আমার জামান ভাই by শাহাবুদ্দীন নাগরী
১৯৭৮
সালে পরিচয়ের সূত্রটা যে এত দীর্ঘ হবে তা আমি ভাবতেই পারিনি। অনার্সপড়ুয়া
একটি ছাত্রকে তিনি পরম আদরে ডেকে নিয়ে বসিয়েছিলেন তার চট্টগ্রামের বাংলাদেশ
পরিষদের অফিস কামরায়। তিনি তখন ডাকসাইটে অফিসার। তারপর সদ্য প্রকাশিত তার
অনূদিত গ্রন্থ ‘হাড়কিপটে বুড়ী’র একটি কপিতে আমার নাম লিখে স্বাক্ষর করে
তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে। সেই যে বন্ধন, তারপর কত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গেছে
আমাদের জীবনে, তা আর ছিন্ন হয়নি। ছিন্ন হল এই ১২ জুন ২০১৪ তারিখে সন্ধ্যায়
তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিটি আর কেউ নন, আমার অতি
প্রিয়জন ফখরুজ্জামান চৌধুরী (১৯৪০-২০১৪)। আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০),
আবিদ আজাদ (১৯৫২-২০০৪)সহ অনেকেই তাকে ডাকতেন ‘ফখরু ভাই’ বলে, শুধু তার
সমবয়সী-অসমবয়সী বন্ধুদের ভেতর আমিই ডাকতাম ‘জামান ভাই’ বলে। আমার দেখাদেখি
অনেকেই তাকে পরে জামান ভাই নামে সম্বোধন করা শুরু করেছিলেন। আশ্চর্যজনক
হলেও সত্য, পরিচয়ের সেই প্রথম দিন থেকেই তিনি আমাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন।
কারণটা আমার অজানাই থেকে গেল। ছেলেটির হাতে তার স্বাক্ষরিত বইটি তুলে দিয়ে
বলেছিলেন, ‘আপনি তো সাহিত্যিক, বইটি পড়ে আপনার মতামত জানাবেন।’ এতদিন পর
আমি আর মনে করতে পারি না বইটি পড়ে তাকে মতামত জানিয়েছিলাম কি না, কিন্তু
সেই সূত্রেই যে চট্টগ্রামের বাংলাদেশ পরিষদের লাইব্রেরিটিতে যাওয়া, ব্যবহার
করা এবং তার সঙ্গে দেখা করে এক কাপ চা খেয়ে আসা আমার প্রায় রুটিনের মতো
হয়ে গিয়েছিল তা স্পষ্ট মনে আছে। জামান ভাই ছিলেন আমার চেয়ে প্রায় ষোল বছরের
বড়, কিন্তু কীভাবে যেন এই অসম বয়সের দুটি মানুষের মধ্যে গভীর সখ্য গড়ে
উঠেছিল। দীর্ঘসময় তিনি বাংলাদেশ পরিষদ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আবাসিক পরিচালক
ছিলেন, পরিষদ বিলুপ্তির পর সেখান থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে যান ১৯৮২ সালের দিকে।
শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কীটতত্ত্বে থিসিস করার কারণে তার দফতরে যাওয়া হতো কম, আমি সকাল-সন্ধ্যা ক্যাম্পাসে থাকায় এক সময় তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হলেও পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝেই তার লেখা দেখতাম। চমৎকার সব অনুবাদ করতেন, গল্প লিখতেন। আমরা যারা কবিতাপাঠক তারা অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদ কবিতা পড়ে মজা পাই না, কিন্তু জামান ভাইয়ের অনুবাদ করা কবিতা পড়ে আমরা মূল কবিতার স্বাদ-গন্ধ-নির্যাস অনুভব করতে পারতাম। এক অসাধারণ মেধাবী মানুষ ছিলেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করলেও ইংরেজিতে তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়। চমৎকার ইংরেজি লিখতে পারতেন। ভালো ইংরেজি না জানলে বাংলায় ভালো অনুবাদ করা যায় না এটা তো চিরন্তন সত্য। কত কত বিখ্যাত বই অনুবাদ করেছেন জীবনজুড়ে তা তার গুণমুগ্ধ পাঠকরাই বলতে পারবেন ভালো। মৌলিক সাহিত্য রচনায়ও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। ভালো কবিতাও লিখতেন এক সময়।
