শুধু নির্বাচন সুশাসন নিশ্চিত করবে না by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক
পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। প্রধান সব দলের অংশগ্রহণ
ছাড়া অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হতে পারে না। দেশের প্রধান
রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম, মিডিয়া ও গণমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকার যত দ্রুত সম্ভব একাদশ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন
করবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পক্ষে জনগণের ভাষা
পড়া সম্ভব হলে তাঁরা তা অনুভব করতে পারতেন। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: জানুয়ারির নির্বাচন থামিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের
উন্নয়নের ধারা। (অর্থনীতি প্রতিদিন, ১২ জুন)
সব দলের অংশগ্রহণ ও অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বাধা হতে পারে নির্বাচনকালে সরকার–পদ্ধতি। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনের সময় দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। কিন্তু সংশোধিত সংবিধানে সেই সুযোগ নেই। সরকার সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি করে নিজেরাই প্রমাণ করেছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। ফলে বিএনপি ও অন্য দলগুলোর পক্ষে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ দাবি পরিত্যাগ করা এখন সম্ভব নয়। সর্বোপরি অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের একটি উক্তি বিএনপি ও অন্য দলের মধ্যে আরও ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন: ‘কোনো বৈধ পথে শেখ হাসিনাকে আর সরানো যাবে না।’ সৈয়দ আশরাফের এই উক্তি থেকে সন্দেহ হয়, ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেছে। এ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া বিএনপিসহ অন্যান্য দল সংসদ নির্বাচনে আগ্রহী হবে কি না সন্দেহ।
তবু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, অন্যান্য দল ও নাগরিক সমাজ নির্বাচনী সরকার নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে বলে আমরা আশা করি। সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। সমঝোতার ভিত্তিতে তা সংশোধন করা সম্ভব। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতও নির্দেশনা দিতে পারেন।
সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমাদের উদ্বেগ দেখে অনেকের মনে হতে পারে, নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান বলে মনে করি। না, আমরা তা মনে করি না। অর্থপূর্ণ নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি ধাপমাত্র। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমরা গণতন্ত্রের জগতে প্রবেশ করি। এরপর আরও বহু কাজ বাকি। আমরা চাই আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একটি ‘গণতন্ত্র সনদে’ একমত হয়ে স্বাক্ষর করুক। কারণ, গণতন্ত্রের অন্যান্য শর্ত মানা না হলে স্বৈরাচারের সঙ্গে তেমন পার্থক্য থাকে না। কোনো রাজনৈতিক দলকে (ও জোটকে) লুটপাটের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য অর্থপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করারও প্রয়োজন নেই। এক দিনের গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের মোহভঙ্গ হওয়া দরকার। বড় দলগুলো নির্বাচনকে খুব গুরুত্ব দেয়। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্য শর্তগুলো পূরণের ব্যাপারে তারা আগ্রহী নয়। তারা আগ্রহী শুধু সংসদ নির্বাচনে। কারণ, সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে তারা জাতীয় সংসদ, সরকারি প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে পকেটে ভরে ফেলতে পারে। সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কারও পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। সরকার এত শক্তিশালী যে সংবিধানকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। মোট কথা, বাস্তবতা হলো, সরকারের ওপরে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারই সব। এ দেশে বিজয়ী দলের হাতেই সবকিছু। উইনার্স টেক্স অল—এটা গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের এই বিকৃত মডেলকে পরিত্যাগ করতে হবে।
কাজেই আরেকটি নির্বাচনের আগেই আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। পরিচ্ছন্ন করতে হলে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোথায় কোথায় দুর্বলতা রয়েছে। শুধু রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঢুকে পড়েছে বললেও বড় কাজ হবে না। বড় কাজ হবে দুর্বৃত্তায়নের পথগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধানের পথ প্রস্তাব করা। এই দুর্বৃত্তায়নে বড় দলগুলো প্রায় সমানভাবে দায়ী, অংশীদার ও পৃষ্ঠপোষক।
