা পরিষদ ব্যবহার করতে চাইলেও সরকারের অনিচ্ছার কারণেও তা সম্ভব হয়নি। পৌরসভাকালীন মোট ২০ জন কাউন্সিলর ছিলেন। বর্তমানে সেই সংখ্যা ৪৪ জনে উন্নীত হয়েছে। তঁাদের এখনো মানসম্মত কার্যালয় নিশ্চিত করা যায়নি; সে কারণে নগর ভবন গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
মেয়রের সঙ্গে কথা বলে একটি বিষয় পরিষ্কার, নগরের কাজ বাস্তবায়নে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। রংপুর জেলা প্রশাসন ও নগর প্রশাসন উভয়ের মধ্যে সমন্বয় বিধান করা অতি জরুরি। একই শহরে সমন্বয়হীনভাবে দুই প্রশাসন কাজ করলে তার পরিণতি কখনোই ভালো হতে পারে না। সে জন্য রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য যে মাস্টারপ্ল্যান করা হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত উভয়ের সম্মতিতে। তঁাদের অবশ্যই রংপুরবাসীর সুবিধা–অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে৷ একটি পরিকল্পিত নগর গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। রংপুর নগরের উন্নয়ন নিয়ে নগরপিতার আগ্রহের কমতি না থাকলেও সমন্বয়হীনতা রংপুরকে অনেকখানি পিছিয়ে দেবে। রংপুরে একটি জনসভায় এখানকার উন্নয়নের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নগর প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে যেন এই উন্নয়নচেষ্টা কিছুতেই ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে রংপুরের মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। সরকারের দৃষ্টিও রাখা চাই রংপুরকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর৷
No comments