জামান ভাই আমার খুব কাছে থেকে দেখা একজন মানুষ। তার জীবনের অনেক কথিত-অকথিত অধ্যায়ের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত। প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া বন্ধনের সূত্রটি আবার জোড়া লাগে ১৯৮৯ সালে আমি চাকরিসূত্রে ঢাকায় চলে আসার পর। তখন আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ মিলে আমরা বের করছি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘শিল্পতরু’। সোনারগাঁও রোডে শিল্পতরু’র অফিস। রোজ বিকালে আড্ডা বসত ওখানে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক তখন রেজোয়ান সিদ্দিকী। এক বিকালে রেজোয়ান সিদ্দিকীকে একটা লেখা দিতে দৈনিক বাংলা অফিসে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তার মুখোমুখি বসে আছেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি তার পেছনে ছিলাম বলে। রেজোয়ান ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘চেনেন নাকি উনাকে? বিখ্যাত অনুবাদক এবং সাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরী।’ আমি ঘাড় কাত করে তাকে দেখে সালাম দিই, উচ্ছ্বসিত হই, তিনিও বোধহয় ভেতরে ভেতরে আনন্দিত হয়েছিলেন। কেননা, রেজোয়ান ভাইয়ের হাতে লেখাটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে তিনি বলেছিলেন, ‘চলেন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।’ সিনিয়রদের সামনে বরাবরই আমি সংকুচিত থাকি, যতক্ষণ না তিনি সংকোচের দ্বারটা ছিঁড়ে ফেলেন। অনেক বছর পর দেখা আমাদের, কোথায় কী করছি পর্ব শেষ হল স্বাভাবিক নিয়মে। আমি তখন থাকি হাতিরপুলে বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আবদুল্লাহ্ আল মুতীর (১৯৩০-৯৮) ভাড়াটিয়া হিসেবে, জামান ভাই থাকতেন ভূতের গলিতেই, ভাবী দিলারা জামানের পৈত্রিকসূত্রেপ্রাপ্ত বাসায়। আমরা শিল্পতরু’তে নিয়মিত আড্ডা দেই, সুযোগ পেলে তিনিও যেন আসেন এমন অনুরোধ করায় তিনি বলেছিলেন, ‘দেখি, আসব।’
আমাদের আড্ডার নিয়মিত সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন জামান ভাই। তখন তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরিচালক (প্রশাসন), শাহবাগের বেতার ভবনে বিটিভি’র অফিসে বসতেন। বিকালে বাসায় ফিরেই এসে জুটতেন আমাদের আড্ডায়। রাত ন’টার আগে কোনোদিন উঠতেন না। ‘শিল্পতরু’ ছিল একটি উদারপন্থী পত্রিকা, আমরা সেভাবেই পত্রিকাটির চরিত্র নির্মাণ করেছিলাম। সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল ‘শিল্পতরু’র পাতা। এমন একটি পত্রিকা পেয়ে জামান ভাই হয়ে ওঠেন ‘শিল্পতরু’র নিয়মিত লেখক এবং উপদেশক। ওই সময়ের কোনো লেখক এই পত্রিকার আড্ডায় আসেননি, তা ছিল রীতিমতো বিরল। ১৯৯১ সালের শেষদিকে কবি আল মাহমুদ উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে পাক্ষিক ‘পালাবদল’ প্রকাশ শুরু করলে জামান ভাই এই পত্রিকায় লিখেছিলেন তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিক উপন্যাস ‘ঐরাবত ও অঙ্কুশ’। ‘পালাবদল’ নিয়মিত লেখার ব্যাপারে আমি তাকে জোর তাগাদা দিলে তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন, যা পরে বই আকারে প্রকাশ (১৯৯৩) করে মঈনুল আহসান সাবেরের ‘দিব্য প্রকাশ’। এই আড্ডার সূত্রেই আমি আর জামান ভাই খুব কাছাকাছি চলে আসি। সাহিত্যের গণ্ডি থেকে আমাদের সম্পর্ক এসে নামে পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে। আমরা প্রায় শুক্রবার সকালে তখন নিউমার্কেটের ‘প্রকাশ ভবন’-এ গিয়ে অতিরিক্ত আড্ডা দেয়া শুরু করি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, পারিবারিক-সামাজিক বিষয়-আশয়, দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব নিয়ে আমাদের আলোচনা কোথায় যে শুরু হতো আর কোথায় যে শেষ হতো তার ঠিক-ঠিকানা থাকত না। আমরা টেলিফোনে কথা বলা শুরু করলে কখনও কখনও ঘণ্টাও পেরিয়ে যেত।