দেখা যাক রাজনীতির কোন কোন জায়গায় সংস্কার করতে হবে। একটা চকিত চিন্তা হিসেবে আমরা কয়েকটি জায়গা চিহ্নিত করতে পারি৷ ১. নির্বাচনের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে৷ ২. নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা৷ ৩. রাজনৈতিক দলে গঠনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। দলের প্রতিটি কমিটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন বাধ্যতামূলক করা। একজন তিনবারের বেশি কোনো কমিটিতে কখনো থাকতে পারবেন না। দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি হবেন না। দুবারের বেশি এই পদে কেউ থাকবেন না। দলের কোনো কমিটিতে ১০ বছর কাজ না করলে তাঁকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। দলের গঠনতন্ত্র আরও নানাভাবে গণতন্ত্রায়ণ করা যায়। এই বিধিগুলো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখবে নির্বাচন কমিশন। ৪. জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা, বিরোধী দলের নেতাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করা, যেমন প্রতি তিন মাসে একবার বিরোধী দলের নেতাকে তাঁর টিমসহ মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমন্ত্রণ৷ ৫. সংসদ অধিবেশন িস্পকারের অনুমতি ছাড়া বর্জন বন্ধ করা, সাংসদ নামে-বেনামে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না৷ সাংসদকে স্থানীয় সরকারের কাজে যুক্ত না রাখা৷ ৬. হরতাল না করার ব্যাপারে একমত হওয়া৷ ৭. সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিটি শাখাকে একটি বাৎসরিক উন্নয়ন বা সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা (বর্তমানে রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের কোনো গঠনমূলক কাজ নেই)৷ ৮. প্রত্যেক স্থানীয় সরকারকে নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন করা, নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো মামলা হলে তা তিন মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে বাধ্যতামূলক করা৷ ৯. স্থানীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় বাজেট দিয়ে তাদের বিকশিত হতে সহায়তা করা৷ ১০. সরকাির প্রশাসনের ২৫ শতাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (সচিব) দলীয়ভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া, বাকি ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তার ব্যাপারে প্রশাসনিক নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া, কোনো সরকাির কর্মকর্তাকে ওএসডি করতে না পারার বিধান৷ ১১. সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিবার্ষিক ভিত্তিতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা৷ ১২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের শাখা ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করা৷ ১৩. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করার জন্য ’৭৩-এর আইন পরিবর্তন করা৷ ১৪. সব সাংবিধানিক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে ইত্যাদি।
এই তালিকা বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা আরও দীর্ঘ করতে পারবেন। তবে তা হতে হবে সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমাদের ধারণা, ওপরে উল্লিখিত শর্তগুলো পালন করা হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে কোনো বিঘ্ন হবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাধাগ্রস্ত হবে না, জিয়াউর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নেও সমস্যা হবে না।
এগুলো প্রাথমিক ধারণামাত্র। একাধিক গবেষণা ও সেমিনারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এই সনদ রচনা করতে পারে। আমরা যখন সংবাদপত্র, সেমিনার ও টিভিতে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমাদের রাজনীতির রোগ ও তার ওষুধ চিহ্নিত করা উচিত। শুধু ‘রাজনীতি দূষিত হয়েছে’ বলে চিৎকার করলে রাজনীতি পরিচ্ছন্ন হবে না।
অনেকে দেশের রাজনীতি নিয়ে হতাশ। তাঁরা মনে করেন, আমাদের রাজনীতির যে রোগ, তার কোনো চিকিৎসা নেই। এ ধারণা ঠিক নয়। নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া পরিকল্পিতভাবে রোগ ও ওষুধ নিয়ে সোচ্চার হলে রাজনীতি সুস্থ হতে বাধ্য। আমরা সোচ্চার হই না। কারণ, আমরা ভীতু ও সুবিধাবাদী (ব্যতিক্রম খুব কম)৷ তাই নাগরিক সমাজ ও মিডিয়াকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
আমাদের মিডিয়া ও নাগরিক ফোরামের একটা সীমাবদ্ধতা হলো, এগুলো বড্ড বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক। দেশের দূষিত রাজনীতি ও এর প্রতিকার সম্পর্কে অন্যান্য জেলার নির্দল সচেতন নাগরিকদের মতামত তেমন শোনা যায় না। প্রতি জেলায় নির্দল নাগরিকদের ‘ফোরাম’ থাকা উচিত, যাতে তাঁরা দেশ, সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কে তাঁদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। আমাদের মিডিয়ার রাজনৈতিক আলোচনায়ও ঢাকার বাইরের অতিথি তেমন দেখা যায় না। সপ্তাহের এক দিন টক শোতে শুধু ভিন্ন জেলার (ঢাকার বাইরে) অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর একটা রীতি গড়ে তোলা যায় না? সুস্থ ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য প্রচারণাও শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক হলে সাফল্য আসবে না। দেশের সব জেলা থেকে এই দািবগুলো আসা উচিত।
