ছবির হাট উচ্ছেদ- সেই ছবি সেই পতাকা কই? by আহমেদ মুনীরুদ্দিন
যাঁরা শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন, যাঁরা
শাহবাগকে ঘিরে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের কারোরই সেই
ছবি সেই পতাকা ভোলার কথা না। শহীদ রুমী স্কোয়াডের উদ্যোগে স্থাপন করা
শহীদজননী জাহানারা ইমামের সেই ছবি। ছবির হাটের টাঙিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের
সেই বিশাল পতাকা, লাল-সবুজে আকাশছাওয়া। আর যাঁরা শাহবাগের বিপক্ষে
দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদেরও ওই গণজোয়ারের ছবি ভুলে থাকার সুযোগ নেই। শাহবাগকে
সমর্থন দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা সরকার এখন ক্ষমতায়। কিন্তু
শাহবাগের ওই ছবি ওই পতাকার কারিগর তরুণদের কেন কোথাও দাঁড়াতে দেওয়া হচ্ছে
না? পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট এসে কেন তরুণদের শিল্পকর্ম ভাঙচুর করছেন?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে শিল্পচর্চার মুক্ত পরিসর ছবির হাট উচ্ছেদ
করছেন? পুলিশই কি ঠিক করে দেবে কোথায় শিল্পচর্চা হবে, কোথায়
ছাত্র-তরুণেরা আড্ডা দেবেন, গান গাইবেন, ছবি আঁকবেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়ায় ছবির হাটের শুরু ২০০৩ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার ঘটনাকে অজুহাত বানিয়ে চারুকলার মোল্লার দোকান ভেঙে দেয় পুলিশ। ভুল যুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্ত পরিসর রক্ষার আন্দোলনে পুনরায় মোল্লার দোকান চালু করেন শিল্পী-ছাত্রছাত্রীরা। এ ঘটনায় সক্রিয় চারুকলার কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী-শিল্পী মুক্ত পরিসরে শিল্পচর্চায় তাঁদের চিন্তাকে সংগঠিত করেন। ওই বছরেরই ১৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে ছবির হাট। ভাবনাটা সহজ সরল এবং প্রাণখোলা। গ্রামের হাটের মতো সপ্তাহে এক দিন হাট বসবে ছবির, শিল্পকর্মের। হাটে শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলবেন আড্ডা দেবেন মানুষ, শিল্পীরা মিশবেন অন্য সবার সঙ্গে। শিল্পকে আরও মুক্ত পরিসরে নিয়ে আসা, মুক্ত পরিসরকে আরও শিল্পিত করা। এ আয়োজন কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি।
মানুষ ‘ছবির হাট’ নামটা গ্রহণ করে৷ মুক্ত পরিসরে মেলামেশার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার ভাবটা গ্রহণ করে। কিন্তু তা এক দিনেই হয়নি। বছরজুড়ে ছবির হাটে নানা প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীতানুষ্ঠানে মানুষের জমজমাট আড্ডা চলে। পাশাপাশি এক দশকজুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রী ও শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের যে মেলবন্ধন গড়ে উঠছিল, তাও নতুন চেহারা নিতে থাকে শাহবাগে, ছবির হাটে ও ছড়িয়ে পড়া মাঠের পরিসরে। বিশেষত, ২০০৮ সালে বিমানবন্দরের সামনে ‘লালন ভাস্কর্য’ হিসেবে নির্মাণাধীন স্থাপনা ভেঙে দেওয়ার পর গড়ে ওঠা ‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’ তরুণ সংস্কৃতিকর্মীদের এ সম্মিলনকে নতুন মাত্রা দেয়। অন্য অনেক দাবির সঙ্গে তাঁরা জোর দিয়ে বলেছিল—‘শিল্পচর্চার মুক্ত পরিবেশ চাই’। প্রবেশপথের হাটটুকু ছাড়িয়ে মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়া চেতনার ছবির হাট ওই আন্দোলনে প্রাণ জুগিয়েছিল। সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল নগরের সাধারণ মানুষ। এভাবেই একসময় এ উদ্যানের মাঠ কার্যত ঢাকার নগরকেন্দ্রে পরিণত হতে শুরু করে। এখানকার খোলামেলা পরিসরের সাধারণ সংস্কৃতি হিসেবে জায়গা করে নেয় নারীর সহজ উপস্থিতি এবং একই স্থানে নানা শ্রেণি–পেশার মানুষের সম্মিলন।
ছবির হাট জানিয়েছে, পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, উদ্যানের সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার জন্যই শিল্পকর্ম রাখার জন্য বানানো ছোট্ট স্টোররুম আর দেয়ালঘেঁষা ছাউনি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন থেকে যায় যে, তা বিনা নোটিশে করা হলো কেন? এবং এভাবে শিল্পকর্ম ভাঙচুর করা হলো কেন? এই প্রশ্নও জাগা স্বাভাবিক যে উদ্যানের পরিবেশ রক্ষায় প্রশাসনের ভাবনা বা উদ্যোগটা আসলে কী? প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সবাইকেই খুঁজতে হবে। বৈঠকি শিল্পকলা ও বুদ্ধিজীিবতা সে দায় এড়ানোর সুযোগ পেলেও মুক্ত পরিসরে শিল্পচর্চায় আগ্রহী, মানুষের জন্য মুক্ত পরিসর নির্মাণে আগ্রহীদের সামনে সমাজের ও জীবনের এই জ্যান্ত সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। মনে রাখা দরকার, ছবির হাটের মতো মুক্ত পরিসর গড়ে উঠেছিল, বিকশিত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে মৌলবাদ ও ক্ষমতাজীিবতার বিরুদ্ধে মাঠের লড়াইয়ে সক্রিয়তার মধ্য দিয়েই।
শাহবাগ আন্দোলনে শুরুর জমায়েত থেকে শুরু করে মাসের পর মাস ধরে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ছবির হাটের তরুণ-তরুণীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হেফাজতিরা তখন তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, অপপ্রচার চালিয়ে এখানে হামলার হুমকি দিয়েছিল। আরেক দিকে ক্ষমতাজীবীরা কাউকে কাউকে ঘুঁটি বানিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের গণতান্ত্রিকতা নষ্ট করেছিলেন, শাহবাগকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। যার পরিণতি শাহবাগ নিয়ে পাশা খেলার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শাহবাগ নিয়ে দেশকে স্বপ্ন দেখানো প্রকৃত তারুণ্য সম্ভবত মৌলবাদিতা আর ক্ষমতাজীিবতা—দুয়ের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে চেয়েছিল। এখন শাহবাগে মুক্ত পরিসর রুদ্ধ করার চেষ্টা চরম পরিহাস হয়ে ওঠে যখন এই কাজ করা হয় সেই উদ্যানে, যেখানে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের বজ্রকণ্ঠ ভাষণে বলেছিলেন ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’। মানুষের মুক্তির পতাকা ওড়াতে চাওয়া তারুণ্যের স্পর্ধা তো যাপিত জীবনের সব দ্রোহ বয়ে বয়ে বেড়ে ওঠে দেশের আনাচকানাচে এমন কিছু মুক্ত পরিসরেই।
আহমেদ মুনীরুদ্দিন: সংস্কৃতিকর্মী ও সাংবাদিক৷
No comments