তার প্রিয় মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কেন এই মানুষটি তার প্রিয় ছিল সে কথা বহুবার বলেছেন। আনিসুজ্জামান স্যারের মনে আছে কি না জানি না, একবার একটি টিভি চ্যানেল তার আর দিলারা জামান ভাবীর সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। অনুষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠান থেকেই একজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে উপস্থাপক উপস্থিত দম্পতির সম্পর্কে জানতে চাইতেন সেই প্রিয় মানুষটির কাছে। প্রিয় মানুষটি আগেই ঠিক করা থাকত। জামান ভাই নাম দিয়েছিলেন আনিস স্যারের। আনিস স্যার তার বিমুগ্ধ বাচনভঙ্গিতে চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন জামান ভাই এবং দিলারা ভাবী সম্পর্কে। তার প্রিয় বন্ধুদের আরেকজন ছিলেন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-৮৯)। হেনা স্যার যখন মারা যান জামান ভাই তখন সরকারি সফরে মালয়েশিয়ায়। তাদের জীবনের অনেক ঘটনা তিনি আমাকে বলেছিলেন নিঃসঙ্কোচে। হেনা স্যারের অকালমৃত্যু তাকে অত্যন্ত শোকাহত করেছিল।
তার বন্ধুর সংখ্যা মোটেও কম ছিল না, কিন্তু শেষদিকে এসে এখন বুঝতে পারি আমাকে তিনি হয়তো সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন, আমার ফোন পেলে যত কষ্টই হোক কথা বলতেন, আমার উপস্থিতি তাকে উজ্জ্বল করে তুলত। কিন্তু জীবনের পথ পরিক্রমায় নানা টানাপোড়েনে আমি যে তাকে সময় দিতে পারিনি, সে কথা মনে হলে এখন কষ্টই হয়। আমেরিকায় থিতু হওয়ার জন্য দু’বার গিয়েছিলেন আমেরিকা। কিন্তু শরীর সায় দেয়নি। ফুসফুসের কষ্টে দীর্ঘকাল ধরে ভুগলেও শেষদিকে এসে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ওকলাহোমায় ছোট মেয়ের বাসা থেকে কয়েকবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন জীবনের। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ফিরে এসে বিদেশ যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়ে বহু আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। দু’দফায় আমেরিকায় থাকার সময় নিয়মিত লিখেছেন সাপ্তাহিক ২০০০-এ ‘আমেরিকার চিঠি’, বন্ধু ড. হারুন-উর-রশীদের তাগাদায় দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখেছেন ‘লেটারস্ ফ্রম ওকলাহোমা’। খুব কম লিখতেন জামান ভাই, কিন্তু যা লিখতেন তা ছিল সুপাঠ্য ও সুখপাঠ্য। জীবনের শেষদিকে এসে অভিমানের সুরে বলতেন, কী হবে লিখে? প্রায় ৫০টির বেশি বইয়ের গ্রন্থকার তিনি, প্রত্যেকটি বই মূল্যবান, অনেকগুলো বই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ দেশে কত রাম-শ্যাম-যদু-মধু অনুবাদ কর্মে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘরে তুলেছে, জামান ভাইকে সেটি পেতে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। জীবনে তদবির করেননি, লক্স্যচ্যুত হননি আদর্শ থেকে, বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন, ১৯৯৬ সালে তাকে বিটিভি থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেননি। স্ত্রী দিলারা জামানের সাফল্যে আনন্দিত হতেন, প্রবাসী মেয়ে আর মেয়েজামাইদের দিকে লক্ষ্য রাখতেন সব সময়, নাতি-নাতনিদের জন্য ছিল অফুরান ভালোবাসা। শয্যাশায়ী থেকেও প্রতিদিন যোগাযোগ রাখতেন