দিনের শেষে আমাদের লক্ষ্য হবে: সব দল (অন্তত প্রধান ১০টি দল) সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি সনদে স্বাক্ষর করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। তা করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু দল বদল হবে, ব্যক্তি বদল হবে, গডফাদার বদল হবে, ঠিকাদার বদল হবে, দুর্বৃত্ত বদল হবে, অনেক কিছু বদল হবে, কিন্তু দূষিত রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
আমরা কি তা চাই?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী৷
সব দলের অংশগ্রহণ ও অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে বাধা হতে পারে নির্বাচনকালে সরকার–পদ্ধতি। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনের সময় দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। কিন্তু সংশোধিত সংবিধানে সেই সুযোগ নেই। সরকার সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি করে নিজেরাই প্রমাণ করেছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। ফলে বিএনপি ও অন্য দলগুলোর পক্ষে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ দাবি পরিত্যাগ করা এখন সম্ভব নয়। সর্বোপরি অতিসম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের একটি উক্তি বিএনপি ও অন্য দলের মধ্যে আরও ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। সৈয়দ আশরাফ বলেছেন: ‘কোনো বৈধ পথে শেখ হাসিনাকে আর সরানো যাবে না।’ সৈয়দ আশরাফের এই উক্তি থেকে সন্দেহ হয়, ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেছে। এ পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া বিএনপিসহ অন্যান্য দল সংসদ নির্বাচনে আগ্রহী হবে কি না সন্দেহ।
তবু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, অন্যান্য দল ও নাগরিক সমাজ নির্বাচনী সরকার নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে বলে আমরা আশা করি। সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়। সমঝোতার ভিত্তিতে তা সংশোধন করা সম্ভব। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতও নির্দেশনা দিতে পারেন।
সব দলের অংশগ্রহণে একটি অর্থপূর্ণ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমাদের উদ্বেগ দেখে অনেকের মনে হতে পারে, নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান বলে মনে করি। না, আমরা তা মনে করি না। অর্থপূর্ণ নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি ধাপমাত্র। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই আমরা গণতন্ত্রের জগতে প্রবেশ করি। এরপর আরও বহু কাজ বাকি। আমরা চাই আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একটি ‘গণতন্ত্র সনদে’ একমত হয়ে স্বাক্ষর করুক। কারণ, গণতন্ত্রের অন্যান্য শর্ত মানা না হলে স্বৈরাচারের সঙ্গে তেমন পার্থক্য থাকে না। কোনো রাজনৈতিক দলকে (ও জোটকে) লুটপাটের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য অর্থপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করারও প্রয়োজন নেই। এক দিনের গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের মোহভঙ্গ হওয়া দরকার। বড় দলগুলো নির্বাচনকে খুব গুরুত্ব দেয়। কিন্তু গণতন্ত্রের অন্য শর্তগুলো পূরণের ব্যাপারে তারা আগ্রহী নয়। তারা আগ্রহী শুধু সংসদ নির্বাচনে। কারণ, সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে তারা জাতীয় সংসদ, সরকারি প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে পকেটে ভরে ফেলতে পারে। সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কারও পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয় না। সরকার এত শক্তিশালী যে সংবিধানকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়। মোট কথা, বাস্তবতা হলো, সরকারের ওপরে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সরকারই সব। এ দেশে বিজয়ী দলের হাতেই সবকিছু। উইনার্স টেক্স অল—এটা গণতন্ত্র নয়। গণতন্ত্রের এই বিকৃত মডেলকে পরিত্যাগ করতে হবে।
কাজেই আরেকটি নির্বাচনের আগেই আমাদের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। পরিচ্ছন্ন করতে হলে আমাদের চিহ্নিত করতে হবে কোথায় কোথায় দুর্বলতা রয়েছে। শুধু রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঢুকে পড়েছে বললেও বড় কাজ হবে না। বড় কাজ হবে দুর্বৃত্তায়নের পথগুলো চিহ্নিত করা এবং সমাধানের পথ প্রস্তাব করা। এই দুর্বৃত্তায়নে বড় দলগুলো প্রায় সমানভাবে দায়ী, অংশীদার ও পৃষ্ঠপোষক।