আমেরিকা আর কানাডায়। মৃত্যুর ২০/২৫ দিন পূর্বে আমার সঙ্গে তার শেষ দেখা। এক বন্ধুসহ তার বাসায় গিয়েছিলাম এক বিকালে। কী যে খুশি হয়েছিলেন বলে বোঝানো যাবে না। কয়েক মাস আগে লাইফসাপোর্টে ছিলেন। বাসায় এসে একেবারে শয্যাশায়ী, উঠে বসতেও পারতেন না। নাকে অক্সিজেনের পাইপ থাকত সব সময়। কানে কম শুনতে পেতেন। সেদিন প্রায় দু’ঘণ্টা ছিলাম আমরা। উঠব উঠব করছিলাম, কিন্তু তিনি চা খেয়ে যেতে বললেন। আমরা চা খাব না বলায় বলেছিলেন, আপনারা খেলে আমিও এক কাপ খেতে পারি। আমরা চা খেয়েছিলাম শুধু তার জন্য। তাকে সারাক্ষণ দেখভাল করত যে ছেলেটি সে তাকে চামচে তুলে তুলে চা খাইয়ে দিয়েছিল। সেদিনও ভাবিনি তার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। মৃত্যু অনেক নির্মম, ভালোবাসা-স্নেহ আর বন্ধনের মূল্য বোঝে না। জামান ভাইকে হারিয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনের একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। মাফ করবেন জামান ভাই, আপনার মরদেহের সামনে দাঁড়াবার শক্তি আমার ছিল না।
শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কীটতত্ত্বে থিসিস করার কারণে তার দফতরে যাওয়া হতো কম, আমি সকাল-সন্ধ্যা ক্যাম্পাসে থাকায় এক সময় তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হলেও পত্র-পত্রিকায় মাঝে মাঝেই তার লেখা দেখতাম। চমৎকার সব অনুবাদ করতেন, গল্প লিখতেন। আমরা যারা কবিতাপাঠক তারা অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদ কবিতা পড়ে মজা পাই না, কিন্তু জামান ভাইয়ের অনুবাদ করা কবিতা পড়ে আমরা মূল কবিতার স্বাদ-গন্ধ-নির্যাস অনুভব করতে পারতাম। এক অসাধারণ মেধাবী মানুষ ছিলেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করলেও ইংরেজিতে তার দখল ছিল ঈর্ষণীয়। চমৎকার ইংরেজি লিখতে পারতেন। ভালো ইংরেজি না জানলে বাংলায় ভালো অনুবাদ করা যায় না এটা তো চিরন্তন সত্য। কত কত বিখ্যাত বই অনুবাদ করেছেন জীবনজুড়ে তা তার গুণমুগ্ধ পাঠকরাই বলতে পারবেন ভালো। মৌলিক সাহিত্য রচনায়ও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। ভালো কবিতাও লিখতেন এক সময়।
জামান ভাই আমার খুব কাছে থেকে দেখা একজন মানুষ। তার জীবনের অনেক কথিত-অকথিত অধ্যায়ের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত। প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া বন্ধনের সূত্রটি আবার জোড়া লাগে ১৯৮৯ সালে আমি চাকরিসূত্রে ঢাকায় চলে আসার পর। তখন আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ মিলে আমরা বের করছি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘শিল্পতরু’। সোনারগাঁও রোডে শিল্পতরু’র অফিস। রোজ বিকালে আড্ডা বসত ওখানে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক তখন রেজোয়ান সিদ্দিকী। এক বিকালে রেজোয়ান সিদ্দিকীকে একটা লেখা দিতে দৈনিক বাংলা অফিসে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তার মুখোমুখি বসে আছেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি তার পেছনে ছিলাম বলে। রেজোয়ান ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘চেনেন নাকি উনাকে? বিখ্যাত অনুবাদক এবং সাহিত্যিক ফখরুজ্জামান চৌধুরী।’ আমি ঘাড় কাত করে তাকে দেখে সালাম দিই, উচ্ছ্বসিত হই, তিনিও বোধহয় ভেতরে ভেতরে আনন্দিত হয়েছিলেন। কেননা, রেজোয়ান ভাইয়ের হাতে লেখাটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে তিনি বলেছিলেন, ‘চলেন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।’ সিনিয়রদের সামনে বরাবরই আমি সংকুচিত থাকি, যতক্ষণ না তিনি সংকোচের দ্বারটা ছিঁড়ে ফেলেন। অনেক বছর পর দেখা আমাদের, কোথায় কী করছি পর্ব শেষ হল স্বাভাবিক নিয়মে। আমি তখন থাকি হাতিরপুলে বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আবদুল্লাহ্ আল মুতীর (১৯৩০-৯৮) ভাড়াটিয়া হিসেবে, জামান ভাই থাকতেন ভূতের গলিতেই, ভাবী দিলারা জামানের পৈত্রিকসূত্রেপ্রাপ্ত বাসায়। আমরা শিল্পতরু’তে নিয়মিত আড্ডা দেই, সুযোগ পেলে তিনিও যেন আসেন এমন অনুরোধ করায় তিনি বলেছিলেন, ‘দেখি, আসব।’
আমাদের আড্ডার নিয়মিত সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন জামান ভাই। তখন তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের পরিচালক (প্রশাসন), শাহবাগের বেতার ভবনে বিটিভি’র অফিসে বসতেন। বিকালে বাসায় ফিরেই এসে জুটতেন আমাদের আড্ডায়। রাত ন’টার আগে কোনোদিন উঠতেন না। ‘শিল্পতরু’ ছিল একটি উদারপন্থী পত্রিকা, আমরা সেভাবেই পত্রিকাটির চরিত্র নির্মাণ করেছিলাম। সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল ‘শিল্পতরু’র পাতা। এমন একটি পত্রিকা পেয়ে জামান ভাই হয়ে ওঠেন ‘শিল্পতরু’র নিয়মিত লেখক এবং উপদেশক। ওই সময়ের কোনো লেখক এই পত্রিকার আড্ডায় আসেননি, তা ছিল রীতিমতো বিরল। ১৯৯১ সালের শেষদিকে কবি আল মাহমুদ উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে পাক্ষিক ‘পালাবদল’ প্রকাশ শুরু করলে জামান ভাই এই পত্রিকায় লিখেছিলেন তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিক উপন্যাস ‘ঐরাবত ও অঙ্কুশ’। ‘পালাবদল’ নিয়মিত লেখার ব্যাপারে আমি তাকে জোর তাগাদা দিলে তিনি উপন্যাসটি লিখেছিলেন, যা পরে বই আকারে প্রকাশ (১৯৯৩) করে মঈনুল আহসান সাবেরের ‘দিব্য প্রকাশ’। এই আড্ডার সূত্রেই আমি আর জামান ভাই খুব কাছাকাছি চলে আসি। সাহিত্যের গণ্ডি থেকে আমাদের সম্পর্ক এসে নামে পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে। আমরা প্রায় শুক্রবার সকালে তখন নিউমার্কেটের ‘প্রকাশ ভবন’-এ গিয়ে অতিরিক্ত আড্ডা দেয়া শুরু করি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, পারিবারিক-সামাজিক বিষয়-আশয়, দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব নিয়ে আমাদের আলোচনা কোথায় যে শুরু হতো আর কোথায় যে শেষ হতো তার ঠিক-ঠিকানা থাকত না। আমরা টেলিফোনে কথা বলা শুরু করলে কখনও কখনও ঘণ্টাও পেরিয়ে যেত।
তার প্রিয় মানুষ ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, কেন এই মানুষটি তার প্রিয় ছিল সে কথা বহুবার বলেছেন। আনিসুজ্জামান স্যারের মনে আছে কি না জানি না, একবার একটি টিভি চ্যানেল তার আর দিলারা জামান ভাবীর সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। অনুষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠান থেকেই একজন প্রিয় মানুষের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে উপস্থাপক উপস্থিত দম্পতির সম্পর্কে জানতে চাইতেন সেই প্রিয় মানুষটির কাছে। প্রিয় মানুষটি আগেই ঠিক করা থাকত। জামান ভাই নাম দিয়েছিলেন আনিস স্যারের। আনিস স্যার তার বিমুগ্ধ বাচনভঙ্গিতে চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন জামান ভাই এবং দিলারা ভাবী সম্পর্কে। তার প্রিয় বন্ধুদের আরেকজন ছিলেন ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (১৯৩৬-৮৯)। হেনা স্যার যখন মারা যান জামান ভাই তখন সরকারি সফরে মালয়েশিয়ায়। তাদের জীবনের অনেক ঘটনা তিনি আমাকে বলেছিলেন নিঃসঙ্কোচে। হেনা স্যারের অকালমৃত্যু তাকে অত্যন্ত শোকাহত করেছিল।