দেখা যাক রাজনীতির কোন কোন জায়গায় সংস্কার করতে হবে। একটা চকিত চিন্তা হিসেবে আমরা কয়েকটি জায়গা চিহ্নিত করতে পারি৷ ১. নির্বাচনের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে৷ ২. নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা৷ ৩. রাজনৈতিক দলে গঠনতন্ত্রের গণতন্ত্রায়ণ। দলের প্রতিটি কমিটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন বাধ্যতামূলক করা। একজন তিনবারের বেশি কোনো কমিটিতে কখনো থাকতে পারবেন না। দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান এক ব্যক্তি হবেন না। দুবারের বেশি এই পদে কেউ থাকবেন না। দলের কোনো কমিটিতে ১০ বছর কাজ না করলে তাঁকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। দলের গঠনতন্ত্র আরও নানাভাবে গণতন্ত্রায়ণ করা যায়। এই বিধিগুলো মানা হচ্ছে কি না, তা দেখবে নির্বাচন কমিশন। ৪. জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা, বিরোধী দলের নেতাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করা, যেমন প্রতি তিন মাসে একবার বিরোধী দলের নেতাকে তাঁর টিমসহ মন্ত্রিসভার বৈঠকে আমন্ত্রণ৷ ৫. সংসদ অধিবেশন িস্পকারের অনুমতি ছাড়া বর্জন বন্ধ করা, সাংসদ নামে-বেনামে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না৷ সাংসদকে স্থানীয় সরকারের কাজে যুক্ত না রাখা৷ ৬. হরতাল না করার ব্যাপারে একমত হওয়া৷ ৭. সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিটি শাখাকে একটি বাৎসরিক উন্নয়ন বা সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা (বর্তমানে রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের কোনো গঠনমূলক কাজ নেই)৷ ৮. প্রত্যেক স্থানীয় সরকারকে নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন করা, নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো মামলা হলে তা তিন মাসের মধ্যে নিষ্পন্ন করতে বাধ্যতামূলক করা৷ ৯. স্থানীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় বাজেট দিয়ে তাদের বিকশিত হতে সহায়তা করা৷ ১০. সরকাির প্রশাসনের ২৫ শতাংশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (সচিব) দলীয়ভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া, বাকি ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তার ব্যাপারে প্রশাসনিক নিয়ম অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া, কোনো সরকাির কর্মকর্তাকে ওএসডি করতে না পারার বিধান৷ ১১. সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিবার্ষিক ভিত্তিতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করা৷ ১২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের শাখা ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ করা৷ ১৩. বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করার জন্য ’৭৩-এর আইন পরিবর্তন করা৷ ১৪. সব সাংবিধানিক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে ইত্যাদি।
এই তালিকা বিশেষজ্ঞ ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা আরও দীর্ঘ করতে পারবেন। তবে তা হতে হবে সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য। আমাদের ধারণা, ওপরে উল্লিখিত শর্তগুলো পালন করা হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে কোনো বিঘ্ন হবে না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বাধাগ্রস্ত হবে না, জিয়াউর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নেও সমস্যা হবে না।
এগুলো প্রাথমিক ধারণামাত্র। একাধিক গবেষণা ও সেমিনারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, মিডিয়া এই সনদ রচনা করতে পারে। আমরা যখন সংবাদপত্র, সেমিনার ও টিভিতে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমাদের রাজনীতির রোগ ও তার ওষুধ চিহ্নিত করা উচিত। শুধু ‘রাজনীতি দূষিত হয়েছে’ বলে চিৎকার করলে রাজনীতি পরিচ্ছন্ন হবে না।
অনেকে দেশের রাজনীতি নিয়ে হতাশ। তাঁরা মনে করেন, আমাদের রাজনীতির যে রোগ, তার কোনো চিকিৎসা নেই। এ ধারণা ঠিক নয়। নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া পরিকল্পিতভাবে রোগ ও ওষুধ নিয়ে সোচ্চার হলে রাজনীতি সুস্থ হতে বাধ্য। আমরা সোচ্চার হই না। কারণ, আমরা ভীতু ও সুবিধাবাদী (ব্যতিক্রম খুব কম)৷ তাই নাগরিক সমাজ ও মিডিয়াকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
আমাদের মিডিয়া ও নাগরিক ফোরামের একটা সীমাবদ্ধতা হলো, এগুলো বড্ড বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক। দেশের দূষিত রাজনীতি ও এর প্রতিকার সম্পর্কে অন্যান্য জেলার নির্দল সচেতন নাগরিকদের মতামত তেমন শোনা যায় না। প্রতি জেলায় নির্দল নাগরিকদের ‘ফোরাম’ থাকা উচিত, যাতে তাঁরা দেশ, সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ সম্পর্কে তাঁদের মতামত তুলে ধরতে পারেন। আমাদের মিডিয়ার রাজনৈতিক আলোচনায়ও ঢাকার বাইরের অতিথি তেমন দেখা যায় না। সপ্তাহের এক দিন টক শোতে শুধু ভিন্ন জেলার (ঢাকার বাইরে) অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানোর একটা রীতি গড়ে তোলা যায় না? সুস্থ ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য প্রচারণাও শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক হলে সাফল্য আসবে না। দেশের সব জেলা থেকে এই দািবগুলো আসা উচিত।
দিনের শেষে আমাদের লক্ষ্য হবে: সব দল (অন্তত প্রধান ১০টি দল) সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি সনদে স্বাক্ষর করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে। তা করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু দল বদল হবে, ব্যক্তি বদল হবে, গডফাদার বদল হবে, ঠিকাদার বদল হবে, দুর্বৃত্ত বদল হবে, অনেক কিছু বদল হবে, কিন্তু দূষিত রাজনীতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
আমরা কি তা চাই?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী৷
No comments