তার বন্ধুর সংখ্যা মোটেও কম ছিল না, কিন্তু শেষদিকে এসে এখন বুঝতে পারি আমাকে তিনি হয়তো সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন, আমার ফোন পেলে যত কষ্টই হোক কথা বলতেন, আমার উপস্থিতি তাকে উজ্জ্বল করে তুলত। কিন্তু জীবনের পথ পরিক্রমায় নানা টানাপোড়েনে আমি যে তাকে সময় দিতে পারিনি, সে কথা মনে হলে এখন কষ্টই হয়। আমেরিকায় থিতু হওয়ার জন্য দু’বার গিয়েছিলেন আমেরিকা। কিন্তু শরীর সায় দেয়নি। ফুসফুসের কষ্টে দীর্ঘকাল ধরে ভুগলেও শেষদিকে এসে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। ওকলাহোমায় ছোট মেয়ের বাসা থেকে কয়েকবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন জীবনের। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে ফিরে এসে বিদেশ যাওয়ার ভুল সিদ্ধান্তটি নিয়ে বহু আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। দু’দফায় আমেরিকায় থাকার সময় নিয়মিত লিখেছেন সাপ্তাহিক ২০০০-এ ‘আমেরিকার চিঠি’, বন্ধু ড. হারুন-উর-রশীদের তাগাদায় দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় ধারাবাহিক লিখেছেন ‘লেটারস্ ফ্রম ওকলাহোমা’। খুব কম লিখতেন জামান ভাই, কিন্তু যা লিখতেন তা ছিল সুপাঠ্য ও সুখপাঠ্য। জীবনের শেষদিকে এসে অভিমানের সুরে বলতেন, কী হবে লিখে? প্রায় ৫০টির বেশি বইয়ের গ্রন্থকার তিনি, প্রত্যেকটি বই মূল্যবান, অনেকগুলো বই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ দেশে কত রাম-শ্যাম-যদু-মধু অনুবাদ কর্মে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘরে তুলেছে, জামান ভাইকে সেটি পেতে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। জীবনে তদবির করেননি, লক্স্যচ্যুত হননি আদর্শ থেকে, বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন, ১৯৯৬ সালে তাকে বিটিভি থেকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হলে তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে দ্বিধা করেননি। স্ত্রী দিলারা জামানের সাফল্যে আনন্দিত হতেন, প্রবাসী মেয়ে আর মেয়েজামাইদের দিকে লক্ষ্য রাখতেন সব সময়, নাতি-নাতনিদের জন্য ছিল অফুরান ভালোবাসা। শয্যাশায়ী থেকেও প্রতিদিন যোগাযোগ রাখতেন আমেরিকা আর কানাডায়। মৃত্যুর ২০/২৫ দিন পূর্বে আমার সঙ্গে তার শেষ দেখা। এক বন্ধুসহ তার বাসায় গিয়েছিলাম এক বিকালে। কী যে খুশি হয়েছিলেন বলে বোঝানো যাবে না। কয়েক মাস আগে লাইফসাপোর্টে ছিলেন। বাসায় এসে একেবারে শয্যাশায়ী, উঠে বসতেও পারতেন না। নাকে অক্সিজেনের পাইপ থাকত সব সময়। কানে কম শুনতে পেতেন। সেদিন প্রায় দু’ঘণ্টা ছিলাম আমরা। উঠব উঠব করছিলাম, কিন্তু তিনি চা খেয়ে যেতে বললেন। আমরা চা খাব না বলায় বলেছিলেন, আপনারা খেলে আমিও এক কাপ খেতে পারি। আমরা চা খেয়েছিলাম শুধু তার জন্য। তাকে সারাক্ষণ দেখভাল করত যে ছেলেটি সে তাকে চামচে তুলে তুলে চা খাইয়ে দিয়েছিল। সেদিনও ভাবিনি তার সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। মৃত্যু অনেক নির্মম, ভালোবাসা-স্নেহ আর বন্ধনের মূল্য বোঝে না। জামান ভাইকে হারিয়ে আমার মনে হচ্ছে আমি আমার জীবনের একজন শ্রেষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছি। মাফ করবেন জামান ভাই, আপনার মরদেহের সামনে দাঁড়াবার শক্তি আমার ছিল না।
No comments